“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১০৮
(নূর নাফিসা)
.
.
ডাক্তার রক্তের ব্যবস্থা করতে বলেছিলো বিধায় ব্লাড গ্রুপ মেচিং এ আসিফ এক ব্যাগ দিয়েছে, আর তার পরিচিত একজনকে ডেকেছিলো সে এক ব্যাগ দিয়েছে। মেহেদী জানতো, নাজিয়া নাফিসা ও নিয়াজ উদ্দিনের রক্তের গ্রুপও তার সাথে ম্যাচিং। যদিও তাদের মধ্য থেকে শুধুমাত্র নাফিসা দিতে পারতো কিন্তু পরিচিত লোক থাকায় আসিফ নিষেধ করলো। কেননা মেয়েরা এমনিতেই দুর্বল প্রকৃতির! তাই রক্ত দিলে নাফিসা খুব সহজেই উল্টো শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে! এদিক বিবেচনায় ছেলেদের কাছ থেকে নেওয়াটাই ভালো। রক্ত দিয়ে লোকটি মাত্রই চলে গেলো।
কিছুক্ষণ পরেই মেহেদীর বাবা-মা হাজির। তারা এখানে আসার সময় আবার নিয়াজ উদ্দিনকে কল করে জানিয়েছে নাহিদাকে হসপিটালে নেওয়া হয়েছে। মেহেদীকে দুইহাত একত্রিত করে থুতনি ধরে রাখতে দেখে মেহেরুনের ভেতরটা চেপে গেলো! এতোটা টেনশনে ছেলেকে বোধহয় আর কখনোই দেখেননি তিনি! মেহেরুন মেহতাজকে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
– নাহিদার অবস্থা কি বেশি খারাপ?
– জানি না মা। ডাক্তার বললো সিজার করানো বেটার!
– হঠাৎ করে কি হলো আল্লাহই জানে! খেয়েছিলো কিছু?
– হ্যাঁ, ভাত খেয়েছি সবাই একসাথে।
মেহেরুন মেহেদীর কাছে এসে বসলো। পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,
– এতো চিন্তা করছো কেন বাবা! আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। আল্লাহ সব ভালো করবেন।
কথা কানে পৌছেছে ঠিকই কিন্তু মস্তিষ্কে পৌছাতে পারেনি। তার চোখ লাল এবং হালকা ভেজা হয়ে আছে! মায়ের এই সান্ত্বনা যেন আজ গায়ের চামড়াও স্পর্শ করতে পারছে না! কি করে করবে! মনের ভেতর যে হাজারো অশান্তি আর হাজারো অপরাধে সৃষ্ট পাহাড় গড়ে উঠেছে!
সবাই চিন্তিত। আরিশা তার বাবার কোলে ঘুমাচ্ছে আর আয়াশের চোখ যেন নিভু নিভু! যদি পারতো তো দাদুর কাছে রেখে আসতো আয়াশকে। কিন্তু এমন একটা পরিস্থিতিতে এখান থেকে যেন নড়তেও পারছে না আসিফ! টেনশন সবার মাঝেই উপস্থিত! মেহেরুন আয়াশকে বেঞ্চিতে শুয়িয়ে দিলেন। আয়াশ নানুর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যাচ্ছে।
ঘন্টাখানেকের মধ্যে রুমানা বেগম ও নিয়াজ উদ্দিনও এসে গেছেন। সারাটা রাস্তা মায়ের মন কাঁদছে ভীষণ। এখন এসেও গম্ভীরমুখে বসে আছে। কারো সাথেই কারো কোনো কথা হচ্ছে না। শুধু নিয়াজ উদ্দিন, জহিরুল ইসলাম ও আসিফের মাঝে টুকটাক জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর তারা দূরে থেকেই দেখতে পেল থিয়েটারের লাল বাতিটা নিভে গেছে। একটা নার্স দুইবার তাদের সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করলো। কিন্তু কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পেল না! পরিশেষে ডাক্তারের দেখা পেলে তারা সকলেই তার কাছ থেকে কিছু শোনার জন্য মনযোগ দৃষ্টি নিক্ষেপ ও কান পেতে আছে। মেহেদী বসা থেকে উঠে দাড়িয়েছে। ডাক্তারের চেহারাটাও গম্ভীর। ডাক্তার জানালো মেয়ে বাবু হয়েছে। বাবু সুস্থ আছে কিন্তু পেটে চাপ পড়ায় মায়ের একটু সমস্যা হয়েছে। কথাটা শোনার পরই রুমানা বেগমের চাপা কান্নার নিচু শব্দ শোনা গেলো! মেয়ের অবস্থার কথা শুনে যেন তার ভেতরের কান্নাটা বাইরেও এসে দেখা দিয়েছে!এখানে আসার পর তার নিকাব খোলা ছিলো। এখন ওড়না দিয়ে মুখ চেপে তিনি কান্না করছেন! ডাক্তার ফারহানা মুহুর্তেই বুঝে গেছেন তিনিই পেশেন্টের জননী। সন্তানের কোনো বিপদ-আপদে সবার আগে সাধারণত মায়ের আর্তনাদই ভেসে আসে! মেহেরুন মেহতাজকে ইশারা করলো আয়াশের কাছে এসে বসতে। মেহতাজ এসে বসলো এখানে। তার চোখেও পানি৷ মেহেরুন রুমানা বেগমের কাছে এগিয়ে গেলেন। মেহেরুনের চোখেও পানি। ডাক্তার ফারহানা রুমানার উদ্দেশ্যে বললেন,
– কাঁদছেন কেন! আপনার মেয়ের তেমন কিছু হয়নি আশা করছি। আল্লাহকে ডাকুন। ইনশাআল্লাহ সুস্থ হয়ে যাবে।
অত:পর মেহতাজকে উদ্দেশ্য করে বললো,
– বাচ্চাকে এভাবে রেখেছো কেন? এভাবে অসমতল জায়গায় শুয়ে থাকলে হাড়ে আঘাত পাবে। ওই কেবিনে ফাঁকা বেড আছে। সেখানে রাখতে পারো। আর বাচ্চাদের হসপিটালে না নিয়ে আসাই ভালো। সবদিক থেকেই কষ্টকর।
ডাক্তার চলে গেলেন। মেহেদী দাঁড়ানো থেকে আবার বসে পড়লো! এমন হাল ছেড়ে বসায় পাশে থাকা মেহতাজ তার দিকে তাকালো। এক হাতে কাধ আঁকড়ে ধরে তাকে শক্ত হওয়ার সংকেত দিলো। মেহেদী দুই আঙুলে চোখ কচলে নিয়েছে। এবার দুহাতেই মুখ চেপে বসে আছে। মেহতাজের ধারণা, যদি মেহেদীটা সেই ছোট্ট মেহেদী থাকতো তাহলে বোধহয় আজ গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতো! মেয়েরা তো অল্পতেই কেদে ফেলে, আর ছেলেদেরকে আল্লাহ তায়ালা পাথর ন্যায় তৈরি করেছে! যার ফলে কাঁদতেও তাদের কষ্ট হয়!
ডাক্তার যাওয়ার পরপরই বাচ্চাকে তোয়ালে দিয়ে পেচিয়ে কোলে নিয়ে নার্স বেরিয়ে এসেছে। প্রায় সকলেই এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াচ্ছিলো। তা দেখে নার্স বললো,
– এই দাড়ান দাড়ান। ভীড় করবেন না, একজন দুজন করে একটু দূর থেকেই দেখুন। এখন কোলে নেওয়া যাবে না।
বলতে বলতে নার্সই তাদের কাছে এগিয়ে এসেছে। দাড়িয়ে থাকা একে একে সবাই দেখছে। আর মেহেদী যেমন ছিলো তেমনই আছে। জহিরুল ইসলাম ডাকলো, “মেহেদী…? ”
কিন্তু মেহেদী মুখ থেকে হাত সরায়নি! মেহতাজ তার কাধে হাত রেখে ঝাকিয়ে বললো,
“মেহেদী, তোর মেয়ে নিয়ে এসেছে…”
মেহেদী আর কারো দিকে না তাকিয়ে ঝটপট বসা থেকে উঠে অন্যদিকে হনহন করে হাটা শুরু করলো। এমনভাবে এখান থেকে উঠে গেছে যে কেউ তার চেহারাটা দেখারও সুযোগ পায়নি! তার এমন আচরণে অনেকেই বিস্মিত! কিন্তু তার কারণ শুধু মেহতাজেরই জানা! মেহেদীর বাবা-মা ভাবছে যেই ছেলে বাচ্চার জন্য এতো উত্তেজিত, সে এভাবে চলে গেলো কেন! আর তার শ্বশুর শ্বাশুড়ি এক মুহুর্তের জন্য ভেবে ফেলেছে জামাই বুঝি সন্তানের প্রতি অনিহা বোধ করলো! নতুবা দেখতে এলো না কেন? মন খারাপ?
আসিফ গেলো মেহেদীর পিছু পিছু। মেহেদী ওয়াশরুমে চলে গেছে। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এসে আসিফকে দেখতে পেল। আসিফ আরিশাকে মেহেদীর কাছে দিয়ে ওয়াশরুমে গেলো। অত:পর দুজন একসাথে আবার এদিকে এলো। এতোক্ষণে নার্স চলে গেছে অন্য কেবিনে। আর মেহেদী তাদের কাছে আসতেও পারেনি, থিয়েটার থেকে বেডে করে নাহিদাকে বের করে আনা হচ্ছে। সে সেখানেই দাড়িয়ে রইলো। তার খুব নিকট দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চেহারা দেখেই ভেতরটায় মোচড় দিয়ে উঠলো! ইচ্ছে করছিলো তাকে একবার জড়িয়ে ধরতে। তাকে একেবারে ছোট্ট বানিয়ে সবার আড়ালে হৃদপিণ্ডে বসিয়ে রাখতে! ভেতরটা এমন খাঁ খাঁ করছে কেন! মেহেদী এক পা ও নড়লো না কোনদিকে! যতক্ষণ পর্যন্ত না চোখের আড়াল হলো, ততক্ষণ শুধু তার দিকেই দৃষ্টি স্থির হয়ে ছিলো। কেবিনে শিফট করা হয়েছে তাকে! সবাই-ই এতোক্ষণ যাবত তাকিয়ে ছিলো নাহিদার দিকে। মেহেদী স্বজনদের কাছে এসে মাকে জিজ্ঞেস করলো বাচ্চা কোথায়? মেহেরুন কেবিন দেখিয়ে দিলে সেদিকেই পা বাড়ালো সে। দরজা খোলাই আছে। বাচ্চাকে রাখার ব্যবস্থা করছিলো নার্স। মেহেদী কথা বলে কোলে নেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলো। ডাক্তার ফারহানা ছিলো সেখানে। তিনি বললে নার্স মেহেদীর কাছে দিলো। খুব সাবধানে কোলে নিয়ে তাকালো তার কন্যা সন্তানের দিকে। এবার তার চোখ খুব তারাতাড়িই ঝাপসা হয়ে এসেছে! বাচ্চা চোখ খুলেনি এখনো। সবাইকে জাগিয়ে রেখে সে-ও ঘুমাচ্ছে, ওদিকে তার মা-ও ঘুমাচ্ছে! আর মেহেদীর কোলে বাচ্চাকে দেখে একটু দূরে দাড়িয়ে থাকা তার পরিবার কিছুটা খুশি হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এবার তারা সবাই নিশ্চিত, তখন মেহেদী অতি কষ্টে এমন আচরণ করেছিলো!
দুতিন মিনিট পরেই আবার নার্স বাচ্চাকে নিয়ে নিলো। মেহেদী চোখ মুছে চলে এলো সেখান থেকে।
ডাক্তারের কথামতো জহিরুল ইসলামের সাহায্যে আয়াশকে পাশের ফাঁকা কেবিনের বেডে রেখে আরিশাকে কোলে নিলো মেহতাজ। আসিফ রক্ত দিয়েছে বিধায় নিশ্চয়ই দুর্বলতা অনুভব করছে তবুও ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যা ভালো লাগছিলো না মেহতাজের। মেহতাজ একপাশে এসে বললো,
– খারাপ লাগছে না?
– না।
– পারলে বাসায় চলে যাও না! কতক্ষণ থাকবে এভাবে! বাসায় গিয়ে এক গ্লাস গরম দুধ খেয়ে ঘুম দাও। ভালো লাগলে সকালে এসো।
– এতো চিন্তা করছো কেন! আমি ঠিক আছি।
সে চিন্তা করতে নিষেধ করলেই কি, চিন্তা থেকে মুক্তি আছে নাকি! মেহতাজ মাকে আয়াশের দিকে লক্ষ্য রাখতে বলে আসিফকে নিয়ে অন্যদিকে চলে এলো। এতো রাতে বাইরে হোটেল খোলা না-ও থাকতে পারে। তাই খুঁজে খুঁজে হসপিটালের ক্যান্টিন থেকে দুইটা সিদ্ধ ডিম কিনে খেতে বললো আসিফকে। নিজের ক্ষুধা বলে তাকে খাওয়ানোর জন্য এনেছে আগে জানলে নিশ্চয়ই আসিফ আসতো না তার সাথে। হসপিটালের খাবার তার কাছে ভালো লাগে না। কিন্তু কিছুই করার নেই, মেহতাজের জোরাজুরিতে খেতে হলো। এছাড়া উপায়ও নেই। মধ্যরাত না হলে অন্য ব্যবস্থা করে নিতো।
ফজরের নামাজ পড়ে নিয়াজ উদ্দিন আরাফ ও ইমরানকে জানিয়েছে নাহিদার কথা। নাহিদা অসুস্থ হওয়া সত্ত্বেও আরাফ সবার সুস্থতার কথা জানিয়েছে নাজিয়াকে। নতুবা নাজিয়া দুশ্চিন্তা করবে। আর আরাফ তখনই রেডি হয়ে বেরিয়ে গেছে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। এদিকে নাফিসা শোনামাত্রই যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু ইমরান বললো নাস্তা করে তারপর যাবে। নাফিসার মন মানছে না। তবুও সে ইমরানের কথায় নাস্তা তৈরি করতে লাগলো। ইমরান বলেছে যত তারাতাড়ি নাস্তা তৈরি করে নাস্তা করে নিবে তত তারাতাড়ি তাকে হসপিটালে নিয়ে যাবে। ইমরানের বলার কারণ, হসপিটালে গেলে হয়তো খাওয়াদাওয়া কিছুই হবে না। বড়মা শুনে বেশি পরিমাণে নাস্তার ব্যবস্থা করে দিলেন সকলের জন্য।
মধ্যরাত থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত পর্যাপ্ত তাপমাত্রার জন্য বাচ্চাকে গ্লাসের ভেতর রাখা হয়েছে। বাচ্চা যখন স্বাভাবিক স্বরে কান্না করলো তখনই বের করা হয়েছে। এবার সজাগ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা বাচ্চাকে দেখতে পেয়েছে সবাই। একে একে কোলেও নিচ্ছে সবাই। কিন্তু নাহিদার এখনো সেন্স আসেনি! যার ফলে কারো মাঝেই খুশির ছিটাফোঁটা নেই। ভয় আর ভয়! হবে না নাকি তার জয়!