বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ চতুর্থ

0
2318

বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ চতুর্থ
মম_সাহা

পরিবেশ উৎসব মুখোর।আজ শুভ্রমদের বাড়িতে অনুষ্ঠান। নীলা এই বাড়িতে এতদিন ছিলো ঠিকই কিন্তু কোনো খবরা খবরই রাখে নি।সারা দিন রুমের ভিতরই বন্দি ছিলো।আর ভার্সিটিতে যেতো এই ই যা।কোনো খোঁজ খবর রাখে নি।আজ যখন নিজের বাবাকে মাথার কাছে বসে থাকতে দেখলো তখন অবাক হয়ে যায়। আর শুধু বাবা না তার পরিবারের সবাই এমনকি রাহাতকে দেখেও অবাক হয়ে যায় নীলা।

তাদের এখানে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে নীলার মা অদ্ভুত কন্ঠে বলে
-‘তুই কি পাগল হয়েছিস নীলা?তুই জানিস না আমি বা আমরা কেনো এসেছি?’

নীলা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে না জানায়।আজিজুর রহমান যখন দেখলেন ঘটনা হাতের বাহিরে চলে যাচ্ছে তখন সেই গম্ভীর কন্ঠে স্ত্রীকে বলল
-‘আরে ও মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে।ঘুমের ঘোরে কি না কি বলছে।যাও তোমরা বাহিরে যাও আমি আমার মেয়েটার সাথে কথা বলে আসছি।’

নীলার মা কতক্ষণ ধারালো দৃষ্টিতে নিজের মেয়েকে পর্যবেক্ষণ করে বাহিরে চলে গেলেন।ওনার পিছে পিছে সবাই চলে যায়। আজিজুর রহমান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন
-‘আম্মা তুমি সত্যিই জানোনা না কিসের অনুষ্ঠান আজ?’

নীলা দু’পাশে মাখা নাড়িয়ে না জানাল।আজিজুর রহমানের চিন্তায় কপালে ভাজ পড়ল।

তারপর হতাশার শ্বাস ফেলে বলল
-‘আজ শুভ্রমের বাগদান।’

নীলা জেনো আকাশ থেকে পরল।তাকে কেউ কিছু বলে নি ভেবে অবাক হলো।পরক্ষণেই মনে পড়ল সে তো কারো সাথে এ কয়দিন কথাও বলে নি কীভাবে জানাবে।

শুভ্রমের কথা ভেবে হাসি আসে নীলার।শুভ্রম আর নীলা এ কয়দিন এক সাথেই ভার্সিটিতে গিয়েছিল। শুভ্রম সেই ভার্সিটির একজন প্রফেসর।সেই সূত্রেই আর খালামনির জোড়াজুড়িতে এক সাথে যেতে হয়েছিলো।শুভ্রমও একটা বার বলে নি।অবশ্য বলবে কীভাবে। সে মুখ কি তার আছে নাকি।

আজিজুর রহমান মেয়েকে চুপ থাকতে দেখে বললেন
-‘আমি এটা দেখে আশ্চর্য হলাম যে, তুমি একটা বাড়িতে আছো সেই বাড়িতে কী হচ্ছে সেই খোঁজ খবর অব্দি রাখছো না।’

নীলা বেশ লজ্জিত বোধ করে। আসলেই সে বোধহয় বেশিই করে ফেলছে।নীলা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল
-‘আসলে বাবা একটু পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত আমি তাই খোঁজ খবর রাখা হয় নি।’

আজিজুর রহমান মাথা নাড়িয়ে উঠে গেলো। নীলার মনে হলো না এবার একটু স্বাভাবিক হতে হবে।তাছাড়া রাহাতও এসেছে তাকে দেখাতে হবে নীলার রাহাতকে ছাড়াও চলবে।যেমন ভাবনা তেমন কাজ।নীলা উঠে ঝটপট ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে গেলো।সবার সাথে বেশ আড্ডাও দিলো।খালামনির বাসার সবাই খুশি নীলাকে স্বাভাবিক দেখে।সবাই ভাবছে নীলা তার পরিবারকে দেখে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু নীলার মনের খবর তো নীলাই জানে।

___________

বিকেল নেমেছে আকাশে।শীতকাল চলছে যত বেলা গরাচ্ছে তত শীত বাড়ছে।অনুষ্ঠান রাতে।সারাদিন সবাই বেশ খাটাখাটুনি করেছে। এখন ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে।

নীলা দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির ছাদে।শুভ্রমের বিয়ে ঠিক হয়েছে তার বোন সোহার ননদের সাথে। সোহা এখনো আসে নি।সন্ধ্যাবেলা শ্বশুর বাড়ির লোকেদের সাথে একবারেই আসবে।

এ কয়দিন শুভ্রম বেশ খেয়াল রেখেছে নীলার।কোনো খারাপ ব্যবহার করে নি। নাহয় শুভ্রমও আগে রাহাতের মতন নীলাকে উঠতে বসতে খোঁচা মেরে কথা বলতো।কিন্তু কখনও রূপ নিয়ে কিছু বলে নি।শুভ্রমের হঠাৎ বিয়ের কারণটাও জানে নীলা।

‘নীলা মনে হয়ে বেশ হট, তাই তো এত ঠান্ডার মাঝে তার সোয়েটার প্রয়োজন হচ্ছে না।’

চেনা ছেলে কন্ঠে একটুও নড়চড় হলো না নীলার।ছেলেটা নীলার সামনে দাঁড়ায়। এসেই হাতটা টান দিয়ে ঘুরিয়ে বলল
-‘কিরে আমি কথা বলছি তোর সাথে ,কানে যায় না?’

নীলা আকাশের থেকে চোখ ফিরিয়ে রাহাতের দিকে তাকায়। আলগোছে রাহাতে হাতটা নিজের বাহু থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দাঁড়ায়। তারপর একটু চুপ থেকে উত্তর দেয়
-‘কোন কথাটা কানে নিবো ভাইয়া? ঐ যে আমি হট সেটা? আপনার হয়তো কিছু বলতে মুখে বাঁধে না তাই বলে কী আমরাও সব কথা কানে নিবো নাকি! কখনো কখনো কিছু কথা উড়িয়ে দেওয়াও ভালো এতে কষ্ট কমে।যদি মাসখানেক আগে আরেকবার আমি আপনার কথাটা না শুনে উড়িয়ে দিতাম তবে আজও হয়তো কম কষ্ট পেতাম।’

নীলার শান্ত কিন্তু শক্ত কন্ঠে ভরকে যায় রাহাত।এতটা কাঠিন্য তো ছিলো না রিয়ার।রাহাতের ভাবনার মাঝেই নীলা খিলখিল করে হেসে বলল
-‘আরে লেবু বেশি চটকালে যেমন তেতো হয়ে যায় তেমনই মানুষকে অতিরিক্ত আঘাত করলে তারা পাথর হয়ে যায়। নীলাও তার ব্যাতিক্রম নয় রাহাত ভাই।’

রাহাতের রাগ উঠে যায়। ঠাস করে চড় মারে নীলার গালে।এটা নতুন কিছু না। অনেক চড় এই হাতের খাওয়া হয়ে গেছে নীলার।অন্য সময় কেঁদে ভাসালেও আজ নীলা কাঁদে নি।বরং চোখ রাঙিয়ে ধমকের স্বরে বলল
-‘আজ যেটা করছেন সেটা ভবিষ্যতে ভুলেও করার চেষ্টা করবেন না।এর ফল কিন্তু খারাপ হবে।’

নীলার এতটুকু কথা রাহাতের কাছে আগুনে ঘি ঢালার মতন মনে হলো।সে আবারও চড় দেওয়ার জন্য হাত উঠাতেই নীলা রাহাতের হাত ধরে ফেলে। রাহাতের চোখে এখন রাগের জায়গায় অবাক ভর করে। নীলা রাহাতের শক্ত হাতটাকে বেঁকিয়ে ধরে।রাহাত ব্যথায় আঁতকে উঠে আ আ শব্দ করলো।নীলা হাতটা বেঁকিয়ে ধরেই বলল
-‘এতদিন অনেক করেছেন।আজ আর না। এবার থামার পালা এসে গেছে।আপনি মাসখানিক আগে কী করেছেন সেটা আমি ভুলি নি।আমার সাথে গেইম খেলেছেন আপনি। আপনাকে ভালোবাসি বলে সেটাও মাফ করেছি। কিন্তু আপনার আচারণ আমাকে আপনার উপর ঘৃণা আনতে বাধ্য করছে।আর একবার ঘৃণা যেহেতু এসে পড়ছে সেহেতু আপনার হাতটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিতোও আমি দু’বার ভাববো না।আফ্টার-অল ক্যারাটে শিখেছি।আমার বাবা হয়তো জানতো কখনো আপন মানুষ নামক জানোয়ারদের সাথেও আমার লড়তে হবে তাই আগেই ক্যারাটে শিখিয়েছে।তাই সাবধান।’

রাহাতের ব্যাথায় মুখ নীল বর্ণ ধারণ করেছে। নীলা রাহাতের হাত টা ঝাটকা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।রাহাত নিজের হাতটাকে ঝাড়তে ঝাড়তে চলে যেতে যেতে বলল

-‘নীলা তোকে আমি পরে দেখে নিবো।এইটা তোর জন্য খুব ভারী পরবে।’

রাস্তা থেকে এক আগন্তুক পুরোটাই খেয়াল করেছে।আর সবটা কল করে কোনো একজনকে জানিয়েছে।ফোনের ওপাশের মানুষটা
ফোন কেটে হাসতে হাসতে নিজে নিজেই বলে
-‘এটা ঘটনা তো আমি নিজেই দেখেছি সবটা।এই তো আমাদের নীলা শক্ত হচ্ছে।যে যে নীলার সাথে যা যা করেছে তার সবটা হিসেব দিতেই হবে।সবে না শুরু।আমি তবে নীলাকে শক্ত করতে পারছি।’

নীলা রাহাতের কথা কানে না নিয়ে আবার আকাশ দেখায় মনযোগী হলো।চারপাশে আজান দিচ্ছে।বেশ খানিক সময় না যেতে ছাদে অন্য কারো উপস্থিতি টের পায় নীলা।ঘুরে তাকিয়ে দেখে শুভ্রম।এগুলোর চিন্তায় শুভ্রমের কথা মাথা থেকে বেরই হয়ে গেছিলো ওর।

শুভ্রম আজ শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পরেছে।পাঞ্জাবির উপরে একটা সোয়েটার খারাপ লাগছে না ছেলেটাকে।আর সে দেখতেও সুন্দর।আজ বেশ লাগছে তাকে।মনে হচ্ছে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবাই বলে বিয়ের জল শরীরে লাগলে নাকি মানুষ অতিরিক্ত সুন্দর হয়ে যায়। শুভ্রমের ক্ষেত্রেও হয়তো তা ই হয়েছে।

শুভ্রম এসে নীলার পাশে দাঁড়ায়। নীলা বেশ হাসি হাসি মুখ করে তাকায় তার দিকে।শুভ্রম কতক্ষণ নীলার দিকে পর্যবেক্ষণ করে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল
-‘তুমি এই শীতে সোয়েটার ছাড়া দাঁড়িয়ে আছো যে?আর গালে কী হয়েছে তোমার ফুলে গেছে?’

নীলা ভয় পেয়ে যায়। শেষমেশ ধরা খেয়ে যাবে না তো।আমতাআমতা করে বলল
-‘আসলে এলার্জির সমস্যা হয়েছে এজন্য ফুলে গেছে।আর আমার তেমন শীত লাগে না তাই সোয়েটার পরি নি।’

শুভ্রম আর কিছুক্ষণ নীলার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর অন্য দিকে তাকিয়ে বলে

-‘নীলাম্বরী তোমাকে সত্যিই আমি ভালোবেসে ছিলাম। তুমি আমাকে রিফিউজড না করলেই পারতে।’

নীলা তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলে
-‘এতই ভালোবাসা বুঝি ছিলো আপনার? তবে রিফিউজ করতে না করতে বিয়ের আসরে বসে যাচ্ছেন যে?’

শুভ্রমের বেশ অপমানে লাগল। সে মাথা নিচু করে বলল
-‘তুমি রিফিউজড করায় আমার রাগ উঠে গিয়েছিলো তাই আমি মাকে বিয়েতে হ্যাঁ করে দেই।এমনেতেও ওরা সোহার ননদকে আগেই পছন্দ করে রেখে ছিলো। আর তোমার মতন একটা মেয়ের এমন রিফিউজড আমি মানতে পারে নি।’

নীলা ভ্রু কুঁচকে বলে
-‘ওয়েট ওয়েট আমার মতন মেয়ে মানে কি বুঝাতে চাইলেন?’

শুভ্রম বিভ্রান্তিতে পরে যায়। আমতা-আমতা করে বলল
-‘আসলে আমি অন্য কিছু মিন করে নি।আসলে

নীলা হাত দিয়ে থামিয়ে দেয় শুভ্রকে।তারপর বড় করে শ্বাস নিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলল
-‘আপনি কি মিন করে বলেছেন আমি বুজেছি।এমনেতেই আমাদের সম্পর্কে তিক্ততা বেশি।সেটা আর না বাড়ালেই বোধহয় ভালো হবে।আর ভালোবাসার সংজ্ঞা টা আপনি আজও জানেন নি তাই আমার মতন মেয়ের রিজেকশন আপনার ইগো হার্ট করেছে।যাই হোক আপনি নতুুন জীবনে এগিয়ে যান সেটাই আমি চাই।আমার মতন মেয়ে আপনার জীবনে যায় নি সেটাই ভালো। আমার থেকে হাজার সুন্দরী বউ পাবেন।দোয়া করি কোনো দিন সুন্দর বউ পেয়ে আফসোস না করেন।আর জীবনের চলার জন্য মুভ অন করা দরকার।তাই আপনার সিদ্ধান্তে আমি খুশি।’

শুভ্রমের অপমানে লাগল কথা গুলো।সেও বেশ উচ্চস্বরে বলল
-‘আমিও দেখি তুমি কোন রাজপুত্র পাও।ঐ তো রূপের শ্রী আবার এত দেমাক।’

নীলা কোনো জবাব দিলো না।শুভ্র গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলো। এর দু’মিনিট পর নীলার শরীরে কেউ চাদর জড়িয়ে দিচ্ছে।নীলা আৎকে পিছে তাকিয়ে দেখে তার বাবা এবং আপু নীলার শরীরে চাদর জড়িয়ে দিচ্ছে।বাবাকে দেখে ভালো লাগলেও আপুকে দেখে খারাপ লাগা কাজ করল।আজ সারাটা দিন আপু এসেছে কিন্তু সে একটা কথাও বলেনি।আর সেই আপু তাকে চাদর জড়িয়ে দিচ্ছে।

নীলাকে ভাবতে দেখে নিরুপমা হেসে বলল
-‘কিরে বুড়ি শীত পরেছে কি দেখেছিস?তাও চাদর পরিস নি কেনো?’

নীলা মুচকে হেসে বলে
-‘আমি চাদর পরে ফেললে কীভাবে জানতাম যে আমার জন্য কার ভালোবাসা কতটুকু।’

নিরুপমা বোনকে জাপটে ধরে।নীলাও কিছুটা ধরে।আজিজুর রহমান দু মেয়েকে নিজের বুকে চেপে ধরে বলে
-‘শীতে থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যেমন শীতের পোশাক প্রয়োজন তেমন জীবনে সুন্দর মতন বেঁচে থাকার জন্য সঠিক মানুষ চেনা প্রয়োজন। মাঝে মাঝে ধরো সোয়েটার কেনার সময় আমরা স্টাইলিশ সোয়েটার কিনি।কিন্তু দেখা যায় ঐ সোয়েটার আমাদের শীত থেকে বাঁচাতে পারে না।ওর খালি বাহিরের চাকচিক্য টাই আছে।তেমনই জীবনেও এমন কিছু মানুষ আসবে যাদের বাহিরের চাকচিক্য টাই সুন্দর কিন্তু অন্তর ভীষন নোংরা। আমাদের সময় নিয়ে সে মানুষ গুলোকে চিনতে হবে।স্টাইলিশ সোয়েটার যেমন তোমাকে শীতের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না তেমন চাকচিক্য মানুষ বলতেই ভালো হয় না।তাই যতই তোমার সেগুলো পছন্দ হোক না কেনো সেগুলো বর্জন করতে হবে।তাই না মা?’

বাবার কথায় মাথা নাড়ায় দুই মেয়ে।নীলা শক্তি পায় এগিয়ে যাওয়ার তবে এগিয়ে যাওয়া কি আর এতই সোজা?

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here