“তৃ-তনয়া” পর্ব- ১০৯

0
2520

“তৃ-তনয়া”
পর্ব- ১০৯
(নূর নাফিসা)
.
.
অবশেষে এগারোটার দিকে নাহিদার দর্শন পেল তার পরিবার। নাহিদা তেমন কথা বলতে পারছে না কিন্তু বাকিদের মধ্যে স্ত্রীলোকেরা কথার সাথে কমবেশি সবাই কাঁদছে। এর মাঝে রুমানা বেগম ও নাফিসা একটু বেশি। নাফিসা তো কান্না পেলে কথাই বলতে পারে না। কথা বলতে গেলেই তার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসবে তাই চাপা কান্না নিয়েই অনেক্ক্ষণ যাবত সবার আড়ালে থেকেছে সে। নাফিসা নাস্তা নিয়ে এসেছিলো কিন্তু লাঞ্চ টাইমে সবার সেই নাস্তা হয়েছে। আসিফ আয়াশকে নিয়ে নিজের বাড়ি চলে গেছে। জহিরুল ইসলাম ও মেহতাজ তাদের বাসায় এসেছে গোসল করে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য। রাতের জন্য সাথে কিছু রান্নাবান্না করে নিয়ে এসেছে সে।
.
আজ প্রায় দুদিন পর মেহেদী নাহিদার সাথে একা সাক্ষাৎ করার সুযোগ পেয়েছে কেবিনে। নাফিসা ছিলো এতোক্ষণ যাবত, মেহেদীকে ফ্রী মুডে আসতে দেখে সে ইচ্ছে করেই বেরিয়ে গেছে। নাহিদা শুয়ে আছে, দৃষ্টি তার অন্যদিকে। মেহেদী তার পাশে বসে বললো,
– কংগ্রেচ্যুলেশন বাবুর আম্মু।
নাহিদা কিছু বললো না। মেহেদী এগিয়ে তার কপালে ঠোঁট ছুয়ে দিতে চাইলে সে বিরক্তসহিত ঘাড় ঘুরিয়ে মুখে ফিরিয়ে নিলো। ভেতরটায় আবারও এক ধাক্কা খেলো মেহেদী! প্রথমবার যখন বাবুর আগমনী বার্তা পেয়েছিলো তখনও অভিনন্দন জানিয়েছিলো। আর তখনও তার দ্বারা এক ভুল সংঘটিত হয়েছিলো যার ফলে নাহিদা সেদিনও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো। আজ এতোদিন পর আবারও সেই এক পরিস্থিতি! এতো আনন্দময় মুহূর্তেই কেন তার দ্বারা এমন ভুলগুলো হয় বারবার ভেবে পায় না সে! মেহেদী পাশে থাকা বাচ্চার দিকে তাকিয়ে আবার নাহিদার দিকে তাকালো এবং বললো,
– এখনো রাগ করে থাকবে? আমি যে মেয়ের আব্বু হলাম, আমাকে তো একবারও অভিনন্দন জানালে না!
নাহিদা অন্যদিকেই তাকিয়ে আছে। মেহেদী আবার বললো,
– কাজটা তো আমি ইচ্ছে করে করিনি। অজান্তেই হয়ে গেছে! ভাবতে পারিনি তুমি তখন সামনের দিকে এগিয়ে….
– মরে গেলাম না কেন আমরা মা মেয়ে!
কথাটা চরম আঘাত হানলো বুকের বাঁ পাশে! মনের অপরাধী ভাবটা দূর করতে মেহেদী তার কথা শেষও করতে পারেনি নাহিদার এমন কথা ভেতরটা মুচড়ে দিয়েছে! খুব কঠিন গলায় কথাটা বলেছে নাহিদা! যদিও স্বর খুব নিচু। এইটুকু বলতেই যেন সে হাপিয়ে উঠেছে যার ফলে এভাবে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে! নাহ, এটা হাপিয়ে উঠা নয়। এটা অতি কষ্টের ছাপ বহন করে! মেহেদী যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে! আর নাহিদা এবার তার দিকে তাকিয়ে আবারও সেই কঠিন স্বরেই বললো,
– এমন আধমরা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে গেলেই তো ভালো হতো না? ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আপনাকে এতো রেগে যেতে হতো না। আমাদের বিষয়গুলো নিয়ে বরাবর আপনাকে জেদ করতে হতো না। সব বিষয়ে এতো জেদ কেন আপনার? কই আমিও তো রাগ করি, তাই বলে কি জেদ করে এটাসেটা ছুড়ে ফেলে দেই? আপনি ইচ্ছে করে করতে চান নি, যেভাবেই হোক ঘটে গেছে না অঘটন? না করতেন এমন জেদ আর না কিছু ঘটার সম্ভাবনা থাকতো। সব কিছুতে এমন জেদ কেন দেখাবেন? আপনি জেদ করলেই সব মানতে হবে আমাদের? সব কথা আপনার কথায় কেন হবে? আমাদের কিছু ইচ্ছে থাকতে পারে না? বাবামায়ের থেকেও বেশি বুঝদার হয়ে গেছেন! আর আমরা যেন কিছুই বুঝি না! আজ জেদ করে বালিশ ছুড়ে মেরেছেন, হয়তো কাল জেদ করে মেয়েকেই ছুড়ে মারবেন! এর চেয়ে তো ভালো হয় আগেই মরে যাওয়া! এমন ভুগে ভুগে মরা তো অনেক কষ্টকর!
একটুও সহ্য হচ্ছে না নাহিদার কথাগুলো। নিজেকে যেন নিজেই অপরাধের সমুদ্রে ডুবিয়ে দিচ্ছে। সে আর এক মুহুর্তও এখানে বসে না থেকে উঠে বেরিয়ে গেলো কেবিন ছেড়ে! নাহিদা চোখ বন্ধ রেখে হাত মুঠিবদ্ধ করে কাঁদছে! কথাগুলো তাকে শুনিয়েও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার! কেননা সে জানে ইচ্ছে করে করেনি মেহেদী। কিন্তু তার অনিচ্ছাকৃত জেদের কারণেই তো তাদের জীবন ভয়ংকর পরিস্থিতিতে চলে গিয়েছিলো!
বাচ্চা জেগে কান্না শুরু করেছে। নাহিদা এক হাতে চোখ মুছে নিলো। কিন্তু বাচ্চাকে যে বাঁ পাশে রেখেছিলো নার্স! এই হাতে তো স্যালাইনের সিরিঞ্জ লাগানো! সে নড়বেই কি করে আর ধরবেই কি করে! তাই স্বর একটু উঁচু করে বাইরের দিকে হাক ছাড়লো,
“নাফিসা?”
এদিকে সে ডাকার সাথে সাথেই নাফিসা মাত্র পা রেখেছে কেবিনে। মেহেদীকে বেরিয়ে যেতে দেখেই সে প্রবেশ করছিলো। এগিয়ে এসে বাচ্চাকে কোলে নিলো। কেবিনে হাটতে হাটতে জিজ্ঞেস করলো,
– আপু? ভাইয়া কি রেগে আছে না-কি?
– কেন?
– মনে হলো যেন রেগে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো!
– না, রেগে নেই।
– বাবুকে কোলে নিয়েছে?
– এখন নেয়নি, ঘুমাচ্ছিলো বলে।
বাকিরা খাওয়াদাওয়া শেষে কেবিনে এলো। নাহিদার মা আজ বাড়িতে গিয়েছিলো। আর এখানে ছিলো, জহিরুল ইসলাম, মেহেরুন, নাফিসা ও আরিশাকে নিয়ে মেহতাজ। তখনকার পর থেকে সারাদিন আর মেহেদীর দেখা পায়নি নাহিদা। মেহেদী তখন বাসায় চলে গিয়েছিলো। রাতে আবার দেখতে পেয়েছে তাকে। বাকিরা ডিনার করতে গেলে সে বাবুকে কোলে নিয়ে বসেছিলো কিছুক্ষণ। কিন্তু কোনো কথা বলেনি দুজনের একজনও। নাহিদা অভিমানে আর মেহেদী অপরাধে! দুজনেই নিশ্চুপ!
বুঝেও অবুঝ থেকে যায় মন,
ক্ষোভে পুড়ে শুধু অন্তরে জ্বালাতন!
হসপিটালে প্রায় বারো দিন কাটিয়ে তারা নিজ আবাসস্থলে ফিরে এসেছে। কমপক্ষে একমাস নাহিদাকে বেড রেস্টে থাকতে বলেছে। ভারি কোনো কাজ করবে না৷ শুধুমাত্র সুবিধামতো সমতল জায়গায় চলাফেরা। তাও কিছুদিন পর থেকে। এমনিতেই সিজারিয়ান তারউপর ক্রিটিক্যাল পজিশন! সুস্থ হতে সময় আরও বেশি লাগতে পারে। সকল বিষয়ে খুব বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে তাকে।
হসপিটালে তো দৌড়াদৌড়ি আছেই, তারউপর বাড়িতে নিয়ে আসার পরও রুমানা বেগম প্রায় এক সপ্তাহের মতো থেকেছেন এখানে। যদিও মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে থাকাটা তার কাছে অস্বাভাবিক লাগে কিন্তু মেয়ের জন্য থাকতে হচ্ছে। মেহেদী এতোদিন মেহতাজের রুমে থেকেছে, রুমানা বেগম চলে যাওয়ার পর থেকে নিজ রুমে অবস্থান করছে। প্রায় অনেকদিন হসপিটালে থাকায় রুমানা বেগম থাকাকালীন মেহতাজ তার শ্বশুর বাড়ি ছিলো। রুমানা বেগম চলে যাওয়ার পরে আবার কিছুদিনের জন্য চলে এসেছে। সেই ভেবে যে, মা নিশ্চয়ই একা পারবে না সবটা সামলে নিতে। সে-ও নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করে, এমন একটা স্বামী ও পরিবার পেয়ে! এমনকি সমস্যা ব্যতিত সে বাবার বাড়িতেও তেমনভাবে পড়ে থাকে না। আসে মাঝে মাঝে, দু একদিন কাটিয়ে চলে যায়। বছরে দু তিনবার এসে মাসব্যাপী বেড়ানোর চেয়ে মাসে দুই বার পিতামাতাকে দেখে যাওয়াটাই ভালো মনে করে মেহতাজ। এতে নিজের মনটাও শান্ত থাকবে, শ্বশুরবাড়িতেও কথা শুনতে হবে না যে কারণে অকারণে বাপের বাড়ি চলে যায়। যেহেতু যৌথ পরিবার, শ্বাশুড়ি ও জা’র সাথে সম্পর্ক ভালো রেখেই চলছে সে।
বাবুর নাম রাখা হয়েছে মার্জিয়া নুসরাত তাজ। অফিস টাইম শেষে মেহেদী দিনের বাকিটুকু সময় বাসায়ই কাটায়। সকলের প্রয়োজন অপ্রয়োজন সবটাই লক্ষ্য রাখার চেষ্টা করে। তাছাড়া নাহিদা ও তাজের প্রতি এক্সট্রা কেয়ার তো আছেই! কিন্তু দুঃখ সেখানেই, নাহিদা তার সাথে কথা বলে না। সে যদি কিছু জিজ্ঞেস করে প্রয়োজন ভেদে কখনো উত্তর দেয় আবার কখনো দেয় না। মেহেদীও আর আগের মতো অতিরিক্ত কথা বলে না। কেমন যেন একটা অপরাধ বোধ করে! যেন ক্ষমা চাওয়াও অনুচিত। কেননা বারবার ভুল করবে আর বারবার ক্ষমা চাইলে ক্ষমা করে দিবে তা তো আর হয় না। সে নিজেই মনে করে একটু শাস্তি হওয়া দরকার তার! কারণ তার জন্য বউ বাচ্চা হারানোর পথে চলে গিয়েছিলো! অবহেলায় কষ্ট হলেও তার স্বজন তার কাছে থাকলেই হয়। আপাতত আর কিছু চাই না তার।
একই ঘরে একই বিছানায় থাকে তবুও খুব দূরে দূরে! ইচ্ছা থাকলেও মন যায় না এগিয়ে, প্রতি রাতে শুধু কেঁদে কেঁদে মরে! সেদিনের পর এমন কোনো দিন হয়তো বাদ যায়নি যে নাহিদা মেহেদীর জন্য কাঁদেনি! কিন্তু সবটাই নিরব ছিলো! আজ তাদের ঘরে তাজমনি আছে, বিপরীতে কতোই না খুশি হওয়ার কথা ছিলো! অথচ সেখানে ঠাঁই নিয়েছে শুধু মান, অভিমান আর অপরাধের দেয়াল!
আল্লাহর রহমতে মাসখানেক পার হওয়ার পর নাহিদা অনেকটা সুস্থ। তবুও এ পরিবার থেকে তার কাজ নিষিদ্ধ। আপাতত তার কাজ শুধু মেয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা। তাজের বয়স দেড় মাস। তাজকে কেউই নির্দিষ্ট একটা নামে ডাকে না। সবার মুখেই ঘুরেফিরে কখনো মার্জিয়া, কখনো নুসরাত আবার কখনো তাজ শোনা যায়। আর মেহেদী যেন “আব্বু” ছাড়া ডাকই দেয় না! মাঝে মাঝে তো জহিরুল ইসলামই সাড়া দিয়ে ফেলে আর হাস্যকর ব্যাপার ঘটে তাদের পরিবারে! প্রথম প্রথম ভুলে সাড়া দিলেও এখন যেন মজা করার জন্য জহিরুল ইসলামের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে ব্যাপারটা! মেহেদী তাকে ডাকলে তিনি চুপ করে থাকেন, আর তার সামনে তাজকে ডাকলে তিনি সাড়া দেন!
ছুটির দিন। সকালে একসাথে নাস্তা করার সময় নাহিদা জহিরুল ইসলাম ও মেহেরুনের সামনে এক্সামের কথা তুললো। মেহদীও আছে এখানে। নাহিদার খুব ইচ্ছে এক্সামটা দেওয়ার। এখন সে অনেকটা সুস্থ আছে, তাছাড়া এক্সামের প্রিপারেশনও আছে মোটামুটি। একটু রিভিশন হলেই সম্ভব। এতোগুলো দিন পড়াশোনা করে একটা বছর গেপ রাখতে চাইছে না সে। মেহেরুন তার শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে তেমনভাবে সাপোর্ট করতে পারলো না। কিন্তু জহিরুল ইসলাম বলেছেন, যদি তার দ্বারা সম্ভব হয় তো শুধু শুধু একটা বছর নষ্ট করার প্রয়োজন নেই।
ঈদুল আযহার পর বাবার বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার আগেই ফর্ম ফিল-আপ করেছিলো নাহিদা। আর তারপরই ভেবে চিন্তে মেহেদীর নিষেধাজ্ঞা! আজ মেহেদী বাবামায়ের সামনে জোর দিয়ে কিছু বলতে পারলো না। আগেরমতো সেই জোরটা যেন হারিয়ে গেছে! রুমে এসে সে শান্ত গলায়ই বললো,
– তোমার কন্ডিশন কিন্তু এখনো স্বাভাবিক হয়নি। একটা বছর মিস করলে আহামরি ক্ষতি হবে না তোমার। এভাবে নিজেরও ক্ষতি করবে, বাচ্চারও ক্ষতি করবে।
নাহিদা তার কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না। ঘুমন্ত তাজের পোশাক পাল্টে দিচ্ছে চুপচাপ। মেহেদীর নিষেধাজ্ঞাও আর ভালো লাগছে না তার। মেহেদী তার পাশে এসে বসলো এবং বললো,
– আমি তোমাকে কিছু বলছি। এক্সাম দিবে না তুমি।
নাহিদা এবার তার দিকে তাকিয়ে ধাধানো কন্ঠে বললো,
– আজ পর্যন্ত তো কোনো সাপোর্ট পেলামই না, প্রত্যেকটা কাজে শুধু বাঁধা দিয়ে গেছেন। অন্তত এই বিষয়ে পিছু না টানুন! নিজের একটা ইচ্ছে স্বেচ্ছায় পূরণ করার অধিকারও কি আমার নেই?
নাহিদার চোখে পানি চিকচিক করছে। মেহেদী আর কিছু বললো না। ঠিকই তো, সে তো কোনোদিক থেকেই সাপোর্ট করতে পারলো না এ পর্যন্ত! তার প্রতিটি কাজেই কি বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় সে!
মেহেদী আর কোনো কথা বললো না এই বিষয়ে। নাহিদা পরদিন ভার্সিটি যেতে চেয়েছিলো এডমিট কার্ড আনতে। মেহেদী বলে দিলো অফিস যাওয়ার পথে স্যারের সাথে কথা বলে সে নিয়ে আসবে।
নাহিদা আর গেলো না। বহুদিন পর আবার সে বই হাতে নিলো। বাচ্চার দেখাশোনা ও অন্যান্য কাজের বাইরে সে বই নিয়েই বসে থাকে। এক্সাম চলছে, সে এক্সাম দিচ্ছে। এক্সাম বিকেলে হওয়ায় হাফ টাইম অফিস করে মেহেদী তাকে এক্সাম হলে নিয়ে যায়। যতক্ষণ নাহিদা বাইরে থাকে ততক্ষণ মেহেরুন দেখাশোনা করে তাজমনির। প্রতিটি এক্সামের মাঝে বন্ধ থাকায় নাহিদার অনেক সুবিধা হয়েছে। মা ও বাচ্চার মাঝে ঘনঘন দূরত্ব না হওয়ায় বাচ্চার প্রতি বেশি একটা প্রভাব পড়ে না। তবে নাহিদা পুরোপুরি সুস্থ না হওয়ায় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করছে। তার এই সিদ্ধান্তটা অপছন্দ হলেও মেহেদী চুপচাপই থাকে।
চারটা পরিক্ষা দেওয়া হলো। পঞ্চম পরীক্ষার জন্য তার পড়াশোনা চলছে। রাতে ডিনারের পরই পড়তে বসেছে। রাত প্রায় বারোটা বাজতে চলেছে৷ নাহিদা খাটে বসে বই পড়ছে আর পাশেই বাবা-মেয়ে দুজনেই জেগে থেকে দুষ্টুমিতে মেতে আছে! তাজের দুমাস পূর্ণ হয়ে গেছে। সে এখন নানান শব্দ করে কথা বলে আর হাসতেও জানে। মেহেদী এখন তাকে হাসানোর চেষ্টাই করছে। নাহিদা কিছুক্ষণ পড়ায় মনযোগ দেয় আবার কিছুক্ষণ তাদের খুনশুটিতে! রাত বারোটা বেজে গেছে। নাহিদা উঠে বই রেখে বাথরুমে চলে গেলো। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখলো মেহেদী টি টেবিলে চকলেট কেক রাখছে। মুহুর্তেই নাহিদার মুখের ভঙ্গি পাল্টে গেছে। মেহেদী মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। আজ বহুদিন পর আলতো করে বাহুডোরে বেঁধে বললো,
“হ্যাপি এনিভার্সারি, মিসেস।”
সাথে সাথেই নাহিদার ভেতর চিনচিন ব্যাথা উঠে গেলো! ভাবতে গেলে মনে হয় সেদিন তার ঘরে এলো। অথচ আজ একটা বছর কেটে গেছে, সাথে তার রাজকন্যাও আছে! তা-ও নাকি দুই মাস পূর্ণ হয়ে গেছে! সময় কোনদিক দিয়ে চলে যায় খেয়ালই থাকে না!
নিজের মাঝে অপরাধের দেয়াল থাকায় সেদিনের পর থেকে অপ্রয়োজনে মেহেদী তার কাছ ঘেঁষেনি। কিন্তু আজ বহুদিন পর একটু চেষ্টা করলো। কিন্তু এতেও লাভ হলো না! নাহিদা স্থিরভাবে দাড়িয়ে আছে। মেহেদী নিজ থেকেই ছেড়ে দিয়ে তার হাত ধরে টানলো কেক কাটার জন্য। নাহিদা তাকে উপেক্ষা করে খাটে চলে গেলো। মেহেদীর চেহারায় বিষন্নতা নেমে এসেছে। তবুও সে নাহিদার কাছে এসে বললো,
– এসো। কাটবে না কেক? আজও এভাবে থাকবে?
থেমে থেমে বলা তিনটি কথার একটিতেও নাহিদা কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না। সে কাথা নিয়ে ঝটপট শুয়ে পড়লো। মেহেদী তাকে জোরাজুরি না করে হতাশ হয়ে কেকের কাছে চলে এলো! আর কখনোই কোনো কিছু নিয়ে জোর করবে না সেটা আরও আগেই ঠিক করে নিয়েছে৷ তাজ তার পাশে কাউকে না পেয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় নিজের ভাষায় ডাকছে। এদিকে নাহিদা মুখ ঢেকে শুয়ে পড়েছে। ভেতরটা তার কষ্টে ফেটে যাচ্ছে! অশ্রু গড়াতে সমিয় নেয়নি একটুও! একের পর এক ফোঁটা পড়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে! কিন্তু কান্নার কোনো শব্দ হচ্ছে না। একটু পর আবার কাথা একটু ফাঁক করে তাকালো, দেখার জন্য যে মেহেদী সেদিনের মতো জেদ করে এই কেকটাও ছুড়ে ফেলেছে কি-না! কিন্তু না, মেহেদী তার আচরণে কষ্ট পেলেও নিজের মতো এনিভার্সারি সেলিব্রেট করছে মেয়েকে নিয়ে! সে টুলের উপর বসেছে তাজকে কোলে নিয়ে। তাজের হাতে ছুরিটা স্পর্শ করিয়ে বাবা মেয়ে কেকে ছুরি চালান করলো। অত:পর মেহেদী আঙুল দিয়ে একটুখানি চকলেট নিয়ে তাজের মুখে দিলো। তাজ সেটুকু খেয়ে আবারও খাওয়ার জন্য জ্বিভ ঠেলে বের করে আনছে! মেহেদী কেক ঢেকে রাখতে রাখতে বললো, “না, আব্বু। এতো খাওয়া যাবে না। তোমার এসব খাওয়া নিষেধ। এটুকুই অনেক হয়ে গেছে। যখন দাঁত উঠবে তখন খেও আবার।”
মেহেদী জেদ না দেখানোর কারণে আজ খুব ভালো লাগলো নাহিদার। একটু না, মেহেদীর মাঝে সে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করেছে এই ক’দিনে৷ আর আজ, আরেকটু দেরী করলেই দৃশ্যটা মিস করে ফেলতো নাহিদা! তারও খুব ইচ্ছে করছিলো তাদের সাথে যুক্ত হতে! তিনজন একসাথে ছুরিতে হাত রেখে কেক কাটতে! মেহেদীকে নিজ থেকে একবার জড়িয়ে ধরে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানাতে! কিন্তু হলো না তার কিছুই! সকল ইচ্ছে কেবল অভিমানে গড়ে তোলা দেয়ালের আড়ালেই রয়ে গেলো!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here