চৈতালি_পূর্ণিমা,পর্ব-৪

0
4774

চৈতালি_পূর্ণিমা,পর্ব-৪
Writer_Asfiya_Islam_Jannat

— অবশেষে তুমি এসেছ।

অকস্মাৎ কারো উদ্বিগ্ন কন্ঠ শুনে স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই রুদ্রকে দেখে তার মেজাজ বিগড়ে যায়। সে এক ঝাটকায় নিজের হাত রুদ্রের হাতের মুঠোয় হতে সরিয়ে নিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বলে, “হোয়াট দ্যা হেল! তোমার সাহস কিভাবে হয় আমার হাত ধরার?”

রুদ্র নিষ্প্রভ চোখে তাকিয়ে বলে, “আর কতদিন এইভাবে রাগ করে থাকবে? অনেক তো হলো৷ এইবার একটা সুযোগ দাও আমাকে, আমার কথা বলার।”

স্পর্শী ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠে, “তোমার কথা শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই আমার। চলে যাও এইখান থেকে, আমি কোন সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছি না।”

রুদ্র এককদম এগিয়ে এসে বলে, “আমিও এইখানে সিনক্রিয়েট করতে আসি নি, শান্তিপূর্ণ ভাবেই কথা মিটমাট করতে এসেছি।”

“সবকিছু তো আগেই মিটমাট হয়ে গিয়েছে, এখন নতুন করে কি মিটমাট করবে?”

“তুমি প্লিজ একটু ওদিকটায় চল, আমরা আলাদাভাবে কথা বলি।”

স্পর্শী দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “ওদিকটায় কেন? নীরব জায়গায় দেখে আবার….”

রুদ্র কথার মাঝেই ফোড়ন কেটে বলে, “স্পর্শী প্লিজ! মানছি আমি ভুল করেছি, কিন্তু বিশ্বাস করো আমি ওমন নই। আমি ইচ্ছে করে সেসব করিনি।”

হঠাৎ কেয়া বলে উঠে, “আমাদের কি আপনার আহাম্মক মনে হয়? আপনি বলবেন আপনি ওমন নই, এমন নই। আর আমরাও নাচতে নাচতে তা মেনে নিব?”

কেয়ার সাথে তাল মিলিয়ে সামি বলে, “আপনাকে আমাদের চেনা হয়ে গিয়েছে ভাইয়া। তাই দয়া করে এই থার্ডক্লাশ এক্টিং আমাদের সামনে করতে আসবেন না।”

রুদ্র বলে, “তোমরা আমায় ভুল বুঝছো।”

স্পর্শী দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “তাহলে ঠিকটা বুঝছে কে?”

“স্পর্শী প্লিজ, একটা সুযোগ দাও কথা বলার।”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর না করে ভ্রু কুঞ্চিত দৃষ্টিতে তাকায়। নিধি পাশ থেকে এগিয়ে এসে স্পর্শীর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে, “একবার গিয়ে দেখ কি বলতে চায়। তুই সাথে না যাওয়া পর্যন্ত এই ব্যাটার ঘ্যানঘ্যানানি থামতো না। আর আমরা তো আশেপাশেই আছি। এইবার উল্টাপাল্টা কিছু করলে গণধোলাই খাইয়েই ছাড়বো, চিন্তা করিস না। ”

স্পর্শী দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়, নিঃশব্দে হেটে যায় সামনে। তা দেখে হাসি ফুটে উঠে রুদ্রের মুখে।

_________________

শহীদ মিনার থেকে কিছুটা দূরতেই নিম গাছের অধস্তনে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র আর স্পর্শী। আশেপাশে তেমন একটা মানুষজনের আসা যাওয়া নেই। নীরব এবং কোলাহলমুক্ত পরিবেশ। মৃদু বাতাসের সাথে ভাসছে শালিকের মিষ্ট কলধ্বনি। পরিবেশটা মন ভালো করার মত হলেও রুদ্রের উপস্থিতির জন্য সবটাই তিক্ততায় পরিপূর্ণ লাগছে স্পর্শীর। এই মানুষটার ছাঁয়াও এখন সহ্য হয়না তার। তীব্র রাগ হয়। রুদ্রের প্রতি নয় বরং নিজের প্রতি এবং নিজের সিদ্ধান্তের প্রতি। কোন আক্কেলে সে এই মানুষটির সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল কে জানে? এখন তো ভাবতেও তার গা ঘিন ঘিন করে এমন এক নিকৃষ্ট মানুষের সাথে সে কখনো কোন সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল। রাগে,ঘৃণায় স্পর্শী অন্য পার্শ্বে মুখ ঘুরিয়ে রাখে। কিছু প্রহর এইভাবেই নীরবে অতিবাহিত হয়ে যায়। অবশেষে নীরবতা ঠেলে রুদ্র বলে, ” সেদিনের ব্যবহারের জন্য আমি সত্যি দুঃখিত। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি ওইসব নিজের ইচ্ছায় করিনি।”

স্পর্শী অন্যদিকে মুখ করে তিক্ত কন্ঠে বলে, ” এতসব করেও বলছো তুমি কোনকিছু নিজের ইচ্ছায় করো নি? লাইক সিরিয়াসলি! আহাম্মক মনে হয় আমাকে?”

“দেখ স্পর্শী, ওই বিষয়টা এখন বিএফ-জিএফের মাঝে কমন। আমার বেশির ভাগ ফ্রেন্ডরাই তাদের জিএফদের নিয়ে প্রায়শই নীরব জায়গায় যায় একান্ত সময় কাটাতে। একমাত্র আমিই এইসবে মধ্যে ছিলাম না, তুমি ওসব পছন্দ করো না বলে। আর এই বিষয় নিয়েই আমার ফ্রেন্ডরা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকারা শুরু করে। আমার পুরুষত্ব নিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে। তাই সেদিন জীদের বসেই তোমাকে আমি সে প্রস্তাব দিয়ে বসি কিন্তু পরে বুঝতে পারি আমি কত বড় ভুল করেছি।”

স্পর্শী তাচ্ছল্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “তুমি আমাকে শুধু প্রস্তাব নয় বরং জোরপূর্বক নিজের সাথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করেছ। আমার ভাগ্য ভালো সেদিন তোমার বলা জায়গায় আমি দেখা করতে রাজি হয়নি। কোলাহলপূর্ণ জায়গায় দেখা করেছিলাম বিধায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলাম৷ নাহলে রাস্তার কুকুরের খাবার হতে আমার সময় লাগতো না।”

— আমি মানছি, আমার দ্বারা অনেক বড় ভুল হয়েছে। আর এর জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থীও। আমি বন্ধুদের কথ..

রুদ্রের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই স্পর্শী বলে, “কুকুরের লেজ কখনো সোজা হয় না, বুঝলে। নিজের স্বার্থ এখনো হাসিল হয়নি বলেই এই ক্ষমাপ্রার্থীর নাটক হচ্ছে তাই তো? তোমার ভালো মানুষি মুখোশ বহু পূর্বেই আমার নিকট খুলে পড়েছে, তাই অভিনয় করে লাভ নেই।”

“তোমার মনে হচ্ছে না তুমি এইবার একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছো? ভুল করেছি, মাফও চাচ্ছি৷ তাহলে খামাখা কথা কেন বাড়াচ্ছো?”

“কথা আমি না তুমি বাড়াচ্ছো৷ আমি আমাদের সম্পর্কের ইতি অনেক আগেই টেনেছি, কিন্তু তুমি মানতে চাইছো না। উল্টো বারংবার আমাকে উত্ত্যক্ত করছো।”

রুদ্র এককদম এগিয়ে এসে বলে, “তুমি আমাকে একটু বুঝার চেষ্টা করো।”

স্পর্শী দ্রুত কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে বলে, “ভুলেও কাছে আসার চেষ্টা করবে না। এইবার অসভ্যতামি করলে কিন্তু শুধু থাপ্পড় না, কপালে অনেক কিছুই জুটবে মনে রেখ।”

“তুমি কিন্তু এখন বেশি বেশি করছো। সেই বিষয়টা অনেক কমন। এমন অহরহ হচ্ছেই, আমিও সেরকমই একটা ইচ্ছা পোষন করেছি এতে এত রিয়েক্ট করার কি আছে?”

” এত ইচ্ছা থাকলে কিছু টাকা রাস্তায় ফালালেই নিজের সকল ইচ্ছা,কামনা পূরণ করতে পারবে৷ খামাখা কুকুরের মত আমার পিছে ঘুরছো কেন? আমি মোটেও কোন তুচ্ছ জিনিস নই। শেষবারের মত বলছি, আমার থেকে দূরে থাকো।”

স্পর্শী তেজী কন্ঠের বুলি শুনে রুদ্রের কান গরম হয়ে যায়। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাতেই স্পর্শী তাচ্ছিল্যে সুরে বলে, “ভাগ্যিস! তোমার সাথে আমি সিরিয়াস রিলেশনশিপে যায়নি অন্যথায় কান্না ব্যতীত ভাগ্যে আমার কিছুই জুটতো না।”

স্পর্শী কথাগুলো বলে চলে যেতে নিলে পিছন থেকে রুদ্র ওর হাত টেনে ধরে। স্পর্শীর রাগ এইবার সকল সীমা পেরিয়ে যায়। সে অবিলম্বে নিজের হাত ছাড়িয়ে তীব্র গতিতে রুদ্রের গালে চড় বসিয়ে দেয়। মুহূর্তেই পরিবেশটা নিস্তব্ধতায় তলিয়ে যায়, নত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রুদ্র৷ রক্তিম হয়ে আসা চোখে যেন অগ্নির বর্ষণ দেখা দিচ্ছে। চারদিকের নিস্তব্ধতা প্রগাঢ় হওয়ার পূর্বেই স্পর্শীর তীব্র কন্ঠের ঝংকারে তা দৌড়ে পালায়,

— আমাকে স্পর্শ করার দুঃসাহসিকতা আর দেখিও না। আজ শুধু থাপ্পড় মেরেছি কিন্তু পরেরবার একদম হাতটাই ভেঙে দিব।

রুদ্র অগ্নিমূর্তি দৃষ্টিতে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে, “কাজটা তুই ঠিক করিসনি। ভালো ভাবে দুই-একটা কথা কি বলেছি, পেয়ে বসেছিস একদম। আরেহ, তোর মত মেয়ের দিকে তো রুদ্র তাকিয়ে দেখে না। নেহাৎ ফ্রেন্ডের সাথে বাজি ধরেছিলাম বলে এতদিন সহ্য করেছি। নাহলে তোর মত মেয়ের সাথে আমার যায় নাকি? কিসের দেমাগ এত তোর? না আছে চেহেরা, না আছে গুণ। পিস অফ গার্বেজ!”

স্পর্শী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কেউ পিছন থেকে বলে উঠে,

” কি হচ্ছে এইখানে?”

কারো ভরাট কন্ঠ শুনে রুদ্র ও স্পর্শী পিছনে ঘুরে তাকায়। আগন্তুকটিকে দেখে স্পর্শী ভিতরে ভিতরে বিচলিত হলেও বহির্ভাগে তা প্রকাশ করে না। স্থির থাকে। কিন্তু রুদ্র কিছুটা ঘাবড়ে যায়। সে আমতা-আমতা করে বলে, ” নির্বাণ স্যার, আপনি!”

নির্বাণ দুই কদম এগিয়ে এসে গাম্ভীর্যপূর্ণ কন্ঠে বলে, “হুম? কোন সমস্যা?”

রুদ্র কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করে বলে, “না-তো।”

নির্বাণ একপলক স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে বলে, “এইখানে কি করছো তোমরা দুইজন? কিছু কি হয়েছে?”

স্পর্শী মুখ না খুললেও রুদ্র বিনয়ী সুরে বলে, “না স্যার কিছু হয়নি। আমরা তো এইভাবেই টুকটাক কিছু কথা বলছিলাম। গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।”

নির্বাণ প্যান্টের পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে বলে, “আচ্ছা। এখন ক্লাসে যাও, এইসময় এইদিকটা নিরাপদ না।”

“জি স্যার।” কথাটা বলেই রুদ্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একবার স্পর্শীর দিকে তাকিয়ে দ্রুত পায়ে হেটে চলে আসে। পুরো ক্যামেস্ট্রি ডিপার্টমেন্টই অবগত নির্বাণের রাগ সম্পর্কে। নির্বাণের আগমনে বেশি দিন নাহলেও তার ভীতি সকলের মধ্যেই কম-বেশি আছে। প্রচন্ড কঠোর ব্যক্তিত্ব তার। তার প্রত্যেক কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হয় স্টুডেন্টদের, সামান্যটুকু ভুল তার নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। যার দরুন, সকল স্টুডেন্টদের নিকট সে ‘হিটলার স্যার’ নামে পরিচিত। বিষয়টা রুদ্রেরও অজানা নয়। সে প্রায় কয়েকবারই নির্বাণের কাছে শাস্তি পেয়েছে এবং বেশ ভুগেছেও। আর কোনরকম ভোগান্তিতে পড়তে চায় না সে, তাই দ্রুত কেটে পড়ে।

রুদ্র চলে যেতেই নির্বাণ স্পর্শীর দিকে তাকায়। স্পর্শী তখনও স্থির দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি তার নত। নির্বাণ গলা ঝেড়ে বলে, “ঠিক আছে সব?”

স্পর্শী মাথা হ্যাঁ-বোধক মাথা নাড়িয়ে বলে, “জি স্যার!”

“আর ইউ সিউর?”

স্পর্শী এইবার দৃষ্টি তুলে তাকায়, ম্লান মুখে বলে, “ইয়েস!”

নির্বাণ কিছু না বলে নীরব দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে স্পর্শীকে। স্পর্শীর তাতে একটু অস্বস্তি হলেও পরবর্তীতে তার মস্তিষ্কে অন্য চিন্তার দল এসে হানা দেয়। ক্ষণেই সে নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকালো নির্বাণের পানে। অকস্মাৎ তার কি হলো কে জানে, সে ক্ষীণ কন্ঠে বলে উঠে,

— আপনি যেমন ভাবছেন তেমন কিছু নয়। আ…..

স্পর্শীকে সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে না দিয়ে নির্বাণ বলে উঠে, “কিছু বলার প্রয়োজন নেই। বিশ্বাস আছে আমার।”

দুই বাক্যের এই ছোট সংলাপে নিগূঢ় মাধুর্য খুঁজে পেল স্পর্শী। যা মুহূর্তেই তাকে বাক্যহারা করে দিল, বাধ্য করলো থমকাতে। নিবার্ণ বা হাত উঠিয়ে একবার ঘড়ির টাইম দেখে বললো, “ক্লাসের টাইম হচ্ছে তোমার, ক্লাসে যাও।”

কথাটা বলেই নির্বাণ হাঁটা দেয় উল্টো পথে। স্পর্শী সেদিকেই সীমান্তহীন বিস্ময় নিয়ে দেখতে থাকে শ্যাম পুরুষটিকে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here