চৈতালি_পূর্ণিমা,পর্ব-১৬

0
4088

চৈতালি_পূর্ণিমা,পর্ব-১৬
Writer_Asfiya_Islam_Jannat

চারদিকে প্রচন্ড কোলাহল। দানব আকৃতির স্পিকারগুলোয় বাজছে আড়ম্বরি গান। গানের প্রখর শব্দ কম্পন সৃষ্টি করছে প্রকৃতির মাঝে। বাচ্চারা দৌড়াদৌড়ি করছে এদিক-সেদিক। বড় গুরুজনেরা বাগানের নীরব একাংশে দাঁড়িয়ে আলাপ-আলোচনা করছেন নিজেদের মধ্যে। উচ্চশব্দে রাদিনের ক্ষতি হতে পারে বলে বাহিরে আনা হয়নি তাকে। রুমে রাখা হয়েছে বিশ্রামের উপর। হলুদ ছোঁয়ানোর পূর্বে বাহিরে নিয়ে আসা হবে তাকে। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা ব্যস্ত মেহমানদের আপ্যায়ন করতে। ব্যস্ততার হাত থেকে যেন আজ কারো নিস্তার নেই।
ব্যস্ত,কোলাহলপূর্ণ পরিবেশের মাঝেও এক জোড়া আঁখিপল্লব বারংবার ঘুরে ঘুরে দেখছে শ্যামময়ী এক মানবীকে। মোহগ্রস্ত সেই দৃষ্টি। যতবারই মানবটি কাজ ফাঁকি দিয়ে দেখছে মানবীকে ততবারই তার বক্ষঃস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে। মানবীর শব্দহীন হাসি যেন ঝংকার তুলছে মানবের কর্ণকুহরে। বাড়ছে মনে মানবীকে নিরন্তর দেখার তৃষ্ণা। একবারে যে এই দেখা শেষ হবার নয়। সময়ের কাটা সেকেন্ড, মিনিট পেরিয়ে ঘন্টায় পদার্পন করতেই মানবটির মনে হলো মেয়েটি যে-বারই শাড়ি পরিধান করে সে-বারই তার অবস্থা করুণ হয়। নির্মল পুরুষালী মনে কলঙ্কের শিলমোহর পড়ে। জাগ্রত হয় নিষিদ্ধ ইচ্ছে। বিচলিত, অনিয়ন্ত্রিত হয় হৃদয়। আগে তো কখনো কোন নারীকে দেখে এমন বোধ হয়নি তার, তাহলে এই মানবীর বেলায় কেন এমন হয়?
জীবনের ঊনত্রিশ বসন্ত পেরিয়েও যে মন কারো কাছে ধরা দেয়নি, কারো সৌন্দর্যের ধার মাপেনি, দুর্বল হয়নি। সেই মন কি-না সর্বশেষ হারলো চৈত্র মাসের এক অপরাহ্নে? এই এক নারীতে? সে স্থির দৃষ্টিতে তাকায় সামনে। এমন সময় পাশ থেকে মন্থর কন্ঠে কেউ বলে,

“অবশেষে বুঝি পাথরের বুকে ফুল ফুটলো?”

নিজের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসলো নির্বাণ। ক্ষণেই কন্ঠে উৎস খুঁজে বের কর‍তে সে পাশ ফিরে তাকালো। নাহিদের ভ্রু উঁচানো দৃষ্টি দেখে ভ্রু কুঞ্চিত হলো তার। স্বগতোক্তি কন্ঠে বলল, “কি বলতে চাইছিস?”

“আরেহ ভাই! আর কত ঢং করবি? স্বীকার যা তুই ভাবীর প্রেমে পড়েছিস।”

কথাটা কর্ণগোচর হওয়া মাত্র নির্বাণ বিব্রতবোধ করলো। নিজের ভিতরকার অনুভূতি কোনমতে লুকায়িত করে শক্ত গলায় বলল, “এইখানে কি করিস তুই? তোকে না গেটের দিকে থাকতে বলেছি আমি? যা, এখনই ওইদিক যা।”

“কথা ঘুরাচ্ছ ভাই? আমার কাছে স্বীকার করতে এত লজ্জা?”

“মাইর না খাইতে চাইলে এখনই চোখের সামনে থেকে দূর হো।”

নাহিদ মুখ বাঁকিয়ে বলে, “স্বীকার করলি না তো? আচ্ছা, ঠিক আছে। আরেকবার খালি ভাবীর দিকে তাকা তুই, ডায়রেক্ট ভাবীকে নিয়েই তোর সামনে হাজির হবো।”

নির্বাণ রোষাগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “আমার হাতে মাইর খাস না অনেকদিন তাই না? আচ্ছা আয়, তোর পিঠটা একটু দেখে দেই।”

নাহিদ মুহূর্তেই একদম পিছিয়ে গিয়ে বলে, “মৃদুল ডাকছে আমায়। যাই আমি!”

কথাটা বলেই নাহিদ উল্টোপথে হাঁটা দিল। তবে কিঞ্চিৎ মুহূর্ত না পেরুতেই নাহিদ পুনরায় ফেরত এসে বলে, “ভাবীর দিকে আর তাকাবি না। তোর দৃষ্টিতে আমার ভাবীর নজর লেগে যাবে।”

কথাটা বলে নাহিদ আর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে দৌড়ে পালালো। নির্বাণ তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে একনজর তাকালো স্পর্শীর পানে। অতঃপর নিজ কাজে মনস্থির করলো।

___________________

নিশীথের কৃষ্ণ আকাশে দীপ্তিময় লক্ষ নক্ষত্রে মাঝে অর্ধ-বৃত্তাংশ চন্দ্রমা অকৃপণ হাতে দ্যুতি বিলাচ্ছে। নিজের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে স্নিগ্ধ দ্যুতির ছটা দক্ষিণা জানালার শিকল পেরিয়ে হামাগুড়ি খেল মেঝেতে। একাংশ স্নিগ্ধতা গিয়ে ঠেকল বিছানায় ঘুমন্ত কৃষ্ণময়ী মানবীর চরণে৷ পায়ের সাথে লেপ্টে থাকা রুপালি পায়েল দু’টি আলোর সংস্পর্শে এসে মুক্তার ন্যায় চিকচিক করল। রুমে প্রবেশ করা মাত্র সর্বপ্রথম সেদিকেই চোখ গিয়ে আটকায় নির্বাণের। ক্লান্ত দৃষ্টিতে ছড়ায় মগ্নতা। দরজার সামনে থেকে সরে আসলো নির্বাণ, খুব সাবধানতার সহিত দরজা আঁটকে দিল। শব্দ হতে দিল না একটুও। অতঃপর দেয়াল হাতড়ে জ্বালিয়ে দিল নীলাভ আলোটি। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো স্পর্শীর পানে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মেয়েটি, চুল এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে মুখ,গলদেশে। নির্বাণ দীর্ঘ নিঃশ্বাস পড়নের পাঞ্জাবিটা খুলে ফেলে। গা থেকে তার ঘামের তীব্র গন্ধ আসছে, গোসল করা প্রয়োজন। নির্বাণ ব্যাগ থেকে এক সেট কাপড় বের করে চলে যায় ফ্রেশ হতে।
ঘন্টাখানিক বাদে নির্বাণ বেরিয়ে আসে। বা হাতে তোয়ালে ধরে ঘর্ষণ চালায় মাথায়। ভালোমতো চুলের পানি মুছে নিয়ে তোয়ালেটা চেয়ারের উপর ফেলে দেয়। ধীর পায়ে এগিয়ে যায় বিছানার দিকে। স্পর্শীর পাশে এসে আধশোয়া হয়ে বসে সে। কিছুটা ঝুঁকে ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে খুব সপ্তপর্ণে স্পর্শীর মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয়। গলদেশ হতেও সরিয়ে দেয়। মেয়েটা বোধহয় গোসলের পর ভালোমত মাথা মুছেনি। চুলে এখনো সিক্ততা বিরাজমান। স্পর্শীকে দেখতে দেখতেই ঘোর লাগলো নির্বাণের। নিজেকে নিজেকেই প্রশ্ন করলো,

“আসলেই কি আমি তোমার প্রেমে পড়েছি? এই পাষাণ হৃদয়ে কি আদৌ কাউরো জন্য ভালোবাসার অনুভূতি জন্মাতে পারে?”

হঠাৎ নির্বাণের দৃষ্টি গিয়ে স্থির হয় স্পর্শীর অধর যুগলে। কিনারে এখনো লালাভ রঙটি লেপ্টে আছে। নির্বাণ এইবার বৃদ্ধা আঙুল ছোঁয়ালো সেখানে, ধীর গতিতে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করলো রঙটি। মুহূর্তেই ঘুমের ঘোরে কেঁপে উঠলো স্পর্শী। খুব আদুরে ভঙ্গিতে নির্বাণের হাত জড়িয়ে ধরে অন্যপাশ ফিরলো সে। মুহূর্তেই নির্বাণ স্পর্শীর আরও নিকটে ঝুঁকে পড়লো। মুখশ্রী গিয়ে ঠেকলো স্পর্শীর গলদেশে। নির্বাণ ভাবলো, এইবার হয়তো মেয়েটার ঘুম ভেঙ্গেই গেল। কিন্তু না এমনটা হলো না। স্পর্শী তন্দ্রাঘোরেই নিমজ্জিত থাকলো। নির্বাণ এইবার কিঞ্চিৎ হাসলো, সেচ্ছায় পিছন থেকেই জড়িয়ে ধরলো স্পর্শীকে। বিরবির করলো আনমনেই,

“তোমাকে আমি ভালোবাসি কি-না জানি না তবে আমার তোমাকেই চাই।”

_______________

এলার্মের কর্কশ ধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই তন্দ্রা কাটলো স্পর্শীর। আধনিভন্ত নয়নে চোখ বুলালো চারদিকে। বালিশের পাশে হাতড়ে মোবাইলটি খুঁজে বের করে এলার্ম অফ করলো। তন্দ্রাভাব পুরোপুরি কাটতেই বিব্রতবোধ করলো সে। স্পর্শী প্রথম দিনকার মত আজও নির্বাণের পায়ের উপর পা উঠিয়ে দিয়েছে। বিষয়টা যত না স্পর্শীর নিকট লজ্জাজনক ঠেকল তার চেয়েও বেশি অস্বস্তিবোধ করলো। অতঃপর নিজের উদরে নির্বাণের বলিষ্ঠ হাত স্থির দেখে স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে বিরবির করল, “রাতে আমি তার উপর হাত-পা ফালাই নাকি সে আমার উপর, কোনটা?”

সঠিক উত্তর পেল না স্পর্শী। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আস্তে করে নির্বাণে হাত নিজের উপর থেকে সরিয়ে উঠে পড়লো। নির্বাণ উঠার পূর্বেই আগে ভাগে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো সে। লজ্জায় নাকি সংকোচে তা বুঝা গেল না।

______________

বিয়ের অনুষ্ঠান দুপুরে হলেও দীর্ঘপথ এবং যানযটের কারণে বরযাত্রীদের নিজ গন্তব্যে এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল ঘনিয়ে আসে। গেট দিয়ে ঢোকামাত্র কনেপক্ষের সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বরযাত্রীদের আপ্যায়নে। খাবারের সময় বহুক্ষণ পূর্বেই অতিক্রম হয়ে যাওয়ায় আগেই বরযাত্রীদের খেতে বসানো হলো। মুহূর্তেই টেবিল সাজানো হলো হরেকপদের রান্নায়। কারো বুঝতে দেরি নি বরযাত্রীদের জন্য-ই বিশেষ আয়োজন। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে আসায় বেশির ভাগ সবাই ক্ষুধার্ত ছিল। যার দরুন খাবার আসার পর পরই সকলে আহার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
খাওয়া-দাওয়া শুরুর মিনিট দুই-এক পরেই নির্বাণ স্পর্শীর পাশে এসে বসে। মন্থর কন্ঠে বলে,

“রোস্ট খাওয়ার প্রয়োজন নেই তোমার।”

কথাটা শ্রবণ হতেই স্পর্শী ভ্রু কুঁচকে তাকায়৷ কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কেন?”

“ওটাতে বাদামের পেস্ট ব্যবহার করা হয়েছে। তোমার না বাদামে সমস্যা? ওইটা বাদে বাকিগুলো তুমি খেতে পারবে।”

স্পর্শী অবাক হলো এই দেখে একবার বলাতেই নির্বাণের মনে আছে তার কোন খাবারে প্রবলেম। সেই সাথে আলাদা ভালোলাগাও করলো মনের গহীনে। সে মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,
“আমি এইভাবেও রোস্ট খেতাম না, এইটাতে বাদামের পেস্ট ব্যবহার হয় আমি জানি। তবে আপনি কিভাবে জানলেন?”

“বাবুর্চি থেকে জিজ্ঞেস করে এসেছি।”

মুহূর্তেই স্পর্শীর ঠোঁটের কোনে ছেঁয়ে গেল তৃপ্তির হাসি। মানুষটার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খেয়াল রাখা যে তাকে প্রতিনিয়ত দুর্বল হতে বাধ্য করছে। নিভৃতেই জায়গায় গড়ে নিচ্ছে তার বক্ষঃস্থলে। তার জন্য এতটা সাবধানতা অবলম্বন হাতে গোনা কিঞ্চিৎ মানুষজনই করেছে৷ সেই মানুষের তালিকায় আজ নির্বাণ পাকাপোক্তভাবেই জায়গায় করে নিয়েছে। স্পর্শী কিছু না বলে মুচকি হেসে নীরবেই খাওয়া শুরু করল।

খাওয়া শেষে নির্বাণ কিঞ্চিৎ মুহূর্তের জন্য দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায়। স্পর্শী চারদিকে নির্বাণকে না পেয়ে এক কিনারে গিয়ে বসে। ক্লান্ত লাগছে তার বেশ। স্পর্শী একটু ঝিমিয়ে বসে পার্স থেকে মোবাইল বের করে। অকস্মাৎ তার সামনে ছোট একটি ভ্যানিলা আইসক্রিমের বাটি তুলে ধরে কেউ। স্পর্শী পাশ ফিরে তাকায়। মুহূর্তেই দৃষ্টির মনিতে নির্বাণের মুখশ্রী ভেসে উঠে। স্পর্শী কৌতূহলী দৃষ্টিতে নির্বাণের দিকে তাকাতেই নির্বাণ মন্থর কন্ঠে বলে,

” ধরো এইটা। বাদামের জন্য পায়েস বা জর্দা কোনটাই তো খেতে পারোনি তুমি।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here