বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ ত্রয়োদশ

0
4178

বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ ত্রয়োদশ
মম_সাহা

আজিজুর রহমান বর্ণের মায়ের থেকে সবটা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। মেয়ের হাতে ফোন দিতে বলে কিন্তু নীলা কোনো হেলদোল দেখায় না।নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। বর্নের মা নীলাকে ফোন হাতে নিতে বললেও সে কথা কানে নেয় না।আজিজুর রহমান বুঝে মেয়ের মনের অবস্থা বর্ণের মাকে বলে লাউডস্পিকারে দিতে।সে ফোন লাউডস্পিকারে দিলে আজিজুর রহমান বলা শুরু করেন
-‘আম্মু তুমি কথা বলবে না বাবার সাথে? বাবাকে এবারের মতন ক্ষমা করে দেও মা।বাবা তোমায় বাঁচাতে পারে নি।তাই বলে বাবাকে এত বড় শাস্তি দিবে মা?’

নীলা কিছু বলে না।কিন্তু এতক্ষণ সে কোনো কান্না না করলেও এখন ভেঙে পড়ে।কেঁদে দেয়। আজিজুর রহমান মেয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পায়।বুকটা তার ফেটে যাচ্ছে।

বর্ণ এতক্ষণ চুপ ছিলো কিন্তু নীলার কান্না দেখে আর ঠিক থাকতে পারলো না।সে নীলার পাশে গিয়ে নীলার বাহু শক্ত করে ধরে।নীলা সরে যেতে চাইলে বর্ণ গম্ভীর কন্ঠে বলে
-‘প্লিজ নীলাম্বরী ডোন্ট ক্রাই।’

নীলাম্বরী সরে না।তবে চুপ হয়ে কেঁদে যায়।আজিজুর রহমান মেয়েকে স্বান্তনার স্বরে বলে
-‘মা কেঁদো না প্লিজ।আমরা এখনই রওনা হচ্ছি।ভোরের দিকেই পৌঁছে যাবো। কেঁদো না কেমন।ওরা যা করেছে তার শাস্তি দিবো আমি ওদের। তুমি ভেঙে পড়ো না।খুব বেশিই ব্যাথা পেয়েছো না মা?’

নীলা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল
-‘বাবা বাহ্যিক ব্যাথাটা কিছুই না ভিতরে আমার রক্তক্ষরণ হচ্ছে।এ শহর ভালো না বাবা।এ মানুষ ভালো না।যতবারই উঠে দাঁড়াতে চেয়েছি ততবারই আপন মানুষ গুলো ভেঙে দিয়েছে আমায় বাবা।আমার যে বেঁচে থাকা দুঃসাধ্য হয়ে যাচ্ছে।’

উপস্থিত সবাই নীলার কথায় নির্বাক হয়ে যায়। একটা মেয়ের মন ভাঙা কি আর্তনাদ।আজিজুর রহমানও থমকে দাঁড়ায়। সত্যি আপন মানুষ গুলোই মেয়েটাকে শান্তি দিলো না।সে নিজেকে শক্ত করে বলল

–‘এরকম বলে না আম্মা। যারা তোমায় কষ্ট দেয় তারা কখনোই তোমার আপন না মা।আর যারা আপন না তাদের আচরণ জীবনে প্রভাব পড়তে দিও না।’

নীলা চোখের জল মুছে কতক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
–‘বাবা আমি থাকতে চাই না এ’শহরে।আমি অন্য কোথাও যেতে চাই যেখানে কেউ থাকবে না এমন।আমি শান্তি চাই বাবা।’

নীলার কথায় বুক মোচড় দিয়ে উঠে বর্নের। সে নীলাকে কিছু বলতে যাবে তখনই নীলা উঠে রুমে চলে গিয়ে দরজা আটকিয়ে দেয়।

বর্ণের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে।দৌড়ে গিয়ে দরজা ধাক্কানো শুরু করে।আজিজুর রহমান বর্ণকে ফোনটা দিতে বলেন।বর্ণের মা বর্ণের কাছে ফোনটা ধরতেই বর্ণ বলে উঠলো
–‘সরি স্যার আপনার কথা আমি রাখতে পারি নি।আপনার আমানত রেখে যাওয়ার মর্যাদা রাখতে পারি নি স্যার।’

আজিজুর রহমান হাজারও কষ্টের মাঝে মুচকি হাসলেন।তার মেয়ে এ’শহরে খারাপ মানুষ গুলোকেই দেখে চলে যেতে চাইলো একবার যদি এই ছেলেটাকে খুঁটিয়ে দেখতো তাহলে এ’শহরে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে দ্বিগুণ হতো।

আজিজুর রহমান মুচকি হেসে বলল
-‘মাই সান কখনো কখনো এমন পরিস্থিতি আসে আমাদের জীবনে যখন আমরা চেয়েও অনেক কিছু করতে পারি না।তখন কোনো ভাবেই নিজেকে ব্লেইম দেওয়া উচিত না। তুমি ঐ পরিস্থিতিতে লড়াই করতে চেয়েছো সেটাই বড় ব্যাপার।’

বর্ণ ভরসা পেলো মানুষটার কথায়। কেমন জেনো যাদু জানে মানুষটা।সব খারাপ লাগা এক নিমিষেই উধাও করে দেয়। হঠাৎ করেই বর্ণের নীলার দরজা আটকানোর কথা মনে পড়লো।তরিঘরি করেই সে বলল
–‘স্যার নীলাম্বরী তো রুমে গিয়ে দরজা আটকিয়ে দিয়েছে।’

আজিজুর রহমান স্বান্তনার স্বরে বলল
–‘চিন্তা করো না।ও নিজের কিছু করবে না।আসলে ও ঘটনাটি মানতে পারে নি।হঠাৎ কাছের মানুষের এত হিংস্র রূপ হজম করতে তো সমস্যা হবেই।’

–‘কিন্তু স্যার ওনার মাথা বেশ খানিক কেটেছে।রক্ত বের হচ্ছে এখনো।উনি বের না হলে কীভাবে ব্যাথার জায়গায় মেডিসিন লাগাবো?’

–‘সব ব্যাথায় কি ওষুধ লাগানো যায় বর্ণ?নীলার ভিতরের রক্তক্ষরণ যতক্ষণ না কমবে ততক্ষণ ও বাহিরের টা নিয়ে ভাববে না।আমরা রওনা দিচ্ছি। ভোরেই পৌঁছে যাবো।তোমরা নাহয় তোমাদের ফ্লাটে চলে যাও।’

আজিজুর রহমান কথাটা বলে সাড়তেই বর্ণের মা মোবাইলটা নিয়ে নিলেন।বিনীত স্বরে বললেন
–‘ভাইসাহেব আমি আমার মেয়ে রেখে কোথায় যাবো?এই অন্যায় কথা বলবেন না।আপনারা নিশ্চিন্ত মনে আসুন।আমরা সবাই আছি আমার মেয়ের কাছে।’

আজিজুর রহমান ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলে ফোনটা রেখে দিলো।আফসানা রহমান ততক্ষণে ব্যাগ গুছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আজিজুর রহমান ফোন কাটতেই তাড়া দিয়ে বলল
-‘কি গো কি বললো?মেয়েটা কিছু বলেছে তোমায়?আমায় ক্ষমা করো।আজ আমার বাপের বাড়ির লোকজনের জন্য এত হয়রানি মেয়েটার।আমি লজ্জিত।’

আজিজুর রহমান গম্ভীর কন্ঠে বলল
-‘ঐ মানুষ গুলো তোমার কখনোই আপন ছিলো না তাই এসব কথা বলো না।’

আফসানা রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন
-‘চলো তাড়াতাড়ি, মেয়েটা তো একা আছে।’

আজিজুর রহমান শান্ত স্বরে বললেন
-‘আমার মেয়ে আর একা নেই আফসা।ওর সাথে ওর অদৃশ্য এক পরিবার আছে।তুমি চিন্তা করো না।’

আগন্তুক কল লাগায়। ফোনের বিপরীত পাশের মানুষটা কল রিসিভ করতেই আগন্তুক বলে উঠে
-‘সবটা শুনেছো তো?নীলা কিন্তু প্রচুর ব্যাথা পেয়েছে।’

ফোনের বিপরীত পাশের মানুষটা বলল
-‘হ্যাঁ সবটাই আমি জানি।তবে নীলা যথেষ্ট প্রতিবাদ করেছে শুনে খুশি হয়েছি।ওর বাহিরের ক্ষতটার দাগ রয়ে যাবে।আর কিছু দাগ থেকে যাওয়া ভালো।ওর দাগ গুলো ওরে স্মরণ করিয়ে দিবে আপন মানুষদের আচরণ,এ দাগ গুলো ওকে ভুল মানুষ হতে সাবধান করে দিবে।

আগন্তুক ছোট্ট শ্বাস ফেলে।তারপর বলে
–‘তুমি আসবে না ওরে দেখতে?’

বিপরীত পাশের মানুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
-‘না এসে কীভাবে থাকবো বলো।তুমি তো জানো ও আমাদের জান।’
__________

চারদিকে সূর্যের লাল আভা ছড়াচ্ছে।আধাঘন্টা হলো নীলার পরিবারের সবাই এসেছে।বাবা মাকে দেখে নীলার যতটা না শান্তি মিলছে রাহাতকে দেখে তার চেয়ে বেশি অশান্তি হচ্ছে।

আসছে পর থেকে নীলা আজিজুর রহমানের বুকে চুপটি করে শুয়ে আছে।আর ওর চাচা মানে রাহাতের বাবা নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।বাবা আসার পরই নীলা মাথায় ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়েছে।

আফসানা রহমান ভিতরে ভিতরে বেশ ভেঙে পড়েছে।কিন্তু শক্ত মনের দেখে এখনো কিছু বলছে না।মেয়ের সামনে যেতেও তার লজ্জাবোধ করছে।

বর্ণের মা শারমিন চৌধুরী নীলার বাবা মা আসার পর সবার সাথে টুকটাক কথা বলে নিজের ফ্লাটে চলে যান নাস্তা বানানোর উদ্দেশ্যে। কাল রাত হতে সবাই ই না খাওয়া। আর বর্ণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। শারমিন চৌধুরীকে সাহায্য করতে রঙের মাও চলে যায়। এখন ড্রয়িং রুমে বর্ণ,বর্ণের ভাই আর রঙ উপস্থিত ওদের বাসার।

আফসানা রহমান কতক্ষণ নির্জীব থেকে তার বড় মেয়েকে ডাক দিলেন।নিরুপমা মায়ের পাশে এসে দাঁড়াতেই আফসানা রহমান শক্ত কন্ঠে বললেন
-‘আমার ফোনটা দাও তো নিরু।’

নিরুপমা তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে আসে।আজিজুর রহমান প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে
-‘এত সকালে কাকে কল দিবে তুমি?’

আফসানা রহমান রুক্ষ কন্ঠে বলে
-‘কাকে দিচ্ছি দেখলেই বুঝবে।এখন যা করার আমাকেই করতে হবে।’

সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে আফসানা রহমানের কর্মকান্ড। ততক্ষণে অপর পাশে থেকে কলটা রিসিভ হয়েছে।

ফোনটা ধরতেই আফসানা রহমান গম্ভীর কন্ঠে বলল
-‘বাহ্ আপা আমাদের ঘুম কেড়ে আরামেই তো ঘুমাচ্ছো।’

রেহানা বেগম এত সকালে বোনের কন্ঠ পেয়ে হুড়মুড় করে শুয়া থেকে উঠে বসে।আমতা-আমতা স্বরে বলে
-‘কী বলছিস আফসু?’

আফসানা রহমান তাচ্ছিল্য হেসে বলল
-‘ কি বলছি ভালো করেই বুঝতে পেরেছো আপা।তাও নাটক করছো কেনো?’

রেহানা বেগম নিচু স্বরে বলল
-‘কালকের ঘটনার জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি আফসু।’

আফসানা রহমান আগের ন্যায় তাচ্ছিল্য হাসিটা মুখে বজায় রেখে বললেন
-‘এত জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে কাহিনী করে ক্ষমা চাইলেই সবটা শেষ হয়ে যাবে আপা?আমাদেরও জাঁকজমকপূর্ণ কিছু করতে দেও।’

রেহানা বেগম ভরকে যায় আফসানা রহমানের এমন কথায়। তোতলিয়ে বলে
-‘কি বলতে চাইছিস আফসু?

আফসানা রহমান তীক্ষ্ণ স্বরে বলল
-‘কি বলতে চাইছি বুজছো না?আমার মেয়েকে বাড়ি বয়ে এসে মেরে যাওয়ার বিচার চাইছি আমি।আর তোমাদের বিচার অবশ্যই হবে।রেডি হও জেলের ঘানি টানার জন্য। অকারণে পরিবার শুদ্ধ এসে আমার মেয়েকে মারধর করে যাওয়ার শাস্তি আমি আইনী ভাবে দিবো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here