বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ পঞ্চদশ

0
2997

বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ পঞ্চদশ
মম_সাহা

বিকেলের আজানের ধ্বনিতে মুখরিত চারপাশ।সূর্য অস্তায়মান। নীলা তার রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।তার পরিবারের মানুষজন সাথে বর্ণের পরিবারের সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে। বর্ণের বাবাও আজ ফিরেছে।এতদিন শহরের বাহিরে ছিলো।

সবাই নিরুপমা আর রাহাতের বিয়ে নিয়ে কথা বলছে।খুব সম্ভবত শীঘ্রই বিয়েটা ধরা হবে।নীলার এসব শুনতে ভালো লাগছিলো না।প্রথমত রাহাত তার প্রথম ভালোবাসা ছিলো,দ্বিতীয়ত রাহাত তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছে আর সব থেকে বড় কথা রাহাত চরিত্রহীন।আর এমন একটা ছেলের সাথে তারই আপন বোনের বিয়ে হচ্ছে আর সেটাও তাকে মানতে হবে।কারণ তার হাত পা বাধাঁ।বিয়েতে কোনো প্রকার বাধাঁ দিলেই সব শেষ হয়ে যাবে।কিন্তু এমন একটা ছেলের সাথে বিয়ে হলে তার বোনের জীবনও শেষ হয়ে যাবে।এতটা চাপ নিতে পারছে না নীলা। তার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে।

হঠাৎ পিছন থেকে বলে উঠলো কেউ
-‘মিস.নীলা এত ছোট মাথায় এত প্রেসার নেওয়া তো উচিত না।যা হচ্ছে হতে দেওয়াই হলো উচিত কাজ।’

চেনা কন্ঠে ফিরে তাকাল নীলা।পিছে ফিরে রাহাতকে দেখে রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়।

রাহাতের জেনো ভালো লাগে নি নীলার আচরণ।সে নীলার কাছে এসে বেশ উচ্চস্বরে বলল
–‘বাহ্ আজকাল ভালোই পাখা গজিয়েছে তোর।আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিস? আগে তো আমার পিছেই পরে থাকতি রাস্তার মেয়েদের মতন।’

নীলা জেনো রাগে গাঁ কেঁপে উঠছে।শক্ত চোখে তাকায় রাহাতের দিকে।তাচ্ছিল্য হেসে বলে
-‘চকচক করলেই সোনা হয় না কথা টা শুনেছেন কখনো? আমি শুনেছি আর উদাহরণস্বরূপ আপনাকে দেখেছি।তা ছুটেছি কেনো বুজেছেন নিশ্চয়ই? আসলে আমি হীরা ভেবে কাঁচকে ছুঁয়ে হাত কেটেছি।’

রাহাতের শরীরে জেনো কেউ আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। অপমানে শরীর রি রি করছে।সে হাত দিয়ে শক্ত করে নীলার দু গাল চেপে ধরলো।তারপর দাঁত কিরকির করে বলল
-‘বেশ কথা ফুটেছে না?কার আশকারায় এত কথা বলছিস?তোর বাপের আশকারাতে তাই না?তুই কি চাস ভিডিও টা নেটে ভাইরাল হোক?আর তোর শক্ত সামর্থ্য বাপ ভেঙে পরুক? যদি তোর বাবার কিছু হয়ে যায় তাহলে ক্ষমা করতে পারবি তো নিজেকে?’

কমে আসে নীলাম্বরীর তেজ।নিভে আসে তার প্রতিবাদী মনোভাব। ভেঙে যায় তার কঠোরতা।হাঁটু ভেঙে বসে পড়ে রাহাতের সামনে।তার দুনিয়া বাঁচাতে নাহয় এই নিকৃষ্ট মানবের কাছে নিচু হলো তাতেও যদি তার বাবার পাহাড়ের সমান উচু ব্যাক্তিত্ব উঁচু থাকে।তার বোন সসম্মানে বেঁচে থাকে।

নীলাকে এতদিন পর আবার ভেঙে দিতে পেরে শান্তি লাগছে রাহাতের।পৈচাশিক হাসি হেসে বলল
-‘কিরে শেষ তেজ?হাওয়া ফুঁস হয়ে গেলো?নিজের যোগ্যতা টা কোথায় বুঝতে পারছিস তো?আমার পায়ের নিচে তোর পরিচয়। সেখানেই থাকার চেষ্টা কর।বেশি বাড় বাড়িস না।’

নীলা মাথা নিচু করে রাখলো।রাহাত শিস দিতে দিতে বের হয়ে গেলো। দু’হাতে মুখ ঢেকেঁ কেঁদে দেয় নীলা। তার বোনের সম্মান বাবার সম্মান সব বাঁচাতে এসব তাহলে মেনে নিতেই হবে।

চারদিকে সন্ধ্যা নেমেছে।নীলা ঠাঁই বারান্দায় বসে আছে। আধাঁর নেমেছে চারপাশে সাথে নীলার মন আকাশেও।নীলা উঠে দাঁড়ালো।গোসল করতে হবে।এভাবে বসে থাকলে চলবে না তাকে কিছু করতে হবে।

একটা সাদা রঙের গোল ফ্রক নিয়ে স্নানাগারে চলে গেলো।বেশ খানিকটা সময় নিয়ে আজ গোসল সেড়ে বের হলো।লম্বা লম্বা চুল গুলো বেয়ে পানি ঝড়ছে।

নীলা আকাশী রঙের উড়না টা মাথায় জড়িয়ে নামাজে বসে যায়। এই একটা উপায় আছে তার সব সমস্যার সমাধান হিসেবে।

বর্ণ নীলার মাথার ক্ষতের অবস্থা দেখার জন্য নীলার রুমে এসেছিলো। কিন্তু দরজা অব্দি এসে থেমে যায়। বিবর্ণ নীলাম্বরীর এ কি শুভ্র রূপ! প্রেমিক পুরুষের হার্টবিট মিস করে।শ্বাস নেওয়াটা দুষ্কর হয়ে যায়। মেয়েলী শ্যাম্পু আর সাবানের একটা গন্ধে মিলেমিশে একাকার হয়ে আলাদা একটা জগৎ সৃষ্টি করেছে।বর্ণ শুষে নিচ্ছে সব টুকু ঘ্রাণ।

নীলা নামাজ শেষে উঠে দাঁড়ানোর সময় চোখ গেলো দরজার দিকে।বর্ণ চোখ বন্ধ করে আছে দেখে ভ্রু কুঁচকে উঠে রমনীর।নীলা ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে শব্দ করে চিরুনি নেয়।তারপর চুল আঁচড়ানো শুরু করে।

হালকা শব্দে ধ্যান ভাঙে বর্ণের।নিজের কাজেই লজ্জা পায় বর্ণ।তারপর গলা পরিষ্কার করে নীলার উদ্দেশ্যে বলে
-‘আসবো?’

নীলা গম্ভীর কন্ঠে বলল
-‘আসুন।’

বর্ণ রুমের ভিতর এসে দাঁড়ায়। কীভাবে কথা শুরু করবে কথা ভেবে পাচ্ছে না সে।বেশ খানিকক্ষণ সময় নেওয়ার পর নরম স্বরে বর্ণ বলল
-‘আমাকে ক্ষমা করবেন নীলাম্বরী। গতকাল আপনাকে না নিয়েই ভুল বুঝে চলে এসে ছিলাম।’

রমনী তাকায় না মানুষটার দিকে। নিজের মতন করে চুল আঁচড়িয়ে যায়। বর্ণ ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল
-‘সরি।আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আর আমার তখনের ঐ রাগান্বিত আচরণ টাও ভিত্তিহীন। আসলে আপনি তখন ঐ লম্পট টাকে কাজিন বলে পরিচয় দেওয়ায় রাগটা আরও বেড়ে গিয়েছিল।’

নীলা আয়নার মাঝে বর্ণের প্রতিবিম্বের দিকে তাকায়। তারপর কন্ঠে আগের ন্যায় গম্ভীর ভাব বজায় রেখে বলল
-‘এটা বলতেই এসেছেন?’

বর্ণ মাথা তুলে তাকায় রমনীর পানে।তারপর মাথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বলে
-‘না আপনার কপাল এখন কী অবস্থা দেখতে আসছি।’

-‘ওহ্,আমার কপাল ঠিকই আছে এখন।’

বর্ণ দ্বিমত পোষণ করলো নীলার কথায়। এগিয়ে এসে বলল
-‘আপনি পুরো ব্যান্ডেজ টা ভিজিয়ে ফেলেছেন।সেটা পাল্টাতে হবে।নাহয় কপালের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।’

নীলা কতক্ষণ তাচ্ছিল্য হাসি হেসে বলে
-‘তাহলে বোধহয় আমার ভাগ্যে ভিজা ব্যান্ডেজ মোড়ানো আছে তাই ভাগ্য খারাপ যাচ্ছে তাই না!’

নীলার কথার আগামাথা বুঝে না বর্ণ।কেবল ড্যাব ড্যাব তাকিয়ে থাকে।নীলা কথা ঘুরাতে বলে
-‘আচ্ছা তাহলে দেন ব্যান্ডেজ টা পাল্টিয়ে।’

বর্ণ নীলাকে খাটে বসতে বলে। তারপর সযত্নে ক্ষতটা পরিষ্কার করে নতুন ব্যান্ডেজ করে দেয়। তারপর বর্ণ উঠে দাঁড়িয়ে বলে
-‘কপালের ভিজে ব্যান্ডেজ খুলে যেহেতু খারাপ হওয়া থেকে বাঁচাতে পেরেছি একবার নাহয় ভাগ্যের টারও দ্বায়িত্ব নিবো।’

নীলা এবার ড্যাবড্যাব করে তাকায়। বর্ণ মুচকি হেসে চলে যেতে নিয়েও দরজা অব্দি গিয়ে দাঁড়ায় তারপর নীলার দিকে ফিরে বলে
-‘শুনেন।’

নীলা প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকায়। জিজ্ঞেসিত স্বরে বলে
-‘বলেন।’

বর্ণ মুচকি হেসে বলে
-‘শুভ্র আর আকাশি রঙে আপনাকে আমার ঠিক আকাশ আকাশ লাগে।’

নীলা বর্ণের এরূপ কথায় অবাক হয়।অন্য কেউ বললে হয়তো বিরক্ত হতো কিন্তু বর্ণের কথায় বিরক্তবোধ হচ্ছে না দেখে নিজের আচরণে অবাক হয় নীলা।তার থেকে বেশি অবাক হয় ঐ কথায় সে মুগ্ধ হয়েছে ভেবে।

বর্ণ মুচকি হাসি দিয়ে আবারও বলে
-‘শুনেন।’

নীলা অবাক কন্ঠে বলে
-‘আবার কি! বলেন।’

বর্ণ হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে
-‘আমার আকাশ বেশ পছন্দ।আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় সব দুঃখের সমাপ্তি জেনো এইখানে।আপনি আমার আকাশ হবেন?বর্ণের বিবর্ণ আকাশ?’

নীলার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সব।বিষ্ময় স্বরে বলে
-‘কি বলছেন এসব!’

বর্ণ এবার যেতে যেতে বলে
-‘যখন বুঝার হবে তখন আমি না বললেও বুঝবেন।এখন আপাতত ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আপনার চুল গুলো বেধেঁ বের হবেন।কারণ আমার আকাশ আমার সম্পত্তি। তার সবটাই আমার কাছে বিশেষ। বিশেষ জিনিস বিশেষ মানুষকে দেখাতে হয় সবাইকে না।’

নীলা বর্ণের যাওয়ার পানে তাকিয়ে আনমনেই চুলটা বেধেঁ ফেলে।তার এই কাজের ব্যাখা সেও জানেনা।তবে এতটুকু জানে সে কারো আকাশ।নীলাম্বরীরা পায়ের নিচে না আকাশ হওয়ার যোগ্যতা রাখে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here