চৈতালি_পূর্ণিমা,পর্ব-২৭

0
5265

চৈতালি_পূর্ণিমা,পর্ব-২৭
Writer_Asfiya_Islam_Jannat

করিডরের সামনে এসে কানের নিচ থেকে ফোন রেখে সামনে এগুতেই খুব জোরে কারো সাথে ধাক্কা খেল স্পৃহা। ধাক্কা জোরে খাওয়ায় মুহুর্তেই নিজের ভারসাম্য হারিয়ে মাটিতে বসে পড়লো সে। হাতের মুঠোয় পুরে থাকা ফোনটি ছিঁটকে পড়লো কয়েক হাত দূরেই। নাকের ডগায় ঝুলতে থাকা চশমা হলো অনড়। স্পৃহা চোখ পিটপিট করে কিঞ্চিৎ মুহূর্ত ব্যয় করলো ঘটনাটা বুঝে উঠার জন্য। অতঃপর বুঝতে পেরে ঝটপট মাথা তুললো৷ সামনে সুঠাম, চওরা বুকের অধিকারী এক শ্যাম মানবকে দেখামাত্র তার ভ্রু কুঁচকে এলো। চশমাটা হাতের তর্জনী দিয়ে পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে গলা খাঁকাড়ি মেরে বলল,

“দেখে চলাফেরা করতে পারেন না নাহিদ ভাই? এত তাড়া কিসের আপনার? পড়ে গেলাম তো আমি।”

স্পৃহার ঝাঁঝালো কণ্ঠ শুনে নাহিদের কপালের মধ্যভাগে সুক্ষ্ম তিনটি ভাঁজ পড়লো। রসিকতার সুরে বলল, “ইন্দুর সমান মানুষ হলে, তাকে কি আর চোখে দেখা যায়? আমার সামনের রাস্তা তো ফাঁকাই দেখেছিলাম।”

নাহিদের ঠাটারি শুনে স্পৃহার বিরক্তিতে চোখ-মুখ ঘুচে এলো৷ সেই সাথে রাগে চোখ অগ্নিশিখার ন্যায় ঝলঝল করে উঠলো। সে একটু খাটো সে জানে, হয়তো নাহিদের তুলনায় একটু বেশি। কিন্তু তাই বলে সে ইন্দুর নয় বা এমন ছোটও নয় যে তাকে চোখেই পড়বে না। সে সাথে, তাকেই পরোক্ষভাবে দোষারোপ করা হচ্ছে। স্পৃহা ফোঁস ফোঁস করে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো, ক্ষণেই কোমরের দিকে সুক্ষ্ম এক ব্যথা আঁচ করতে পেরে মৃদু কন্ঠে আর্তনাদ করে পুনরায় বসে পড়ে সে৷ চোখ দু’টি খিঁচে বন্ধ করে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করলো। অতঃপর চোখ খুলে পুনরায় উঠার চেষ্টা করার পূর্বেই সামনে থেকে একটি হাত কেউ এগিয়ে দিল, “হাতটা ধরে উঠো।”

স্পৃহা একপলক নাহিদের মুখপানে তাকিয়ে, হাতের দিকে তাকায়। খানিকটা ইতস্তত করলো সে, “লাগবে না। উঠতে পারবো আমি।”

নাহিদ এইবার রাশভারি কন্ঠে বলে উঠলো, “হাত ধরতে বলেছি তোমায়। ধরো!”

স্পৃহা অসন্তোষ নয়নে তাকালো তবে কথা বাড়ালো না, নাহিদের হাত ধরেই উঠে দাঁড়ালো৷ ইফতারের পরবর্তী সময় হওয়ায় মানুষজনের আনাগোনা তেমন একটা নেই৷ যার দরুন, মান-সম্মান একটু হলেও রক্ষিত আছে স্পৃহার। উঠে দাঁড়ানোর পর কোমরে চিনচিন ব্যথা অনুভব করলো সে। বেশি জোরে না পড়ায় ব্যথাটা সহ্যনীয়, তবে পরে পেইনকিলার না খেলে উপায় হবে না। স্পৃহার মুখের অদ্ভুত আর উদ্ভট অভিব্যক্তি দেখেই নাহিদ বলে উঠলো, “বেশি লেগেছে বেয়াইন সাহেব? মালিশ করে দিব?”

স্পৃহা কটমট দৃষ্টিতে তাকালো, “ফাজলামো পেয়েছেন? একে তো আপনার জন্য পড়লাম আমি, তার উপর সরি পর্যন্ত বললেন না আপনি।”

নাহিদের গা ছাড়া ভাব, “সারাদিন বান্দরের মত লাফালাফি করলে এমনটাই হবে। বিয়েতেও তো স্থির ছিলে না এক জায়গায়, সারাক্ষণ টো টো করছিলে এদিক সেদিক।”

প্রথমে ইন্দুর আর এখন বান্দর সম্মোধন শুনে স্পৃহা প্রচণ্ড ক্ষেপে উঠলো৷ রোষানল দৃষ্টিতে নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি যাই করি না কেন আপনার সমস্যা কি?”

নাহিদ রসিকতার সুরে বলে, “সমস্যা যে আছে। আপনি হচ্ছেন আমার একটা মাত্র বেয়াইন, আপনার কিছু হলে এই বেয়াই মানুষটার-ই তো সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে। নিঃসঙ্গ হয়ে যাবে সে।”

স্পৃহা চোখ ছোট করে বলে, “ফ্লার্ট করছেন আমার সাথে?”

নাহিদ ঠোঁটের কোণে চমৎকার এক হাসির রেখা টেনে বলে, “তোমার তাই মনে হলে, তাই-ই। হ্যাঁ, করছি আমি ফ্লার্ট।”

স্পৃহা ফুঁসে উঠলো, কড়া কন্ঠে দুইটি বাণী বলার প্রস্তুতি নিতে যাবে তার পূর্বেই নিজের ফোনের দিকে দৃষ্টি গেল তার। ফোনের স্ক্রিনে আড়াআড়িভাবে লম্বাটে একটি দাগ পড়ে আছে। ফোনটির করুণ অবস্থা দেখা মাত্র দ্রুত সে-টি তুলে নেওয়ার জন্য উদ্যোগী হলো। ফোনটা হাতে নেওয়া মাত্র উৎকন্ঠা সে বলে উঠে,

“ডেম ইট! এখনই নষ্ট হতে হলো ফোনটা।”

নাহিদ সচকিত দৃষ্টিতে একবার তাকালো স্পৃহার দিকে। ভাবলো, এখনই স্পৃহা হয়তো রাগে ফেটে পড়বে। কিন্তু না তার ধারণা ভুল করে দিয়ে স্পৃহা একবারে শান্ত হয়ে গেল, টু শব্দ পর্যন্ত করলো না আর। নিঃশব্দে কিছুক্ষণ মুঠোফোনের ভাঙা ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে থাকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। অতঃপর কোন দ্বিরুক্তি না করে চুপচাপ পাশ কাটিয়ে চলে গেল সে। নাহিদ অনিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো স্পৃহার চলে যাওয়ার পানে।
স্পৃহা সাহেলার সাথে এসেছিল স্পর্শী আর নির্বাণের জন্য খাবার নিয়ে। কথা ছিল একসাথেই ইফতার করবে তারা। নাহিদ আসরের পর থেকেই হসপিটালে হওয়ায় দেখা হয়ে যায় তাদের। অতঃপর স্পৃহার ফোন আসায় সে বাহিরে চলে যায়, ঠিক তখন নাহিদও তার ব্যক্তিগত কাজে বের হয়। আর করিডরে আসতেই সেই ঘটনাটা ঘটে যায়।

কিয়ৎক্ষণ পর, নিজের কার্য শেষে নাহিদ স্পর্শীর কেবিনে আসলে জানতে পারে স্পৃহা সন্ধ্যার ঘটনার পর পরই চলে গিয়েছে। স্পৃহা চলে গিয়েছে শুনে নাহিদের মন আপনা-আপনি ক্ষুণ্ণ হয়ে গেল। অনুশোচনাবোধ হলো নিজের মাঝে। খেয়াল হলো, দোষটা বোধহয় ওরই ছিল।

_____________

স্পর্শীকে ডিসচার্জ দেওয়া হয়েছে কিয়ৎ প্রহর পূর্বেই। ডাক্তার আপাতত বাসায় কয়েকদিন বেডরেস্টে থাকতে বলেছেন। স্পর্শীর খেয়াল রাখতে নির্বাণ লাজশরম ভুলে নিলুফাকে বলে ওদের বাসায় চলে আসে। কিছুদিন স্পর্শীর সাথে থাকবে বলে। স্পর্শী প্রথমদিকে এই বিষয় নিয়ে প্রচন্ড লজ্জা পেলেও পরবর্তীতে ঠিক হয়ে যায়।
রাতে সাহেলা স্পর্শীকে খায়িয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার পর নির্বাণ রুমে আসে। ঔষধের বক্স হতে রাতের ঔষধগুলো বের করে স্পর্শীকে দেয় খাওয়ার জন্য। ঔষধের বক্স পুনরায় নিজ স্থানে রাখার উদ্দেশ্যে নির্বাণ সেদিকে যাওয়া মাত্রই পার্শিয়া মৃদু শব্দ করে রুমে প্রবেশ করলো। ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে এলো স্পর্শীর দিকে। কাছে আসতেই খুব আদুরে ভঙ্গিতে স্পর্শীকে ডাকতে শুরু করল৷ স্পষ্ট কোলে উঠার আহ্বান তার। স্পর্শী স্মিত হাসলো, হালকা ঝুঁকে হাত নিম্নে নিয়ে পার্শিয়ার মাথায় হাত বুলালো। বেশি ঝুঁকলো না পেটের সিলিতে টান পড়বে বলে। স্পর্শী পার্শিয়ার উদ্দেশ্যে কিছু বলার পূর্বেই নির্বাণ বলে উঠে,

“ওকে রুম থেকে বের কর।”

স্পর্শী চোখ তুলে তাকায়, “ওর থেকে আপনার এত কি সমস্যা শুনি? কি করেছে ও?”

“ডাস্ট এলার্জির সমস্যা আছে আমার, বিড়ালের সংস্পর্শ সয় না আমার। আর এমনেও বিড়াল আমার পছন্দ না। বের কর ওকে।”

স্পর্শী নাক ফুলিয়ে কিছু বলার পূর্বেই পার্শিয়া উচ্চস্বরে ‘মিয়াও!মিয়াও!” করে চিল্লিয়ে উঠল। ক্ষণেই চমকে উঠল দু’জনেই৷ পার্শিয়া গা ঝামটা মেরে পিছন দিক দেখিয়ে রুম থেকে চলে গেল৷ পার্শিয়ার এহেন কর্মে নির্বাণ হতবিহ্বল নয়নে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে, “এমন করলো কেন?”

স্পর্শী কিছু হেসে উঠে বলে, “বেচারা রাগ করেছে আপনার উপর। তাই এমন করল।”

“তাই এমন? অদ্ভুত!”

“একটা কথা বলে রাখি, আমাকে আপন করার আগে কিন্তু আপনাকে পার্শিয়াকে আপন করে নিতে হবে। না-হলে কিন্তু বউ পাবেন না।”

নির্বাণ ঠোঁট দু’টি গোল করে চিন্তামগ্ন হওয়ার অভিনয় করে বলে, “কিন্তু… বউকে যে আমি অনেক আগেই আপন করে নিয়েছে, এখন কি হবে? আমি কি বিবাহিত ব্যাচেলর বলে গণ্য হব তখন?”

নির্বাণের কথার অর্থ বুঝতে পেরে স্পর্শীর শ্যামবর্ণ গালে রক্তজবার গাঢ় রঙ আলতোভাবে মেখে গেল। অস্ফুটস্বরে বলে, “আপনি চরম অসভ্য।”

নির্বাণ দরজায় খিল দিতে স্পর্শীর দিকে এগিয়ে এসে বলে, “হ্যাঁ শুধু তোমারই জন্য।”

স্পর্শী প্রত্যুত্তর করলো না। নির্বাণ স্পর্শীর কাছে এসে ওর হাত টেনে ধরলো, হাতের মধ্যখানে হ্যান্ড-স্যানিটাইজার ঢেলে দিয়ে বলল, “হাত ভালো মত রাব করে নাও। পার্শিয়াকে ধরেছ তুমি।”

কথাটা শোনামাত্র স্পর্শী অসন্তোষ নয়নে তাকায়, তবে কিছু বলে না। কারণ সে জানে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিয়ে নির্বাণের মাথাব্যথা সীমাহীন। তাকে বলেও কাজ হবে না। তাই সে, নিভৃতেই নির্বাণের কথা মেনে নিল৷ নির্বাণ স্মিত হেসে রুমের বাতি বন্ধ করে নীলাভ আলোটি জ্বালিয়ে দিল। সন্তপর্ণে স্পর্শীর নিকটে এসে শুয়ে ওকে আলগাভাবে জড়িয়ে ধরলো। তৎক্ষনাৎ স্পর্শীর অধরের শেষপ্রান্তে উপস্থিত হলো একরাশ হাসি। কিয়ৎক্ষণ নিভৃতে কেটে যেতেই নির্বাণ মিহি কন্ঠে বলে উঠে, “রাতে কোনপ্রকার সমস্যা হলে আমাকে জাগিয়ে বলবে। নিজে নিজে মাতব্বরি করবে না, অন্যথায় আমার সাবজেক্টে তোমার নাম্বার কাটতে কোন কৃপণতা করবো না আমি।”

কথাটা শোনামাত্র স্পর্শীর অধরের কোণে লেপ্টে থাকা হাসিটুকু উবে যায়। সে অভিযোগের সুরে বলে, “এটার সাথে নাম্বারের কি সম্পর্ক? বর বলে আপনি এমন দূর্নীতি করতে পারেন না, এইটা অন্যায়। তার উপর বউকে থ্রেট তো গুরুতর অন্যায়।”

“তোমার মত ত্যাড়া মানুষকে সোজা করতে মাঝে মধ্যে দূর্নীতিবাজ হওয়াই যায়। আর এমন থ্রেট না দিলে বউ জীবনেও কথা শুনবে না।”

স্পর্শী বিরবির করে বলল, “স্যারকে বিয়ে করার এমন সাইড ইফেক্টস থাকবে জানলে আমি জীবনে এই বিয়ে করতেই রাজী হতাম না।”

নির্বাণের কর্ণকুহরে কথাটা গিয়ে পৌঁছাতেই নির্বাণ বলে উঠে, “রাজী যেহেতু হয়েছ সেহেতু ভোগান্তি তো ভুগতেই হবে। ইউ হ্যাভ নো আদার চয়েস।”

“হুহ!” স্পর্শী অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। নির্বাণ তা দেখে ধীর গতিতে নিজের মুখটা স্পর্শীর গ্রীবাদেশে নিয়ে আলতোভাবে অধর ছুঁয়ে দিয়ে বলে, “সাইড ইফেক্ট নিয়ে চিন্তা না করে সুস্থ হও আগে। এরপর বেনিফিটও দেখতে পাবে।”

“বেনিফিট কি কি একটু শুনি।”

নির্বাণ স্পর্শীর কান বরাবর মুখ স্থির করে মিহিস্বরে বলে, “তোমাকে মা ডাক শুনাবো।”

পরক্ষণেই স্পর্শীর কান গরম হয়ে আসতেই স্পর্শী বলে, “লাগবে না আমার কোন বেনিফিট। ঘুমান তো আপনি।”

নির্বাণ আরও কিছু বলতে চাইলো তবে সময় কাঁটা টুকটুক করে একের পর এক ঘর পেরিয়ে যেতে নির্বাণ কথা এগুতে চাইলো না। তাই ছোট করে বলল, “আচ্ছা ঘুমোও। রাত হয়েছে অনেক।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here