তেজস্ক্রিয়_রক্তধ্বনি,পর্ব_৯
লেখিকা_রিয়া_খান
-বস দেহেন অই যে রিংগের ভিত্তর দিয়া ফু দিলে ফটকা বাইর হয় অই গুলা কিন্না দেন না।
একটা ছোটো চার বছরের পিচ্চি মিশানের কাছে আবদার করে বসে।, ওর সাথে বাকিরাও ছিলো। প্রায় আট দশজনের গ্যাং ওদের।যারা পথশিশু বা টোকাই নামে পরিচিত।
-লাল্লু।
-ইয়েছছ বস?
-এই পঁঞ্চাশ টাকা টা নে, রোডের অই পাশে যাবি অই যে হলুদ সাইনবোর্ড ওয়ালা দোকান টা অইখান থেকে ২০ টাকার গুনা কিনবি,আর এক ডজন সানসিল্ক শ্যাম্পু।বাকি টাকা ফেরত দিবি আমাকে।
-ওক্কে যাইতাছি বসসস্ ।
লাল্লু মিশানের কথা মতো টাকা নিয়ে গেলো।
মিশান এই পথশিশুদের সাথে রোজ সময় কাটায়,ওর ডিপ্রেশন কমানোর এটাই বেস্ট ওষুধ। বাচ্চাগুলোও মিশানের হেবভি ভক্ত।মিশানকে সব সময় বস বলে ডাকে, কারণ মিশানের কাছে হাত পাতলেই টাকা পায়, মিশান ওদের সব সময় প্রোটেক্ট করার চেষ্টা করে, ওদের সাথে খেলাধুলা করে, দুষ্টুমি করে,আবার সবাইকে ভয় দেখিয়ে চোখ রাঙিয়েও রাখে।
লাল্লু এসে বাকি টাকা ফেরত দিতেই মিশান টাকা রেখে দিলো।গুনা দিয়ে রিং বানিয়ে সবার হাতে হাতে দিলো আর একটা করে শ্যাম্পুর প্যাকেট।
-এইবার দেখ অই ব্যাটার থেকে তোদের গুলা বেশি বড় হবে।
বাচ্চাদের সাথে শ্যাম্পু দিয়ে বেলুনের মতো বানিয়ে উড়াচ্ছে এমন সময় রাস্তা দিয়ে তীব্র যাচ্ছিলো। ফুটপাতে মিশানকে দেখে গাড়ির ড্রাইভারকে গাড়ির বেগ কমাতে বলে, উইন্ডো দিয়ে হাল্কা মাথা বের করে মিশানকে ডাক দিলো জোরে।
-অই সেন্টি!
মিশান ঘুরে তাকালো।
-আমার গাড়ির পেছন বরাবর তোর মামার গাড়ি দেখলাম।
কথা শুনেই মিশানের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। কোন দিক ছেড়ে কোন দিকে ছুটবে দিশে পাচ্ছে না।
তীব্র তো কথাটা বলেই চলে গেছে।
-স্যার আপনার সাথে মেয়েটার কি পূর্ব শত্রুতা আছে?
-কেনো?
-এই যে সব সময় ওকে দৌড়ের উপর রাখেন।মাঝে মাঝে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়াও করেন গিয়ে। কখনো আপনাকে কোনো মেয়ের সাথে অফিসিয়াল কথাবার্তা ছাড়া আর কিছু বলতে দেখি না ।কিন্তু একমাত্র এই মেয়ের সাথেই আপনি সব সময় আন অফিসিয়ালি কথা বলেন ঝগড়া করেন,ওকে রাগান, ভয় দেখান।
-মানুষ মজা পাগলের সাথেই নেবে তাই না? সুস্থ মানুষের সাথে তো আর এরকম করা যাবে না। তাঁর উপর এই টাইপের মানুষকে দৌড় পারাতে আমি অনেক আনন্দ পাই।
জীবনে পৈশাচিক আনন্দেরও প্রয়োজন আছে।
-ও কি আসলেই পাগল?
-কি জানি, চাল চলনে তাই ই মনে হয় আমার। মাথার স্ক্রু ঢিলা আছে এটা শিউর।
-কিভাবে চেনেন ওকে?
-এইযে তুমি যেভাবে চেনো, আমিও সেভাবেই চিনি।যদিও তুমি এসেছো তিনমাস, তবুও নতুন ই ধরা যায় তোমাকে , তাই জানো না তেমন একটা ওর ব্যাপারে। আর কয়টা দিন থাকলেই জানবে।
ড্রাইভার আব্দুর রহমান হাসতে হাসতে বললো।
-আমিও স্যারের সাথে একমত।স্যাররে নিয়া চলা ফেরা করার পথে এই মেয়ের সাথে এতো বার দেখা হইছে যে মনে হয় এই মেয়েটারে সেই জন্মের পর থেকেই চিনি।
রিফাত কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-কতটুকু চেনো তাও?
-মেয়েটা সেনাবাহিনী ছিলো আগে।এখন চাকরি ছাইড়া দিছে, মাথার সমস্যার কারণে। মেয়ের মামা কর্নেল। বাবা মা নাই মনয়,মামার বাড়িই বড় হইছে। পাগলের মতো রাস্তা দিয়া ঘুরাফেরা।রাতে মদ খাওয়া এইসব ই তাঁর জীবন।
তীব্র তুচ্ছ হাসি দিয়ে বললো,
-মোড়াল অফ দ্যা স্টোরি কি বুঝলে রিফাত?
-কি স্যার?
-সরকারি চাকরী সবার জন্য না।
ম্যাক্সিমাম মানুষ চাকরী শেষে পাগল হয়, আর কিছু মানুষ অকালে ঝরে যাওয়া পাতার মতো মাঝ পথেই নেতিয়ে পড়ে, নাহয় এরকম উন্মাদ হয়।
বাই এনি চান্স মামা যদি বাড়ি ফিরে এখন, দুপুরে খাবারের ডাইনিং টেবিলে মিশানকে উপস্থিত না দেখলে মহা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
যেহেতু মিশানের এখন কোনো কাজ নেই, তাই অসময়ে বাইরে থাকা নিষেধ । এরকম মাঝ দুপুরে তো বাইরে থাকা ওর জন্য পুরো হারাম।
কিন্তু মিশান কি এসব মেনে চলার মতো পাত্রী! দিনের বেলা মামা যতক্ষণ বাড়িতে মিশানও ততোক্ষণই বাড়িতে। মামাও বের হয়,মিশানও হাওয়া হয়।আর রাতে তো চুপি চুপি টেকনিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পরে মাঝ রাস্তায় কেউ কিচ্ছুটি টের পায় না। তার মধ্যে বাড়িতে দুটো হেল্পার ডিটেক্টিভ আছে দ্বীপ আর তাপসিন, মিশানের উকালতি করার জন্য মামী আছে।মিশানকে বাঁচানোর লোকের অভাব নেই সোজা কথা। যদিও মামী জানে না মিশান রাত বিরাত এভাবে বের হয়,কিন্তু জানলেও তেমন কোনো সমস্যা হবে না, শুধু একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবেন।তবে যদি দেখে মিশান ড্রিঙ্ক করে তাহলে উনি মরা কান্না জুড়ে দেবেন মাঝ রাতেই।
কোনো মতে গাড়িতে উঠে মিশান বাড়ি ফেরার জন্য ছুটে যায়।
বাড়ি ফেরার পর দেখে মামা এখনো আসে নি, ঘন্টার পর ঘণ্টা কেটে যায় মামার খবর নেই।
দুপুর ছেড়ে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো মামা এখনো আসে নি।মিশান বুঝাতে পারলো তীব্র ওকে ডস খাইয়েছে।
মেজাজটা সেই লেভেলের হট হলো।
বাড়ি থেকে আর বের ই হলো না এবেলা।
বাড়িতে থাকা মানেও যন্ত্রণা, মামী সারাদিন খাবারের উপর রাখে কিন্তু মিশান বাইরে হাবিজাবি খেয়ে পেট ফুল করে আসে।তার ওপর ড্রিঙ্ক করলে খাবার দাবারের প্রতি অভক্তি এসে যায়, ও পাকস্থলী চেপে আসে।
ড্রিঙ্ক না করলেও মিশানের চলে না, স্বাভাবিক অবস্থায় ঘুমাতে পারে না, দুঃস্বপ্ন দেখে ভয়ে আঁৎকে উঠে।ড্রিঙ্কস করে তালগোল হারিয়ে সেই লেবেলের ঘুম হয় সেরাতে।
,
-মিশান তোর কোন বান্ধুবী জানি আছে না, মনিরা নাম, ও কল দিয়েছিলো।ওর বিয়ের জন্য নাকি আজ ব্যাচেলর পার্টি রেখেছে। তোকে যেতে বলছে তুই রাজি হচ্ছিস না,সেজন্য আমাকে কল করে বললো তোকে রাজি করাতে।
নিজের ঘর থেকে বনিতা বেগম মিশানের উদ্দেশ্যে বললো কথাটা।
মিশান একটু থ মেরে বসে রইলো।কিছুই বুঝতে পারছে না। পাশে দ্বীপ বসে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছিলো মিশান দ্বীপের কানের কাছে গিয়ে বললো,
-এই মনিরা টা কে আবার?
দ্বীপ মিশানের কানের কাছে গিয়ে বললো।
-তুই ই তো দুপুরে বললি মাকে ম্যানেজ করতে।
-কিন্তু কেনো?
-আমি কি করে বলবো?তুই যা করতে বলেছিস আমি তাই ই করেছি।
মামী এবার ড্রয়িংরুমে এলো,
-কি রে চুপ করে কেনো? কিছু বলছিস না যে?
-কি বলবো?
– মাঝে মাঝে বান্ধুবীদের সাথে সময় কাটাতে কি হয়?মন টা তো একটু হাল্কা হয়।পার্টিতে যাবি না বলেছিস কেনো?এভাবে ঘরকোণে হয়ে থাকিস ভাইদের সাথে থেকে থেকে নিজেও পুরো আস্ত ছেলে হয়ে গেছিস,একটু মেয়ে বান্ধুবীদের সাথেও তো টাইম স্পেন্ড করতে পারিস তাই না?
মিশান খানিকটা বিমুখী ভাব নিয়ে বললো,
-না মিমি , আমার ভালো লাগে না এসব রাত বিরাতের পার্টি ফার্টি।দিনের বেলা হলে ভেবে দেখতাম।
-রাত ই কি আর দিন ই কি।তুই তো আর একা যাচ্ছিস না, আরো অনেকের যাবে। তোর অনেক ফ্রেন্ড ই যাবে। আমি বলছি এতো কিছু না ভেবে ভালোভাবে যা। ভালো না লাগলে আজ রাতে ফিরিস না।
-না মিমি,আমি যাবো না।
-আরে যা না রে মা । মাইন্ড ফ্রেশ হয়ে যাবে, গিয়ে দেখ একটাবার।
-আরে মিশান কেনো মায়ের কথা শুনছিস না?
এতো করে যখন বলছে মা, তাহলে যা না।
-রাত করে বের হবো তাই?
-আরে কিচ্ছু হবে না। চল আমি দিয়ে আসি তোকে।
মিশান উত্তর দেয়ার আগেই ওর ফোন বেজে উঠলো।কল রিসিভ করে কানে নিলো।
-হ্যালো আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম ৯:৩০ এ কল দিতে বলেছিলেন। বের হয়েছেন কি?
মিশান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-কেহ?
-আরে আমি তমাল , আমার নাম্বার টা সেভ করে রাখেন নি?
-ওহ মনিরা? তাই বল।আচ্চা ঠিক আছে আসছি।তোদের জ্বালায় আর পারি না। ফোন রাখ রেডি হয়ে বের হচ্ছি
পার্টিতে এসে কল দিচ্ছি।
তমাল বুঝতে পেরেছে মিশানের পাশে কেউ আছে হয়তো,
-ওকে বাই!
মিশান ফোন রেখে উঠে দাঁড়ালো।
-যাক বাবা তাহলে যাচ্ছিস! দেখে শুনে যাস মা। এক কাজ কর দ্বীপ তুই ওকে দিয়ে আয়।পার্টি শেষে নিয়ে আসিস আবার গিয়ে।
-না মিমি দরকার নেই তার।আমি একাই যেতে পারবো।রেডি হয়ে আসছি আমি।
মিশান নিজের ঘরের দিকে গেলো।
রেডি হয়ে বের হওয়ার আগে দ্বীপের কাছে বাইকের চাবী চাইলো।
-বাইকের চাবীটা দে।
দ্বীপ হেসে দিয়ে বললো,
-ব্রো নতুন পাখি পাইছো নাকি?
মিশান হেসে দিয়ে বললো,
-পুরাই!
দ্বীপ বাইকের চাবি দিয়ে চোখ টিপ দিয়ে বললো বেস্ট অফ লাক, এন্ড বি কেয়ারফুল।
-হুম।
-আর ড্রিঙ্ক বেশি না।কোনো প্রবলেম হলে সাথে সাথে কল দিবি।
-ওকে ওকে ওকে।এখন যাই টাটা বাই।
চাবী হাতে নিয়ে, মামীর থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
বাইক স্টার্ট দিয়ে হাই স্পীডে চালানো শুরু করলো ।
সেই একই স্থানে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তমাল সাথে আরেকজন ছেলে মিশান সামনে এসে বাইক থামালো,
-তোমার সাথে ও কে?
-আরেহ ওকে চিনলেন না?ওর কথায় তো আপনি দুপুরে জিজ্ঞেস করলেন,জোবায়ের।
-ওহ মনে ছিলো না।
-আর জোবায়ের, মিট মাই গার্লফ্রেন্ড মিশান!
কথাটা তমালের মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো।মিশান তমালের দিকে ভ্রুঁ বাঁকিয়ে তাকালো,তমাল ভয় পেয়ে যায় কিছুটা।
আস্তে করে বললো,
-স স সরি!
মিশান স্বাভাবিক স্বরেই বললো,
-চলো যাওয়া যাক।
-কোথায় যাবো?
-ফলো করো আমাকে।
কথা শেষ করেই মিশান বাইক স্টার্ট দিলো, মিশানকে পেছন থেকে ফলো করলো জোবায়ের। তমাল জোবায়েরকে সাথে এনেছে এই কারণেই, রাত করে মিশানের সাথে দেখা করাটা একটু ভয় ভয় লাগছিলো,জোবায়ের সাথে থাকলে তাও একটু সাহস জন্মাবে।
একটা ক্যাসিনোর সামনে বাইক থামিয়ে দাঁড়ালো। তমাল অবাক হয়ে গেলো,ডেটিংয়ের জন্য কোনো রেস্টুরেন্ট পার্ক এসব কোনো কিছু না, ক্যাসিনো!
ওর জানা মতে এখানে ভালো কোনো মানুষ আসে না আর মেয়ে মানুষ তো না ই।
তমাল কিছু বলার আগেই মিশান ইশারায় ওর সাথে ভেতরে যেতে বললো।হাবাতের মতো পিছু পিছু গেলো সাথে জোবায়েরও।
ভেতরে যাওয়ার পর বুঝা যাচ্ছে একটু একটু করে এটা মিশানের পরিচিত জায়গা,হয়তো রেগুলার কাস্টমার।
-ম্যাডাম আমরা এখানে এসেছি কেনো?
-মদ খেতে?
-ম ম মদ মা মানেহ!
আঙুলের ইশারায় মিশানকে মদের বোতল ধরে সামনে দেয়া হলো,
-আপনি মদ খান?
-কেনো তোমরা খাও না?
-ছি ছিহঃ একদম না,আমি সিগারেটও খাই না।
-ওকে শুনো,
-বলুন।
-আমি আজকে মদ বেশি খাবো না, তাই তোমরা আমার সাথে কথা বলতে থাকো, যখন দেখবে তোমাদের প্রশ্নের কোনো উত্তর আমি দিচ্ছি না,তখন আমাকে মদ খেতে দেবে না,আমি খেতে চাইলেও না, যদি পায়েও ধরি তবুও খেতে দেবে না, প্রয়োজনে আমার গলায় ছুরি ধরে এখান থেকে বের করবে আমাকে। মনে থাকবে?
তমাল মিশানের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।
মিশান স্ট্রিক্ট অর্ডার দিয়ে নিজের কাজ শুরু করে দিলো, বসে বসে একের পর এক গ্লাস খেয়েই যাচ্ছে।
তমাল প্রচ্চুর ভয় পাচ্ছে, একটা পর্যায় মিশান খাওয়ার বেগ বাড়িয়ে দিলো, আর কথার কোনো উত্তর দিচ্ছে না, তমাল জোবায়ের দুজনেই পড়ে গেছে মহা বিপদে।মিশানের কথা মতো দুজনেই মিশানকে মদ খাওয়া থেকে বিরত করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না,মিশান কোনো কথায় শুনছে না।
তখন মনে পড়লো মিশানের গলায় ছুরি ধরে ভয় দেখিয়ে এখান থেকে বের করতে।বারের একটা ছেলের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-স্যার একটা চাকু হবে আপনাদের কাছে?
-মিশান ম্যাডামকে ভয় দেখানোর জন্য?
-জি স্যার।
-ভুলেও এই কাজ করবেন না স্যার,হাতের কাছে যে মদের বোতলটা দেখছেন ওটা আপনার মাথায় ভাঙবে।প্রথম প্রথম আমরাও বুঝি নি, মেডামকে থামানোর জন্য যেই ভয় দেখানোর কৌশল অবলম্বনের চেষ্টা করেছে আমাদের লোক ম্যাডাম তাদের মাথার মধ্যে বোতল দিয়ে বাড়ি মেরেছিলো।
তমাল ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে বললো,
-এখন তাহলে কি করবো?এভাবে ফেলে রেখেও তো যাওয়া যাবে না। রোজ কিভাবে যায় এখান থেকে?
-ম্যাডাম তো রোজ আসে না, যখন আসে তখন মদ খেয়ে এখানেই পড়ে থাকে, একজন লোক এসে নিয়ে যায়,আবার মাঝে মাঝে ম্যাডাম ড্রিঙ্কস জুসের প্যাকেট বা ওয়ান টাইম জুস গ্লাসগুলোর ভেতর ভরে বাইরে নিয়ে যায়, হয়তো বাইরে খেয়েই রাস্তায় পড়ে থাকে।
তমাল আর জোবায়ের ভাবছে কি করা যায় এখন।
বলে কয়ে মিশানকে থামানো যাচ্ছে না, উল্টো চোখ রাঙাচ্ছে মিশান।
একটা সময় ওর সামনে থেকে বোতল গ্লাস সরিয়ে টেনেটুনে বাইরে নিয়ে গেলো।
বাইরে বের হতেই কারেন্টের গতিতে মিশান যেনো একটু চেঞ্জ হয়ে গেলো।তমালের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো।
মাতাল স্বরে বললো,
-শুনো আমি একটা লোকেশন দিচ্ছি, তুমি আমার বাইকটা সেখানে রেখে আসো, আমি এখন বাইক চালাতে পারবো না।
-ঠিক আছে আমি বাইক চালাচ্ছি,আপনাকেও দিয়ে আসছি বাড়িতে।
-আমি কি একটা বারও বলেছি এখন বাড়ি যাবো?
-তাহলে?
-বাইক আগে রেখে আসো, তারপর প্ল্যান করছি।
-কিন্তু!
-হুম্মমহহ! কোনো কিন্তু নয়,পুরো কেস খাইয়ে দিবো বললাম,যা বলছি স্ট্রেট তাই করবে।
মিশানের ধমকে ভয়ে ওর কথা মতো বাইক টা নিয়ে যাওয়া শুরু করলো মিশানের দেয়া লোকেশনের দিকে।
মিশান আর জোবায়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলো,
-হেই ইউ!
জোবায়ের মিশানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-আমি?
-হুম,তোমার বাইক স্টার্ট দাও।
-আমাকে কোথায় পাঠাবেন আবার?
-তুমি বাইক চালাবে, আমি পেছনে বসে লোকেশন বলে দিচ্ছি।
-কিন্তু তমাল?
-ওই বোকা গাধারাম ভোগে যাক।
-বাইক থেকে পড়ে যাবেন না তো আবার?
-সেটা আমি বুঝবো।
-ওকে।
জোবায়ের বাইকে উঠে স্টার্ট দিতেই মিশান পেছনে উঠে বসলো।
জোবায়ের গাড়ি চালাচ্ছে,মিশান ঘোরের মাঝে আবোলতাবোল রাস্তার দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে।
অনেক্ষণ ভরে মিশানের ডিরেকশন শুনে
শুনে বাইক চালানোর পর জোবায়ের বুঝতে পারলো ওরা ঢাকার বাইরে এসে গেছে, মাঝরাতে এরকম একটা মেয়েকে নিয়ে তাঁর কথা মতো যাওয়া হচ্ছে, এটা ভেবেই জোবায়েরের ভয় লাগছে, তবুও সাহস করে জিজ্ঞেস করলো,
-আমরা কোথায় যাচ্ছি?
মিশান স্বাভাবিক ও শক্ত কন্ঠস্বরে বললো,
-আমরা না, বলো আমি!
-মা মানেহ!আপনি কোথায় যেতে চাচ্ছেন?
-আমি তোমার কথা বলেছি।
-ম্যা ম্যাডাম কিসব বলছেন!
-তুমি নর্থ সাউথে পড়ো তাই না?
-জি ম্যাডাম।
-তোমার বাবা মা সিরাজগঞ্জ থাকে?
জোবায়ের একটু আৎকে গেলো, মিশান কি করে জানলো এটা!
-তোমার একটা বোন আছে ক্লাস সেভেনে পড়ে, আরেকটা খালাতো বোন আছে যে তোমাদের সাথেই থাকে, তোমার সাথে তার অনেক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।সম্পর্কটা এতো ঘনিষ্ঠ যে বিছানা অব্ধি চলে গেছে।তোমার বোন ক্লাস এইটের একটা ছেলের সাথে প্রেম করে।
ধীরে ধীরে মিশান নানান রকম কথা বলছে জোবায়ের সংক্রান্ত। ওর গায়ে ঘাম ছুটে গেছে ভয়ে। পুরোটাই বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা হচ্ছে,মাথায় আটছে না মিশান জানে কি করে এতো কিছু!
বাইক চালানোর শক্তি আর হচ্ছে না, বাইকটা যেই ব্রেক করে থামাতে যাবে তাঁর আগেই মিশান ওর গলায় ছুরি দিয়ে ফাঁস দেয়।
গলার কণ্ঠনালী, ধমনী সমস্ত শিরা কেটে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়,কুরবানির গরুর রক্ত যেভাবে ছিটকে ঢলে পড়ে ঠিক সেভাবেই পড়ছে জোবায়েরের।
বাইক থেকে হেলে পড়ার আগেই মিশান ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়,আর রাস্তার পাশ গড়িয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে পড়ে গেলো মৃত শরীর টা।
মিশান বাইক স্ট্যান্ড করে দাঁড়িয়ে জোবায়েরের গড়িয়ে পড়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে বলতে লাগলো,
-তোমার আসলে তেমন কোনো অপরাধ নেই।আমার কোনো ক্ষতিও করো নি,তবে তুমি কারো উপকার করেছিলে তাঁর পক্ষ থেকেই তোমার এই প্রতিদান! হ্যাভ এ গুড জার্নি,টা টা।
মিশান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো,বাইকটা এখন কি করবে?এটা চালিয়েই যাবে নাকি এখানেই রেখে যাবে।ডিসিশন নিলো,
– বাইকটা বরং রেখে গেলেই ভালো হবে,প্রথমে এক দল মানুষ সকাল হওয়ার সাথে সাথে বাইক এখানে পড়ে থাকতে দেখবে, অতঃপর পুলিশ জানাজানি হবে তাতে ডেড বডিটা পুলিশদের খুঁজে পেতে সুবিধা হবে। হুম তাই ই করি,কিন্তু আমি এখান থেকে বাড়ি যাবো কি করে?এতো রাতে গাড়ি কি আমার জন্য থামবে?গাড়ি থামলেই বা কি,আমার কাছে গাড়ি ভাড়াই তো নেই,মদের দাম এতো বেড়েছে কদিন পর দেশিটা চালাতে হবে।
রাস্তায় কোনো বিপদে পড়বো না তো!এই বাইকটা চালানোর শক্তিও তো আমার নেই!দ্বীপকে একটা কল করবো?না থাক দ্বীপ অফিসের কাজ করে টায়ার্ড! তাপসিন? না না ও তো ভীতু এতো রাতে ওর পক্ষে সম্ভব না এখানে আসা।কারো বাড়িতেও তো রাখবে না কেউ একরাত।যাই গিয়ে সামনের দিকে দেখি কোনো থানা পাই কিনা, গিয়ে পুলিশের সাথে দুটো বেয়াদবি করলেই আজকের রাতটা জেলেই কাভার,সকালে দ্বীপ এসে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে।
যেই ভাবা সেই কাজ।মিশান সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো চেহারার মাঝে একটা ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে ঢোলতে ঢোলতে হাঁটছে।
কোথায় এসেছে নিজেও জানে না,আশে পাশে তাকিয়েও বুঝতে পারছে না, শুধু এইটুকু বুঝতে পারছে রাস্তার পাশে বুড়িগঙ্গা বইছে,নোংরা পানির একটা আমেজ আসছে।
সেনাবাহিনীতে থেকে মিশানের একটা দিকে খুব ইম্প্রুভ হয়েছে সেটা হলো, মাইলের পর মাইল হাঁটা বা দৌড়িয়ে কখনো হাঁপিয়ে যায় না ।
কি দিন ছিলো,আর এখন কেমন বরবাদ হয়ে গেছে!
ইচ্ছে করছে রাস্তাতেই ঘুমিয়ে যেতে,ঘুম পাচ্ছে প্রচুর পরিমাণ, এখন ঘুম দিলে কোনো দুঃস্বপ্নও জালাতে পারবে না, ফার্স্ট ক্লাস একটা ঘুমের সুযোগ ছিলো,কিন্তু মাথার নিচে বালিশ জাতীয় কিছু না পড়লে ঘুম আসবে না। তার উপর এই এই কংক্রিট -পিচের উপর তো না ই,মশার ইতিহাস তো বাদ ই দিলাম।
অনেক্ষণ হাঁটার পর মোবাইল টা বের করে সুইচ অন করলো,আর সাথে সাথে একটা নাম্বার থেকে কল, মিশান রিসিভ করলো,
-হ্যালো, কে?
-ম্যাডাম আমি তমাল।আপনারা কোথায়?আমি তো সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি কখন থেকে,আপনি জোবায়ের কাউকেই দেখছি না। জোবায়ের তো ফোনটাও রিসিভ করছে না।
-হুমহ আমি আছি,কিন্তু জোবায়ের মরে গেছে।ওকে আমি মেরে ফেলেছি।
তমাল আতংকিত হয়ে গেলো নিমেষেই ।
– মা মা মা মানে!
-বুদ্ধ দেবের এক হাত পেটে আরেক হাত আকাশের দিকে করা, কেনো জানিস?
তমাল ঢোক গিলে উত্তর দিলো,
-না তো।
-হয় কথা পেটে রাখো না হয় আকাশে ছেড়ে দাও।যদি ভুল করেও সত্যিটা তোর মুখ দিয়ে বের হয়।তোর লাইফ মনে কর শেষ,প্রথমে পুলিশ ধরে নেবে,১২ বছরের জেল হবে। তারপর যেদিন তুই বের হবি জেল থেকে, আমি মেরে ফেলবো তোকে।
-না ম্যাডাম এরকম করবেন না প্লিজ!আমি কাউকে কিচ্ছু বলবো না ম্যাডাম।
-হুম গুড বয়।তোকে আমার বাইক টা দিয়ে পাঠিয়েছিলাম তোকে বাঁচানোর জন্য, যেভাবে বাঁচিয়েছি সেভাবে ফাঁসাতেও টাইম লাগবে না।।
-ও ও ও ওকে ম্যাডাম, তাই হবে।আমি কাউকে কিছু বলবো না।কিন্তু যদি পুলিশ এসে জিজ্ঞাসাবাদ করে তখন কি বলবো?
-দিনের বেলা দেখা হলে বলে দিবো, কি করতে হবে।
এখন ফোন রাখ ব্যাটা।
ফোন টা পকেটে রেখে এলোপাথাড়ি সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো, আর মিশানের হাঁটা মানেই মাঝ রাস্তা দিয়ে হাঁটা।
এদিকে শেষ রাতে তীব্র একা একা ড্রাইভ করছে,কোথাও যাচ্ছে নাকি কোথাও থেকে আসছে তা বুঝা যাচ্ছে না। এতো রাতে লং ড্রাইভে বেরিয়েছে নাকি কোনো অভিজানে সেটা একমাত্র তীব্রই ভালো জানে।
অভাগী মিশান হাঁটতে হাঁটতে একটা সময়
তীব্রর গাড়ির সামনে পড়লো, মিশানকে দেখেই তীব্রর মেজাজ চটে গেলো ।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে মিশানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েই বুঝলো মিশান নেশা করেছে।
বেশি প্রশ্ন না করে একটা কথায় জিজ্ঞেস করলো,
– তোমার লাইসেন্স টা যেনো কোথায়?
-কেনো স্যার?
মিশান এখন তীব্রর সাথে প্রচুর তাতলামো করবে, কিন্তু মিশানের তাতলামো সহ্য করার সময় বা ধৈর্য্য কোনোটাই নেই।
তীব্র মিশানের উপর থেকে নিচ অব্ধি তাকালো,একটা টপস আর প্যান্ট পড়া, সোজা মিশানের প্যান্টের পকেটে হাত দিতে যাবে তার আগেই মিশান পকেট থেকে আপসে কাগজ বের করে সামনে ধরে,তীব্র ওটা হাত থেকে নিয়েই সুন্দর করে ছিঁড়ে ফেলে।
মিশান চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো,
-এই এই এই কি করলেন স্যার এটা।
-প্রমাণ করো, তোমার ড্রিঙ্কস করাটা লিগ্যাল।
-স্যার কাজটা কিন্তু ঠিক করলেন না, এর ফল আমি দিনের বেলা দিয়ে যাবো স্যার।
তীব্র তুচ্ছ হাসি দিয়ে বললো,
-হুমহ, প্রথমত ফলাফল দেয়ার জন্য তোমার এই স্ক্রিনটুকু মনে রাখতে হবে, দ্বিতীয়ত মনে থাকলেও লাভ নেই, এখন তোমাকে আমি জেল হাজতের ভেতর পোষবো।
-জেলে ঢুকাবেন আমায়?কি অপরাধ আমার?
-ইললিগ্যাল ভাবে মদ খেয়ে রাস্তায় অনডিউটি এসপির সাথে বেয়াদবি। আপাততো এইটুকুই, পরে সময় নিয়ে আরেকটা স্টোরি এড করে দিবো।
গাড়ি থেকে হ্যান্ডকাপ বের করে, মিশানের হাতে পড়িয়ে গাড়িতে বসালো।মিশানের তো ভালোই হলো রাত কাটানোর জন্য এমনিতেও একটা থানা খুঁজছিলো।এখন গাড়িতে ঘুমাতে ঘুমাতে থানায় গিয়ে ঘুমাবে।
গাড়ির পেছনে বসাতে গিয়েও মিশানকে সামনেই বসালো কারণ মিশানকে দিয়ে বিশ্বাস পাচ্ছে না, মাতালরা যা কিছু করতে পারে,তাই পাশের সিটে বসিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করতে লাগলো।
মিশান চোখ বন্ধ করার আগে তীব্রর দিকে তাকাতেই দেখে, ওর গালে হাল্কা রক্তের ছিটা, চোখ ঘুরাতেই দেখে কাঁধ বরাবর শার্টেও রক্ত।
মিশান হেসে হেসে বললো,
-স্যার এতো রাত করে কোনো জন্তুর সাথে লড়াই করতে গিয়েছিলেন নাকি?গায়ে এতো রক্ত লাগিয়ে শহীদ হয়ে এসেছেন, হি হি হি।
তীব্র মিশানের দিকে চোখ গরম করে তাকালো।
-একটা সাউন্ড মুখ দিয়ে বের হবে তোর, মেরে তোর উপর দিয়ে গাড়ী চালিয়ে যাবো এখান থেকে।
চলবে…………