“তৃ-তনয়া” ?বোনাস পর্ব ?

2
5054

“তৃ-তনয়া”
?বোনাস পর্ব ?
(নূর নাফিসা)
.
.
দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় ইমরান বিসিএস ক্যাডার হতে পেরেছে। ইমরান যেমন তার স্বপ্ন নিয়ে আল্লাহর কাছে প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করতো ঠিক তেমনই নাফিসাও আল্লাহর কাছে খুব চাইতো যেন ইমরানের ইচ্ছেটা পূরণ হয়। মন থেকে চাইলে মহান আল্লাহ তায়ালা নিরাশ করেন না কাউকে। প্রচেষ্টায় সফলতা প্রদান করেন তিনি। ইমরানও আজ বিসিএস ক্যাডার। অডিট এন্ড একাউন্টস এ ক্যাডার সে। যথাযথ প্রচেষ্টার সাথে মন থেকে চাইতো বলেই আজ সে তার ইচ্ছে পূরণে সফল।
নাফিসা আর আগের মতো ফাকিবাজি করেনি। খুব মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করেছে। বাকি সেমিস্টারে সে ফার্স্টক্লাস পেলেও ফাইনাল রেজাল্ট তার তেমন ভালো হয়নি। ফার্স্ট ক্লাস এসেছে কিন্তু পয়েন্ট কম! ফার্স্ট সেমিস্টারে সেকেন্ড ক্লাস না হলে ফাইনাল রেজাল্ট ভালো হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু অতি আশ্চর্যের বিষয়, নাফিসা তার এমন রেজাল্টে মোটেও মন খারাপ করেনি! রেজাল্ট নিয়েছিলো ইমরান। যেহেতু এতোটা ভালো হয়নি সেহেতু ভেবেছিলো নাফিসা মন খারাপ করবে বা অল্পতেই তার যেহেতু কান্না করার অভ্যাস আছে সেহেতু সে কান্না করবে। প্রথমে একটু বকাঝকা করে পরে সান্ত্বনা দিবে সেই প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলেছে ইমরান। কিন্তু ঘটলো ভিন্ন ব্যাপার! মন খারাপ করার বিপরীতে সে রেজাল্ট শুনে অতি উৎফুল্লতার সাথে বাবা-মা ও আপুদের কাছে কল করে জানিয়েছে! তার উৎফুল্লতা দেখে যে কেউ বলবে সে সারাদেশের মধ্যে প্রথম না হলেও দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় স্থান দখল করে নিয়েছে! তার এমন উৎফুল্লতা দেখে ইমরান বকাঝকা করেছে কিন্তু তা নাফিসার কানে পৌছালেও মস্তিষ্কে পৌছায়নি! কেননা ইমরানই একসময় বুঝাতো, শুধু সার্টিফিকেট হলেই হয় না। একজন মানুষের সুশিক্ষিত হওয়াটা জরুরী। যার জন্য উচ্চশিক্ষারও প্রয়োজন আছে। সেই সূত্রে ইমরান বকাঝকার বিপরীতে নাফিসা উত্তর দিয়েছে তার ভালো রেজাল্টের প্রয়োজন নেই। সে এখন সুশিক্ষিত কি না, সেটা দেখাই মূখ্য বিষয়।
তবে নাফিসা ইমরানের পূর্বে বলা কথা ঠিকই মিলিয়ে নিতে পেরেছে, শিক্ষিতের মর্যাদা সর্বত্রই আলাদা। তার পরিবারেও বাকিরা তাকে এখন যথেষ্ট মর্যাদা দেয়। যা পূর্বে এতোটা পাওয়া যায়নি। শুধু চাকরি বা উপার্জনের জন্য পড়াশোনা হয় না। পড়াশোনা হতে হবে সুশিক্ষা অর্জনের জন্য। সুশিক্ষিত হওয়ার মাধ্যমে নিজেকে পরিবার ও সমাজে আলাদা একটা মর্যাদায় ভূষিত করা যায়, নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা নিশ্চিত হওয়া যায়, নিজের মধ্যে ভিন্ন এক মানসিকতার জন্ম হয় যা আচার-আচরণ ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অন্যের নিকট তাকে প্রিয় করে তুলে৷ সংসার সহ নিজের সন্তানকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারে একজন শিক্ষিত মা। যেটা বর্তমানে নাফিসার মাঝে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এবং সে নিজেই উপলব্ধি করতে পারছে বিষয়টি।
বছর গড়িয়ে তাদের কোলেও এসেছে ফুটফুটে কন্যা সন্তান। আল্লাহর রহমতে আপুদের মতো নাফিসার কোনো সমস্যা হয়নি। তবে যত সমস্যা হয়েছে পড়াশোনায়। ইমরান চেয়েছিলো সে মাস্টার্সে ভর্তি হবে। কিন্তু তখন তাকে মাস্টার্সের বদলে হসপিটালে ভর্তি হতে হয়েছে! প্রেগন্যান্সির দুই থেকে প্রায় পাঁচ মাস পর্যন্ত সে বমি করতে করতে অস্থির! খাবার মুখে তোলা ধুরে থাক, খাবার দেখলেই যেন সে বমি দিয়ে ঘরবাড়ি ডুবিয়ে দিবে! তবে বাড়িঘর না ডুবাতে পারলেও ইমরানকে সময়ে অসময়ে গোসল করিয়ে ছাড়িয়েছে তার উপর বমি দিয়ে! নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার সুযোগটাও যেন হয়নি তার! শ্বশুর বাড়ির লোকজন তার সেবা করতে করতে ক্লান্ত! অত:পর রুমানা বেগম নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন কিছুদিনের জন্য। কোনো লাভ হয়নি! মাকেও জ্বালিয়ে সেড়েছে! নাফিসার জন্য নাহিদা এসে কিছুদিন থেকে গেছে বাবার বাড়ি। কিন্তু নাজিয়া আসেনি। এসময় এলে উপকারের চেয়ে বেশি অপকার হয়ে যাবে! এমনিতেই নাহিদার একজন, আবার তার দুইজন! একসাথে হলে হাসাহাসি, খেলাধুলা আর কান্নাকাটিতে যেন বাড়িঘর তছনছ করে ফেলে! তাই আসেনি সে।
আর নাফিসার যত্নে ইমরানের কথা না বললেই নয়! বেচারা এবাড়ি, ওবাড়ি ও অফিস দৌড়াদৌড়ি করতে করতে নিজেই আধমরা! তবুও প্রচেষ্টা কমেনি। কখনো রেগে, কখনো ধমকি দিয়ে আবার কখনো স্নেহের সাথে নাফিসার খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু কোনো মতো বাঁচিয়ে রাখতে পারলেও সুস্থতার দিকে সফলতা অর্জন করতে পারেনি! কেননা নাফিসা তো আর ইচ্ছে করে এমনটা করেনি যে তাকে মানিয়ে নিলেই সুস্থ হয়ে উঠবে!
অত:পর নাফিসা অতি দুর্বল হয়ে পড়ায় তাকে হসপিটাল ভর্তি করা হয়েছে। সেসময়ই তার মাস্টার্সে ভর্তি কার্যক্রম চলে। এই অবস্থায় তাকে ভর্তি করার কথা দ্বিতীয়বার ভাবেনি ইমরান।
হসপিটাল থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে আসার পর থেকে আবার তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে। উন্নতি হতে হতে এক সময় এমন পর্যায়ে এসেছে বারবার ক্ষুধা পায়, বারবার এটাসেটা খেতে ইচ্ছে করে। তবে ভাতে রুচি কম। তবুও পরিবারের সদস্য খুশি! অন্তত আগের মতো বমি করে তো আর অস্থির হয় না!
নাফিসার এমন অবস্থায় আবিদা বেগমের ধারণা ছিলো ছেলে বাবু হবে। কেননা তিনি এমন ধারণায় বিশ্বাসী যে, ছেলে বাবু হলেই গর্ভাবস্থায় মাকে এতো জ্বালাতন করে। কিন্তু ভুল ধারণা ঘুচে দিয়ে তাদের ঘর আলোকিত করে এলো মেয়ে। এতে আবিদা বেগম শুধু খুশি নয়, মহা খুশি! তিনিও যেন একটা মেয়ে বাবুরই প্রত্যাশায় ছিলেন! কেননা তার বড় ছেলের ঘরে দুই নাতি দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, তাই এখন নাতনি দেখারই প্রত্যাশা করে যাচ্ছিলেন তিনি।
মেয়ের নাম রাখা হয়েছে ইসরাত আল নিসা। সবাই ইসরাত ডাকে, ইমরান আল নিসা ডাকে৷ আর নাফিসার ঠিক নেই, কখনো ইসরাত আবার কখনো আল নিসা। যেদিন আল নিসার জন্ম, সেদিন হসপিটালে নাফিসার সাথে সাক্ষাতে ইমরান তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো,
“কি? মিটে গেছে না মা হওয়ার শখ?”
বেডে শুয়ে থাকা নাফিসা ইমরানকে অবাক করে দিয়ে প্রত্যুত্তরে বলেছিলো,
“বাবুর আগমনে নতুন করে যেমন আজ আমার নতুন জীবনের জন্ম হলো, তেমনি নতুন করে এক নতুন শখ জন্মেছে আমার মাঝে। এই শখে অতৃপ্ত স্বাদ আছে। মাতৃত্বের শখ মিটে যাওয়ার নয়।”
ইমরান তার কাছে মোটেও এমন কিছু প্রত্যাশা করেনি! গতদিন গুলোতে নাফিসা যতটা অধৈর্য হয়ে পড়েছিলো, সেই সুত্রে তার কাছে এটা প্রত্যাশা করার মতোও নয়! সে হতবাক হয়ে নাফিসার পাশে বসে পড়েছিলো তখন। কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধ থেকে আবার বলেছিলো,
“এটা কি করে হতে পারে, জান!”
ইমরানের মুখভঙ্গি দেখে নাফিসা লজ্জিত কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলো,
“মা তো আমি হয়েছি, তুমি বুঝবে কি!”
এরপর থেকে সংসারে দৃশ্যমান হয়েছে নতুন জীবনের নতুন দৃশ্য! নাফিসার মধ্যে দেখা গেছে একজন সংসারীর প্রকৃত রূপ। সংসারের বাকি দায়িত্বের পাশাপাশি নতুন করে যুক্ত হয়েছে সন্তানের দায়িত্ব। এতোদিন আশেপাশে অন্যকে এই দায়িত্ব পালন করতে দেখতো, আজ সে নিজে সেই অবস্থানে। নিসা যখন ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলো, নাফিসার চেচামেচি আর জ্বালাতনও ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো! তার সকল কাজ করতে যেন মানা হয়ে পড়েছে। ঘুমের মধ্যেও সে মাকে খুজে। বাকিদের কোলে সীমিত সময়ের জন্যই শান্ত থাকে সে। তবে বাবার কাছে শান্ত থাকতে দেখা গেছে। ইমরান বাড়িতে থাকাকালীন যতটুকু শান্তিমত কাজকর্ম করে নিতে পারে নাফিসা। নতুবা তার আর সুযোগ হয় না। মেয়ের কান্না সম্পূর্ণই বিরক্তিকর! মস্তিষ্কে অসহ্য যন্ত্রণা কাজ করে যখন মেয়ে কাঁদে! যতক্ষণ পর্যন্ত মেয়েকে শান্ত না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত নিজের শান্তি নেই। এ হচ্ছে নাড়ীর টান! ইমরানও যতক্ষণ বাড়িতে থাকে, মেয়ের সাথেই সময় কাটায়৷ মাঝে মাঝে মেয়ে ঘুমিয়ে থাকলেও ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে নিয়ে রাখে! যা নিয়ে নাফিসা প্রায়ই রাগারাগি করে! তখন ইমরানের উক্তি হয় এমন,
“আমি কোলে রাখতে পারলে তোমার সমস্যা কি?”
তখন নাফিসার জবাব থাকে না। থাকুক সে কোলে নিয়ে। তার কি! যখন সময়ে অসময়ে মেয়ে ইমরানের কোলে প্রস্রাব করে, তখন নাফিসার হাসি যেন বাঁধা মানে না! তখন তার উক্তি হয় এমন,
“আসলেই তো! আমার কি! সবই তোমার। বাবু, মুতে মুতে তোর বাবাকে আরও ডুবিয়ে দে।”
শুধু কি মুতে! বমিতেও ডুবিয়ে দেয় সাথে! খাওয়ার পরপরই স্বেচ্ছায় কিংবা মেয়ের ইচ্ছায় কোলে নিলে কয়েক মিনিট পরই বমি করে দেয়! তখন ইমরান দোষারোপ করে নাফিসাকে,
“দেখেছো? হুবহু তোমাকে ফলো করে! পেটে থাকতে তুমি বমিতে দিনরাত গোসল করিয়েছো আমাকে! আর এখন মেয়ে! আল্লাহ তোমাদের পাকতন্ত্র কি দিয়ে বানিয়েছে!”
নাফিসা তখন জবাবে বলতো,
“যেটা দিয়ে তোমাকে বানায়নি সেটা দিয়ে।”
জবাবের সাথে তার হাসি ফ্রি থাকতো। কেননা মিথ্যে বলেনি তো ইমরান! বমির বেগ সামলাতে না পেরে যত্রতত্র বমি করে দিতো নাফিসা। সেসময় ইমরান কাছে থাকলে তার উপরই বমি করে দিতো কখনো কখনো! এখন মেয়েও এই কান্ড ঘটায়!
নাফিসার এবারের ঈদুল ফিতর উপভোগ ছিলো সবচেয়ে আলাদা, সবচেয়ে বেশি আনন্দের। কেননা এবার ইসরাত আছে তার কোলে। মেয়ের প্রথম ঈদ। এমনিতেই সবার আদরের দুলালি। তারউপর আনন্দের দিনে মেয়ের আনন্দে সবার আনন্দটা যেন আরও বেড়ে গেছে।
সকালে ঘুম থেকে উঠার পর ইমরান বাইরে ঘুরতে নিয়ে গেছে এখানে নাফিসার কাজকর্মে বিরক্ত করবে তাই। অত:পর ঘুমের রেশ কেটে মাইন্ড ফ্রেশ হলে বাসায় ফিরে নেমে গেছে জিহান ও জিদানের সাথে খেলায়। তাদের দেখাদেখি সেমাই পিঠা খাওয়া, খেলনা নিয়ে ভাঙচুর, নতুন জামা নিয়ে কাড়াকাড়ি করে যাচ্ছে। জিহান জিদানকে নতুন জামা পড়তে দেখে তাদের জামা টানাটানি করছে! অত:পর নিশাত নিয়ে গেছে তাকে জামা পড়িয়ে দেওয়ার জন্য। গোসল করিয়ে, জামা জুতা পড়িয়ে, মেকাপে সাজিয়ে দিয়েছে তাকে৷ যদিও বেশিক্ষণ টিকেনি! ঘন্টাখানেক পরপরই তার জামা পাল্টাতে হয়েছে। ঠোঁটে লিপস্টিক লাগালে অর্ধেক খেয়েই ফেলে! গত রাতে ঘুমের মধ্যে হাতে মেহেদী দিয়েছিলো, তা-ও লেপ্টে ফেলেছে কিছুটা। নড়াচড়া করছিলো বিধায় ইমরান তার হাত ধরে বসেছিলো ততক্ষণ, যতক্ষণ পর্যন্ত না মেহেদী শুকিয়ে যায়। নাফিসা মজা পেয়ে হাসছিলো তখন। শাস্তিস্বরূপ ইমরান তাকে আরও রাত জাগিয়ে নিজের হাতে মেহেদী দিয়ে দিতে বলেছে। নাফিসা আগেই বলেছিলো কিন্তু সে নিষেধ করেছিলো তখন৷ যদিও তার ইচ্ছে ছিলো না তবুও নাফিসার শাস্তি দিতে সে চোখ বুজে ঘুমের ভান ধরে থেকেছে আর নাফিসা বসে বসে তার হাতে মেহেদী লাগিয়েছে। নাফিসার কাছে এই শাস্তি ভালোই লাগছিলো। মেহেদী লাগানো শেষে সে ইমরানের গালে টিউব দিয়ে খোচা মেরেছে। কারণ সে জানে ইমরান ঘুমায়নি৷ ইমরান চোখ খুলে ব্রু কুচকে তাকালে বিপরীতে নাফিসা দাত বের করে হেসেছিলো!
সালামিতে ভরে গেছে নাফিসার দুহাত। এগুলো তার নয়, তার মেয়ের। কেননা জিহান জিদানসহ বাড়ির সবার কাছ থেকে সালামি পেয়েছে ইসরাত। আর একে একে তা এনে নাফিসার হাতে দিয়েছে। নিশাত কিংবা জেরিন দুষ্টুমি স্বরূপ তার কাছে থেকে টাকা নিতে চাইলে মহা চিৎকারের সাথে ঝাড়ি দেয়! এমনকি ইমরানের হাতেও দেয়না৷ টাকা খুব ভালো চেনে আজকালকার বাচ্চারা! নিশাত পরীক্ষা করার জন্য কাগজ কেটে দিয়েছিল ইসরাতের হাতে। ইসরাত হাতে নিয়ে সেটা ঢিল মেরে নিশাতের দিকে দিয়েছে! তা নিয়ে তাদের মাঝে হাসাহাসি। সারাদিন চোখে ঘুম নেই। সেই সকাল থেকে ঘুরাঘুরি, মারামারি, খেলাধুলায় মেতে আছে ইসরাত! খাওয়ার জন্যও টেনে আনা যায় না!
নামাজের পর আশিক আয়াতের বাড়ি ঘুরে ইমরানের বাড়ি এসেছিলো আরোহী ও নির্ঝরকে সাথে নিয়ে। বাচ্চাদের সালামি দিয়েছে কিপ্টুস আশিক! আবার নিয়েছেও ভাইদের কাছে থেকে। জেরিন থেকেও আদায় করতে পেরেছে কিন্তু নাফিসার কাছ থেকে আদায় করতে পারেনি। আশিক যখনই এ বাড়িতে আসে ইসরাতকেসহ জিহান ও জিদানকে সাথে নিয়ে ,দোকানে যায় এটাসেটা কিনে দেয়। ইসরাত প্রথম প্রথম যেতে চায়নি তার কাছে। নিশাত যখন ভিডিও কলে আশিকের সাথে কথা বলে, মাঝে মাঝে ইসরাতকে সাথে রাখে। এভাবে দেখে দেখে এখন কিছুটা সে চেনে আশিককে। আর আশিক যখনই আসে, কান্না করলেও সে ইসরাতকে কোলে নিবেই, প্রয়োজনে রাস্তার ধারে যায় শান্ত করতে। পূর্বের বলা কথানুযায়ী নাফিসা একদিন বলেছিলো,
“আপনি না বলছেন আমার বাবুদের কোলে নিবেন না?”
তখন আশিক হেসে জবাব দিয়েছিলো,
“আরে ভাবি! আমি নিয়েছি নাকি! আপনার মেয়েই তো উঠে পড়লো আমার কোলে!”
“হু? আমার মেয়ে নিজে নিজে উঠে গেছে না?”
আশিক তখন হেসে উঠেছিলো।
আরোহী ও নির্ঝরকে নিয়ে কিছুক্ষণের জন্য এলেও নাফিসা রেখে দিয়েছে বাচ্চাদের। তার ইচ্ছে আপু ও ভাইয়াকে আসতে বলবে বিকেলে। কিন্তু নাজিয়া এলো না। ঈদের দিন নিজের বাড়িতেই ঝামেলা। তবে বিকেলে ইমরান আরাফের বাড়ি গিয়েছিল। দেখা সাক্ষাৎ করে আরাফকে সাথে নিয়ে এসেছে। তাজকেও দেখতে ইচ্ছে করছিলো খুব কিন্তু আজ আসবে না। ফুপির বাড়ি চলে গেছে সে। বিকেলে আবার নানু বাড়ি যাবে।
আরাফ খালার বাসায় এসে দেখা করলো। অত:পর ইমরান ও সে জিহান ও জিদানসহ বাচ্চাদের নিয়ে শ্বশুর বাড়ি গিয়েছে। মাঝপথে থাকতে আরাফ মেহেদীকে কল করে বললে সে-ও এসেছে তাজকে নিয়ে। সে দুপুরের দিকে আসতো, কিন্তু আরাফ বিকেলে আসবে বলে সে এবং ইমরান উভয়ই ভাবলো একসাথে বিকেলেই আসবে। মেয়েরা না এলেও সন্ধ্যায় নিয়াজ উদ্দিনের বাড়িতে ঈদ জমেছে জামাই ও নাতি-নাতনীদের নিয়ে। এখানেও সালামি দেওয়া-নেওয়া। সারাদিন হৈ-হুল্লোড় করে নানু বাড়ি থেকে বাড়ি ফেরার সময় ইসরাত ঘুমিয়ে পড়েছে।
এবার ঈদে ইসরাত আল নিসার আটমাস বয়সে বাবার বাড়ি বেড়াতে এসেছে নাফিসা। এর আগেও দুইবার এসেছে, তবে এবার আপুরা সবাই একসাথে। কেননা উপলক্ষ ছিলো ঈদুল ফিতর। এমনিতে যেমন তেমন আসাযাওয়া, কিন্তু বছরে দুই ঈদে তারা একসাথে এসে আট-দশ দিন কাটিয়ে যায় বাবা মায়ের সাথে। এরমাঝে নাফিসা আরও বেশি আসতো, কিন্তু স্থান পরিবর্তনের ফলে ইসরাতের সর্দি লেগে যেতো। তাই কয়েকমাস বাবা মায়ের কাছে কমই এসেছে।
নুসরাত, নুযহাত, ইসরাত ও নির্ঝর বেশ কিছুদিনের জন্য একসাথে এবার নানু বাড়িতে। বাকিরা তো স্পষ্ট কথা বলতে পারে কিন্তু ইসরাত কিছু কিছু শব্দ উচ্চারণ করতে পারে। বাকিরা দৌড়াদৌড়ি করে খেলাধুলা করে আর সে হামাগুড়ি দিয়ে পিছু নেয়! দিনে কতবার তার পোশাক পাল্টাতে হয় তার হিসেব নেই। আজও নেমে গেছে বাকিদের সাথে ফাঁকা মুরগির খামারে। নাফিসা কয়েকবার ধরে ধরে তাদের ঘরে বন্দী করে খেলনা দিয়েছে। কিন্তু বাচ্চারা কম কিসে! দুষ্টুমিতে তাদের চেয়ে কয়েক গুন এগিয়ে! বারবারই চলে যায় বাইরে। না যেতে দিলে গড়াগড়ি দিয়ে কান্না! ঘরে আসবাবপত্র ভাঙ্গাভাঙ্গি! নুযহাত ও নুসরাত জামাকাপড়ে ময়লা লাগায় না। কিন্তু নির্ঝরটা অযথা হাত পা ছড়িয়ে মাটিতে বসে যায়, মাটিতে গাড়ি চালাতে চালাতে সে নিজেই শুয়ে পড়ে আর গাড়ির মতো চলতে থাকে! কোনো কিছু মন মতো না হলেও জেদ করে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্না শুরু করে! আবার কখনো ইসরাতের সাথে হামাগুড়ি দিয়ে চলে! আর এই দুইটাই নিয়মিত পিটুনি খায়!
আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কখনো মলমূত্রত্যাগ করে জামাকাপড় নষ্ট, আবার পড়িয়ে দেওয়া মাত্র বাইরে এসে মাটি দিয়ে জামা নষ্ট! যার ফলে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নাফিসা দু তিনবার ইসরাতকে পিটুনি দিয়েছে। আর রুমানা বেগম বারবারই লাঠি নিয়ে এসেছে নাফিসাকে তাড়া করতে! রুমানা বেগমের কথা হলো, বাচ্চা খেলবেই৷ জামাকাপড় ময়লা হোক, তিনি ধুয়ে দিবেন।
গোসলের কথা বললে একটাও যাচ্ছে না! টানলেই কান্নাকাটি! আর নানু তো আছেই তাদের সাপোর্টার! রুমানা বেগম এক্ষেত্রেও বলে দিলেন তারা যেন একে একে গোসল করে নেয়। বাচ্চারা আরেকটু খেলা করুক। তিনি গোসল করিয়ে দিবেন। নাজিয়া বাচ্চাদের কাপড়চোপড় নিয়ে চলে গেছে বাথরুমে। ইসরাতের জামাকাপড় বালতিতে ভেজানো ছিলো, সেগুলোও কেচে দিলো। এদিক থেকে শান্তিতে আছে নাহিদা। তার মেয়ে এতো ময়লা করে না। কাঁদা মাটি দেখলে তার মাঝে যেন একটা ঘিনঘিন ভাব চলে আসে। কেননা সে কাঁঁদা মাটিতে খেলে অভ্যস্ত না। আর বাকিরা তো মাটির মানুষ! খোলামেলা বাড়িঘর। ঘরে ঘন্টাখানেক আটকে রাখলেই তাদের যেন দম বন্ধ হয়ে যায়! কখন বাইরে যাবে আর কখন ছুটাছুটি করবে সেই চিন্তায় মগ্ন থাকে তারা।
নাফিসা নাহিদা ও রুমানা বেগম খামারের ভেতর বাচ্চাদের পাশে বসে কথা বলছিলো। বাচ্চারা খেলতে খেলতে বাইরে বেরিয়ে এসেছে।
এদিকে নির্ঝর ঘর থেকে পানির জগ এনে নুযহাতের মাথায় ঢেলে দিয়েছে! সে নাকি একে একে সবাইকে গোসল করাবে! আর ইসরাত পানি দেখে খুশিতে এগিয়ে এসে লেপাপোঁছা শুরু করেছে! বৃষ্টি হওয়ায় মাটি কিছুটা ভেজা ভেজা ছিলো। এখন পানি ঢেলে লেপাপোঁছার কারণে কাঁদামাক্ত হয়ে উঠেছে! নুসরাত তাদের সাথে যোগ দিচ্ছে না বলে নির্ঝর হাতে কাঁদা নিয়ে নুসরাতের জামাতে মেখে দিলো! তার জামা নষ্ট হওয়ার কারণে সে কান্না শুরু করে খামারের ভেতর ঢুকতে গেলে বাকিদের দৃষ্টি এদিকে পড়লো! আর সবাই থতমত খেয়ে গেছে! এইটুকু সময়ে চোখের আড়ালে এতো বড় কান্ড ঘটিয়েছে বিছু বাচ্চারা! তারা তিনজনই ধমকে উঠে এলো। নাহিদা বিস্মিত হয়ে বললো,
“এখানে পানির জগ এলো কিভাবে?”
নুসরাত কান্না করতে করতে জবাব দিলো,
“আম্মু, নিঝর নিয়ে আসছে! দেখো, আমাকে কাদা লাগিয়ে দিছে!”
আর ওইদিকে নির্ঝর দাত বের করে হেসে যাচ্ছে। রুমানা বেগম তেড়ে এলে সে দৌড় দিতে গিয়ে ধপাস করে পিছলে পড়েছে! আর এমন চিতপটাং হয়েও তার হাসি থামে না! বরং আরও বেড়ে গেছে! নুযহাত ভিজে চুপচাপ বসে ছিলো, নির্ঝর পড়ে যাওয়াতে সে-ও খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো! আর ইসরাত মনের খুশিতে ইচ্ছেমতো লেপাপোঁছা করে যাচ্ছে! নাফিসার এখন একটুও রাগ হলো না। বরং আরও অনেক বেশি হাসি পাচ্ছে তিনটার কান্ডকারখানা দেখেই!
রুমানা বেগম একে একে তাদের কাদা থেকে সরিয়ে আনলেন। কিন্তু কোনো লাভ নেই! একজনকে সরিয়ে আনলে অন্যজন চলে যায়!নাহিদা নুসরাতের জামা খুলতে খুলতে নাফিসাকে বাচ্চাদের কাদা থেকে সরিয়ে আনতে বললো। নাফিসা সরিয়ে আনবে কি, নানি ও নাতি-নাতনীদের কান্ড দেখে সে নিজেই হেসে কুটিকুটি!
রুমানা বেগম এবার লাঠি নিয়ে এলেন। লাঠি দেখে বাকি দুইজন দৌড়ে খামারে চলে গেলো আর ইসরাত হা হয়ে তাকিয়ে আছে নানুর দিকে!
এমনি গোসল সেড়ে নাজিয়া বেরিয়ে এলো। বাচ্চাদের অবস্থা দেখে সে হতবাক! নির্ঝর এই অবস্থা করেছে জানতে পেরে সে রেগে আসছিলো। তা দেখে নির্ঝর দৌড়ে এসে নাফিসাকে ঝাপটে ধরলো আর নাফিসার জামাকাপড়ে কাদা লেগে গেলো! নাজিয়া লাঠি নিতে নিতে নাফিসা বাচ্চাদের নিয়ে দ্রুত বাথরুমে চলে গেলো গোসল করিয়ে দেওয়ার জন্য। তাদের জামাকাপড় নিয়ে নাহিদাও এলো বাথরুমে। একপাশে বসে বাচ্চাদের পড়নের কাপড়চোপড় সব কেচে দিচ্ছে নাহিদা৷ আর অন্যদিকে একে একে সবাইকে গোসল করিয়ে দিচ্ছে নাফিসা! সবগুলো বদের হাড্ডি! এমনিতে টেনে আনা যায় না! অথচ একত্রে আসায় এখানে পানির মগ নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে গেছে আগে গোসল করানোর জন্য। নাফিসা চকলেটের লোভ দেখিয়ে তাদের শান্ত করলো। প্রথমে নুযহাতকে গোসল করিয়ে দিলো। কেননা সে প্রায় পুরো ভিজে বসে আছে! অত:পর ইসরাতকে গোসল করিয়ে দিলে নাজিয়া এসে নিয়ে গেলো। অত:পর নির্ঝর এবং নুসরাত। তাদের পরপর সেও গোসল করে নিলো।
ঘরে এসে দেখলো নাজিয়া বাচ্চাদের খায়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। ইসরাত আষ্ঠেপৃষ্ঠে মিশে আছে নাজিয়ার সাথে। নাফিসা বললো,
“না খেয়েই ঘুমিয়ে গেছে!”
নাজিয়া জবাবে বললো,
“তাদের দেখাদেখি অল্প ভাত খেয়েছে। তুই নামাজ পড়ে আবার খাওয়া৷”
“তুমি খেয়েছো?”
“না। নামাজ পড়ে আয়, একসাথে খাবো।”
নাফিসা নামাজ পড়ে এই রুমে আসতেই চোখ পড়লো নির্ঝরের দিকে! কেন জানি মনে হলো এইমাত্র নির্ঝর চোখ বন্ধ করেছে! সে কাছে এসে একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখলো চোখের পাতা কাপছে! অত:পর নাজিয়ার উদ্দেশ্যে বললো,
“তোমার ছেলে ঘুমাইছে?”
নাজিয়া বালিশ মাথা উঠিয়ে নির্ঝরের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়ে বললো,
“ঘুমায়নি!”
নাফিসা নির্ঝরের পেটে সুড়সুড়ি দিতেই নির্ঝর খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো! নাজিয়া রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকালে নির্ঝর বললো,
“নানু ভাইয়া আসে না কেন?”
নাফিসা জবাব দিলো,
“নানু ভাইয়া আসবে৷ আগে ঘুমাও৷ নতুবা নানু ভাইয়া আর ঘুরতে নিয়ে যাবে না।”
নির্ঝর চোখ বন্ধ করলে নাফিসাও নাজিয়ার সাথে গল্প করতে লাগলো৷ আগামীকাল মেয়ের জামাইরা নিতে আসবে সেজন্য সকালে বাজার করতে বেরিয়েছেন নিয়াজ উদ্দিন। তখন নির্ঝর পিছু নিয়েছিলো, তাই তিনি বলে গেছেন কাজ সেড়ে বাড়ি ফিরে ঘুরতে নিয়ে যাবে। নির্ঝর এখন সেই অপেক্ষায়ই আছে! পাঁচ মিনিটের মতো অতিক্রম হতেই নিয়াজ উদ্দিন বাড়ি ফিরলো। নানু ভাইয়ার কণ্ঠ শুনে নির্ঝর ঘুমের নিমকুচি করে লাফিয়ে খাট থেকে নেমে চলে গেলো। নাজিয়া উঁচু গলায় ডাকলো, কোনো পাত্তাই দিলো না! এদিকে ইসরাতের ঘুম ভেঙে গেছে। বাকি দুইজন ঘুমে মগ্ন। নাহিদা খাওয়ার জন্য ডাকলে তারা সবাই চলে গেলো। একসাথে খাওয়াদাওয়া হলো। তবে ইসরাত ও নির্ঝর বিরক্ত করেছিলো! খাওয়া শেষে নিয়াজ উদ্দিন নির্ঝরকে নিয়ে ঘুরতে বের হলেন।
পরদিন মোটামুটি বড়সড় এক আয়োজন হলো তৃ-তনয়ার শ্বশুর বাড়ির লোকজন নিয়ে। নাফিসা ঘুরে ঘুরে বাচ্চাদের কান্ড কারখানা দেখছিলো! তার মেয়ে ইমরানকে দেখে না পারে দৌড়ে চলে যায়! কিন্তু দৌড় তো জানে না, তাই সম্ভব হলো না। তবে ইমরানই দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসেছে মেয়ের আহ্লাদ দেখে! কোলে উঠে যেন এভারেস্ট জয় করেছে ইসরাত! এতোটা খুশি সে! ওদিকে নির্ঝর আশিকের কাধে চড়ে বসে আছে! নুযহাত তার বাবার কোলে বসে বসে নানান জিজ্ঞাসা করে চলেছে! আর মেহেদী যখন এসেছে তখন নুসরাত গোমড়া মুখু হয়ে বসে আছে! তার দাদা দাদু কখন চলে এসেছে, কিন্তু বাবা পরে এলো কেন! তা নিয়ে বাবার উপর রাগ! অথচ এতোক্ষণ যাবত সবার সাথে হেসে খেলা করছিলো৷ ইমরানের কোলে উঠে বাইরেও ঘুরে এসেছে! মেহেদী অফিসে গিয়েছিলো বিধায় একটু দেরি করে এসেছে। তার মেয়ের অভিমান নতুন না। প্রায়ই এমন অভিমান জন্মে বাবার প্রতি। সে এসে বসেও নি। নুসরাতকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেছে অভিমান ভাঙানোর জন্য! এ নিয়ে নাহিদা কিছুটা বিরক্ত হলো! এতোটা পথ ভ্রমণ করে এসেছে, এখন আবার বের হওয়া প্রয়োজন ছিলো! একটু বিশ্রাম নিয়েও তো যেতে পারতো!
সন্ধ্যার পূর্বেই সবাই নিজ গন্তব্যে উপস্থিত হয়েছে। ইমরান ঘরে এসে ইচ্ছাকৃতভাবে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললো,
“আহ! ঘরটা আমার ভরে গেছে! এতোদিন মনে হতো আমি বনবাসে ছিলাম! একা দিন কাটাও, একা রাত কাটাও!”
তার প্রত্যুত্তরে নাফিসা বললো,
“একা কেন কাটালে! বনবাসে থাকলে তো মানুষ পশুপাখির সাথে দিন কাটায়। বাড়ির আনাচে কানাচে কতগুলো বিড়ালের বাচ্চা ঘুরে একটু আশ্রয় পাওয়ার জন্য। তুমি তাদের ডেকে নিলেই পারতে!”
ইমরান হেসে বললো,
“বিড়ালের বাচ্চা বিছানায় মুত্র ত্যাগ করলে তো আবার তোমাকে বিছানা ছাড়তে হতো!”
“ছাড়বো কেন! তুমি বিছানায় ঘুমাতে, আমি তোমার উপর ঘুমাতাম আর বাবু আমার উপর ঘুমাতো! ব্যাস!”
“ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো! ধরে আনবো না কি দু চারটা?”
“যা-ও, যা-ও। বেরিয়ে দেখো, দ্বিতীয়বার ঘরে ঢুকতে পারো কি না!”
সকাল থেকে জিদানের সাথে ইসরাতের খেলাধুলা হৈহোল্লোড় আর জিহান স্কুল থেকে ফেরার পর তিনজন একত্রে মেতে উঠে! একএকজন হাপিয়ে উঠে, তবুও থামে না কোনোমতে! এই হাসাহাসি, এই কান্নাকাটি! নিরব বাড়ি এখন কোলাহলপূর্ণ!
ইমরান ব্যাংকে উচ্চপদে চাকরিরত আছে। ব্যাংক বন্ধ হওয়ায় ইমরান আজও বাসায় ছিলো। দুপুরে ইসরাতকে খাওয়ানোর জন্য নাফিসা বাটিতে খাবার নিলো। কিন্তু ইসরাত নেই! এইমাত্র ড্রয়িং রুমে দেখে গেছে, এইটুকু সময়ে সে কোথায় চলে যেতে পারে! জিদানকেও দেখা যাচ্ছে না। রুমের বাইরে যারা ছিলো তারাও দেখলো না রুম থেকে বের হতে! নাফিসা জেরিনের রুমে দেখে এলো, নেই! ড্রয়িং রুমে এসে দরজার আড়ালে দেখলো, সেখানেও নেই। সোফার এপাশ ওপাশ দেখলো সেখানেও নেই! অত:পর জিদানের ফিসফিস শব্দ শুনে খাটের নিচে উঁকি দিয়ে দেখলো দুইটাই শুয়ে আছে! নাফিসাকে উঁকি দিতে দেখে উভয়ই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো!
জিদানটাও বড্ড পাজি! সেমি বক্স খাটের এইটুকু ফাঁকা দিয়ে ঢুকে যায়! নিজেও লুকিয়ে থাকে, ইসরাতকেও শিখিয়ে দিয়েছে! যেকোনো কারণে দরজার আড়ালে, কাথাবালিশের আড়ালে, গুটিয়ে রাখা মশারী এলোমেলো করে তার ভেতর, ডাইনিং টেবিলের নিচে, কিংবা পড়ার টেবিলের নিচে এবং বাথরুমে সহ লুকিয়ে থাকে! এসব শিখিয়ে যাচ্ছে জিদান! যদিও এখনো বাথরুমে লুকায় নি ইসরাত। এইটুকু মেয়েটাও এতো পাজি যে, ডাকলেও সাড়া দেয় না! একদম চুপটি মেরে বসে থাকে যখন লুকিয়ে থাকে! আর হামাগুড়ি দিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়! মাঝে মাঝে কিচেনে এসে খুটিনাটি করে। ঝুড়ি নিচে থাকলে শাকসবজি সব ফ্লোরে ফেলে দেয়, নাফিসা ধমক দিলে আবার একে একে তুলে রাখে। এদিক থেকে নাফিসার ভদ্র মেয়ে ইসরাত। তবে ভদ্রতা সবসময় থাকে না। নাফিসার চোখের আড়ালে সে অভদ্রের গুরু! কোনো কিছু মেঝেতে থাকলে তা নিয়ে ঢাকঢোল পিটায়। কোনো কিছু তার হাতে পড়লে সেটা আর আস্ত থাকে না। মেঝেতে আছড়ে ভাঙ্গাভাঙ্গি! মাঝে মাঝে কিচেনে এসে হাড়িপাতিল মেঝেতে পেলে ভাঙ্গা ভাঙ্গি করে! তখন জেরিন কিংবা বড়মার হাক পড়ে, “নাফিসা গো, সব ভেঙ্গে ফেললো।”
বিচার দিতে দেখে কখনো রেগে ধমক দেয় ইসরাত, “এই!” ” বপ!” আবার কখনো ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে! জেরিন ও নিশাত বড্ড বেশি মজা পায় ইসরাতের ধমকে। একাধিক বার তার মুখে এই ধমক শোনার জন্যও তারা ইচ্ছে করে বারবার রাগিয়ে দেয় ইসরাতকে।
এখন খাটের নিচ থেকে জিদান হাতরে বেরিয়ে আসতে পারলেও ইসরাত পারছে না! নাফিসা টেনে বের করে আনতে গেলে ইসরাত মাথায় ব্যাথা পেয়ে কান্না জুড়ে দিলো। বিপরীতে নাফিসা আরও দুইটা থাপ্পড় দিয়ে কান্না বাড়িয়ে দিলো! কান্না যেহেতু করবি তো বেশি করেই কর! নাফিসার বর্তমান মনোভাবটা এমন! কারণ এমন দুষ্টুমি কেন করবে যেখানে ব্যাথা পাবে!
ইমরান মাত্রই এসেছে লাঞ্চ করার জন্য, এমনি নাফিসাকে মারতে দেখে জোরে ধমক দিলো। নাফিসা খাবারের বাটি টেবিলে রেখে ভেঙচি কেটে চলে গেলো। ইমরান মেয়েকে মেঝে থেকে কোলে নিয়ে শান্ত করতে লাগলো। অত:পর নাফিসা ইমরানের খাবার নিয়ে এলে সে বসে খাচ্ছে এবং ইসরাতকে খাওয়াচ্ছে। বিরক্ত তো বেশ করছে, কিন্তু ধৈর্যহীন হচ্ছে না ইমরান। নাফিসা চুপচাপ নিজে খাচ্ছে আর তাদের কর্মকাণ্ড দেখছে। বাবা মেয়ের মুখে খাবার দেয়, আর মেয়ে কিছু গিলে তো কিছু থু থু মেরে বাবার উপর ফেলে!
খাওয়া শেষে ইমরান ইসরাতকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এসেছে। নাফিসা আসবাব গুছিয়ে একটু পর এসে দেখলো ইমরান চোখ বুজে হেলান দিয়ে খাটে বসে আছে। আর দুহাতের বন্ধনে আবদ্ধ ইসরাত তার বুকে ঘুমিয়ে আছে! এই মাত্রই না এলো, এতো তারাতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লো বাবা মেয়ে! নাফিসা ফোনটা হাতে নিয়ে চমৎকার দৃশ্যটা ক্যামেরা বন্দী করলো। যদিও দৃশ্যটা নতুন না। কিন্তু যখনই দেখে, তখনি নতুনত্ব আনন্দ পায় নাফিসা। মন্দ হয় না, যদি এমন দৃশ্যে সে-ও সামিল হয়! তাই ফোন রেখে অতি সাবধানে সে-ও তাদের কাছে এলো। তারা এতো আবাশে জড়িয়ে থাকবে, সে কেন দূরে দূরে থেকে তাদের সুখী সুন্দর পরিবার অসুন্দর করবে!
নাফিসা খুব সাবধানে ইমরানের পাশে বসে ইমরানের দেহে হেলান দিয়ে তাদের উপর একহাত রেখে চোখের পাতা বন্ধ করলো! ইমরান চোখ খুলে মুচকি হেসে একটা হাত বাড়িয়ে নাফিসাকে আরও জড়ো করলো। নাফিসা মুচকি হাসির রেখা টেনে বললো,
“ঘুমাওনি!”
“এতো তারাতাড়ি ঘুম আসে নাকি!”
“মেয়ে তো ঘুমিয়ে সাবাড়!”
“মেয়ের তো ঘুমানোর বয়স।”
“আর তোমার?”
“আমাদের তো খুনসুটির বয়স। একটু ঘুম পাড়িয়ে দাও তো।”
“ইশ! বুইড়া বেটা আসছে কচি সাজতে।”
“এখনো চুল পাকলো না, বাচ্চাকাচ্চা দিয়ে ঘরবাড়ি ভরলো না, ছেলেমেয়ে বিয়ে দিলাম না, নাতিনাতনি দেখলাম না! এখনই বুইড়া হয়ে গেছি!”
“হু, গেছো। বিয়ে করছো, বাচ্চার বাপ হইছো তাই বুইড়া হয়ে গেছো! এই, নিশাতের বিয়ে কি তার অনার্স কমপ্লিট হওয়ার সাথে সাথেই হবে না?”
“নিশাতের বিয়ে হয়ে গেছে।”
“আরে, প্রোগ্রামের কথা বুঝিয়েছি।”
“তুমি এতো পাগল হয়েছো কেন? যার বিয়া তার খবর নেই, পাড়াপড়শির ঘুম নেই!”
“যা, ফাজিল বেটা! আমি তার দুইমাত্র ভাবি, আমি পাগল হবো না! কবে থেকে আশায় আছি ননদের বিয়ে খাবো! আশা আর শেষ হয়না!”
“এহ! বিয়েতে কি এমন খাবার আছে যা অন্যভাবে খাওয়া যায় না।”
“বিয়েতে বর আছে, কনে আছে, তাদের ঘাড় মটকে খাবো। যা অন্যভাবে খাওয়া যায় না। বুঝতে পারছো?”
“হায় হায়! আমি রাক্ষসীর সাথে সংসার করি!”
“হু, এখন বেশি কথা বললে আপনার ঘাড়ও মটকে দিবো!”
অত:পর চোখ বন্ধ রেখে দুজন খুনসুটিময় প্রেমালাপ করছিলো। হঠাৎই ইমরান চমকে সোজা হয়ে বসলো। ইসরাত ভিজিয়ে দিয়েছে তাকে! প্রস্রাব করার পরপরই ঘুম ভেঙে গেছে তার। বাবা-মা কে পাশে দেখে কাদেনি ইসরাত। সে চোখ মেলে নাফিসার দিকে তাকিয়ে আছে কেননা নাফিসা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো ইমরান ভিজে যাওয়ায়! ইমরানের কোলে যতবার মূত্র ত্যাগ করেছে সেই তুলনায় নাফিসার কোলেও বোধহয় এতোবার ত্যাগ করেনি! নাফিসাকে পাগলের মতো হাসতে দেখে ইমরান ইসরাতকে তার কাছে দিয়ে বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে বললো,
“তোমরা মা মেয়ে যা করলে আমার সাথে!”
“হি হি হি, উই লাভ ইউ।”
“এভাবে ভালোবাসতে হয়!”
নাফিসা হাসি থামিয়ে ইসরাতের জামা পরিবর্তন করতে করতে ইসরাতের উদ্দেশ্যে বললো,
“পাজি মেয়ে! বাবাকে এভাবে ভালোবাসতে হয়! আর কখনো বাবার কোলে মুতে দিবি না। আমি তো মোটেও চাই না তুই তোর বাবাকে বমি আর মুতু দিয়ে ভালোবাসবি! আমি তো সেই দিনের প্রত্যাশায় আছি, যেদিন তুই তোর বাবার কোলে পাদুর সাথে হাগু দিয়ে বাবাকে ভালোবাসবি! জানিস তো, আমার একটাই আফসোস! তুই আজও বাবার কোলে হাগু করলি না! সবসময় বাবার কথা মানতে হয়? কিছু কিছু সময় মায়ের কথাও মানতে হয়, বুঝলি? এরপর থেকে বাবার কোলে উঠে সবার আগে মায়ের কথাটা মনে করবি। মনে থাকবে তো?”
ইমরান পুরোই স্তব্ধ! নাফিসা সবসময়ই মজা করে সেটা জানে সে। কিন্তু এখন যেই ভাবটা নিয়েছিলো, মনে হয়েছে তার মেয়ে বুঝদার হয়ে গেছে বিধায় সে মেয়েকে জ্ঞান দিচ্ছিলো! কিন্তু এ কেমন জ্ঞান, যা শুনে তাকে হতে হয় অজ্ঞান!
———– 0 ———–

2 COMMENTS

  1. গল্প টা অনেক সুন্দর হয়েছে। এখানে সাধারণ মানুষের জীবনের সাথে অনেক মিল রয়েছে ???

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here