তেজস্ক্রিয়_রক্তধ্বনি,পর্ব_২৪

0
1132

তেজস্ক্রিয়_রক্তধ্বনি,পর্ব_২৪
লেখিকা_রিয়া_খান

জ্ঞান যখন ফিরে আসে মিশানের, নিজেকে তখন একটা ছোট্ট বদ্ধ জায়গায় দেখতে পায়। ভেতরটাতে পুরো অন্ধকার।
কোথায় আছে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না।
মনে হচ্ছে একটা ছোট্ট বাক্সের ভেতর বন্দী আছে, এমন সময় মিশানের গায়ের সাথে লাগানো বেবি ক্যারিয়ার থেকে চিৎকার শুরু করে নিশান, ছোট্ট কয়েক মাসের বাচ্চা, এভাবে অন্ধকার দেখলে কাঁদবে এটাই স্বাভাবিক।

এইটুকু ছোট্ট মিশান আরেকটা ছোট্ট বাচ্চাকে কিভাবে কন্ট্রোল করবে!বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে নিজের সাথে।
মা ই বা কোথায় গেলো?
নিশানের কান্না থামাতে গিয়ে মিশান মহা বিপাকে পড়ে গেছে।
নিজের কান্না থামাবে নাকি কোলে থাকা ছোটো বোনের।

বাড়িতে থাকা কালীন নিশান কেঁদে উঠলে মাকে দেখতো নিশানের মুখে ফিটার ধরলে, দুধ খেতে খেতে কান্না থেমে ঘুমিয়ে যেতো।
মিশানও বেশ কয়েকবার শখ করে নিশানকে খাইয়ে দিয়েছে।
কিন্তু এখন ফিটার পাবে কোথায়!
হতভম্ব হয়ে নড়াচড়া করতে গিয়ে পিঠের সাথে একটা ব্যাগ দেখতে পেলো, মিশান অন্ধকারেই ব্যাগটা খোলার চেষ্টা করলো,একটা চেইন হাতে পড়তেই চেইন টান দেয়, আর ব্যাগ খুলে যেতেই কিছু জিনিস গড়িয়ে পড়লো। তারমধ্যে একটা গোল সবুজ রঙের বল ছিলো,বলটা মিশানের।এটা একটা বিশেষ বল,যা অন্ধকারে আলো বিচ্ছুরণ করে।
আর এখন বলটা অন্ধকারে বেরিয়ে আসায় আলো বিচ্ছুরিত করছে, অন্ধকার জায়গাটুকু সবুজ আলো দিয়ে ভরে গেলো।
এবার মিশান সব টুকু জায়গা ভালো মতো দেখতে পায় আধোআধো আলোতে।
ব্যাগের মধ্যে মা আগেই নিশানের জন্য ফিটারে দুধ রেখে দিয়েছিলো, মিশান সেটা দেখতে পেয়ে নিশানের মুখে ফিটার দেয়।
খিদের কারণেই নিশান এতো কান্না করছিলো। ফিটার খেতে খেতে আবার ঘুমিয়ে যায় নিশান।

নিশান ঘুমিয়ে পড়ার পর মিশান থ হয়ে বসে
থাকে, বুঝতে পারছে না কোথায় আছে, হঠাৎ এমন পরিস্থিতিতে মিশান পুরোটাই আতংকিত। মায়ের কথার ভাবে মনে হচ্ছিলো, ওর মা ওদের রেখে কোথাও যাবে, কিন্তু এখন তার উল্টো দেখতে পাচ্ছে।
এতোটা ভয় আর আতংক মিশানকে চেপে ধরেছে যে কান্না করতে ভুলে গেছে।
মিশানের মা তখন ক্লোরোফরম ইউজ করে মিশানকে অজ্ঞান করেছিলো,যার রেশ এখনো কিছুটা আছে,মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে ব্যাগের সাথে হেলান দিয়ে মিশান ঘুমে তলিয়ে পড়ে।

সকাল নয়টার দিকে সাদেক খান কোথাও থেকে ঢাকায় ফিরেন, ওনার পরিধানে সেনাবাহিনী ইউনিফর্ম । তখন তিনি কর্নেল ছিলেন না, মেজর ছিলেন। উনি কর্নেল হয়েছেন বর্তমান থেকে এগারো বছর আগে।

বাড়ি ফিরে ড্রাইভারকে বলে গাড়ির ডিকি থেকে ব্যাগপত্র বের করতে।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকবে তখন পেছন থেকে উনার ড্রাইভার ডাক দিয়ে উঠে,
-স্যার!
সাদেক খান পেছনে ঘুরে তাকান।
গাড়ির ডিকি খুলে দাঁড়িয়ে ভীতস্বরে ড্রাইভার উনাকে বললেন,
-স্যার এইদিকে আসুন একটু!
সাদেক খান গাড়ির ডিকির সামনে গেলো।
ড্রাইভার ডিকির ভেতরের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে দেখা।লো,
-স্যার দেখুন।
সাদেক খান ডিকির ভেতর তাকিয়ে দেখে পরীর মতো সুন্দর ফুটফুটে দুটো বাচ্চা । মনে হচ্ছে মানুষ না এরা। কোনো রূপকথার গল্পের সেই স্নো হোয়াইট এঞ্জেল।
সাদেক খান অপলক হয়ে বাচ্চা দুটোর দিকে তাকিয়ে আছে।
দৃষ্টিটা এতো বেশি কেড়ে নিয়েছে যে বাচ্চাদুটোর মোহে পড়ে গেলো।
-তোমাদের ম্যাডামকে ডেকে আনো এখানে, যাও তো।

ড্রাইভার গিয়ে বনিতা বেগমকে ডেকে আনলো।
বনিতা বেগম বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাদেক খানের কাছে এসে বাচ্চা দুটোকে দেখতে পায়।
উনিতো নিমেষেই এই বাচ্চাদুটোর মায়ায় পড়ে গেলো। পরীর বর্ণনাময় এতো সুন্দর বাচ্চা দুটো দেখে যেনো লোভে পড়ে গেলো এদের।

ঘুমের মাঝে হঠাৎ গালে কারো শীতল স্পর্শ অনুভব করতে পেরে, মিশান ভাবলো মা ফিরে এসেছে হয়তো,চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে সামনে তিনজন মানুষ, একজন মহিলা দু জন পুরুষ।
মিশান এদের দেখে অনেকটা ঘাবড়ে গেলো।
বনিতা বেগম মিশানের গাল ছুঁয়ে মিষ্টি ভাষায় জিজ্ঞেস করলো,
-মা তোমার নাম কি?

মিশান ভয়ার্ত দৃষ্টিতে উনাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।বনিতা বেগমের ভাষা বুঝতে পারছে না মিশান।
উনাদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।
মিশানের কোলে ছোট্ট নিশানকে দেখতে পেয়ে বনিতা বেগম মিশানের বেবি ক্যারিয়ারের থেকে নিশানকে বের নিতে চাইলে মিশান নিশানকে আঁকড়ে ধরে।

শুকনো মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় চিকন স্বরে বললো,
-মেরা বেহেন কো মাত লো।
আপ লোগ কন হো?
ম্যে কাহাপে হো?অর মেরি মাম্মা পাপা কাহাপে?কিয়া আপলোগ জানতি হ্যে মেরি মাম্মা কাহা গায়্যি?
মিশানের ভাষা শুনে বনিতা বেগম সাদেক খান উভয় ই অবাক হলো, এই বাচ্চা বাংলাদেশি না, কিন্তু এরা উনার গাড়ির ডিকিতে এলো কিভাবে? সেটা দুজনের একজনের মাথাতেও আসছে না।
উনারা ভাবলো হয়তো হিন্দুস্তানের হবে মিশান, তাই সাদেক খান মিশানকে আদর করে হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো
-বেটা ডরাও মাত।
তোমহারা নাম কিয়া হ্যে?
-মেরা নাম মিশান খান,অর ইয়ে মেরি বেহেন, নিশান খান।
-তোমহারা ঘার কাহা বেটা?
মিশান বলতে যাবে তার আগেই মনে পড়লো,মা বলে দিয়েছিলো পরিস্থিতি যেমন ই হোক তার অনুপস্থিতিতে যেনো মিশান ওর বাড়ি কোথায় সেটা না বলে কাউকে।
কাঁদোকাঁদো কন্ঠে মিশান উত্তর দিলো,
-মুঝে ইয়াদ নেহি হ্যে!কিয়া আপলোগ জানতি হ্যে মেরি মাম্মা পাপা কাহাপে?মুঝে মাম্মা কি পাস যানা হ্যে।
-বেটা রো মাত।মেইনে তোমকো লে যাওংগি তোমহারা মাম্মাকি পাস।
তাব তাক তোম হামারী সাথ রেহনা। তোমহারা মাম্মানে কাহা কি তুমকো মেরি পাছ রাখনে।
-কিয়া মাম্মা নে সাচমোচ আপকো বোলা, আপলোগও কি সাথ রেহনে কে লিয়ে?
-হা বেটা?
-কিয়া আপ মেরি মাম্মাছে মুঝে বাত করা সাঁকতি হ্যে?
-বেটা তোমহারা মাম্মা এক কামপে গায়া।উসকি আনে মে থোরা ওয়াক্ত লাগেগী।তাব তাক তোম হামারা সাথ রেহ্ যাও বেটা।

মিশান চুপ করে রইলো।
বনিতা বেগম নিশানকে কোলে তুলে নিলো,আর সাদেক খান মিশানকে কোলে তুলে নিলো।
দ্বীপ সেই সময় ঘুমে, বাবা নেই বলে সেই সুযোগে ঘুমাচ্ছে,বাবা থাকলেই ভোরে উঠতে হয়।
দ্বীপ মিশানের থেকে দু মাসের বড় হবে।আর তাপসিন তখন পেটেও আসে নি।
সাদেক খানের ব্যাগের সাথে মিশানের সাথে একটা বড় স্কুল ব্যাগ ছিলো। ব্যাগের চেইন খোলা দেখে ব্যাগের বাইরে যা যা পড়েছিলো তা ব্যাগে ভরে ড্রাইভার চেইন লাগিয়ে সব গুলো ব্যাগ ভেতরে নিয়ে গেলো।

একটা ব্যাগ বেশি দেখার পর সাদেক খান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
-এই ব্যাগ কার?
-আপনার না স্যার এটা?
-না তো?
-ডিকিতেই তো ছিলো আপনার ব্যাগের সাথে।

সাদেক খান মিশানকে জিজ্ঞেস করলো,
-বেটা কিয়া ইয়ে ব্যাগ তোমহারা?
মিশান ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে দেখে বললো,
-নেহি, ইয়ে মেরি মাম্মা কা।
সাদেক খান বুঝতে পারলো ব্যাগটা ওর সাথেই পাঠানো হয়েছে।
আগ্রহ নিয়ে ব্যাগ খুলে ভেতরে দেখে, অনেক গুলো টাকার বান্ডিল, যেগুলো বাংলাদেশি না, পাকিস্তানি। আর অনেক গুলো সোনার গহনা। ওগুলোর সাথে একটা চিঠি দেখতে পেলো।
চিঠিতে ইংরেজীতে লিখা
“প্রিয় সহৃদয়বান ভাই/বোন,আসসালামু আলাইকুম।
জানি না আপনি কে,কোথায় থাকেন, কি করেন । চিঠিটা যেহেতু আপনার হাতে সেহেতু আশা করছি
আমার দুই মেয়ে হয়তো এখন আপনার কাছে।
ব্যাগটা আমার দু মেয়ের সাথেই দিয়ে দিয়েছি। আপনার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, আমার মেয়ে দুটোকে দেখে শুনে রাখবেন দয়া করে।
ব্যাগের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা ও গহনা আছে, যা দিয়ে বেশ কয়েক বছর আমার দু মেয়ের ভরণ পোষণ অনেক ভালো মতো চলে যাবে।এবং আপনিও এখান থেকে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবেন।শুধু আমার মেয়ে দুটোকে আমানত রাখুন।আল্লাহ যদি বাঁচিয়ে রাখে আমি ফিরে এসে আমার দুই মেয়েকে নিয়ে যাবো, এবং আপনার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার ঋণ পরিশোধ করে যাবো।
আর যদি আমার ফেরা না হয়, তবে কষ্ট করে আমার মেয়ে দুটোকে এমন ভাবে লালন পালন করবেন যেনো ওরা বড় হয়ে আপনার ঋণ শোধ করতে পারে।
আমার ছোটো মেয়ে বড় হয়ে কেমন হবে জানি না,তবে বড় মেয়ে মিশান খুব ভালো ও শান্ত। ও একটু আবেগী তবে কাদার মতো, যেভাবে গড়ে তুলবেন যা বলবেন তাই ই করবে, আমার মেয়েটা ভীষণ লক্ষ্মী।
আপনার কাছে আমার অনুরোধ আমার মেয়ে দুটোকে পথে ফেলে দেবেন না, ওদের সুশিক্ষা দিয়ে বড় করবেন যেনো ভবিষ্যতে আপনার লাঠি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আমার মেয়ে দুটোকে বাঁচানোর জন্য আজকে এভাবে আমার কলিজার টুকরা মেয়ে দুটোকে এভাবে অচেনাতে ঠেলে দিতে হলো, জানি না ওদের আবার কিভাবে খুঁজে পাবো। মেয়ে দুটোর ভীষণ বিপদ, মায়ের মন তো, তাই নিজের চোখে নিজের মেয়েদের মৃত্যু দেখতে পারবো না,এতো ধন সম্পদ দিয়ে কি করবো যদি আমার উত্তরাধিকারীই না থাকে।
সেজন্য আমার এ পথ বেছে নেয়া ।

আমার কলিজা দুটোকে আমানত রাখার জন্য আমি আজীবন আপনার কাছে ঋণী ও কৃতজ্ঞ থাকবো।দোয়া করি আল্লাহ আপনার ও আপনার পরিবারের মঙ্গল করুক।”

চিঠিটা পড়ে সাদেক খান সাহেবের বুঝার বাকি রইলো না কিছু।
মিশানের মা জানেও না মিশান এখন কোথায়, বিপদে পড়েই এভাবে মেয়ে দুটোকে অচেনাতে ঠেলে দিয়েছে।কিন্তু সবার মনে প্রশ্ন একটাই জাগছে বাংলাদেশে কি করে এলো।
আর মিশান কোন শহরের সেটাও ওর মা চিঠিতে উল্লেখ করে নি।

বনিতা বেগম মিশান নিশানকে সাদরে নিজের কাছে বরণ করে নিলেন।
সাদেক সাহেব তখন মিশানকে এটা বলে শান্তনা দিলো উনি মিশানের মায়ের ভাই, মানে মিশানের মামা।আলাদা দেশে থাকার কারণে আগে কখনো দেখা হয় নি, সেই সময়ের জন্য মিশান সবটা বিশ্বাস করে নেয়।
বনিতা বেগম সাদেক সাহেবকে শপিংয়ে পাঠায় মিশান নিশানের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনা কাটা করে আনার জন্য।
দ্বীপ যখন ঘুম থেকে উঠে মিশান নিশানকে দেখে এটা ভেবে খুশি হয়, ও খেলার সাথী পেয়েছে।

বনিতা বেগম মনে মনে মিশানের মায়ের কাছে কৃতজ্ঞ হলো, আর আল্লাহর কাছে প্রশংসা আদায় করল, এতো সুন্দর ফুটফুটে দুটো মেয়ে উপহার দেয়ার জন্য।
দুজনকেই উনি কোলে পিঠে নিজের মেয়ের মতো আদর যত্ন করে।
মিশান সব সময় মন খারাপ করে থাকতো, ওর চেহারা দেখেই বুঝা যেতো ও কারো জন্য অপেক্ষা করছে।
সব সময় বাড়ির ছাদে গিয়ে, বারান্দায় গিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখতো মা বাবা আসছে কিনা।

মিশানের দিন যাচ্ছিলো এভাবেই, মায়ের জন্য অপেক্ষা করে।
বাড়ির প্রত্যেকে সব সময় চেষ্টা করতো মিশানকে খুশি রাখার।মামা যখন এটা সেটা এনে দিতো মিশান শুধু বলতো ওকে এতো কিছু দেয়ার দরকার নেই,শুধু নিশানকে দিলেই হবে।
যদি মিশানকে জিজ্ঞেস করতো ওর কিছু চায় কিনা, মিশান উল্টো প্রশ্ন ছুড়তো ওর মা বাবা কবে আসবে।

আস্তে আস্তে মিশানের বাংলা শেখাও শুরু হয়, সবাই মিলে একটু একটু করে মিশানকে বাংলা শেখায়,একজন টিচারও রেখে দেয় মিশানকে বাংলা শেখানোর জন্য।
কয়েক মাসেই মিশান বেশ ভালোমতো বাংলা ধরতে পারে।
বয়স ছয় হতেই দ্বীপ মিশানকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়।

দিন যত যাচ্ছিলো মা বাবার জন্য অপেক্ষা করা ততোই ক্লান্তিকর হচ্ছিলো, আস্তে আস্তে বড় হয় মিশান বাস্তবটা বুঝতে পারে,একটা সময় অপেক্ষা ছেড়ে দেয়, বুঝতে পারে মা বাবা আসবে না, ওদের সাথে দেখা করতে।

নিশানকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে হবে। মামা মামী যখন যা বলতো মিশান তাই ই করতো, ক্লাসে কখনো ফার্স্ট থেকে সেকেন্ড হতো না।
কিন্তু এসবের মধ্যেও মিশান কখনো বাবা মায়ের জন্য কাঁদে নি,ও অনেক বেশি শান্ত ছিলো,সব কষ্ট ভেতরে জমা রাখতে রাখতে মস্তিষ্কে এক প্রকার হ্যালুসিনেশন ক্রিয়েট হয়। যা মিশানকে রাতে ঘুমাতে দিতো না শান্তি মতো। ছোটো বেলতে এটা তেমন প্রখর ছিলো না। কিন্তু নিশান মারা যাওয়ার বছর খানেক আগে থেকে এটা বাড়তে থাকে, আর নিশান মারা যাওয়ার পর এটা প্রকট আকার ধারণ করে।

সব থেকেও যেনো শুন্য মিশানের জীবন। যদিও মামী এতোটা আদর দিয়েছে সেটা মায়ের থেকে কোথাও কম না, দুধের শিশু নিশানকে যেভাবে আগলে বড় করেছে সেটা বনিতা বেগমের জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো সম্ভব ছিলো না।
পরিচয় বিহীন দুটো মেয়েকে এভাবে আগলে যত্ন করে লালন পালন করা চাট্টি খানি কথা না।

তাদের এই বিনয়ী দেখে মিশান কখনো তাদের কথার অবাধ্য হতো না, কষ্ট পাবে এমন কিছু করতো না।
শেষ সময়ে এতো ঝড় নিতে না পেরে মিশান এভাবে মদের দিকে হেলে পড়েছে।যদি নিশান সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতো তাহলে হয়তো কখনোই মিশান এ পথে হাঁটতো না।
মা বাবাকে ভুলে থাকতে পারলেও নিশানকে ভুলে থাকতে পারে না।বাবা মায়ের থেকে বেশি সময় নিশানের সাথেই কাটানো হয়েছে বলে হয়তো।

অতীতের কিছু অংশ মনে করিয়ে দেয়ায় মিশানের খুব কষ্ট হচ্ছে , বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে নিবে তখন আবার ঘুরে এলো।তীব্রর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
-স্যার!
-বলো,
-পিস্তলের বুলেট শেষ।
তীব্র চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বললো,
-ফুল লোড করে পিস্তলটা দিয়েছিলাম,
তুমি কি পিস্তল ফুল লোড অবস্থায় পাও নি?
-জি স্যার,আমি সে রাতেই চেক দিয়ে দেখেছিলাম ফুল লোড ই ছিলো।আপনি ওটা রেখে যাওয়ার পর কেউ হাত লাগাই নি আমিই নিয়েছিলাম।
-এতো গুলো বুলেট কি গিলে খেয়েছো?
-বুঝতে পারছি না, কিভাবে কিভাবে যেনো শেষ হয়ে গেলো।
– আরেকটা পিস্তল?
-ওটা তো আপনার কাছে, সেদিন রাতে ধরা খাওয়ার পর আপনিই নিয়ে নিয়েছিলেন।
-ওহ,মনে নেই।ওটা এসবিতে আছে। এক এএসপির কাছে।
-এখন কি করবো তাহলে স্যার?বুলেট শেষ তো।
– ফালতু খরচের টাকা নেই আমার, টাকা হলে পেয়ে যাবে।

মিশান চোখ রাঙিয়ে বললো,
-হাড়কিপ্টে ফকির কোথাকার!পুলিশের চাকরি ছেড়ে টিএসসি তে ঝালমুড়ি বেচেন গিয়ে,অনেক ভালো ইনকাম হবে।
-তোর কাছে শুনে শুনে কাজ করতে হবে?এ মাসে কত খরচ হয়েছে তোর পেছনে আইডিয়া আছে? তোর বাবা না সাইন্টিস্ট যা বাপের কাছে যাহ।

মিশান সন্দেহদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-আমার বাবা সাইন্টিস্ট আপনি কি করে জানলেন?
তীব্র জিজ্ঞসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-তোর বাবা সাইন্টিস্ট?
মিশান উত্তর না দিয়ে চুপ হয়ে গেলো,বুঝার বাকি রইলো না তীব্র আন্দাজি ঢিল ছুড়েছে। তীব্রর এরকম ফাঁদে আগেও পড়েছে। তর্কাতর্কি না করে চলে গেলো।

আজকে মিশানের বাজার করার ডেট,সেজন্য এখান থেকে সোজা বাজারে গেলো।
তীব্র বিছানা ছেড়ে উঠে শার্ট আর জ্যাকেট পড়ে নিলো ।
ওয়ালেট মোবাইল গাড়ির চাবি একসাথে থাকার কারণে সব একসাথে জ্যাকেটের পকেটে ভরতে ভরতে বেরিয়ে গেলো।
চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে, দাড়ি গুলোও বড় হয়েছে , তীব্র নিজের প্রতি এতোটা অগোছালো যে ও কবে আয়নার সামনে গিয়েছিলো নিজেরও খেয়াল নেই।নিজেকে ওর একদম পছন্দ না, কিন্তু জীবনকে ভালোবাসতে চায়।
নিজের ঘরে কোনো আয়না নেই, কখনো কোনো আয়নার সামনে দাঁড়ায় না।
নিজের প্রতি এতোটা বিরক্ত ভুল করেও যদি কোনো আয়নাতে নিজেকে দেখে সে আয়না আর আস্ত থাকে না।যেমনটা বেশ কিছুদিন আগে হয়েছিলো মিশানের ফোনের সাথে।

তীব্র বাড়ি যাওয়ার পর তৃপ্তি তীব্রর মুখের দিকে কেমন দৃষ্টিতে যেনো তাকিয়ে আছে।
-এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো?চিড়িয়াখানা থেকে এসেছি?
-ভাইয়া! তুমি কোথা থেকে এলে সেটা জানা নেই কিন্তু!
-কি কিন্তু?
-তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ তোমাকে ইচ্ছে মতো পিটিয়েছে, সত্যি সত্যি মার খেয়ে আসো নি তো?কোনো ভাবে পাবলিকের হাতে?
দেখি তো দেখি গায়ে কেমন চোট লেগেছে?
-আরে যাও তো, ঘুম থেকে উঠে এসেছি ওমনিই, হাত মুখও ধুই নি।
-ওমহু,শুধু হাত মুখ না ধোয়ার জন্য এমন চেহার হয় না কারো, কাহিনী একটা আছেই,শরীর দেখাও।
-ওয়েট দেখাচ্ছি।কিন্তু শর্ত আছে,
-কি শর্ত?
-গায়ে যদি কোনো মারের দাগ না থাকে আমার শার্ট আর জ্যাকেট টা তুমি ধুয়ে দেবে। এটা তোমার শাস্তি হবে, আমাকে মিথ্যে অপবাদ দেয়ার জন্য।
-ওকে ডান।

তীব্র গায়ে থেকে শার্ট আর জ্যাকেট খুলে ফেললো তৃপ্তি পরোখ করে তীব্রর চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছে।গায়ে কোনো দাগ নেই।মায়ের কাছে শুনেছে তীব্র প্রায় ই রাতে বাড়ি ফিরে না, কোনো ডিউটি না থাকা সত্ত্বেও। তাই তৃপ্তির মনে সন্দেহ জাগে ভাইয়ের ক্যারেকটারে কোনো সমস্যা দিলো কিনা, হতে পারে রাতে মেয়েদের নেশায় মগ্ন থাকে ।
তৃপ্তির ধারণা ছিলো তীব্র যদি রাতে মেয়েদের সাথে থাকে তবে প্রমাণ স্বরূপ গায়ে দাগ থাকবে ।
কিন্তু সন্দেহ ভুল প্রমাণিত হলো।
তৃপ্তি হাত বাড়িয়ে বললো,
-দাও জামা দুটো দাও এখনি ধুয়ে দিচ্ছি।
তীব্র বাঁকা হাসি দিয়ে বললো,
-দাদার কথা বাসী হলে ফলে তাই না?
-দাদারাও যে মহাপুরুষ সেরকমটা না, সব সময় যা বলবে তাই ই ঠিক, তা তো হবে না। আগের দাদা আর বর্তমানের দাদাদের মাঝে আকাশ পাতাল তফাৎ, এখনকার দাদাদের মধ্যে ফরমালিনে ভরা।
-প্যাক প্যাক না করে ভালোমতো জামা দুটো ধুয়ে আয়রন করে রেখো।নিজের হাতে ধুবে, ভুলেও কাজের লোক ইউজ করবে না।
-ওকে ওকে।
তৃপ্তি জামা দুটো নিয়ে যেতে লাগলো। তীব্র নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে।

তৃপ্তি জ্যাকেটের এক সাইড একটু ভারী ভারী ফিল করলো, পকেটে হাত দিয়ে দেখে তীব্রর ওয়ালেট মোবাইল, বের করতে করতে তীব্রকে পেছন থেকে বললো,
-বাহ ভাইয়া নতুন ফোন নিলে কবে?বেশ সুন্দর তো! দাম কত পড়লো?

তীব্র একটু প্রশ্নবিদ্ধ হলো,
-নতুন ফোন কোথা থেকে এলো আবার?(মনে মনে)
পেছনে ঘুরতে ঘুরতেই তৃপ্তি মোবাইলের সাইড বাটনে ক্লিক করতেই লক স্ক্রিনে একটা মেয়ের ছবি ভেসে উঠে,তীব্রর শেষ রক্ষা হলো না!তীব্র তৃপ্তির হাতে মিশানের ফোন দেখতে পেলো।
-এটা কার ছবি লক স্ক্রিনে ওয়ালপেপার দিয়েছো ভাইয়া?বেশ সুন্দর তো,আমার জানা মতে এরকম তো কোনো নায়িকা নেই।কিন্তু তুমি তো কোনো মেয়ের ছবি ওয়ালে তো দূর গ্যালারীতের রাখার কথা না।কে এটা ভাইয়া?

দাঁতে দাঁত চেপে তীব্র মনে মনে বললো,
-মিশান! সেন্টিখোর, মাতাল!ফোন এক্সচেঞ্জ করলো কখন!আমিই বা কেমন এটা খেয়াল করি নি!এখন কি উত্তর দেবো!তৃপ্তি আবার মাকে ডেকে বলে দেবে নাতো!

চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here