তেজস্ক্রিয়_রক্তধ্বনি,পর্ব_২৫

0
1147

তেজস্ক্রিয়_রক্তধ্বনি,পর্ব_২৫
লেখিকা_রিয়া_খান

তীব্র হন্তদন্ত করে তৃপ্তির কাছে গিয়ে ওর হাত থেকে মোবাইল টা নিয়ে নেয়।তৃপ্তির মনে সন্দেহ জেগে উঠে, চোখে সন্দেহ নিয়ে তীব্রকে প্রশ্ন করে,
-কি হলো এভাবে ফোনটা নিলে কেনো?মেয়েটা কে বলছো না কেনো?
তীব্র দাঁত চেপে রাগ দেখিয়ে বললো,
-কারো পারসোনাল জিনিসে পারমিশন ছাড়া হাত দিতে নেই। মানলাম পকেটে ভুলে রেখে চলে যাচ্ছিলাম, তুমি এটা দেখতে পেয়ে বের করেছো, এই অব্ধি ঠিক আছে। কিন্তু ফোন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে যাচাই করা ফোন নতুন না পুরাতন, আবার সাইড বাটন ক্লিক করে ভেতরের কি আছে সেটা দেখা,এই দুটো কাজ দণ্ডনীয় অপরাধ।
তুমি ভদ্র মেয়ে হয়েও এমন আতেলের মতো কাজ করলে!

তৃপ্তি কোমরে হাত রেখে ঝগড়াটে স্বরে বললো,
-এতো কিছু আমি জানি না বুঝি না, কে এই মেয়ে এটা বলো? আমাদের থেকে লুকাচ্ছো কেনো?তোমার কি লুকানোর বয়স আছে? বাবা মা কি কেউ বলেছে তোমার পছন্দের কাউকে মানবে না?
-আরে আশ্চর্য! কি ধাচের কথা এগুলো?বিন্দুকে সিন্ধু, সিন্ধুকে গুহা বানানো তোমাদের নারী জাতির স্বভাব।স্বাভাবিক জিনিসকে স্বাভাবিক নিতে পারো না?
-ঠিক আছে তাই ই। এখন বলো এই মেয়ে কে?
তীব্র উচ্চস্বরে বললো,
-কিসের মেয়ে! এটা আমার ছবি,ফেস অ্যাপ দিয়ে মেয়ে বানিয়ে রেখেছি।
-ও তাহলে এটা বলো, তোমার নাক তো হুকড নাক, বাজ পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকানো, কিন্তু এই মেয়ের নাক তো সোজা লম্বা।এটা তো আমি মেনে নিতে পারছি না।

-এইটুকু সময়ে এতো কিছু খেয়াল করে ফেলেছে, মহা মুশকিলে পড়লাম তো!(মনে মনে)
-তোমার সমস্যা কোথায় তৃপ্তি? মোবাইল দিয়ে এখন কতকিছু করা যায় ধারণা আছে তোমার? তুমিও তো আমার বোন হয়ে বোঁচা, এটা কি আমি মেনে নেই নি?
-তোমার মত নাক হয়নি বলে খোঁটা দিলে?দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা।মা…..মা…
জোড়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মাকে ডাকতে লাগলো।
-সৃষ্টিকর্তা যখন কোনো ছেলের উপর নারাজ হন তখন তাঁর জীবনে এরকম একটা বোন পাঠায়।

বিড়বিড় করে কথাটা বলে তীব্র নিজের ঘরে ঢুকে গেলো,তৃপ্তি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাকে ডেকেই যাচ্ছে।

তীব্র মোবাইলের সাইড বাটনে ক্লিক করতেই লক স্ক্রিনে ভেসে উঠে ছবিটা, তীব্র ভেবেছিলো মিশানের ছবি ওয়ালে দেয়া, কিন্তু এটা নিশানের ছবি।
কি ছেড়ে কি ভেবেছিলো! ছবিটার দিকে তীব্র পলকবিহীন তাকিয়ে রইলো, মেয়েটা মরে গেছে সেই কবে।মৃত মানুষের ছবি দেখলে কম বেশি একটু হলেও বুক কাঁপে।
এরকম একটা জীবন্ত ছবি দেখলে তো কথায় নেই।
নিশানের মৃত্যুর সেই দৃশ্যটা মনে পড়ে গেলো, কতোটা নির্মম মৃত্যু ছিলো। নিশানকে হসপিটালে নেয়ার পর ওকে আর দেখা হয় নি,নিশানের লাশ দেখার মতো সাহস বা শক্তি কোনোটাই তীব্রর মধ্যে আসছিলো না। নিশান মারা যাওয়ার পর আজ মিশানের মোবাইলে ওর ছবি দেখা হলো।

স্ক্রিন অফ করে তীব্র ড্রয়ার থেকে আরেকটা ফোন বের করে, ওর ফোনে কল করলো।
মিশান তখন সবজির বাজারে সবজি হাতিয়ে হাতিয়ে দেখছে কিনছে আর ব্যাগে ভরছে ।
এমন সময় ফোন বেজে উঠে, পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করে কানে নেয়, একটা বারও খেয়াল করলো না এটা ওর ফোন না, এমনকি নাম্বারটা কার সেটাও দেখলো না।
-হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।
-কোথায় তুই?
-বাজারে।
-তুই আমার মোবাইল নিয়ে চলে গেছিস কেনো?ইচ্ছে করে এমন করেছিস তাই না? ফোনের ভেতর কিচ্ছু পাবি তো দূর ওটার লক ই তো খুলতে পারবি না।

মিশান ধমকের স্বরে বললো,
-আরে কি বলছেন!আপনার ফোন আমি নেবো কেনো?
-ওরে মাতালকানা ভালোমতো তাকিয়ে দেখ, যেটা দিয়ে কথা বলছিস ওটা আমার ফোন, তোর মোবাইল আমার কাছে।

মিশান একটু অবাক হয়ে কান থেকে ফোন সরিয়ে চোখের সামনে এনে দেখে এটা ওর ফোন না, তীব্রর ফোন।
-এতো বড় ভুল করলাম কি করে আমি?

একটু ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে খেয়াল করলো, লাস্টে যে তীব্রকে রাগ দেখিয়ে মিশান বের হচ্ছিলো তখনি ভুলে তালে তালে নিজের ফোনের জায়গায় তীব্রর ফোন পকেটে ভরলো।
-স্যার আপনার হোম এড্রেস টা দিন, আমি বাজার করা হয়ে গেলে , মোবাইলটা আপনাকে দিয়ে আসি।
-মদ খাস তুই, মাতাল কি আমি?
যেখানে আছিস সেখানেই থাক।আমি রহমানকে পাঠাচ্ছি ওর কাছে ফোনটা দিয়ে দে।
-আর স্যার আমার ফোনটাও দিয়ে দিয়েন, হ্যান্ড টু হ্যান্ড!
-তোর সাহস তো কম না,আমার সাথে ডিল করিস!তুই জানিস তোর একটা ভুলের জন্য আমি কতবড় সমস্যাই পড়ে গেছি?সামনে পেলে রে সেন্টি তোকে, কি যে করতাম সেটা কেবল আমিই জানি।
-আপনি আমার ব আকার ল টা ফালাইতেন।

মিশান ফোন কেটে দিয়ে পকেটে ভরে রেখে ওর কাজে মন দিলো।
তীব্র রহমানকে পাঠিয়ে দেয় মিশানের থেকে মোবাইল এক্সচেঞ্জ করার জন্য।
রহমান এসে মোবাইল বদলে দিয়ে যায়।

বেশ কিছুদিন চলে যায় মিশানের সাথে তীব্রর দেখা হয় না।
দুজন দুজনের পথে।
কিন্তু সেদিন তৃপ্তি মাকে গিয়ে কি বুঝিয়েছে কে জানে, তারপর থেকে বাড়ির সবাই তীব্রর দিকে কেমন নজরে যেনো তাকিয়ে থাকে।তীব্র বুঝতে পারে এদের মনে কি চলছে। বাড়ির লোকও কিছু বলছে না হাতে নাতে প্রমাণ নেই বলে।
তীব্রর লেভেলের পুরুষরা কম বেশি ক্যারেকটারলেস হয়, সেটা ভেবেই ওকে সন্দেহের নজরে দেখা হচ্ছে।যদি তীব্রর ক্যারেকটার খারাপ পায় বাড়ির লোক, তাহলে এটা তাঁরা স্বাভাবিক ভাবে নিবেন না।
তীব্রর বাবা একজন সৎ পুলিশ অফিসার ছিলেন, চাকরিজীবনে উনি কোনো অসামাজিক অবৈধ কাজ করেন নি।
তাঁর ছেলে হয়ে যদি ক্যারেকটার খারাপ বের হয় তাহলে সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না।

তীব্রকে এরকম প্রখর ভাবে সন্দেহ করার কারণ, ম্যাক্সিমাম টাইম তীব্র শেষ রাতে বাড়ি ফিরে, কিছু কিছু রাতে ফিরেও না। কিন্তু তীব্র তো কাজের জন্য বাইরে থাকে, সেটা ওর পরিবারকে কে বুঝাবে!

তীব্র কখন কি করে সেটার ১০০% কেউ জানে না। একমাত্র আব্দুর রহমানই ওর কাজকর্মের ৬০% জানে।
আব্দুর রহমান অনেকটা বিশ্বস্ত। বডিগার্ড দুদিন পর পর চেঞ্জ করলেও আব্দুর রহমানকে চেঞ্জ করে নি। বিশ্বস্ত হলেও পুরোপুরি ভরসা , বিশ্বাস কখনোই করে না তীব্র।
ও সবাইকেই সন্দেহের নজরে দেখে।তীব্র ভালোমতোই জানে আব্দুর রহমান চাইলেও কখনো ওর সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করতে পারবে না। তীব্র যাদের নিজের হাতে রাখে তাদের প্রত্যেককে।
সিক্রেট ব্ল্যাকমেইল করে রাখে, সোজা পথে কাউকেই সে বেছে নেয় না। যেনো কোনোভাবেই কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করতে না পারে, ভুল করেও বিশ্বাসঘাতকত করলে পরিণতি একটাই সেটা হলো মৃত্যু।
সেজন্যই ওর এই পন্থা অবলম্বন করা,তীব্রর মতে এটা একটা কার্যকরী পন্থা ।

দুপুর থেকে কেমন যেনো অস্থির অস্থির লাগছে বলে বিকেলের দিকে তীব্র বাড়ি ফিরে যায়,
-স্যার আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?ডক্টরের কাছে যাই চলুন, গাড়ি পুলিশ হসপিটালের দিকে নেবো?
তীব্রর বডি গার্ড জুয়েল তীব্রর উদ্দেশ্যে পেছনে ঘুরে বললো কথাটা, প্রতিউত্তরে তীব্র বললো,
-দরকার নেই,ড্রাইভারকে গাড়ি বাড়িতে নিতে বলো ।
-কিন্তু স্যার!
তীব্র বিরক্তি দেখিয়ে বললো,
-তুমি কি আমার থেকে বেশি বুঝো?রোগী তুমি না আমি?
-স সরি স্যার!
বাড়ির কাছাকাছি যেতেই তীব্র গাড়ি থামাতে বলে গাড়ি থেকে নেমে যায়।
জুয়েলও সাথে নেমে আসতে চাইলে তীব্র বারণ করে।

ও হেঁটে হেঁটে বাড়িতে যায়, রহমান গাড়ি নিয়ে তীব্রর পেছন পেছন যায়।
জুয়েল মনে প্রশ্ন নিয়ে রহমানকে জিজ্ঞেস করে,
-ভাই স্যার সবসময় এরকম খিটখিটে মেজাজে থাকে কেনো?ভালো কথাতেও চেতে খালি।
-উনি এমনই, দেখেন না আমি কথা বলি না বেশি, শুধু জিজ্ঞেস করি কোন দিকে নেবো গাড়ি,আর স্যার কিছু বললে হ্যাঁ না তে উত্তর দেই।আপনিও একই কাজ করবেন, স্যার বেশি কথা বলা পছন্দ করেন না।যে বেশি কথা বলে তাকেই আউট করে দেয়। আমার মতো চুপচাপ নিরব দর্শক হয়ে থাকবেন তাহলে দেখবেন অল ইজ ওয়েল!
-স্যারের হার্টে ভালোরকম সমস্যা, ডক্টর দেখাচ্ছে না কেনো?
-প্রথমত স্যার কোনো কিছু হলে পুলিশ হসপিটাল ছাড়া অন্য কোথাও ডক্টর দেখায় না।আর উনার এই রোগের চিকিৎসা এখনো পুলিশ হসপিটালে আসে নি। স্যার একমাত্র ইন্ডিয়াতে দেখান।বেঙ্গালুরের টপ কার্ডিয়াক সার্জন ডক্টর দেবি প্রসাদ শেঠি।
স্যারের চিকিৎসা শুরু থেকেই উনি করে আসছেন।
-ওহ! স্যারের সমস্যা টা কি অনেক বছরের?
-না, তবে প্রায় দু বছরের মতো হয়ে আসে,কয়েকটা বুলেট লেগেছিলো বুকে সেখান থেকেই স্যারের হার্টের বিপর্যয় শুরু হয়। মারাত্মক ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপা আর ডক্টর দেবি প্রসাদ শেঠির জন্যই স্যার সুস্থতার মুখ দেখে।সবাই স্যারের আশা ছেড়েই দিয়েছিলো।উনার হার্ট চলাচল বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো, উনার প্রাণ ফিরেছে মেডিকেল মিরাকলের মতো।
-পুলিশ, র‍্যাব, সেনাবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস। এসব ডিফেন্সের কর্মীদের জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়েই মাঠে নামতে হয়।কিছু মানুষের নিমক হারামীপনা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য এই পেশা গুলোর বদনাম হচ্ছে। তাদের পাপাচারের জন্য সত্যিকারের ত্যাগী নিষ্ঠ মানুষদের কর্মের গুঞ্জন চাপা পড়ে থাকে।
-হুম।
-স্যার কি হেঁটেই বাড়ি অব্ধি যাবে?
-হ্যাঁ, হার্টে ব্যাথা অনুভূত হলে হাঁটাহাঁটি করলে নাকি ব্যাথা কমে যায় স্যারের।
-ও আচ্ছা।

তীব্র হেঁটেই বাড়িতে যায়।
বাড়ির ভেতরে গিয়ে নিজের ঘরে গেলো না, ড্রয়িংরুমেই বসে পড়লো। বাড়িতে কাজের লোক আর মা ছাড়া কেউ নেই।
-আজকে হঠাৎ এতো আগে বাড়ি এলি বাবু,কোনো দরকারে এসেছিস?

তীব্র কিঞ্চিৎ অস্থিরতার সাথে উত্তর দিলো,
-নাহ,আজ আর বের হবো নাহ।
-শরীর খারাপ লাগছে বাবু?
-নাহ,পানি পিপাসা পেয়েছে, এক জগ নরমাল পানি আনতে বলো।
তীব্রর মা নিজেই গিয়ে পানি এনে দিলো, তীব্র একটু একটু করে অনেকটুকু পানি খেয়ে নিলো।
-তোর না ডক্টর দেখানোর ডেট ছিলো। এখনো যাচ্ছিস না কেনো?
-যাবো দু একের মধ্যে। কাজ আছে কিছু, শেষ দিয়েই যাবো।
-মানুষ নিজের প্রতি এতোটা অযত্নশীল কি করে হয় কে জানে! যদি বেঁচেই না থাকিস তাহলে কাজ করবি কি করে?দিন নেই রাত নেই শুধু ছুটাছুটি করতে দাও,পুলিশের চাকরী মানুষ আর করে না। তোর বাবাও তো চাকরি করেছে, তোর থেকে বড় পোস্টেই ছিলো, বিয়েও করেছিলো অনেক আগে, কই তাকে তো এতো ব্যস্ত দেখি নি? তুই তো বিয়েও করিস নি, অথচ তোর বাবা যখন তোর সমান পোস্টে ছিলো তখন তোর বয়স ছয় বছর।
-ওমহু,আমি যখন হই তখন ই তো বাবার প্রমোশন হয়।বাবা তখন এসপি থাকে না, মনে করে দেখো।
তোমার হিসেব ভুল আছে, বাবাও অনেক দেরিতে বিয়ে করেছিলো।
-আমাদের বিয়ের সময় কি তুই ছিলিস?আমাদের থেকে তুই জানিস বেশি?
বিয়ের সাড়ে সাত বছর পর তুই জন্মেছিস।

বিরক্তিকর ভাবে তীব্র বলে উঠে,
– একটু চুপ থাকবে?আমার অস্থির লাগছে। নিশ্বাস নিতে দাও,কথা বলতে গেলে নিশ্বাস নেয়া হচ্ছে না ঠিক মতো।
-ওষুধ খেয়েছিস?
-হুম।
-কিছু শুকনো খাবার দেবো?
-কিছু দরকার হলে বলে নেবো।তুমি এখান থেকে যাও প্লিজ!

তীব্রর মা সরে গেলো। তীব্র সোফায় হেলান দিয়ে মাথা উপুড় দিক করে চোখ বন্ধ করে পায়ের উপর পা তুলে নিরব হয়ে বসে রইলো।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই ঝিম ধরে বসে রইলো। এরমধ্যে খেয়াল করলো, তৃপ্তির বা ওর বাচ্চাকাচ্চা কারোর ই কোনো শব্দ পাচ্ছে না।হয়তো চলে গেছে , আগ্রহ করে আর জিজ্ঞেস করলো না কিছু।

কিন্তু ধারণা ভুল হলো,কিছুক্ষণ পর তৃপ্তি ওর দুই বাচ্চা বাড়িতে আসে,ওদের শব্দ পেয়ে তীব্র চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে,তৃপ্তির সাথে দীপ্তিও এসেছে।
তৃপ্তি আর দীপ্তি দুজনে সম বয়সী। ওরা যখন হয়, ওদের নামটা মিলিয়ে রাখা হয়। একসাথে কোথাও গেলে ওরা বোনের পরিচয় দিতো। দীপ্তি ক্লাস সিক্স অব্ধি তৃপ্তির সাথে এক স্কুলেই পড়েছে, এরপর দুজনে একসাথে ক্যাডেটের জন্য কোচিংও করেছে দীপ্তি ক্যাডেটে চান্স পেলেও তৃপ্তি পায় না।

অনেকদিন পর দুজনের দেখা হওয়াই তৃপ্তি ওকে জোর করে নিজের সাথে বাড়িতে এনেছে।দীপ্তি কোনোভাবেই আসতে চায় নি,কিন্তু তৃপ্তিও নিজের জেদ ছাড়েনি।তৃপ্তি জানে দীপ্তি তীব্রকে পছন্দ করে ছোটো বেলা থেকে, দীপ্তি প্রত্যক্ষ ভাবে প্রকাশ না করলেও তৃপ্তি বুঝে যায়। কিন্তু তীব্রর মাঝে আজ অব্ধি কোনো কিছু দেখতে পায় নি।

তীব্রর মা দীপ্তিকে দেখে অনেক এক্সাইটেড হয়ে যায়, অনেকদিন পর দেখা হলো ওর সাথে।মেয়ে হিসেবে উনার দীপ্তিকে খুব পছন্দ, তীব্র রাজি থাকলে দুবার ভাবতো না ওদের বিয়ে দিতে।
দীপ্তিকে দেখে জড়িয়ে ধরে স্বাগতম জানায়।
এদিকে তীব্র দীপ্তিকে দেখে চোখ কপালে উঠে যায়।ও ভয় পাচ্ছে, তৃপ্তির সাথে যেরকম ভাল সম্পর্ক দীপ্তির, তাতে দীপ্তি ওকে তীব্রর কথা বলে দিয়েছে কিনা কে জানে।
এতোক্ষণ চুপচাপ থেকে যতোটুকু সুস্থতাবোধ করছিলো, এখন দীপ্তিকে দেখে হার্টবিট দ্বিগুণ হয়ে গেলো।
মম, মাশুক এসে তীব্রর ঘাড়ে চড়ে বসলো।বাচ্চা কাচ্চা দুষ্টুমি করে বলেই তীব্র বাচ্চা দেখতে পারে না, বোনের ছেলেমেয়ে বলে মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারে না, বড় হলে দু একটা ধমক দেয়া যেতো, কিন্তু ছোটো বলে কিছু বলে না। এমনিতেও তীব্রর ভাগ্নেভাগ্নি ওকে জ্বালানোর জন্য কাছে পায় না।

দীপ্তি তীব্রর বরাবর বসলো,তীব্রর মা তৃপ্তি সবাই ওর পাশে বসে গল্প করতে লাগলো। এদের কথার জ্বালায় খুব বিরক্ত লাগছে তীব্রর কিন্তু একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে বসে আছে চুপচাপ। একটু পর পর সবার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রত্যেকের ভেতরের কথা চোখের মাধ্যমে পড়ে নিচ্ছে।কিন্তু দীপ্তি তীব্রর দিকে খুব একটা তাকাচ্ছে না,যতোবার তাকাচ্ছে নিজের অজান্তে।

দীপ্তির সামনে নানান রকম খাবার রেখেছে,কিন্তু দীপ্তি শুধু মাত্র চা ছাড়া আর কিছু খাচ্ছে না।
দীপ্তি আগে তীব্রর মায়ের হাতের বিরিয়ানি খুব পছন্দ করতো,আজ অনেক দিন পর আসায় ওকে জোর করেই বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়াবে বলে ঠিক করে।কিছুক্ষণ গল্প করে কিচেনে চলে গেলো ওর মা, এদিকে তৃপ্তিও কি কারণে যেনো একটু নিজের ঘরের দিকে গেলো,ড্রয়িংরুমে তীব্র দীপ্তি আর ওর ভাগ্নেভাগ্নি।
তীব্র দীপ্তির উদ্দেশ্যে বললো,
-তোমাদের দুজনের কি আজ রাস্তায় দেখা হয়েছে?
-না তো।
-ওহ।
-তৃপ্তি সকালে কল দিয়ে বলছিলো অনেক দিন ধরে দেখা হয় না আমাদের, তাই আজ দেখা করতে। সেজন্য ঘুরতে বেরিয়েছিলাম আমরা।ঘুরাঘুরি শেষে বাড়ি চলে যাবো তখন ও আমাকে জোর করেই নিয়ে এলো এখানে।
-এসেছো ভালো করেছো।মা তোমাকে অনেক মিস করে।মাঝে মাঝে আসতেই পারো। মা একাই থাকে, অই একমাত্র তৃপ্তিই মায়ের কথা বলার মানুষ।
-তাহলে তুমি বিয়ে করে নিচ্ছো না কেনো?একটা বিয়ে করলে তোমার বউ আন্টির সাথে সময় কাটাতে পারবে।
-বিয়ে করবো সময় হলে,
-এখনো সময় হয় নি?
-নাহ!
-প্রেম তো করছোই, বিয়ে করতে সমস্যা কি?এমন না যে মেয়ে পাচ্ছো না।
– ওটাই সমস্যা,যার সাথে প্রেম করি,সেই বিয়ে করতে রাজি না,বিয়ের জন্য আরো
সময় লাগবে।
-তোমার গার্লফ্রেন্ড কি করে?
-সেনাবাহিনীতে ছিলো।
-এখন নেই?
-নাহ, বাদ দিয়েছে।
-তুমিই কি চাকরী টা ছেড়ে দিতে বলেছো?
-অই রকম ই।মেয়ে মানুষ চাকরি করে কি করবে,আমার টাকা দিয়েই চলবে।
দীপ্তি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-ভালোহ।
তোমাদের মানিয়েছে ভালো,তোমার গার্লফ্রেন্ড তোমার মতোই লম্বা, শুধু একটু বেশি শুকনা।তবে দেখতে মাশআল্লাহ!
– থ্যাংকস। সেনাবাহিনীতে যাওয়ার আগে ওর স্বাস্থ্য ভালোই ছিলো।
-ওহ বুঝেছি।

দীপ্তি চুপ হয়ে গেলো।তীব্রও চুপ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পর তীব্র দীপ্তিকে আবার বললো,
-দীপ্তি!
-হুম?
-তুমি কি আমার প্রেমের কথা তৃপ্তিকে বলেছো কিছু?
-কই না তো!
-ওহ থ্যাংকস! ওকে বলো না কিছু,আমার মাকেও না।
-তোমার বাড়ির লোক জানে না, তোমার প্রেমের কথা?
-নাহ।
-কিন্তু কেনো?
-জানলেই তো বিয়ে করতে বলবে, তাই জানাই নি।তুমি প্লিজ কাউকে বলো না।
বিষয়টা জানাজানি হয়ে যাবে বলে আমার প্রেমিকাকে নিয়ে কখনো ডেটিংয়েও যাই না।
হুটহাট রাস্তাঘাটে একটা একটু দেখা হয়,অই অব্ধিই।
-হুম বুঝেছি তোমার সমস্যাটা।
-আচ্ছা আমি উঠি তাহলে কেমন?কাজ আছে আমার।
-বাইরে যাবে?
-নাহ ঘরে যাবো।
সামান্য একটা প্রশ্নের জন্য তীব্র এতোক্ষণ অপেক্ষা করছিলো সু্যোগের জন্য।

দুদিন ধরে ড্রিঙ্কস একদম ই করতে পারছে না মিশান,গায়ে হাল্কা জ্বর জ্বর। ড্রিঙ্ক করলেই বমি এসে যাচ্ছে । যার ফলে রাতে ঘুমোতেও পারছে না,দু চোখের পাতা এক করলেই অতীত এসে জড়ো হচ্ছে। বার বার ছিটকে উঠছে, সময় খুবই খারাপ কাটছে।

স্বপ্নে অনেক কেঁদেছে যার জন্য চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে আছে, ওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে গুটিশুটি মেরে চুপচাপ বসে আছে,শরীর টা কাঁপছে। একটু পর পর চিৎকার দিয়ে উঠলে মামী দৌড়ে আসে বলে, মিশানের ভেতরে গিল্টি ফিল হয়, না চাইতেও বাড়ির লোকদের ঘুমে বিরক্ত করছে।
তাই দরজা আটকে দিয়ে রেখেছে।

এমন সময় তীব্র ফোন করে বের হতে বলে,
মিশান জামার উপর জ্যাকেট পড়ে একটা চাদর মুড়িয়ে বেরিয়ে গেলো।

রাস্তার নিরিবিলি স্থানে গাড়ি থামিয়ে বের হয়ে গাড়ির উপর বসে বসে সিগারেট টানছে, মিশান বাড়ি থেকে বেরিয়ে তীব্রর কাছে আসে,
-কি বলবেন বলুন।
-বসো তারপর বলছি।
মিশান তীব্রর পাশে বসতে যাবে তীব্র বলে উঠে,
-দাঁড়াও আগেই বসো না, গাড়ির ভেতর দেখো বোতল আছে নিয়ে বসো।
মিশান উত্তর না দিয়ে তীব্রর পাশে বসলো,
-কি হলো, আমার কথা শুনতে পাও নি?
-খাবো না।
-ভালো হয়ে গেলে নাকি অসুস্থ?
-কোনোটাই না, ভালো লাগছে না।
-সানগ্লাস খুলো, মাস্ক তো পড়েই আছো।
-আপনার প্রবলেম হবে না তো?
-আমার প্রবলেম তো আগে থেকেই, যাতে অন্য কারো প্রবলেম না হয় সে জন্য সানগ্লাস পড়ে থাকতে বলি।
মিশান মাথা নিচু করে নরম স্বরে বললো,
-আমার চোখ টা কি দেখতে অনেক বাজে?
-নাহ, বাজে না ঠিক।কিন্তু তোমার চোখ আমার ভালো লাগে না।
-ওহ।
তীব্র ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে মিশানের চোখে দিকে ধরতেই মিশান চোখ বন্ধ করে নেয়।
-চোখটা কেমন লাল হয়ে আছে, ড্রিঙ্কস ছেড়ে ড্রাগস ধরলে নাকি?

তীব্র আবার কড়া স্বরে বললো ,
-এই মিশান ওয়ার্নিং দিচ্ছি। ড্রিঙ্কস করো, সেটা মেনে নিয়েছি বলে ভেবো না ড্রাগস নেয়া মেনে নেবো।তোমাকে কি পরিমাণে স্পেস দিয়েছি ধারণা আছে?
-আরে কি সব বলছেন, ওসব আমি নিই না। চোখ লাল দেখাচ্ছে কারণ আমার ঘুম আসছে কিন্তু ঘুমাতে পারছি না।

তীব্র ওর জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা বক্স বের করে মিশানকে দিলো।বক্সটা র‍্যাপিং করা।
-নাও।
-কি এটাই?
-খুলে দেখলে কি চোখ খুলে পড়ে যাবে?

মিশান কিছু না বলে কিছুক্ষণ নিরব হয়ে রইলো, বক্সটা সাইজে ছোটো হলেও অনেকটা ভারী, বুঝতে পারছে না কি এটাই।কিছুটা আন্দাজও করতে পারছে।
ভেতরে আগ্রহ নিয়ে র‍্যাপিং পেপার খুলতে লাগলো।
চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here