তেজস্ক্রিয়_রক্তধ্বনি,পর্ব_২৭

0
1112

তেজস্ক্রিয়_রক্তধ্বনি,পর্ব_২৭
লেখিকা_রিয়া_খান

-আমি যাবো কেনো সেটা তো বলুন?
-তোমাকে বশ করার জন্য কালো জাদু করবো।
-এই আপনার সমস্যা কোথায়?সোজা উত্তর দিন।
-তোমাকে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাবো।
মিশান চমকিত দৃষ্টিতে বললো,
-হোয়াট!! পাগলের ডাক্তার আমি দেখাবো কেনো?আমি তো সুস্থই,আমাকে কোনো এংগেলে পাগল লাগে?
-তোমাকে কে বলেছে, সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে পাগলেরা আসে?
মিশান চেয়ারে পা তুলে বসতে বসতে বললো,
-বলার কি আছে,জানা কথায়।
-দেখো মিশান যদি ভালোমতো আমার সাথে না যাও তবে এখন এমন সিন ক্রিয়েট করবো সবাই ভাববে তুমি পাগল,হা করে তাকিয়ে থাকবে প্রত্যেকে। তাই বলছি ভদ্র মেয়ের মতো আমার সাথে চলো।
-আজব!আমার সমস্যা কোথায়?
-সমস্যা তোমার না, আমার সমস্যা।আমি যদি ডক্টরকে আমার সমস্যার কথা বলার সময় সব কিছু ভুলে যাই, তুমি মনে করিয়ে দেবে।
-আমি কিছু জানলে তো মনে করিয়ে দেবো,তাই না?

-আমার কথা শুনো মন দিয়ে। আমরা দুজনে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাবো, আমি বলবো আমার তোমাকে দেখলে মেজাজ গরম হয়, এটার কারণ কি? সমস্যা কি আমার মাঝে নাকি তোমার।

মিশান উত্তর না দিয়ে তীর্যকভাবে তাকিয়ে রইলো তীব্রর দিকে।
তীব্র হাত বাড়িয়ে মিশানের হাত ধরে টান দিতেই মিশান উঠে দাঁড়ালো।
তীব্রর সাথে ডক্টরের চেম্বারে ঢুকলো।
পরিচয় দিতেই ডক্টর চিনে ফেললো, কারণ তার বন্ধুর থেকে তীব্রর সম্পর্কিত তথ্য আগেই পেয়ে গেছে।
-যার সমস্যাটা জটিল বেশি তাঁর টা আগে বলুন।
মিশান চুপ করে তীব্রর মুখের দিকে তাকিয়ে নজর সরিয়ে অন্যদিকে ফিরে রইলো।
তীব্র হাল্কা গলায় কাশি দিয়ে বললো,
-ডক্টর,জটিল সমস্যা বলতে আমার ওয়াইফের।যতো দিন যাচ্ছে ওর সমস্যাটা বেড়ে চলেছে।নাইটম্যার প্রবলেম ।
ওর বয়স যখন ৫+ তখন এ সমস্যার উৎপত্তি, যতো দিন যাচ্ছে এটা বড় আকার ধারণ করতে করতে এমন পর্যায় চলে গেছে যে এখন ওর স্বাভাবিক একটা ঘুম দেয়ার জন্য এলকোহলের আশ্রয় নিতে হয়।
-এলকোহল কি সব সময় নিতে হয়?
-না শুধু রাতে, তাও রেগুলার নিতে দেই না।
-শুধু এলকোহল নাকি আরো কিছুর আশ্রয় নেয়া চলে?
-না না শুধু এলকোহল ই।
-দুঃস্বপ্ন টা আসার কারণ জানা আছে কি?নাকি হুট করে?
-আসলে ডক্টর দুঃস্বপ্ন আসার যথেষ্ট কারণ আছে, ওর লাইফের উপর দিয়ে যথেষ্ট ক্রাইসেস গেছে যার জন্য ওর আজ এই হাল। ছোটো বেলায় বাবা মায়ের মধ্যে অশান্তি দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠা,সেখান থেকে মাথায় কিছুটা চাপ পড়া। আবার হুট করেই বাবা মাকে হারিয়ে যাওয়া। ও এতোটা ছোটো ছিলো যে ওর বাবা মা কোথায় সেটাও জানে না, বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে সেটাও জানে না। সেখান থেকে অইটুকু বয়সে দুঃস্বপ্নের ছোট্ট একটা অংশ ওর মস্তিষ্কে প্রবেশ করে। বাবা মাকে হারিয়ে যাওয়াটা ছিলো একটা ভূতুড়ে কাহিনী, ও ঘুমিয়েছিলো আর ঘুম থেকে উঠে দেখে ও অচেনা একটা দেশে,কোথা থেকে কোথায় কিভাবে এলো ওর জানা নেই ।
যখন ও বাবা মায়ের থেকে হারিয়ে যায় তখন ওর বয়স সাড়ে পাঁচ বছরের মতো, আর ওর সাথে একটা ছোট্ট বোন ছিলো যার বয়স ছয় মাসেরও কম ছিলো, সেটাকে নিয়ে একটা অচেনা রাষ্ট্রে এসে পড়ে।
তারপর আসি কয়েকবছর পর, বেশ কয়েক বছর যাওয়ার পর বাবা মায়ের আশা ছেড়ে দিয়ে ও ভালোভাবে বাঁচার চেষ্টা করে ওর বোনকে নিয়ে।কিন্তু কয়েক বছর পর জানা যায় ওর বোন অনেক অসুস্থ, যাকে বাঁচিয়ে রাখাটা ছিলো রীতিমতো মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে মৃত্যুকে হারিয়ে তাকে বাঁচিয়ে রাখা।
সেখান থেকে নতুন ভাবে দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়, সুপ্ত অবস্থায় থাকা দুঃস্বপ্ন জাগ্রত হয়ে বড় আকার ধারণ করতে শুরু করে, মাঝেপথে ছোটো বড় অনেক কিছু হারায়, আর শেষ সময় বোনকে হারাতে হলো। কোনোভাবেই তাকে বাঁচাতে পারে নি।আপনজন শুন্য হয়ে একদম মাঝ সমুদ্র ডুবে পড়া অবস্থা ।

সব মিলিয়ে এমন পর্যায় ওর লাইফ চলে গেছে যে, ওর দুচোখের পাতা এক করলেই দুঃস্বপ্ন এসে হাজির। এমন না যে ওর ঘুম আসে না, ওর ঘুম আসে প্রচুর কিন্তু ঘুমাতে পারে না।দুঃস্বপ্ন গুলো এমন ভাবে আসে যে ওর কাছে মনে হয় ওগুলো বাস্তব, আর ঘুমের মাঝেই চিৎকার দিয়ে উঠে,কান্নাকাটি করে।
-এলকোহল কি ছোটো বেলা থেকে?
-না ডক্টর, ছোটো বেলা থেকে ধৈর্য্য ধরে থাকতে থাকতে এক পর্যায় ও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। গত দুবছর ধরে ও এলকোহল নিচ্ছে। শুধু এলকোহল ই, যার মধ্যে রেড ওয়াইন টা বেশি চলে, ওটা খেলে নাকি সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য টেনশন কমে একটু ঘোর মাতাল হলে ঘুমের মাঝে যদি দুঃস্বপ্ন এসেও পড়ে ওর ওপর কোনো এফেক্ট করতে পারে না।

ডক্টর মিশানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-আপনি কোন স্বপ্ন গুলো রাতে বেশি দেখেন?মানে যেগুলোর জন্য আপনার ঘুমাতে কষ্ট হয়?
-আমার সব স্বপ্নই প্রায় একই।
অন্ধকার ছায়া, দু একটা নারী কন্ঠের , পুরুষ কন্ঠের চিৎকার, ডাকাডাকি । এ কন্ঠগুলো আমি বাস্তবে শুনি নি কখনো।তবে স্বপ্নের মাঝে যেগুলো হয় সে কন্ঠগুলো খুব চেনা চেনা লাগে, খুব আকর্ষণ করে। সাদাকালো ছায়া, অন্ধকার, যুবতী নারী,যুবক পুরুষ, ছোটো ছোটো বাচ্চা, কিশোরী মেয়ে।
এই কয়েকটা ক্যারেকটার নিয়ে বেশি দেখি। যার অধিকাংশ সময় শুধু ছুটাছুটি করে,আমায় ডাকে, আর্তনাদ করে, চিৎকার করে।ঘটনাগুলো এমন ভাবে সাজায় যেনো আমার সামনে বাস্তবে হচ্ছে সব, আমি কিছু করছে পারছি না, আমি কিছু করার চেষ্টা করলেই আমার আশেপাশে থেকে ইয়া বড় বড় অজগর সাপ এসে আমাকে পেঁচিয়ে ধরে, আমি ছুটতে পারি না, যখন আমাকে ছোবল দিতে আসে আমি তখন ছুটতে পারি, আর ছুটে কোথাও যাওয়ার আগেই আমি পানিতে পড়ে যাই,ডুবে যাই, উপরে উঠতে পারি না, পানির নিচ থেকে আবার কিছু একটা টেনে ধরে।

মিশান ওর স্বপ্নের সংক্রান্ত সমস্ত কিছু খুলে বললো ডক্টরকে।
ডক্টর সবটা শুনে চুপচাপ হয়ে রইলো।
এবার তীব্রকে জিজ্ঞেস করলো,
-এর আগেও কি কোনো ট্রিটমেন্ট নিয়েছে আপনার ওয়াইফ?
-হ্যাঁ ওর যে অভিভাবক, মানে যাদের কাছে ওরা বড় হয়েছে, তাঁরা যথেষ্ট ভালো মানুষ। যখন থেকে ওর সমস্যা টা প্রকাশ পাচ্ছিলো তখন থেকেই ওকে ভালো ভালো সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো হয়েছে।
কিন্তু তারা প্রত্যেকেই ওকে শুধু কড়া ঘুমের ওষুধ দেয়, সেটাতে কোনো উপকার আসেনি ওর, উল্টো সমস্যা বেড়েই চলেছে,ইদানীং মনভোলাও হয়ে যাচ্ছে, কখন কি করে তার ঠিক নেই, হুটহাট প্রয়োজনীয় জিনিস ভুলে যায়, একটা কাজ দিলে আরেকটা করে, এগুলো হয়তো অতিরিক্ত পাওয়ারের ঘুমের ওষুধ খাওয়ার জন্যই এমন হয়েছে।যখন দেখা গেলো ওর অবনতি হচ্ছে, তখন ওষুধ খাওয়া বাদ দিলো।
-আপনাদের বিয়ে কিভাবে হলো?এরেঞ্জ নাকি লাভ ম্যারিজ?
-না ডক্টর। এরেঞ্জ বা লাভ কোনোটাই না।
আমি ওকে জোর করে বিয়ে করি,অনেকটা ব্ল্যাকমেইল আর থ্রেট করে।
-কেনো?
-ওর যা অবস্থা দেখতে পাচ্ছিলাম আমার মনে হচ্ছিলো ওর পাশে কেউ একজন থাকা দরকার মেন্টালি সাপোর্ট দিতে।এভাবে একা নিজের যন্ত্রণা নিজের মধ্যে পোষতে পোষতে আজ এলকোহল ধরেছে কাল যে ড্রাগস নেবে না, তার কি গ্যারান্টি?এভাবে লাইফটা শেষ করে দেবে? জীবন কি এতোই সস্তা?এসব কিছু ভেবে আমি ভাবলাম জোর করে হলেও ওর কাছের কেউ হওয়ার, যেনো ও না চাইতেও ভেতরের কষ্ট গুলো আমার সাথে শেয়ার করে। বাট মিশান এমন যে, ও কোনো ছেলের চোখের দিকে তাকায় ই না, আমাকে দেখবে তো দূরে থাক।তখন ভাবলাম এর সাথে আমার বন্ধুত্ব হবে না কখনো, তাই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলাম,চাইলেও আমার থেকে ছাড়াতে পারবে না নিজেকে।
জোর করে বিয়ে করি ঠিকি কিন্তু ওর কাছের কেউ হয়ে ওঠতে পারি নি। এই দিক দিয়ে সমস্যা ওর না, সমস্যাটা আমার। কারণ আমি কারো সাথে ফ্রি হওয়ার জন্য স্বাভাবিক বা একটু মধুমাখা স্বরে কথা বলতে পারি না, আমি চাই ওর সাথে ভালোভাবে কথা বলতে, কিন্তু আমার ভেতর থেকে আসে না কথা। আমি শুধু ওর সাথেই এমন না। সবার সাথেই এমন, আমার বাবা মা থেকে শুরু করে অফিস কলিগ কেউ বাদ নেই, আমি ভালোভাবে কথা বললেও অপরপাশের মানুষ মনে করে আমি প্রচন্ড রেগে আছি।

আমাদের সম্পর্কটা স্বাভাবিক না হওয়ার আরো কিছু কারণ আছে, ওকে কখনো কিছু ভালোমতো বললে সেটা ও বাঁকা ভাবে নেয়, যতক্ষণ না আমি ওকে বাঁকা ভাবে না বুঝাবো ও ঘাড়ত্যাড়ামো করবেই।ওর সাথে পরিচয় হয়েছে তখন থেকেই ওর এরকম চালচলন, বুঝতে পারছি না এটা ওর মানুষিক সমস্যা নাকি জন্মগত স্বভাব।
দু হাজার… (তীব্রর কথার মধ্যে মিশান তীব্রর দিকে চোখ গরম করে বলে উঠলো)
-আমি ঘাড়ত্যাড়ামো করি?আপনি কতোটা খবিশ সেটা কেনো বলছেন না?

তীব্র চোখ গরম করে মিশানের দিকে ঝুঁকে দাঁত চেপে আস্তে করে বললো,
-মিশান আমার পুরো কথা শেষ হয় নি।
পুরোটা বলে নিই, তারপর তোমার তাফালিং শুরু করো।

-ও আরো কিছু বাকি আছে আমার নামে বলার? নিজে তো আস্ত ইবলিশের বংশধর। কথার লাইন নেই ঠিক। জটলা যতো নিজের মধ্যে, নিজের গুণ সব ঠেলে ঠেলে আমার দিকে দিচ্ছেন।
-মিশান থামো এখানে এভাবে ঝগড়া করো না, ডক্টর কি ভাববে বলো?উনি আমাদের ভাষা জানে না বলে কি বুঝতে পারছে না, তুমি কি বলছো?
-বুঝোক তাতে আমার কি? সমস্যা আপনার আপনি ডক্টর দেখান, আমি সুস্থই আছি।

দাঁত কিড়িমিড়ি করে কথা গুলো বলেই মিশান চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেলো। ডক্টর মিশানের এক্টিভিটিস দেখছিলো। তীব্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডক্টরের দিকে তাকিয়ে বললো,
-ওর রাগটাও খুব বেশি,একটুতেই রেগে যায়, রাগ চেপে রাখাটা ওর দ্বারা সম্ভব হয় না। রেগে গেলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না। রাগের মাথায় বেশ কয়েকবার আমাকে মারার চেষ্টাও করেছে।
-বুঝতে পারলাম উনার সমস্যা। মিস্টার তীব্র আপনার ওয়াইফের ব্যাপারটা খুবই জটিল।
আমাকে এটা নিয়ে স্টাডি করে রাইট ট্রিটমেন্ট দিতে হবে, যেহেতু ঘটনা দু একমাস বা বছরের না, এটা বহু বছরের উৎপন্ন সমস্যা। আমাকে কি একটু সময় দেয়া যাবে?
-শিউর ডক্টর!
-আপনি আমার সাথে ঠিক কালকের পরের দিন এই সময়ে দেখা করবেন।
-ওকে ডক্টর।
-এখন আপনার সমস্যা টা বলুন,
-আমার টা পরেই বলি আগে ওর টা ঠিক হোক।
-ঠিক আছে যেটা করে খুশি।
-তাহলে আজ আসি।
ডক্টরের থেকে বিদায় নিয়ে তীব্র বেরিয়ে গেলো। মিশান হসপিটালের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে।গাড়ির ভেতরে গাইড বসে আছে ড্রাইভিং সীটে।

-এভাবে ছুটে এলে কেনো?ভদ্রতাসূচক মানুষ ধৈর্য্য ধরে চুপচাপ বসে থাকে,সেটা তো পারলেই না উল্টো বেয়াদবি করে বেরিয়ে এলে।
-আমি ভদ্র হয়ে কি করবো?নেশাখোর মাতাল আমি। আপনি ভদ্রলোক রাখুন আপনার ভদ্রতার বজায়।
-আমার ই ভুল, সমস্যা আসলে আমার মধ্যেই।তুমি যে জেনেটিক্যালি এরকম সেটা আমি বুঝে উঠতে পারিনি।
-………………

মিশান গাল ফুলিয়ে চুপ করে রইলো।তীব্র ধমকের স্বরে বললো,
-দাঁড়িয়ে আছো কেনো? গাড়িতে উঠো।
মিশান গাড়িতে উঠে চুপ করে রইলো।
দুজন গাড়ির দু প্রান্তে বসে রইলো, মিশানের উপর মেজাজ এতোটা গরম হচ্ছে যে, কিছু বলতে পারছে না বলে ভেতরেই রাগ জমা করছে, আর সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে উড়িয়ে দিচ্ছে।
হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে মিশান জানালার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে আর কিছু একটা ভাবছে।
-মানুষটা কি আসলেই ভালো? নাকি অভিনয় করছে আমার সাথে?নিশান তুই কেনো এই লোকটাকে পছন্দ করতিস? শুধু তোর জন্য আমি এর পিছু কাটতে পারছি না।
কি আছে এই লোকটার মাঝে?কি করা উচিৎ আমার?
অতীত ভুলে কি আমার নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে বর্তমানের সাথে?নাহ সেটা আর পারবো না আমি। হারাতে হারাতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি, কাউকে ভালোবাসার চেষ্টা মানে তাকে হারিয়ে যাওয়ার প্রসেস শুরু হওয়া।

আমার জন্মটাই একটা কুফা।কুফা না হলে কি কেউ নিজের বাবা-মায়ের জীবনে অশান্তি ডেকে আনে? পরিবারকে হারায়? যাকেই ভালোবাসি সেই হারিয়ে যায়।
মা!বাবা তোমরা কোথায়?এই পৃথিবীতেই আছো নাকি নিশানের মতো মাটির নিচে?
শুনেছি পৃথিবী টা নাকি অনেক ছোটো, তাহলে কেনো এতোগুলো আলোকবর্ষ পেরিয়েও তোমাদের সাথে দেখা হলো না?
মা তুমি তো বলেছিলে সময় মতো ফিরে আসবে! তুমি কি জানো তোমার একটা মেয়ে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে, আরেকটা মেয়ে জীবিত লাশ হয়ে বেঁচে আছে। তুমি কি জানো মা, তোমার বড় মেয়ে তোমায় দেয়া কথাটা রাখতে পারেনি, নিশানকে আমি আগলে রাখতে পারি নি, ওকে প্রোটেক্ট করতে পারি নি, কিছু কুকুর তোমার মেয়েকে মেরে দিয়েছে, তোমার বড় মেয়ে কিছু করতে পারেনি মা।

এই পৃথিবীটা আমাকে হারতে পাঠিয়েছে জিততে নয়। কিছু পাওয়ার আগেই হারিয়ে যাচ্ছি তবুও ভুল করে কিছু পাই নি মা। যখন যাকে ভালোবাসছি তাঁর জীবনেই মৃত্যু হয়ে আগমন করছি। আমার অতীত থেকে কি করে বের হবো মা? অতীত থেকে বেরিয়ে এলে কি আমার ভাগ্য বদলে যাবে?আমার হারিয়ে যাওয়া গুলোকে ফিরে পাবো?

মা যদি পৃথিবীতেই থাকো তুমি, তবে শেষবারের মতো দেখতে চাই তোমাকে,বাবাকে!আমি হারাতে হারাতে ক্লান্ত মা।
আচ্ছা মা তুমি সেদিন আমায় নিয়ে ওভাবে ছুটছিলে কেনো? বাবা কোথায় ছিলো?অই লোকগুলো বাবার সাথে কি করছিলো?
জানো মা তীব্র স্যার না আমার সম্পর্কিত সব তথ্য জানে, কি করে জানে এত্তসব? তুমি কি উনাকে চেনো? উনি আমার কিছু হয় কি? উনি পুরোটাই একটা রহস্যময় বস্তু জানো তো! উনার কোনো কাজের আগা মাথা বুঝি না, আর উনার ব্যবহার এতো খারাপ, বলে বুঝাতে পারবো না।আমার উনাকে একটুও ভালোলাগে না কিন্তু কেনো জানি না, আমি উনাকে ছাড়তেও পারি না। কি একটা আকর্ষণ যেনো আছে উনার মাঝে।

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মিশানের পেছনে তীব্র এসে দাঁড়ালো।
-মিশান!
মিশান পিছু ঘুরে তাকায়,
-বলুন।
-একটা কাজ করতে হবে।
-কি?
-এবারের কাজটা একটু কঠিন কাজ, তবে মার্ডার না। তবে যেটা করবে সেটাতে অনেক রিস্ক আছে।
-বলুন।
তীব্র মিশানের পাশে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
-দেখো মিশান তোমার সাথে আমার দাঁ মাছ সম্পর্ক হলেও তুমি আমার বিশ্বস্ত। দিন শেষ আমি তোমাকে দিয়েই ভরসা পাই। তাই কঠিন কঠিন কাজ গুলো তোমায় দিয়েই করাই।
-তেল পরে মারুন আগে কাজের কথা বলুন।
-আমরা একরাতে যে বাড়িটা পর্যবেক্ষণ করছিলাম, ওটার যে মালিক উনি অনেকটাই বয়ষ্ক, এই ধরো ৫০ এর ওপর, তবে দেখে বুঝা যায় ৪০ বছর বয়স।তাঁর একটা ছেলেও আছে ছেলেটার বয়স ২৫ বছর। বাইরের কান্ট্রিতে থাকে।
উনার এতো টাকার উৎস ছিলো কঠিন অধ্যবসায়, তবে শর্টকাটে।
-হিস্টোরী কি?
-নাম জাফর হাসান না আহমেদ কিছু একটা হবে। অনেক গরীব ঘরের ছিলো তবে অনেক ভালো স্টুডেন্ট ছিলো। স্কলারশিপ পেয়ে দেশের বাইরে পড়তে যায়, ইউরোপে মেবি।
সেখানে স্টুডেন্ট লাইফে এক বয়স্ক টাকাওয়ালা মহিলাকে বিয়ে করে। বিয়ের বছর খানেক পর মহিলা টা মারা যায়, নাকি মেরে ফেলা হয় সেটা জাফর ই ভালো জানে, তবে সবাই স্বাভাবিক মৃত্যুই ধরে নিয়েছে,মহিলাটার এজমা প্রবলেম ছিলো।
মহিলাটার কোনো সন্তান ছিলো না।জাফরকে বিয়ে করার ৩ বছর আগে স্বামী মারা যায়, সেই সুত্রে স্বামীর সমস্ত সম্পত্তি সে পায়।
এরপর সে মারা যাওয়ার পর তার সমস্ত সম্পত্তির মালিক হয় জাফর।
একটা বিশ বছরের ছেলে কোটি কোটি টাকার মালিক ভাবা যায়?
সে টাকা দিয়ে জাফর ভালো কিছুও করতে পারতো,কিন্তু ও কালোরাস্তায় জোয়া খেলার মতো মেতে উঠে সে সমস্ত টাকা দিয়ে, টাকার পরিমাণ হাজার গুণ হারে বাড়লেও ওর সমস্ত সাদা টাকা কালো টাকায় রূপান্তর হয়।দেশে এসে তৈরী করে সন্ত্রাসী গ্যাং, ওর নামে চাঁদা তোলা হচ্ছে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা।
অবৈধ অস্ত্র পাচার, বোমাবাজি, খুনখারাবি, দখলদারি হয়ে উঠেছে ওর জীবনের দৈনন্দিন রুটিন।
ও হ্যাঁ, যখন ও স্কলারশিপ পেয়ে ইউরোপ যায়,তার দু বছর আগে ওর গার্লফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে যায়।
টাকার জোয়ারে ফুলে ফেঁপে উঠে দেশে এসে যখন জায়গা করে, তখন তাঁর এক্সের কোলে একটা ছেলে সন্তান। অত:পর সেই নারীকে জাফর বিয়ে করে নিয়ে আসে ছেলেটা সহ।

এখনো সেই ছেলেই আছে , আর বাচ্চা কনসিভ করে নি। তবে খবর পেয়েছি ও আরেকটা বিয়ে করেছে, যেটা ওর অই বউ জানে না।
-ওয়াহ!পুরো ফিল্মি লাইফ স্টাইল!
-শুধু এখানেই শেষ না, এক কালে ওর গার্লফ্রেন্ডকে ও ভালোবাসতো ঠিকি পাশাপাশি অন্যদের গার্লফ্রেন্ডকেও ভালোবাসতো।মেয়েটার নাম মেবি মোনালিসা। তো মোনালিসা ছিলো জাফরের খালাতো ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড, সেখান থেকে ওদের পরিচয় প্রেম। আবার বিয়ে হয়ে যাওয়া বাচ্চা হওয়া সেই বাচ্চা সহ জাফরের কাছে আসা।

যাই হোক মাথা ধরানো ইতিহাসে না যাই, ওদের ব্যাপার ওরা বুঝোক। ওদের পারসোনাল লাইফ নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যাথা নেই। কিন্তু আমাদের মাথা টা খাটাতে হবে অন্য এক জায়গায়।
-কি?
-জাফরের ছেলেটা তো দেশের বাইরে থাকে, তাই ওকে দিয়ে কিছু হবে না আপাততো। যেহেতু জাফর দেশে থাকে, আর ওর সুন্দর নারীদের প্রতি একটু বেশিই দুর্বলতা সেজন্য তোমার একটু কাজটা করে দিতে হবে প্লিজ!
-এক বিছানায় শুবো?
-ছি ছিহঃ এরকম কিছু না। তুমি আমার বউ,অন্য কারো বিছানায় কেনো যাবে?
-তাহলে?
-ধরো উঠানে একটা পায়রা বসে আছে, আমি কোনো প্রকার জোর জবরদস্তি না করে কিভাবে ঘরে আনবো?.
-সিম্পল! কিছু ধান বাইরের উঠান থেকে ফেলতে ফেলতে ঘরের দিকে আনবো।পায়রা ধান খেতে খেতে ধানের লাইন ফলো করে ঘরে এসে যাবে।
-এক্সাক্টলি তাই ই করতে হবে।
-স্যার!
-বলো।
-এটা বেশি রিস্কি হয়ে যায় না? উনার যা বর্ণনা দিলেন তাতে আমার ভয় হচ্ছে, কোনো ক্ষতি করে দেবে না তো?পায়রার মতো যদি ধান খেয়ে ফেলে?
-মিশান! তুমি একটা কথা মাথায় রেখো, যেখানেই যাও না কেনো তুমি। এই তীব্র সর্বদা তোমার ছায়া হয়ে থাকবে।
-সেটাই তো সমস্যা! আপনি যেখানে আছেন সেখানেই আমার বিপদ অনিবার্য।
-শুধু শুধু ভুল বুঝো তুমি।
-আর একটা কথা,আমি আপনার বউ এটা দয়া করে বার বার উচ্চারণ করতে হবে না আমার সামনে।বার বার তীর মারার কি দরকার একবারে গুলি করেই মেরে দিন।
তীব্র শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
-আসলেই দেবো?

মিশান বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-বাজে লোক একটা!

সাইক্রিয়াটিস্টের সাথে দেখা করার ডেটে তীব্র একাই দেখা করতে গেলো।মিশানকে কোনো ভাবেই সাথে নিতে পারলো না।
ডক্টর তীব্রকে জানালো, মিশানের এ সমস্যাটা কোনো ওষুধ দিয়ে কাজ হবে না।এর থেকে বের হওয়াটা সময় সাপেক্ষ। তাই প্রাথমিক অবস্থায় কোনো প্রকার মেডিসিন না দিয়ে কিছু রুলস ফলো করতে বললো। তীব্রকে বলে দিলো কি কি করতে হবে।

ডক্টর দেখানোর ঝামেলা শেষ দিয়ে ওরা দেশে ফিরে আসে।
তীব্রর কাজটা করার আগে মিশান শর্ত দেয় আগে ওর বাটের একজনকে মারতে হবে।
তীব্র রাজি হয়ে যায়।
মিশান যে ছেলেটাকে মারবে বলে ঠিক করে,
সেই ছেলের পিছু নিয়ে সমস্ত আপডেট কালেক্ট করে ফেলে, এবার একটা অমাবস্যাতিথির জন্য অপেক্ষা যেরাতে হরর স্টাইলে মারবে।

চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here