বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ দুইবিংশ

0
1734

বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ দুইবিংশ
মম_সাহা

হাতের চিরকুটটা নিয়ে বেশকিছু ক্ষণ চিন্তা করেও কূল পায় নি নীলা।কিন্তু হাতের লেখা বেশ পরিচিত মনে হয়েছে তার।কোথাও দেখেছে এমন লেখা।কিন্তু ঠিক কোথায় দেখেছে মনে করতে পারে না নীলা।চিঠিটা ড্রয়ারের ভিতর রেখে বর্ণের জন্য খাবার সার্ভ করতে গেলো।

খাবার টেবিলে বর্ণ বসে খাবার খাচ্ছে।তার পাশের চেয়ারে নীলা বসে আছে। বাড়ি ভর্তি মানুষজন।আসা যাওয়ার পথে অনেকে তাকাচ্ছে বর্ণের দিকে।কেউ বর্ণের প্রশংসা করছে।কেউ ভাবার নীলাকে পাশে দেখে ভ্রু কুঁচকাচ্ছে।নীলা সবার দৃষ্টিই বুঝতে পারছে।সে কয়েকবার উঠে যেতে চেয়েছে কিন্তু পরক্ষণেই বর্ণের চোখ রাঙানি দেখে বসে পড়েছে।

বর্ণের খাওয়া প্রায় শেষের দিকে।বর্ণের খাওয়া শেষ হলেই তারা ছাদে যাবে।কাজিন সবাই সেখানেই আছে।নীলা বর্ণের জন্যই বসে আছে।

হঠাৎ করে এক মহিলার কেমন ঠেস মারা কন্ঠ ভেসে আসলো।মহিলা বলছে
-‘কিরে কালরাত হ্যাবলার মতন বসে আছিস যে এখানে?’

চির পরিচিত বিষাক্ত নামটা দেখে নীলার বুঝতে বাকি রইল না এই ব্যাক্তি কে।পিছে ঘুরে দেখে সে ঠিক ধরেছে।তার ফুফু হাবিবা খানম।নীলা বিরক্তিতে মুখ কুঁচকায়।নীলার মা আফসানা রহমান নিজের ননসের কথা শুনে রান্নাঘর থেকে তাড়াতাড়ি ড্রয়িং রুমে আসে।

বর্ণ ততক্ষণে খাবার খাওয়া থামিয়ে দেয়।মাহিলার কথার ধরণেই বলে দেয় মহিলা কোন ধরনের হবে।

হাবিবা খানম আফসানা রহমানকে দেখে ঠেস মেরে বলল
-‘আফসু তোমার মেয়ে দেখি সব আদব-কায়দা খেয়ে বসেছে। ওর বড় ফুফু আমি কতদিন পর বাড়ি আসলাম আর সে কিনা নবাবের বেটির লাহান চেয়ারে বসে আছে।সালাম কালাম দিতে হয় সেটা জানে না নাকি?’

আফসানা রহমান বাকি মায়েদের মতন না। কিন্তু তার ননসকে সে কিছুই বলতে পারবে না।অন্য কেউ হলে হয়তো কিছু বলা যেতো।তার ননস তিল কে তাল বানানো মহিলা।পরে কি থেকে কি হবে আর বাড়ি মাথায় উঠবে উপরওয়ালা মালুম।

নীলাও কোনো রকম ঝামেলা না করে তার ফুফুকে সালাম করলো সাথে ফুপাকেও সালাম করলো।ফুপা সুন্দর করে সালামের জবাব দিলো কিন্তু হাবিবা খানম মুখ ফিরিয়ে নিলেন।

মুখ ফিরিয়ে বেশ ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলল
-‘এভাবেই নানা ভাবে আমাদের মুখ পুড়াস সামান্য ভদ্রতা না জানলে তো বংশের মুখটাও পুড়াবি।আজিজ যে কীভাবে তোরে বড় করেছে আমি হলে উঠতে বসতে ঠাঁস ঠাঁস চড় লাগাতাম।’

নীলার ফুপা ফজলুর সাহেব ঠেস মেরে নিজের বউকে বললেন
-‘তোমারও তো ছেলেমেয়ে আদব কায়দা শিখেনি।সামনে মামী দাড়িয়ে আছে কই সালাম টালাম তো দিতে শুনলাম না।আর আজিজুরের বংশের মুখ তুমি জন্মের পরই পুড়েছে।’

হাবিবা খানম পারে না চোখ দিয়ে স্বামী ধ্বংস করে ফেলে।ফজলুর সাহেব আফসানা রহমানকে বলে তাড়াতাড়ি রুমে চলে যায়। এখানে থাকলে তার বদমাশ স্ত্রী অপমান করে বসবে।

বর্ণ হাত ধুঁতে উঠে গেলো।এই মহিলার কথাবার্তা তার মেজাজ খারাপ করে দিচ্ছে।বেশি ক্ষণ থাকলে মেজাজের আরও বারোটা বাজবে।তাড়াতাড়ি হাত ধুঁয়ে নীলাকে সরাতে হবে এখান থেকে।

ততক্ষণে হাবিবা খানম সোফায় সিট দখল করে বসলো।বর্ণের মা আর ফুফু রান্না ঘরের দরজা থেকে সবটা দেখছে।

হাবিবা খানমের এক ছেলে এক মেয়েও মায়ের সাথে এসে বসেছে।মেয়েটা পুরো মায়ের কার্বণ কপি হয়েছে। ছেলেটা বাবার মতন। ছেলে অনার্স শেষ করেছে আর মেয়েটা ইন্টারে।ওদের বড় বোনও আছে যে বিবাহিত একটা বাচ্চাও আছে।সে অবশ্য আসে নি আগামীকাল আসবে হয়তো। হাবিবা খানম সোফায় বসেই নীলাকে উদ্দেশ্য করে বলল
-‘কিরে আন্ধার পানি টানি দে।মেহমানদের সমাদর করতেও জানিস না দেখছি।’

নীলা কিছু বলার আগেই ওর মা তড়িঘড়ি করে বলল
-‘আপা আমি আনছি।নীলা তুই যা।’

হাবিবা খানম চরম বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বলল
-‘কই যাবে ও?তুমিই তাইলে ওরে এমন বানাইছো? ফুপু এতদিন পর আসলো।এখানে সমাদর করবে তা না মেয়েকে এখন থেকে তাড়াচ্ছো।’

আফসানা রহমান চরম অস্বস্তি অনুভব করছে।এখানে পরিবারের মানুষ ছাড়াও অনেক আত্মীয় স্বজন আছে। সবার সামনে তার এত বড় মেয়েটাকে কত গুলো কথা শুনালো। এখান থেকে না সরালে আরও কথা শুনাবে।

বর্ণ এবার এগিয়ে এসে মুখটা গম্ভীর করে বলল
-‘আসলে ওনার শরীর ভালো না।ওনি এসব কাজ করতে পারবে না।ওনার এখন ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে।’

বর্নের কথায় পূর্ণদৃষ্টিতে সবাই তাকালো বর্ণের দিকে। হাবিবা খানম বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল
-‘তুমি কে?তোমাকে তো চিনলাম না!’

আফসানা রহমান আগে আগে উত্তর দিলো
-‘আপা ও আপনার ভাইয়ের প্রিয় ছাত্র। নিরুপমার বিয়ের জন্য আসছে ওরা বেড়াতে।’

হাবিবা খানম জিজ্ঞেস করলেন
-‘কি করো তুমি?নাম কি?’

বর্ণের বিরক্ত লাগলো।আফসানা রাহমানের দিকে তাকাতেই তিনি করুন দৃষ্টি ফেললেন।বর্ণ বিরক্তিটা নিজের ভিতরেই দমন করে বলল
-‘আমি ডাক্তার। আমার নাম বর্ণ এহসান।’

ডাক্তার শুনে হাবিবা বেগমের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো।ন্যাকা ন্যাকা স্বরে গদোগদো হেসে বলল
-‘আরে বাবা তোমার আচার আচরণ কত ভালো একদম আমাদের রিংকুর মতন।এই যে আমার ছোট মেয়েও সবার সাথে এমন মিলেমিশে থাকে।’

বর্ণ মহিলার গদগদ কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। আজব কথাবার্তা। সে কখন ভালো ব্যবহার করলো আর মহিলার মেয়ের ভাব ভঙ্গিমা দেখেও তো এমন ভালো মনে হলো না।

বর্নের ভাবনার মাঝে হবিবার ছেলে দিগন্ত বলে উঠলো
-‘কি বলো মাম্মি?তোমার এই অসভ্য মেয়ে ভালো আচরণ করে?কবে থেকে?’

দিগন্তের কথায় ফিক করে হেসে উঠলো নীলা।তারপর মুখ চেপে ধরলো দু’হাতে।হাবিবা খানম কিছু বলতে উদ্ধত হলেই বর্ণ ওষুধ খাওয়ার নাম করে টেনে নিয়ে আসে সেখান থেকে।আফসানা রহমান কৃতজ্ঞতার হাসি হাসলেন।
________
ছাদে আড্ডার আসর বসেছে।নিরুপমা,নীলা,রাহাত,বর্ণ,রিংকু,দিগন্ত,নীড়,রঙ,অহন,নীলার বান্ধবী পুষ্পা,সিন্গ্ধা,অনন্ত,আবির,নীলার আরো চাচাত ভাই-বোন। বর্ণের পাশে রিংকু বসেছে একটু কিছু হলেই হা হা করে বর্ণের উপর এসে পড়ছে।এতে বেশ বিরক্ত বর্ণ।আর রাহাত অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছে নীলার সাথে কথা বলার কিন্তু পারছে না।আড্ডার আসর রমরমা।হাসি ঠাট্টা গান হচ্ছে।হঠাৎ দিগন্ত বলে উঠে
-‘সবাই দাঁড়াও রক আপু গান শুনাবে আমাদের কেমন?’

বর্ণ, নীড়,রঙ বাদে সবাই বুঝতে পেরেছে কার কথা বলেছে দিগন্ত। নীড় অবাক কন্ঠে বলল
-‘রক আপু আবার কে ছোট ব্রো?’

দিগন্ত হেসে বলে
-‘আরে ভাইয়া আমাদের নীল নীল নীলাঞ্জনা আপাই তো রক আপু।’

বর্ণ ভ্রু কুঁচকে বলল
-‘নীলা? নীলা রক আপু হলো কীভাবে?’

দিগন্ত হেসে বলল
-‘ভাইয়া নীলাপু হেব্বি গান জানে।লাষ্ট দু তিন বছর আগে শুনেছিলাম নিরু আপার বিয়ের দাওয়াত,,,,

থেমে যায় দিগন্ত। নীলা মুখ তুলে শক্ত চোখে তাকায়। রিংকু তাচ্ছিল্য করে বলে
-‘আর ভাইয়া বাকিটাও কমপ্লিট কর।নিরুপমা আপুর আগের বিয়ের দাওয়াতে এসে শুনেছিলি।’

দিগন্ত ধমক দেয় রিংকুকে।শক্ত কন্ঠে বলল
-‘তুই ছোট চুপ করে থাক।আন্দাজি কথা বলবি না।’

রিংকু কিছু বলতে নিলেই বর্ণ কথা ঘুরানোর জন্য বলল
-‘তাহলে তো আজ নীলাকে গান গাইতেই হবে।নীলা আজ গান গেতেই হবে।’

নীলা না না শুরু করে।কত বছর আগে গান গেয়েছিলো।এমনই উৎসব মুখর পরিবেশ ছিলো সেদিনটা।না না নীলার বুক কেঁপে উঠে। সে গাইবে না।সবাই জোড়াজুড়ি করছে এর মাঝেই নিরুপমা উঠে গেলো।সবাই নিরুপমাকে হঠাৎ উঠে যেতে দেখে অবাক হলো।নীলা বুজেছে তার বোনের আগের কথা মনে পড়ে গেছে।খারাপ লাগে নীলার।বর্ণ বুঝতে পারে নীলার মন খারাপ।দিগন্ত মুখ কালো করে বলে
-‘রক আপু আমি ভুলবশত বলে ফেলেছি। সরি আপু।’

নীলা কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে ‘ইটস ওকে’ বলে।আড্ডার আসর চুপ হয়ে যায়। নীলা উঠতে নিলেই নীড় বলে উঠে
-‘আরে ছোট আপুই কোথায় যাচ্ছো? নিরু আসবে দেখো।বসো তুমি।’

এর মাঝেই পিছন থেকে নিরুপমা বললো
-‘কই যাস নীলু?তোর জন্য কষ্ট করে গিটার আনতে গেলাম আর বাবাকেও নিয়ে আসলাম আর তুই কিনা চলে যাচ্ছিস? এই দুইটা ছাড়া তো তুই গান গাইতে পারিস না তাই নিয়ে আসলাম।বাবা আর গিটার।’

নীলা পারছে না ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদেই দিবে এখন।আজিজুর রহমান ছোট মেয়ের কাছে এসে জাত বুলিয়ে বলল
-‘গাও না মা।আপু এত শখ করে তোমায় বলেছে গাও।’

নীলা কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বলল
-‘বাবা সেদিনের মতন যদি,,

আজিজুর রহমান চোখ দিয়ে ইশারা করে বলল
-‘না মা একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে তুমি এসব বলতে পারো না।গাও।’

বর্নও চোখ দিয়ে ইশারা করলো।সবাই চুপ হয়ে গেলো।নীলা গিটারে সুর তুলে গাওয়া শুরু করলো
-‘বাবা মানে হাজার বিকেল আমার ছেলেবেলা,,
বাবা মানে রোজ সকালে পুতুল পুতুল খেলা,,
বাবা মানে যাচ্ছে ভালো কাটছে ভালো দিন,,
বাবা মানে জমিয়ে রাখা আমার অনেক ঋণ।’

গান গাইতে গাইতে নীলা বাবার কাছে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে বাবার হাতে চুমু খাই। তারপর আবার গায়,,

“বাবা মানে অনেক চাওয়া,
বাবা মানে অনেক পাওয়া,
বাবা মানে ছোট্ট শূণ্যতা,
বাবা মানে অনেক পূর্ণতা।”

তারপর নীলা রাহাতের দিকে তাকায়। কতক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আবার গায়

“আমি যখন এলোমেলো ভুলের অভিধান
বাবা তুমি সঠিক সময় সহজ সমাধান,,,

নীলার গান শেষ হতেই বাবার হাটুঁতে মুখ গুঁজে কেঁদে দেয় সে।উপস্থিত সবাই চোখে জল নিয়ে হাত তালি দিচ্ছে।নীলার গান শুনে নিচে থেকে ওর মা বর্ণের মা ফুপু আরও মহিলারাও এসেছিলো।

আফসানা রহমান আঁচলে মুখ চেঁপে কেঁদে দেয়।তার দুই রাজকন্যা যে তাদের আত্মা তাদের প্রাণ।

নিরুপমাও বাবার কাছে এসে কেঁদে দেয়।দুই মেয়েকে বুকে গুঁজে নেয় বাবা।জেনো পৃথিবীর সব দুঃখ থেকে এভাবেই আড়াল করছে তার মেয়েদের।বাবার প্রশস্ত বুকেই জেনো মেয়ের স্বর্গ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here