অব্যক্ত_প্রিয়তমা,part_4

0
1425

অব্যক্ত_প্রিয়তমা,part_4
ফাতেমা_তুজ

টানা সারা দিন কান্না করায় কন্ঠ ভেঙে গেছে অনিন্দিতার। হাতের ব্যাথায় আর টানা কান্না করায় ঠান্ডা লেগে জ্বর ও এসে গেছে। তিন দিন অব্দি এ জ্বর বেড়েই চললো। সাত দিনের মাথায় জ্বর নামলো। সবাই দেখতে আসলে ও নির্ভীক দেখতে এলো না এতো টা হেলায় ও মেয়ে টা নির্ভীক কে খুঁজে চলেছে। কিন্তু কোথাও নির্ভীক কে দেখা গেল না। মাঝে একদিন ডাক্তার দেখানোর জন্য বের হচ্ছিলো। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় চোখাচোখি হয়। তবে নির্ভীক তাঁর খোঁজ নেয় নি। শাহানার সাথে দু একটা কথা বলে চলে গেছে। প্রচন্ড কষ্ট নিয়ে দশ দশ টা দিন কাটিয়ে দিলো অনিন্দিতা। এখন শরীর অনেক টাই সুস্থ। চারুলতার কথা অনুযায়ী আজ নির্ভীক পড়াতে আসবে। বেজায় খুশি মেয়েটা। কতো দিন পর আজ নির্ভীক কে দেখতে পাবে।
পরিপাটি হয়ে বসে আছে অনিন্দিতা। যদি ও নির্ভীক তাঁর দিকে ফিরে ও তাকায় না তবু ও নিজেকে পারফেক্ট দেখানো চাই ই চাই।
হঠাৎ করেই ফোন বেজে উঠলো। ইনতেহা কল করেছে। রিসিভ করেই বললো
_ হ্যাঁ ইনতেহা বল।

_ এখন কেমন আছিস তুই ?

_ ভালো ।

_ এখনো মন খারাপ ? নির্ভীক ভাইয়া তোকে দেখতে আসে নি না ?

_ আরে তা কেন হবে। এই তো সেদিন ওহ সিঁড়ি তে দেখা হলো। অতো ঘটা করে দেখা সাক্ষাৎ হয় নাকি ?

কথা গুলো বলার সময় অনিন্দিতার স্বর কেঁপে উঠলো। কতো কষ্টে নিজের আবেগ লুকিয়ে আছে তা নিজে ও জানে না। ইনতেহার দীর্ঘশ্বাস বুঝিয়ে দিলো সে ধরা পরা গেছে।
_ আমাকে বোঝাতে হবে না আর। আজ থেকে নির্ভীক ভাইয়ার তোকে পড়ানোর কথা তাই না?

_ হ্যাঁ। আন্টি তো বলেছে দেখি ওনি আসেন কি না।

_ আচ্ছা ঠিক আছে। ভালো করে পড়িস কিন্তু এমনিতেই একটা বছর পিছিয়ে গেলি। এখন রাখছি কেমন ?

_ আচ্ছা।

অনিন্দিতা ফোন রেখে দিলো। চোখে পানি চিক চিক করছে। পেছন ঘুরতেই নির্ভীক কে দেখতে পেল। অবাক চোখে তাকালো। নির্ভীক তাঁর বুকসেলফ নাড়াচাড়া করছে। কখন এলেন ওনি ?

_ কিছু ম্যাথ লিখে দিয়েছি সলভ করুন।

অনিন্দিতা মাথা ঝাঁকালো ঠিক ই তবে চোখ সরালো না।ব্ল্যাক ট্রাউজার এর সাথে ছাই রঙা টি শার্ট টা এতো ভালো যায় জানা ছিলো না।
নির্ভীক পেছন ঘুরে তাকালো। অনিন্দিতা কে তাকিয়ে থাকতে দেখে বেশ বিব্রত হলো। তবে তেমন কিছু না বলে বই দুটো টেবিলে রাখলো। অনিন্দিতার সে দিকে খেয়াল নেই।
_ দেখা শেষ হলে পড়তে বসুন।

অনিন্দিতা চমকে তাকালো। নির্ভীক এর কথায় খানিকটা লজ্জা পেল। নির্ভীকের ডান হাতের দিকে বার বার তাকানোর চেষ্টা চালালো। তবে ব্যর্থ হলো। ছেলেটার হাতে এখনো কি যন্ত্রনা হয় ?

স্কেল দিয়ে টেবিলে বারি দিতেই অনিন্দিতা চমকে উঠলো। নির্ভীক মুখে কাঠিন্য এনে বলল
_ আমি কি চলে যাবো ?

_ স্যরি।

নির্ভীক উত্তর দিলো না। অনিন্দিতা পড়তে বসলো। বার বার মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটছে। হঠাৎ করে নির্ভীকের ফোন আসলো। ফোন রিসিভ করে ব্যলকনিতে চলে গেল।

*

লেকের ধারে বসে আছে রোজ। মেয়েটার সুশ্রী মুখে বিন্দু বিন্দু চিন্তার ছাপ। সূর্য তাঁর সারাদিনের কর্মব্যস্ততার জীবন পেরিয়ে আকাশের বুকে নিজে কে লুকিয়ে নিয়েছে। ভারী নিশ্বাসের শব্দ কেমন নিস্তব্ধতার সুর তুলেছে । বার বার ঘড়ি দেখছে সে। উপায় না পেয়ে ফোনে নাম্বার ডায়াল করে কল লাগালো।
_ আর কতোক্ষন লাগবে নির্ভীক ?

_ আসছি তো। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম ইয়ার।

_ জ্যামে বসে থাক তুই। এদিকে পুরো লেক ফাঁকা হয়ে গেছে। কেউ তুলে নিয়ে গেলে আমাকে আর পাবি বল ?

_ রাগ করিস না একটু ওয়েট কর। এসেই পরেছি ।

_ আচ্ছা আয়।

রোজ কল কেঁটে মৃদু হাসলো । ফোনের লক স্ক্রিনের তাঁর আর নির্ভীকের হাস্য উজ্জল ছবি।
কানাডা তে ভারসিটির শেষ দিনে ছবি টা তোলা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নির্ভীকের অপেক্ষা করতে লাগলো।

মিনিট দশেক পর নির্ভীক চলে আসলো। রোজ হালকা হেসে সে দিকে আসলো। নির্ভীককে এক হাতে জড়িয়ে বলল
_ অসভ্য প্রথম দিনেই এতো লেট ?

_স্যরি।

রোজ বিগলিত হাসলো। নির্ভীকের বা হাত টা গুটানো দেখে ভ্রু কুঁচকালো। খপ করে নির্ভীক এর হাত ধরতে যেতেই নির্ভীক সরে গেল
_ দেখা হাতে কি আছে !

_ দেখাবো না।

_ খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।

_ তো ?

_ নির্ভীক আমি কিন্তু তোকে খুব মারবো।

নির্ভীক ভয় পাওয়ার ভান করে বলল
_ মাফ কর আমায়। দেখাচ্ছি তো একটু ওয়েট।

রোজ মাথা ঝাঁকালো। নির্ভীক পেছন থেকে এক গুচ্ছ অর্কিড বের করে দিতেই রোজ লাফিয়ে উঠল। নির্ভীক মৃদু হাসি ফুঁটিয়ে তাকালো । রোজের সামনে আসা চুল টেনে দিয়ে বলল
_ এটার জন্য ই এতো লেট হলো। কতো গুলো ফুলের দোকান ঘুরতে হয়েছে। সময় আর টাকা দুটোই গেছে।

_ খোটা দিচ্ছিস ?

_ একটু একটু।

রোজ খিল খিল করে হাসে। নির্ভীক ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বলল
_ কোন রেসট্রন ?

_ রেসট্রন নয় ক্যাফে তে যাবো।

*

রক্ত রাঙা কাগজ টা তে নাক ডুবিয়ে রেখেছে অনিন্দিতা। নির্ভীকের রক্তের ঘ্রান যেন তাঁকে পাগল করে দিচ্ছে। বার বার রক্ত রাঙা কাগজ টা তে ঠোঁট ছোয়াচ্ছে।
নির্ভীকের স্পর্শ করা বই গুলো বুকে চেপে ধরেছে। বিকেলে কারো সাথে কথা বলে বেরিয়ছিলো নির্ভীক। তাঁতে একটু মন খারাপ হয়েছিলো তবে ভীষন সুখ সুখ অনুভূতি হচ্ছে।
যাওয়ার আগে নির্ভীক তাঁকে এক বার ঘুরে দেখেছে । যদি ও চোখে মুখে ছিলো বিরক্তির নীল ছায়া।

_ অনি এই অনি ।

_ আসছি আম্মু ।

বই গুলো গুছিয়ে অনিন্দিতা চলে গেল। শাহানা ব্যথায় কুকরে গেছেন। হীর পা টিপে দিচ্ছে।
_ কি হয়েছে আম্মু ?

_ বাতের ব্যাথা টা বোধহয় বেরেছো। সাথে মাথা টা ঝিম মেরে আছে।

_ আচ্ছা আমি তেল মালিশ করে দিচ্ছি।

_ তাঁর আগে নাস্তা টা খেয়ে নে।

_ পরে খাবো।

খুব যত্নে মায়ের মাথায় তেল মালিশ করে দিচ্ছে অনিন্দিতা। হীর পা টিপে দিতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরেছে।শাহানার চোখ ও প্রায় লেগে এসেছে।

_ আম্মু

_ হুমম

_ মনে আছে ছোট বেলায় একটা গল্প শুনিয়ে ঘুম পারাতে আমায় ?

_ হুমম। তাঁতে কি হয়েছে ?

_ গল্প টা শোনাও না প্লিজ।

_ এখন কি বাচ্চা আছিস তুই ? ঐ সব তো রূপকথার গল্প। বাস্তব হয় না কখনো।

_ আহা বলো ই না।

_ আচ্ছা বলছি।

গল্পের কথা শুনে জেগে বসেছে হীর। শাহানার পায়ের কাছে আরাম করে বসলো দুজনে। থুতনি তে হাত দিয়ে গল্পের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।

“একি দেশে বাস করতো এক রাজ পুত্র আর এক রাজকন্যা। দুজনের মাঝে তেমন কিছুই মিল ছিলো না। তবে রাজকন্যা বেশ পছন্দ করতো রাজপুত্র কে। আর রাজপুত্র তাঁর উল্টো। রাজকন্যা কে একদম ই দেখতে পারতো না। এক টা সময় সে ও রাজকন্যা প্রেমে পরে যায়। তখন রাজকন্যা বেঁকে বসে। আর রাজপুত্র পাগলের মতো করতে থাকে। হাজারো কষ্টের মাঝে জর্জরিত রাজ পুত্র ভেঙে পরে। রাজকন্যা নিজের প্রিয়তমর কষ্টে কষ্টিত হয়। সমস্ত কিছু ছাপিয়ে রাজপুত্রর কাছে ফিরে আসে। আর তারপর রাজ পুত্র আর রাজকন্যা একটা লম্বা জীবন এক সাথে কাঁটায়। ”

হীর হাত তালি দিয়ে উঠলো। শাহানা হেসে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হয়। অনিন্দিতার চোখ চকচক করছে। আচ্ছা তাঁর রাজপুত্র কি কখনো তাঁর হবে ? সে ও কি নির্ভীকের সাথে লম্বা একটা জীবন কাটাবে ?
নাকি রূপকথার গল্প রূপকথাই থেকে যাবে।

*

” আব্বু আমি আবার কানাডা ফিরে যেতে চাই। তিন মাস অন্তর অন্তর না হয় দেশে আসবো। তবু ও বারন করো না প্লিজ । ”

ছেলের কথা তে প্রচন্ড চমকালেন আজমল। সাত বছর বিদেশে পড়াশোনা করেছে । তাই বলে এখনো বিদেশে চলে যাবে?
আজমল একটু সময় নিয়ে ভাবলেন। মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে বললেন
_ তোমার এমন সিদ্ধান্তের কারন কি নির্ভীক ?

_ এমনি । তুমি জানো কানাডা তে আমার খুব ভালো জব হয়েছিলো। সেলারি ওহ ছিলো তিন গুন।

_ টাকার জন্য কানাডা ফিরতে চাচ্ছো ?

_ তেমন টা নয়। আসলে আমার ভালো লাগছে না বিডি তে।

_ যদি টাকা নিয়ে ভেবে থাকো তাহলে আমি বলবো তোমার বাবার যা টাকা আছে এতে তুমি বেশ ভালো জীবনযাপন করতে পারবে।
আর যদি অন্য কিছু হয়ে থাকে তাহলে বলবো ভুলে যাও সেই সব বিষয়। এইচ এস সি পরীক্ষার পর ই বিদেশে পারি জমিয়েছো । আমাদের বয়স হয়েছে তোমাদের প্রয়োজন।

_বিদেশে থাকলে ও তো আমি তোমাদের কাছে ফিরবো। তাহলে সমস্যা কোথায় আব্বু ?

_ ভুলে যেও না তিন বছরের চুক্তি করেছো এন এস ইউর সাথে।

_ সেটার জন্য ই তো তোমার সাহায্য প্রয়োজন।

বাবা ছেলের এক প্রকার কথা কাঁটা কাটি হয়ে গেল। নির্ভীক রেগে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। আজমল কিছু একটা ভাবলেন। চারুলতা কে আশে পাশে খুঁজলেন ।
কিচেনে দেখতে পেয়ে সে দিকেই পা বাড়ালেন।
_ চারু ।

_ হুমম বলো।

_ তোমার ছেলে কি কাউকে পছন্দ করে ?

_ কার কথা বলছো ?

_ নির্ভীকের কথা বলছি। কানাডা ব্যাক করতে চাচ্ছে।

চারুলতা ভীষন অবাক হলেন। একটু ভেবে বললেন
_ ছাড়ো তো ওর কথা। ছেলে মানুষ , খাম খেয়ালি হলে যা হয় আর কি।

আজমল ওহ আর কথা বাড়ালেন না। চারুলতার থেকে চা নিয়ে লাইব্রেরির দিকে পা বাড়ালেন। বহু দিন হলো বই পড়া হয় না। মন টা অশান্ত বইয়ের সাথে ডুবে যেতে হবে।

একের পর এক কলে বিরক্ত হলো নির্ভীক। চারুলতা ফোন করে যাচ্ছে। রাত প্রায় দেড়টার কাছা কাছি অথচ নির্ভীক বাসায় নেই। অনিন্দিতার পরিবার সহ আর ও কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে। অনিন্দিতা ঘুমে ছিলো। নির্ভীক বাসায় নেই কথা টা শুনেই লাফিয়ে উঠে পরেছে।

বার বার বাইরের দিকে তাকিয়ে যাচ্ছে। নির্ভীক আসছে না। ছেলেটার কোনো বিপদ হলো না কি সেটা ভাবতেই হাত পা অবশ হয়ে যাচ্ছে। হৃদপিন্ড যেন বুক চিরে বের হতে চায়। দম বন্ধকর অবস্থা । কিন্তু কোনো এক শক্ত বলের কারনে ব্যাঘাত ঘটছে।
চারুলতা কান্না জুড়ে দিয়েছে। রাত দুটো বাজতে চলেছে। নিহাল দীর্ঘশ্বাস ফেলে নির্ভীক কে খুঁজতে বের হবে তখনি গাড়ির হর্ন বেজে উঠলো।
সবাই সে দিকে ছুটে গেলে ও অনিন্দিতা গেল না। ওর দৃঢ় বিশ্বাস ওকে দেখলে আবার রাগ করবে নির্ভীক।
তাই পিলারের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইলো। মিনিট পাঁচেক পর সবাই চলে আসলো। নির্ভীক কে দেখতে পেল না। মনের ভেতর যেন ঝড় তুলেছে।
সবাই ভেতরে চলে গেলে ও অনিন্দিতা গেল না। ছুটে গেল বাইরের দিকে। অসাবধানতার কারনে ধুম করে মাথায় বারি খেল। তখনি বাসার ভেতরে আসলো নির্ভীক।
অনিন্দিতা অশ্রু শিক্ত নয়নে তাকালো। প্রানে যেন পানি ফিরে পেয়েছে। নির্ভীকের মুখে চরম বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ। তাঁতে ও যেন মেয়েটার শান্তি।

[ থিম নিয়ে কিছু কথা : অনিন্দিতা চরিত্র টি হলো অত্যাধুনিক পাগল। এই চরিত্রে থাকবে ছ্যছরামি। কেন আত্মসম্মান নেই মেয়েটার ? কারন হলো ভালোবাসা। আপনি যদি ভালোবাসেন তো আত্মসম্মানের খেয়াল থাকবে না। সামনে অনিন্দিতার আরো পাগলামি দেখতে পাবেন। এই চরিত্র তৈরির একটাই উদ্দেশ্য ছেলেরাই কেন ভালোবাসার জন্য পাগলামি করবে মেয়েরা কেন পারবে না ? মেয়েদের ভালোবাসা কি এতো টাই ঠুনকো ?
তাই বলে কেউ এটা ভাববেন না আমি নারী চরিত্র টিকে অপমান করছি। আমি অন্য রকম ভাবে চরিত্র টি ফুটিয়ে তুলতে চাচ্ছি । নির্ভীকের আচারন নিয়ে আমি পরের পার্ট এ বলবো। ]

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here