অব্যক্ত_প্রিয়তমা,part_6,7

0
1168

অব্যক্ত_প্রিয়তমা,part_6,7
ফাতেমা_তুজ
part_6

দ্রুত রেডি হয়ে নেয় অনিন্দিতা। নির্ভীক সময়ের অপচয় একদম ই পছন্দ করে না। পরীক্ষার পিপারেশন বেশ ভালো। ভালোয় ভালোয় চান্স টা পেয়ে গেলেই হয়। দোয়া পড়ে বেরিয়ে যায় মেয়েটা। নির্ভীক দের বাসার কলিং বেল চাপার আগেই দরজা খুলে যায়। শুভ্র সাদা শার্ট এ নির্ভীক কে আইসক্রিমের মতোই লাগছে। ছেলেটার গালের খোঁচা খোঁচা দাড়ি তে হাত বুলাতে ইচ্ছে হলো। অনিন্দিতা তাঁর ইচ্ছে দমাতে পারলো না। ফট করে নির্ভীকের গাল ছুইয়ে দিলো। প্রচন্ড পরিমানে ঝটকা খেল নির্ভীক। পরীক্ষার দিন হওয়াতে তেমন কিছু ই বলল না। অনিন্দিতা বেশ অবাক হলো । নির্ভীক তাকে ফেলে হাঁটতে লাগলো। অনিন্দিতা ভাবলো ছেলেটা তাঁর প্রতি একটু মায়ায় পরেছে।
_ একটা কথা বলবো ?

_ আপনার সাহস আলোর থেকে ও অধিক হারে বেড়ে গেছে অনিন্দিতা। নিজেকে সংযত করবেন। ভারসিটি তে কোনো ভেজাল চাই না আমি।

_ নির্ভীক ভাইয়া !

_ পড়া শোনা নিয়ে কিছু বলার থাকলে বলুন। অযথা কথা বলা আমার পছন্দ নয়।

অনিন্দিতা দমে গেল। কেউ যেন বুকে তীর ছুড়ে দিয়েছে। প্রতি নিয়ত সেই স্থান থেকে রক্ত ক্ষরন ঘটে। আর সন্তপর্নে পাষানের মতো নির্ভীক তা উপেক্ষা করে। নেত্র পল্লবে পানি জমেছে। বা হাতে তা মুছে নিলো।

গাড়ি তে উঠে বসেছে নির্ভীক । অনিন্দিতা সে দিকে খেয়াল করে নি। বার বার হর্ন বাজাতে বাজাতে বিরক্ত হলো। পরিশেষে ধমকে সুরে বলল
_ অনিন্দিতা।

নির্ভীকের কঠিন কন্ঠে ভরকে গেল মেয়েটা । সহসা নির্ভীক এমন ধমক দেয় না। কঠিন কথা বললে ও কন্ঠ শান্ত রাখে।
অকস্মাৎ নির্ভীক বেরিয়ে আসে। অনিন্দিতা মুখো মুখি হয়ে দাঁড়ায়। দু চারটে কড়া কথা শোনাবে তখনি ফোন বেজে উঠে।
প্রচন্ড রকমের বিরক্ত হয়। তবে স্ক্রিনে থাকা নাম টা দেখে হেসে ফেলে। অকস্মাৎ এমন পরিবর্তনে হতবাক হয়ে যায় অনিন্দিতা।
কথা শোনার চেষ্টা চালালে ও শুনতে পায় না।
তবে ফোনের অপর পাশের ব্যক্তি টি যে নির্ভীকের খুব প্রিয় তা মুখের ভঙ্গিমা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

অনিন্দিতা আশাহত হলো। হঠাৎ করে মাথায় চরাও করে উঠলো সেই মেয়েটার কথা। যাকে আলিঙ্গন করেছিলো নির্ভীক।

ফোনে কথা বলা শেষ হলে নির্ভীক এগিয়ে আসে। শান্ত স্বরে বলে
_ চলুন।

অনিন্দিতা উত্তর দেয় না। ডোর খুলে গাড়ি তে উঠে বসে।

এন এস ইউ ভারসিটির পরীক্ষার হলের কাছে এসে গাড়ি পার্ক করে। উপদেশ দেওয়ার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই। তবু ও দিতে হবে। আজমাল বার বার বলে দিয়েছি সাহস দিতে। নির্ভীক সে দিকে পাত্তা দিলো না। শুধু বলল
_ যেকোনো সমস্যা হলে গার্ড কে প্রশ্ন করবেন।
যেহেতু আপনি শপথ নিয়েই ফেলেছেন তাই ভালো করে পরীক্ষা দিন। আশা করি এবার চান্স না পেলে পাগলামি করবেন না।

অনিন্দিতা ফিচেল হাসে। নির্ভীকের কথার পৃষ্ঠে বলে
_ কিছু সময় পাগলামি করতেই হয়। যাকে ছ্যছরামি ওহ বলা চলে।

ঘন্টা বেজে উঠে। ছুটে যায় অনিন্দিতা। নির্ভীক তাজ্জব বনে গেছে। সে বুঝতে পারে না এই টুকু মেয়ের এতো তেজ কি করে ?
দীর্ঘশ্বাসে ভরে উঠে চারপাশ। শান্তির জন্য হলে ও রোজ কে কল করা দরকার।

*

পরীক্ষা টা খুব ভালো হয়েছে অনিন্দতার। ফুল মার্ক না পেলে ও 90% নাম্বার থাকবেই। 80% মার্ক হলেই চান্স পাওয়া যাবে। কোনো আড়ষ্ঠতা ছাড়াই পরীক্ষা দিয়েছে সে। যদি ও দুটো মেয়ে তাকে গ্যাপ দেওয়া নিয়ে উত্যক্ত করেছে। সে দিকে পাত্তা দেয় নি। নির্ভীক তাঁর কাছে সব থেকে বড়ো ট্রফি। যা পাওয়ার জন্য এক বছর গ্যাপ নিতান্তই তুচ্ছ।

ভারসিটির সুন্দরী ম্যাডাম মেহেরিমার সাথে কথা বলছে নির্ভীক। দুজনের বয়সের পার্থক্য তেমন নেই। মেহেরিমা এন এস ইউ তেই পড়াশোনা করেছে। ভাগ্য ক্রমে লেকচারার ও হয়ে গেছে। সব থেকে মজার বিষয় ভারসিটির বাচ্চা ছেলে রা ওহ তাকে প্রেম পত্র পাঠায়। কেউ বা শখের বসে কেউ বা সিরিয়াস মুডে। প্রতি টা প্রেম পত্র ই তীক্ষ্ম বুদ্ধি দিয়ে প্রত্যাখান করে সে।

_ নির্ভীক তুমি কিন্তু ভারী মজার মানুষ।

_ তেমন কিছু না। তবে হাসতে ভালোবাসি। জীবন তো হেসে খেলেই যায় তাই না ?

_ হ্যাঁ সেটাই। আমাকে দেখো বয়স 25 পেরোলে ও বিয়ের ইচ্ছে হয় নি। হাসি মজা তেই বেশ ভালো আছি।

নির্ভীক হাসে। মেহেরিমা কলিগ হিসেবে খুব ই ভালো। বয়সের পার্থক্য খুব অল্প হওয়াতে তুমি করেই সমোন্ধন করে। যদি ও ভারসিটির অনেকের কাছে সেটা দৃষ্টি কটু মনে হতে পারে। তাতে কোনো সমস্যা নেই ওদের। মেহেরিমার সাথে আজকের পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা বলে নিলো। পরীক্ষা প্রচন্ড হার্ড হয়েছে এবার।নির্ভীক সামান্য খুশি হলো। পরক্ষনেই ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেল। অনিন্দিতা এবারো কি পাগলামি করবে ?

বিষয়টা খুব লজ্জা জনক। কোনো ভাবে অনিন্দিতার বিষয় টা সকলে জেনে গেলে তখন জটলা বাঁধবে। ফ্যামিলি ই বা কি ভাববে ? সব কিছু মিলিয়ে নির্ভীক চাইলো অনিন্দিতা যেন পাস করে যায়।

মেহেরিমার সাথে কথা বলতে দেখে অনিন্দিতার মন বিষিয়ে গেল। খুব সুন্দরী মেহেরিমা। গত বার ও দেখেছিলো ।কখনো তাঁর সাথে কথা হয়ে উঠে নি। তবে শুনেছে বেশ রসিকতা জানে মেয়েটা।

অনিন্দিতা রসিকতার দোহাই দিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো। এক চিলতে হেসে নির্ভীকের দিকে আগালো। মাত্র ই মেহেরিমা কে বিদায় জানিয়েছে। ঠিক তখনি অনিন্দিতার আগমন যেন চোখের বিষ হয়ে উঠলো।
অধরের হাসি টা মিলিয়ে গেল মুহুর্তেই । মুখে কাঠিন্যর ভাব। প্রচন্ড মন কষ্ট নিয়েও অনিন্দিতা হাসলো। নির্ভীক নিজেকে শান্ত করে বলল
_ পার্কিং এ যান আমি আসছি।

*

ঘর্মাক্ত মুখে এদিক ওদিক চোখ বুলাচ্ছে আসিম। একটুর জন্য মিস করেছে সে।তবে দমে থাকার পাত্র যে সে নয়। প্রায় দশ মিনিট খুঁজে পার্কিং এর দিকে চলে আসলো।

গলায় কার্ড ঝুলিয়ে হাতেস হার্ড বোর্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অনিন্দিতা। প্রায় মিনিট দশেক হয়ে গেল। অথচ নির্ভীকের আসার নাম নেই।
নির্ভীক কি কোনো কাজে আটকে গেল ? নাকি ইচ্ছে করেই এমন করলো। নিজের কথার মর্ম করলো না সে। নির্ভীক কেই গুরুত্ব দিলো।
হাসি খুশি মনে নির্ভীকের অপেক্ষায় থাকা মেয়েটাকে হঠাৎ ভো বলে চমকে দিলো কেউ।
ছিটকে দু হাত পিছালো। পেটে হাত দিয়ে হাসছে আসিম। অকস্মাৎ ঘটনায় অবাক হলো। আসিম কে চেনা চেনা ঠেকছে। মনে করার চেষ্টা চালালো। মনে পরতেই ভ্রু বেঁকে গেল।
হাসতে হাসতে আসিম তাঁর কাছে চলে এসেছে। সামান্য দুরুত্বে চলে গেল অনিন্দিতা।
আসিম বলল
_ তোমাকেই খুঁজছিলাম। কতো টা দৌড় করালে জানো ?

_ আমি ?

_ হ্যাঁ , তুমি।

আসিমের কথা গুলো প্রচন্ড রকমের হেয়ালি লাগছে । বিরক্তি প্রকাশ করতে বিবেকে বাঁধছে । কথা পাল্টে নিলে ও আসিম থামলো না। অনিন্দিতার থেকে সামান্য দুরুত্ব রেখে বলল
_ হল থেকে বের হতে দেখেলাম তোমায়। কিন্তু বন্ধুর ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে দিক ভ্রান্ত হলো।

_ তুমি এখানে ?

প্রচন্ড অবাকের সহিত কথা টা বললো অনিন্দিতা । আসিম ফিচেল হেসে বলল
_ তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য।

_ হোয়াট।

_ বিশ্বাস হচ্ছে না ?

অনিন্দিতা ভ্রু কুঁচকালো। আসিম আরেক দফা পেট চেপে হাসলো। এক হাতে মাথার চুল গুলো ঠিক করে নিলো। শার্টের হাতা ফোল্ড করে বলল
_ আমি এন এস ইউ তেই পড়ি। তোমার বোকামির জন্য তুমি আমার জুনিয়র হয়ে গেলে।

কথা টা পছন্দ হলো না অনিন্দিতার। সে কোনো বোকামি করে নি। নির্ভীক তাঁর কাছে স্বপ্নের মতো। যে স্বপ্ন পুরনে হাজারো বিসর্জন দিতে রাজি। আসিম যেন কিছু বুঝতে পারলো। অনিন্দিতার বাহু তে ধাক্কা মেরে বলল
_ রাগ করলে তুমি ?

_ না।

_ স্যরি । আমার এভাবে বলা উচিত হয় নি। আসলে আমি এন এস ইউ তে পড়তে চাই নি। আমার আপু আমাকে জোড় করে এডমিশন করিয়েছি। আর দেখো এন এস ইউ তোমার স্বপ্ন।

_ এটা আমার স্বপ্ন নয় , এটা আমার জীবনের অংশ।

_ ওয়াও ! দারুন বললে তো। বাই দ্যা ওয়ে তুমি কি ছোট থেকেই এন এস ইউ তে পড়তে আগ্রহী ছিলে ?

অনিন্দিতা হাসলো। পেছন ঘুরে নিলো। লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বলল
_ উহহু। এক বছর আগে আমার স্বপ্ন আমার অংশ এ ভারসিটি তে জড়িয়ে পরেছে।

আসিম বুঝতে পারলো না। প্রচন্ড পেঁচানো কথা বলে মেয়েটা। নিজে কে সংযত করলো। অধিক প্রশ্নে বিরক্ত না হয়ে যায়। হাত দিয়ে কপালে স্লাইড করে বলল
_ এবার এক্সাম কেমন হলো ?

_ ভালো।

_ বাই দ্যা ওয়ে আমরা কি বন্ধু হতে পারি ?

কথা টা একদম বাচ্চাদের মতোই বললো। যেন কোনো বাচ্চা ছেলে চকলেটের জন্য অনুরোধ করছে।
অনিন্দিতা প্রশস্ত হাসলো। আসিম কিছু বলবে তাঁর আগেই একটা ঝাঁঝালো কন্ঠ ভেসে আসলো।
_ আসিম !

ঘুরে তাকালো আসিম। নির্ভীক কে দেখে মৃদু হাসলো।
_ জি স্যার ।

_ আজ তো ভারসিটি অফ ছিলো। হঠাৎ কি কারনে আসলে ?

_ এমনি এক্সাম দেখতে এসেছিলাম। গত বছরের তুলনায় এবার অনেক হার্ড হয়েছে।

_ হ্যাঁ। আচ্ছা তোমার কি মনে হয় , এবার এক্সাম দিলে তুমি টিকবে ?

আসিম হাসলো। জোড়ালো কনফিডেন্স নিয়ে বলল
_ অবশ্যই । মনে আছে গত বার না পড়েই এক্সাম দিয়েছিলাম। তবু ও টপ লিস্ট এ ছিলো আমার মার্ক।

_ কনফিডেন্স ভালো তবে ওভার কনফিডেন্স ভালো নয়। না হলে জীবনে পিছিয়ে যেতে হয়।

কথা টা অনিন্দিতার গায়ে এসে লাগলো। কারন নির্ভীকের কথা টা বুঝতে পেরেছে সে। কথাটা তাকেই এট্রাক করে বলা। তবু ও মন খারাপ করলো না। কারন ড্যাম সিউর এবার চান্স হবেই।

নির্ভীকের সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা চললো আসিমের। এক মুহূর্তের জন্য অনিন্দিতা ভেবেছিলো নির্ভীক প্রশ্ন করবে আসিমের সাথে তাঁর পরিচয় কি করে। তবে তাঁর কিছু ই হলো না। আসিমের সাথে হেসে কথা বললে ও অনিন্দিতার প্রতি আগ্রহ নেই তাঁর। চোখ দুটো ছলছল করছে। অনিন্দিতার মনে হলো মরন বুঝি খুব ই সোজা। কারো অবহেলা হৃদয় কে এতো টা ব্যথিত করে জানা ছিলো না।

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন ।

চলবে…..

#অব্যক্ত_প্রিয়তমা
#ফাতেমা_তুজ
#part_7

পরীক্ষা দিয়ে নিজের জন্য যত টা না টেনশন হয়েছে তাঁর থেকে হাজার গুন টেনশন হচ্ছে অনিন্দিতার রেজাল্ট নিয়ে। যদি ও নির্ভীক নিজে দুটো এক্সাম পেপার দেখেছে। তবু ও নির্ভীক এর টেনশন হচ্ছে। অনিন্দিতার পাগলামি তে বিরক্ত সে। আর কতো সহ্য করবে ?
এমন পাগলামি কারো ই কাম্য নয়। একটাই ভয় শেষ মেশ ভয়ঙ্কর কিছু না হয়ে যায়। অন্য দিকে চার হাত পা তুলে দিয়ে আরাম করছে অনিন্দিতা। কোথায় মুখে টেনশনের কালো রেখা পরবে তা না হয়ে সুশ্রী মুখ টা আরো বেশি চকচকে হয়েছে।

শাহানা বেগম সকাল সকাল তুমুল চটেছেন। বছর খানেক হয়ে গেছে বাপের বাড়ি যান না ওনি। সবাই রাজি থাকলে ও অনিন্দিতা রাজি হয় না। দাঁত কামড়ে এই বাসাতেই পরে থাকে। হীরের ভীষন মন খারাপ। কারন মামাতো ভাই পৃথিবীর উপর বেশ বড় সড় ক্রাশ খেয়ে আছে। যদি ও বয়সের ফারাক বছর ছয়েক তবু ও পৃথিবীর সাথে মারা মারি করে। হীরের সন্দেহ আছে পৃথিবী ও তাকে পছন্দ করে। এই তো তিন মাসে আগে মামার বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছে। তিন মাস যেতে না যেতেই গত সপ্তাহে পৃথিবী তাঁদের বাসায় চলে এসেছে। তবে একদিন থেকে চলে গেছে। যাহ বড্ড পীড়া দায়ক। অনিন্দিতার বাহু ঝাঁকিয়ে বলল
_ প্লিজ আপু চলো প্লিজ। তুমি না গেলে আম্মু যাবে না। আর আমার ও যাওয়া হবে না।

_ আমি যাবো না বলেছিই তো।

_ আপু !

_ যদি সকাল দশটার পর গিয়ে বিকেল চারটের আগে ফিরে আসে তাহলেই যেতে পারি।

_ আপু এটা কি করে সম্ভব ?

_ কেন সম্ভব নয় ?

_ দশটার পর বের হলে দুটো বেজে যাবে পৌছাতে। চারটের আগে ফিরবো কি করে ? এটা অসম্ভব !

_ তাহলে আমার যাওয়া টা ও অসম্ভব।

হীর রেগে গেল। কোল বালিশ টা ছিটকে ফেলে দিলো। অনিন্দিতা কিছু বললো না। ডায়েরী হাতে লেখা লেখি করতে লাগলো। হীরের রাগ আকাশের চূড়ায়। ডায়েরী টা ছিঁড়ে ফেলতে পারলে শান্তি হতো। গট গট শব্দ তুলে চলে গেল।

অনিন্দিতা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মনে মনে সকলের কাছে ক্ষমা চাইলো। বাসায় না থাকলে নির্ভীক কে দেখবে কি করে ? সপ্তাহে একবার ও তো দেখা মিলে না। একটু দেখার জন্য কতো ছল ছাতুরি করে ওদের বাসায় যায়।
প্রতি বার ই আশাহত হয়। কারন নির্ভীক তাঁর রুম থেকে বের ই হয় না। চারুলতার থেকে জানতে পেরেছে নির্ভীক নিজেকে আড়াল করতেই পছন্দ করে। তাই অতো টা মন খারাপ হয় নি। এটা হয়তো নির্ভীকের সহজাত অভ্যাস।

অনিন্দিতার ভাবনার মাঝে ঝাঁঝালো কন্ঠে শাহানার ডাক। ডায়েরী টা খুলে নিয়ে নাক ডুবায় মেয়েটা। নির্ভীকের রক্তের ঘ্রান যেন প্রান কে সতেজ করে দিলো। বিচিত্র অনুভূতি হয়। এই রক্ত ই তো তাঁর প্রান। নির্ভীকের অংশ , যেখানে নির্ভীকের পায়ের ধূলোকনা ঠোঁটে শুষে নেয় সেখানে রক্ত তো হৃদয়ে চেপে নিবে।

দরজায় বারি পরতেই হতচকিয়ে উঠে অনিন্দিতা। দ্রুত কাবাডে ডায়েরী টা রেখে দেয়। শাহানা প্রচন্ড ঝাঁঝে বললেন
_ তুই কি চাস আমি আমার বাপের বাড়ি না যাই ?

_ তা কেন হবে ?

_ তাহলে যেতে চাচ্ছিস না কেন ?

_ আমার এই বাসা ছাড়া কোথাও থাকতে ইচ্ছে করে না। তোমরা যাও না বাঁধা দিয়েছে কে ?

তিক্ত হয়ে উঠেন শাহানা। হাতের কাছে থাকা ঘড়ি টা ছুঁড়ে ফেলে দেন। অনিন্দিতা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল
_ এটা আমার প্রিয় ঘড়ি ছিলো আম্মু।

_ চুপ। একটা কথা বলবি না। আমার ইচ্ছের কোনো মূল্য আছে তোর কাছে ?

_ আম্মু তুমি এমন কেন ভাবছো। আমি বাসায় থাকি তোমরা যাও না।

শাহানার কানে সে কথা গেল না। ঝমঝমিয়ে কাঁদলেন ওনি। হীর ছুটে আসলো। মা কে জড়িয়ে ধরে অনিন্দিতার দিকে লাল চোখে তাকালো। মেয়েটা কি কেঁদেছে ?
অনিন্দিতা ফোঁস করে দম ফেললো। একটা মানুষের জন্য স্বার্থপর হয়েছে আজ। একটু দেখার জন্য প্রান টা যে মরিয়া হয়ে উঠে।
আরশাদ ওহ কয়েক বার ফোন করে বলেছে। কিন্তু অনিন্দিতা সে কথা শুনে নি।

বিকেলের দিকে চারুলতা আসেন। বাসায় ছিলেন না ওনি। কাজের মেয়েটা জানালো অনিন্দিতার জন্য শাহানা কেঁদে ভাসিয়েছেন।
এক প্রকার ভয় পেয়েই গিয়েছিলেন। অনিন্দিতার কোনো ক্ষতি হলো নাকি সেই আশঙ্কায় ছুটে এসেছেন।
_ শাহানা কি হয়েছে বলো তো ? কেঁদে নাকি চোখ লাল করে ফেলেছো ?

_ আপা কি বলবো বলো তো ? মেয়েটা হয়েছে এক পাষান।

_ কি সব বলছো এসব ? অনি কি করেছে এমন ?

_ জানো ই তো এক বছরের বেশি সময় বাপের বাড়ি যাই না। মা অসুস্থ, বলা যায় না কিই হয়। অথচ মেয়েটা যাবে না বলে দিয়েছে।

চারুলতা একটু ভাবলেন। তারপর চকচকে চোখে বললেন
_ থাক না মেয়েটা যখন যেতে চাচ্ছে না। জোর করে না যাওয়াই ভালো। ওহ কদিন না হয় আমার কাছেই থাকবে।

_ কিন্তু আপা

_ কোনো কিন্তু নয় । অনি কি আমার মেয়ে নয় ? তোমার মতো যত্নে না রাখতে পারলে ও যত্ন ঠিক ই করতে পারবো। বিশ্বাস রাখো তো ?

শাহানা বিগলিত হাসলেন। তারপর পর ই চারুলতার সাথে খোশ গল্পে মেতে উঠলেন।

*

নির্ভীকদের বাসায় থাকা যেন চন্দ্র মামা কে হাতে তুলে দেওয়া। অনিন্দিতার খুশি যেন আর সয় না। এতো হাসি খুশি দেখে শাহানা ও স্বস্তি পেলেন। আরশাদ নানান উপদেশ দিলেন। যেহেতু দুদিন বাদেই রেজাল্ট দিবে তাই যেন মন খারাপ না করে। হাসি মুখে সম্মতি জানালো অনিন্দিতা । শাহানা মেয়ের মাথায় চুমু খেয়ে নিলেন । বাহু তে হাত রেখে বললেন
_ একদম মন খারাপ করবি না। তুই তো চেষ্টা করেছিস ই। আল্লাহ চাইলে নিশ্চয়ই চান্স হবে।

_ হুমম দোয়া করো আম্মু। আর আমি খুব স্যরি।

শাহানা সহ সবাই হেসে ফেললো। অনিন্দিতার চোখ ভরে উঠেছে । কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ করেই শাহানা কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে। হীর ফিচেল হাসি তে মাতে। অনিন্দিতার দিকে টিসু এগিয়ে দেয়। তাঁতে নাক ফুলিয়ে নেয় মেয়েটা।

নিহাল ভারী অদ্ভুত ভাবে সব দেখছে। এখানে শোক পালন হচ্ছে নাকি আনন্দ যাপন বুঝতে পারলো না। পরিশেষে বলেই ফেললো
_ এভাবে অর্ধেক হাসি অর্ধেক কান্নার কোনো স্পেশাল মিনিং আছে কি ?

অনিন্দিতা নাক টেনে তাকায়। নির্ভীক একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। সবার দিকে তাকালে ও অনিন্দিতার দিকে তাকায় নি। অভিমানে বুক ফাঁটে। কান্না ভেজা গলায় তাকায়। এক পশলা অভিমানের ঝরা নামিয়ে বলে
_ আবেগ !

নির্ভীকের কানে যেন কেউ বাজনা বাজিয়ে দেয়। খলবিলিয়ে তাকায়। চোখাচোখি হলে ও চোখ সরায় না। প্রচন্ড আবেগ ঝরানো কন্ঠে অনিন্দিতা উচ্চারন করে
_ ছ্যছরামি।

সবাই প্রচন্ড অবাক হয়। হীরের ধাক্কা খেয়ে হুস ফেরে। নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁত কেলিয়ে হাসে। আরশাদ তাঁর স্নেহের হাতে অনিন্দিতার মুখে স্পর্শ করে। মেয়েটা একদম তাঁর মায়ের মতো হয়েছে। প্রচন্ড আবেগী আর ঝরঝরে চাহনি। সাথে অটল থাকে নিজের কর্মে।

*

নির্ভীকের রুমের অপজিটেই অনিন্দিতার ঘর। দুদিন পেরিয়ে গেছে। চারুলতা কোনো কিছুর অভাব রাখে নি। ক্ষনে ক্ষনে প্রশ্ন ছুঁড়ে কিছু লাগবে কি না। আজমাল সকাল বিকাল এসে দেখে যায়। নিহাল তো প্রচন্ড রসিকতায় রাখে। শুধু নির্ভীক ই তাঁর সাথে কথা বলে না। লাঞ্চ বাইরে থেকেই করে আসে। সকালে ব্যস্ততা দেখিয়ে নাস্তা না খেয়েই চলে যায়। শুধু ডিনার টাই একসাথে করে। তবে অল্প একটু খেয়েই উঠে যায়। যার ফলে ব্যথিত হয় অনিন্দিতার মন।

আজ সকাল সকাল উঠেছে নির্ভীক। উদ্দেশ্যে ভারসিটি যাওয়া। রেজাল্ট নিয়ে প্রচন্ড টেনশনে রয়েছে। না জানি কোন আনল হতে চলেছে। চূড়ান্ত ফলাফল দেখার সুযোগ হয় নি এখনো । ভারসিটি গেলেই জানা যাবে। তবে সমস্যা হচ্ছে আজমাল কে নিয়ে। কিছু তেই বের হতে দিচ্ছেন না ওনি।
ওনার মতে অনিন্দিতার সাহস প্রয়োজন। সেখানে ভারসিটির লেকচারার ই যদি সাহস দেয় তাহলে রেশ পরবে কয়েক দিন। ভিন্ন ধাঁচের যুক্তি তে ফেসে গেছে। নিহাল কপট রাগ নিয়ে বলল
_ সমস্যা কি তোর ? ভারসিটি যাবার জন্য এমন উতলা হওয়ার কোনো বিশেষ কারন রয়েছে ?

_ ভাইয়া দেখ আমাকে যেতে হবে। এই ভাবে বাসায় বসে থাকা উচিত কার্য নয়।

_ উচিত বুঝিয়ে লাভ নেই। অনির অবস্থা দেখেছিস ? কাল থেকে চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে। আমরা তো সাহস দিয়েছিস। তবে তুই হলি টিচার। তোর সাহস টা বেশি প্রয়োজন।

_ আজব। আমি এমন অযুক্তিক যুক্তি কখনো শুনি নি।
আমি বললেই তো রেজাল্ট ভালো হবে না!

চারুলতা চটে গেলেন। ছেলেটা প্রচন্ড রকমের বেয়াদব। দেশে থাকতে চায় না। বাসাতে মন টিকে না। সন্দেহর গন্ধ খুঁজে পেলেন ওনি।

নির্ভীকের মুখ দেখে নিভে গেলেন। নিহাল কপট রাগ দেখিয়ে বলল
_ কয়টায় রেজাল্ট দেওয়ার কথা ?

_ 11 টায়।

_ আচ্ছা। আমি অনি কে ডেকে নিয়ে আসছি। আম্মু সবার জন্য নাস্তা রেডি করো। কি জানি লাঞ্চ টা গলা দিয়ে নামবে নাকি।

আজমাল পূর্ন সমর্থন করলেন। চারুলতা চিন্তায় মন মরা করে রেখেছে। সকলের মাঝ থেকে নির্ভীক তাঁর বুক ভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ভালো লাগছে না আর। অনিন্দিতার পাগলামি সত্যি ই আর নেওয়া যাচ্ছে না। এখন তো পরিবার ও যোগ দান করেছে।

কাঁধের ব্যাগ টা ডিবাইনে ধপ করে রেখে দিলো। করিডোর দিয়ে ব্যলকনিতে চলে আসলো। রোজের নাম্বার টা ও পাচ্ছে না। মেয়েটা কানাডায় গিয়েছে না জানি কেমন আছে। এতো ক্ষনে তো পৌছে যাওয়ার কথা।

ভাবনার মাঝেই হোয়াটস অ্যাপে টেক্সট এলো। এক গাল হেসে রোজ কে কল লাগালো।
_ পুরো আঠারো ঘন্টা কথা হয় না তাই না ?

_ এতো হিসেবে রেখেছিস তুই !

_ তো কি করি বল তো। তোর মতো পাগল কে সামলাতে গিয়ে আমার নাজেহাল অবস্থা।

_ পাগলামির কথা ছাড়। ফিরছিস কবে ?

_ রিলাক্স নির্ভীক। মাত্র তো এলাম , মাস খানেক যাক তারপর না হয় আসার চিন্তা করবো।

বিষাক্ত মন নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকালো নির্ভীক । ভারসিটি থেকে মেল এসেছে । রোজের সাথে দ্রুত কথা শেষ করলো। আর বিডি তে দ্রুত ফিরে আসার কথা বলে নিলো। লম্বা নিশ্বাস নিয়ে মেল টা ওপেন করলো।
বুক থেকে যেন পাথর নেমে গেল। অনিন্দিতা সিলেক্ট হয়ে গেছে। যাক এই বার আর গ্যাপ যাবে না। আর না নিজেকে দোষী মনে হবে।

প্রান ভরে শ্বাস নিলো। সাথে ভেবে ও নিলো ভারসিটির ফার্স্ট ক্লাস টা বদলে নিবে। অনিন্দিতার মুখোমুখি হতে চায় না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলে চরম বিরক্তি আসে।
এক জনের জন্য এতো গুলো স্টুডেন্টস কে আলগা করে দেখা টা অন্যায়। তাঁর থেকে ভালো ক্লাস চেঞ্জ করে নেওয়া।
” বিষ দাঁত থাকার থেকে উপরে ফেলাই মঙ্গল ”

[ প্রিয় মানুষের দর্শন অমৃত তুল্য। অনিন্দিতা কে পাগল প্রেমিকা ভেবে নিবেন। অনুভূতি তে সে সেরা তবে বাস্তবতার সাথে লড়াই করার শক্তি তাঁর নেই । জীবনে এমন প্রেম আসা কষ্ট সাধ্য। যে এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায় সেই বুঝতে পারে। প্রিয় মানুষ কে না দেখতে পাওয়ার যন্ত্রণা সবাই উপলব্ধি করতে পারে না। প্রেমে আত্মসম্মান এর কোনো মূল্য নেই। প্রেম হলো সাধনা । দাঁত কামড়ে পরে থাকার পর ই এর সফলতা আসে। তবে সেই সফলতা সবার জন্য নয়।]

বি : দ্র : ভুল ত্রুটি মাফ করবেন ।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here