অব্যক্ত_প্রিয়তমা,part_25
ফাতেমা_তুজ
পাহাড়ে কিংবা বদ্ধ ঘরে কোনো কথা বললে যেমন বার বার কানে বেজে উঠে। ঠিক তেমনি ভাবে অনিন্দিতার কন্ঠস্বর বার বার বেজে উঠে। নির্ভীকের হৃদপিন্ডের প্রতি টা স্পন্দন যেন একটি শব্দেই থমকে আছে। রক্ত প্রবাহ বোধহয় নিজের কার্যক্রমের আওতায় নেই।ঘাড় ঘোরায় নির্ভীক। ঘোলা চোখে দাঁড়িয়ে থাকা স্নিগ্ধ প্রিয়তমা কে দেখে যেন বাক শক্তি হারিয়ে ফেলে। রুগ্ন শরীরে এগিয়ে আসে অনিন্দিতা। ইশরাক বুঝতে পারে এখানে থাকা অপ্রয়োজনীয় বটে। সন্তপর্নে সরে যায় ওহ। ভাঙা গলায় অনিন্দিতা বলে
” কেন সম্ভব নয় নির্ভীক ভাই ? ভালোবেসে ভালোবাসা কে কাছে পাওয়া কেন পাপ বলুন তো নির্ভীক ভাই। আমি কোন পাপের শাস্তি বহন করছি বলুন তো। আপনি কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছেন। ”
স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নির্ভীক যেন সাগরের অতলে হারিয়ে যায়। কিংবা আকাশের মাঝে মেঘের আড়াল হয়ে যায়। এই মুহুর্তে কি করা উচিত বুঝতে পারে না। এগিয়ে আসে অনিন্দিতা। ঘোলাটে চোখে নির্ভীকের কাছে এসে দাঁড়ায়। কাঁপা হাতে খুব সহজেই স্পর্শ করে নির্ভীক কে। প্রিয় মানুষের সংস্পর্শ দুজন কেই হীম শীতল করে দেয়। এই স্পর্শেই ডুবে যায় দুজনে। সিক্ত চোখে হাসি ফুটিয়ে অনিন্দিতা বলে
” একবার জড়িয়ে ধরবো আপনাকে ? কতো শত দিন দেখি না আপনাকে। কেন দূরে সরিয়ে রাখলেন আমায়। কেন বলুন তো। ”
” অনিন্দিতা আপনি এখানে ! ”
ছলছল নয়নে হাসে অনিন্দিতা। খুব যত্নে নির্ভীকের বুকে মাথা রাখে। প্রিয়তমার স্পর্শ পেয়ে শিউরে উঠে নির্ভীক। চোখ দিয়ে নোনা জল নেমে যায়। থমকে যায় ওর ছোট্ট পৃথিবী। অনিন্দিতা কে জড়িয়ে ধরে ওহ। আজ নিজেকে এলোমেলো মনে হয়। বলে
” অনিন্দিতা আমি আপনাকে ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি, আমি আপনাকেই ভালোবাসি। শুধু মাত্র আপনাকে ভালোবাসি। ”
” কেন বললেন না আমায় ? কেন এতো দিন কষ্ট পেলেন। কেন ই বা এতো দিন কষ্ট দিলেন । ”
উত্তর করে না নির্ভীক। অনিন্দিতার মুখে হাত রাখে সে। সুপ্ত অনুভূতি কে আজ গুরুত্ব দিয়ে অনিন্দিতাকে আবারো কাছে টেনে নেয়। নিজের কাধে নির্ভীকের চোখের পানি অনুভব করে ওহ। ধক করে উঠে হৃদয়। থমকানো পৃথিবী তে যেন ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। সাগরের উথাল করা টেউ যেন অনিন্দিতা কে আঁকড়ে নেয়। বিস্ময় নিয়ে বলে
” আপনি কাঁদছেন কেন ? ”
” জানি না। আমি জানি না কাঁদছি কেন। আমি আপনাকে কেন জড়িয়ে ধরলাম তা ও জানি না। ইচ্ছে করছে পৃথিবীর সমস্ত নিয়ম ভেঙে আমি আপনাকে ভালোবেসে যাই। ইচ্ছে হয় পৃথিবীর বুকে অব্যক্ত ভালোবাসার আগুন নিভিয়ে ব্যক্ত করে যাই ভালোবাসার ফোয়ারা। আমি আপনাকে ভালোবাসি অনিন্দিতা। ভালোবাসি অনিন্দিতা । ”
জীবনে সুখ বোধ হয় সমস্ত কষ্ট কে দূর করে দেয়। নিজের ভালোবাসার মানুষ টার বলা একটি কথা অনিন্দিতার রক্তে শীতলতা হয়ে যায়। অন্ধকার কে ছাপিয়ে নামিয়ে দেয় ভোর। জীবনের প্রতি টা মুহুর্ত কে রাঙিয়ে তুলে। নাক টেনে কাঁদে অনিন্দিতা। নির্ভীকের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর ইচ্ছে হয় না বরং এভাবেই কাঁটিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে জাগে কয়েক জনম। ভালোবেসে ভালোবাসা কে ভালোবেসে যাই নামের রোদ্দুর কাঁপানো বর্ষন নামাতেই প্রেমের উথাল পাথাল ঝড় বয়ে যায়। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হয় ” প্রেম সুন্দর , সত্যিই প্রেম সুন্দর। ”
নদীতে জোয়ার ভাটা নেমে যায়। নির্ভীকের বোধবুদ্ধি যেন হারিয়ে গেছে অনেক আগেই । কি করেছে কল্পনার অতীত। অনিন্দিতার শরীর থেকে আসা মাতাল করা ঘ্রান যেন ওকে আরো বেশি পাগল করে দেয়। নির্ভীক বলে
” প্রেমের পরিনতি কেমন হয় অনিন্দিতা। ”
” সুন্দর , খুব সুন্দর। ”
” সত্যিই সুন্দর হয় ? ”
” হ্যাঁ। ”
কথা বলে না সে। চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠে। মৃদু স্বরে বলে
” এভাবেই থাকবেন ? ”
” হুমম। ”
” এখনো পাগলামি গেল না ? এতো দিন পর আমি ও পাগল হয়ে গেলাম। অন্যায় করে দিলাম। অদ্ভুত তাই না ? ”
” কোনো অন্যায় নয় নির্ভীক ভাই। কোনো অন্যায় নয়। ”
সহসা হাসে না নির্ভীক। ব্যাথাতুর হৃদয়ে পাথর চাঁপা দিয়ে অধর কোনে ছোট করে হাসে ছেলেটা। অদ্ভুত হলে ও সত্য অনিন্দিতা তাঁর নয়। জীবনের লড়াই অনিন্দিতা কে কেড়ে নিয়েছে। অনিন্দিতার মাথায় চুমু খায় নির্ভীক। বলে
” এই কলঙ্ক আমাদের। নিষ্কলঙ্ক দেহে কলঙ্ক নিয়ে নিলাম। ভালোবেসে দুজনেই পাপ করলাম। ”
” কি কথা বলছেন আপনি ? ”
” নিজেকে শান্ত করুন অনিন্দিতা। চরম সত্যের মুখোমুখি করতে হবে আপনায়। ”
” কিসের সত্যি কথা ? ”
” আজকে আপনাকে দেখতে আসবে তাই না ? ”
” সেসব বাদ দিন। আমি মানা করে দিবো।”
তাচ্ছিল্য হাসে নির্ভীক। অনিন্দিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে
” আপনি আমার ভাগ্য নন অনিন্দিতা। আপনি শুধুই আমার ভালোবাসা। সব ভালোবাসার পরিনতি শুভ হয় না। আমাদের ও হবে না। ”
” কেন হবে না ? ”
” আপনাকে রিং পরাতে আসবে আম্মু। ”
অবাক হয়ে অনিন্দিতা বলে
” বুঝি নি। ”
পকেট থেকে সিগারেট বের করে নির্ভীক। আগুন ধরিয়ে সিগারেটে টান দেয়। অনিন্দিতার মাথায় আসে না। ধোঁয়ার কারনে হালকা কাশে নির্ভীক । পেছন ফিরে বলে
” ভাইয়ার জন্য আপনাকে আংটি পরাতে আসবে। ”
” নির্ভীক ভাই কি সব বলছেন! ”
” সঠিক কথাই বলছি। ”
অনিন্দিতার পৃথিবী থমকে যায়। নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ দুটো ঘোলাটে। ছুটে আসে অনিন্দিতা। নির্ভীক কে জড়িয়ে ধরে বলে
” আমি আপনাকে ভালোবাসি নির্ভীক। আজকেই সব কিছু বলে দিবো আমি। আমাদের আলাদা করতে পারবে না কেউ। আমি সবাই কে বলবো। ”
” কি বোঝাবেন অনিন্দিতা? এটাই বোঝাবেন নির্ভীক তাঁর বড় ভাইয়ের জন্য ঠিক করা মেয়ে কে ভালোবাসে। এটাই বলবেন ভাইয়ের সুখ কেড়ে নিতে চায় নির্ভীক। বেইমান নির্ভীক মাহতাব ? ”
গগন কাঁপানো হাসি তে হাসে নির্ভীক। ভেজা পল্লবে তাকায় অনিন্দিতা । নির্ভীকের হাসি যেন পৃথিবীর সব থেকে কষ্টের প্রতীক। একি অবস্থা নির্ভীকের। অনিন্দিতার বাহু তে হাত রাখে ছেলেটা । সিক্ত নয়নে অনিন্দিতা কে দেখে। বলে
” আব্বুর সাথে আঙ্কেল এর সম্পর্ক বরাবর ই ভালো। তবে সম্পর্ক গাঢ় হয় আব্বুর এক্সিডেন এর সময়। আঙ্কেল কে সেদিন পাশে পেয়েছিলো আব্বু। হয়তো আঙ্কেল এর জন্য ই বেঁচে আছে । আল্লাহ সেদিন আঙ্কেল কে উছিলা করে পাঠান। আব্বুর অপারেশন সাকসেসফুল হওয়ার পর আঙ্কেলের হাত ধরে আপনাকে নিজের মেয়ে হিসেবে চায়। আমার চোখের সামনে আমার প্রিয়তমা কে আমার বড় ভাইয়ের জন্য চেয়ে নেয় আব্বু। আমি সেদিন নির্বিকার ছিলাম। ভাইয়ার চোখে মুখে কোনো রকম বিরক্তি ছিলো না। আমি খুব করে চেয়েছিলাম ভাইয়া বিয়ের কথা তে বারন করুক। কিন্তু ভাইয়া আপনাকে পেয়ে খুশি ছিলো। আমার জন্য ভাইয়া এই ছোট জীবনে অনেক কিছু করেছে। আমার এখনো মনে আছে ক্লাস ফাইফে আমার জন্য একটা ছেলে কে খুব মেরেছিলো। সেই জন্য ওকে ও রক্তাক্ত হতে হয়। হসপিটালে এডমিট থাকতে হয়। সেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসার অপমান করতে পারি নি আমি। ভাইয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে আপনার ভালোবাসা কে তুচ্ছ করেছিলাম। তবে কি জানেন সেই সময় টা আপনি নিজে ও আমাকে ভালোবাসতেন না। ভেবেছিলাম নিজেকে মানিয়ে নিবো। কিন্তু যখন দেখলাম আপনি নিজেই আমাকে চান তখন আমার পুরো পৃথিবী থমকে গিয়েছিলো। আপনার থেকে আলাদা হওয়ার বহু চেষ্টা করেছি। কিন্তু আপনার ভালোবাসা বার বার ব্যর্থ করেছে আমায়। আমি পারি নি আপনাকে না ভালোবেসে থাকতে। কি করবো আমি ? আপনার আর ভাইয়ার সম্পর্কে পারবো না বাঁধা হতে। চলে যান অনিন্দিতা। আপনি প্লিজ চলে যান। আমি পারবো না আপনাকে গ্রহন করতে। আমাদের ভালোবাসার পরিনতি কখনোই শুভ হবে না। ভেঙে যাবে অনেক গুলো সম্পর্ক। ”
” নির্ভীক ভাই। ”
” প্লিজ। ”
দু পা পিছিয়ে যায় অনিন্দিতা।নিজেকে শূন্য মনে হয় ওর। এতো যন্ত্রণা আগে কখনো হয় নি। প্রিয় মানুষ কে পেয়ে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রনা বোধহয় কোনো কিছু তে নেই। পৃথিবী তে প্রিয় মানুষ কে না পাওয়ার ব্যাথা ত্রিভুবন কে কাঁপিয়ে দেওয়ার মতোই। পেছন ফিরে অনিন্দিতা। নির্ভীক তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। যে চোখে রয়েছে ভালোবাসা কে না পাওয়ার বেদনা। তীব্র ব্যাথায় পাগল হয়ে যাওয়ার ইচ্ছে। সব কিছু ধ্বংস করার চেষ্টা। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির সাথে পেরে উঠে না। অনিন্দিতা আগায়। হঠাৎ করেই নির্ভীক বলে
” অনিন্দিতা। ”
ছুটে আসে নির্ভীক। অনিন্দিতা কে জড়িয়ে কেঁদে উঠে। অনিন্দিতার মাথায় চুমু খায়। যেন বদ্ধ পাগলে পরিনত হয়েছে সে। কোনো কিছুই ঠিক নেই ওর। অদূরে দাঁড়িয়ে থেকে সব টা দেখে রোজ আর ইশরাক। রোজ কাঁদছে , খুব কাঁদছে। এভাবে চোখের সামনে দুটি হৃদয় আলাদা হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারছে না।
ভালোবাসা , প্রেম , অব্যক্ত হয়ে থাকা টা বড় যন্ত্রণা। তদ্রূপ দুটি হৃদয় আলাদা হয়ে যাওয়া টা ও মৃত্যুসম। নির্ভীকের ভালোবাসা অব্যক্ত রইলো না আর । তবে পাওয়া হলো না প্রিয়তমা কে। ভালোবাসা কে ব্যক্ত করে ও না পাওয়ার বেদনা দুটি মন কে বিক্ষিপ্ত করে দিলো। আবছা হয়ে যাওয়া চোখে কেউ একজন অনুভব করে রক্তক্ষরণের ব্যাথা। অব্যক্ত প্রিয়তমার জন্য হৃদয়েল প্রতি টা কোনে ব্যাথা অনুভব হয়। ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করতে পারে না সে। পাগলামি নেই তাঁর মাঝে। হয়তো আছে , তবে গুটিয়ে রাখে সেই ভালোবাসা। অথচ সে ও ভালোবাসে তাঁর প্রিয়তমা কে এক আকাশ সমান। কিন্তু তাঁর ভালোবাসা অব্যক্ততায় তিক্ত হয়ে রয়।
চলবে