তারকারাজি-০৪,০৫

0
662

তারকারাজি-০৪,০৫
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
পর্ব-০৪

আকাশটা মেঘলা। শারদীয় বর্ষণের সমাপ্তি ঘটেছে বহুক্ষণ আগেই। মিশমি এক হাতে তার সাদা সালোয়ার উঁচু করে বেশ সাবধানে হেঁটে চলেছে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুদের কাছে। বিস্তীর্ণ তৃণাবৃত মাঠটা যেমন বৃষ্টিস্নানে সতেজ দেখাচ্ছে। তেমন-ই মাঠের এখানে-সেখানে থৈ-থৈ করছে কাঁদা-জল৷ অথচ তার পাশাপাশি হেঁটে চলা বান্ধবী নীলাশার কোনো উদ্বিগ্নতা-ই নেই নিজের পরিধানকৃত সাদা চুড়িদার নিয়ে। সে আনমনে এদিক-সেদিক তাকিয়ে হেঁটে চলেছে বেশ! এমন সাবধানতা অবলম্বন করেই মিশমিরা গিয়ে পৌঁছাল নিশানদের কাছে। বলা বাহুল্য যে সেখানে নিশান, রিশান ও পিহু তো ছিলই। সেই সাথে আরও একদল ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। নীলাশা গুরুত্ব না-দিলেও অস্বস্তিতে জবুথবু হয়ে যাচ্ছিল মিশমি। গুনে-গুনে সাতটা ছেলে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। একটা ছেলে তো রসিকতায় বলেই ফেলল যে, নিশানরা আজকাল মেয়েদের পিছনে ঘোরা শুরু করেছে। সেই নিয়ে পিহুর কী প্রতিবাদ! সে তো খিটখিটিয়ে বলেই বসল,

“ কেন ভাইয়া, বন্ধু বলে কোনো শব্দ কি আপনাদের ডিকশনারিতে নেই? ”

সেই নিয়েই তাদের মাঝ থেকে শিহাব নামের একটি ছেলে অমর্ষ সমালোচনা করে বসল। পিহু পরাস্ত হলো ঠিকি কিন্তু সমালোচনাটা আঘাত হানল মনে৷ এদিকে শিহাবের ঠাট্টাকে ভীষণ নিন্দিত সমালোচনা হিসেবে ধরে নিয়ে ক্ষিপ্ত হলো নীলাশা। নীলাশার অপরিবর্তিত এক বৈশিষ্ট্য, বন্ধু মানেই তার প্রাণ! বন্ধুত্বের ব্যাপারে এমন ধারণা সে মানবে না। তীক্ষ্ণ চোখে শিহাবের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

“ হুয়াই আর ইউ টকিং লাইক দিজ, মিস্টার শিহাব? আপনার কাছে ফ্রেন্ডশিপের মানে এমন জঘন্য কী-করে হতে পারে? অ্যাকচুয়লি ইউ নো হুয়াট, ইউ গাইজ হ্যাভ আ চিপ মেন্টালিটি লাইক দ্য সো-কল্ড ডিসগাস্টিং পার্সন। ব্লাডি… ”

নীলাশা সম্পন্ন করতে পারল না তার কথা। তার আগেই রিশান ধমকে বলল,

“ ব্রিটিইশ্শা মাইয়া, অফ যা এইবার! বড় ভাইদের সাথে তুই এখন লাগালাগি করবি? অবশ্য ব্রিটিশরা এছাড়া আর পারে কী? বাঙালিদের উপর অত্যাচার করা তো তাদের স্বভাব। ”

পিহু উত্তর দেয়,

“ তুই ওকে কেন দুষতাছিস? ও একদম ঠিক কথা বলছে। আর হ্যাঁ শোন, সব-সময় ওর ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে ওকে খোঁচাবি না৷ ওর মাতৃভাষা বাংলা। বিদেশে পড়াশোনা করেছে বলেই সেই দেশের ভাষা বলায় অভ্যস্ত ও৷ ভাষায় নীল ব্রিটিশদের মতো হতে পারে, রক্তে না। ”

পিহুর কথাটাও পছন্দ হয় না রিশানের। কথা কাটাকাটি করতেই জানা যায়, পিহুও নীলাশার কথায়-কথায় ইংলিশ বলায় বিরক্ত হতো। তাদের বাক-বিতণ্ডা থামাতে মিশমি বলল,

“ থাম না ইয়ার! কেন আজাইরা ঝগড়া করছিস তোরা? নীলকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা না-করলে কি তোদের দুই ভাইয়ের খাবার হজম হয় না? ”

নিশানের স্পষ্ট কথা, “ তো কি তোকে নিয়ে তামাশা করব, মাদারবোর্ড? তুই তো সারাদিন হাম্মা-হাম্মা কইরা দিনরে রাত আর রাতরে দিন করিস৷ অনেক পোলারে দেখছি মাও-পাগলা হয়। তুই মাইয়া হইয়ে যে মাও কইয়া জ্ঞান হারাস, সেইটা মাইকিং করতে বলছিস? আর তোর মাও উঠতে-বসতে তোর মাথায় যে প্যারেক মারে, সেইটাও বলতে বলছিস? তোর জামাইয়ের কপালে বিরাট দুঃখ আছে এমন শয়তান শ্বা… ”

“ আম্মুকে নিয়ে কিছু বলতে নিষেধ করেছি, নিশান! ”

মেয়েটা ধমকও দেয় খুব নিম্ন স্বরে। সামনের ছেলেগুলো মজা নিচ্ছিলো ভালোই। তারপর শুরু হলো তাদের পরিচয় পর্ব। পরিচিত হতে-হতে অপর পক্ষের ছেলেগুলোর নাম সায়ান, রোহান, সাহেল, শিহাব, তনয়, সাইফ বলে শেষ করে যখন নিশান বলে উঠল গিটার হাতে ছেলেটির নাম আরাভ। তখনই যেন নীলাশার মন মোচড় দিয়ে মুখে বুলি ফুটিয়ে তুলল,

“ কে আরাভ? ”

হঠাৎই সেই প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে থমকে যায় নিশান৷ পরিচয় পর্বে নীলাশার গুরুত্বহীন ভাবটা যে কীভাবে এতটা গুরুত্বে টইটম্বুর হয়ে গেল তা ধরতে পারছে না সে। নীলাশার হুট করেই কী যেন হয়ে যায়! এই মেয়েকে বোঝা মুশকিল বলেই মনে করে নিশান৷ সে ঠিক নীলাশার সামনের ছেলেটিকে দেখিয়ে বলে, “ এইযে এইটা আরাভ ভাই। ”

সেই প্রথম তাকানো, আপাদমস্তক কৃষ্ণাভ ছায়ার সুদর্শন পুরুষটাকে দেখে নেওয়ার ইচ্ছা দমিয়ে রাখা আর হলো না নীলাশার। আরাভের মাথার ঝাঁকড়া চুল আর শ্যামবর্ণের ছিমছাম মুখের গঠন দেখে নীলাশার মনে একটা শব্দই উঁকি দিয়ে উঠল, কবি। আরাভের এহেন চিত্র তার কাছে কবিদের মতোই লাগছে যার গহীন নয়নে ডুবন্ত কতশতই-না কবিতা! ঠিক সেই সময়টা আরাভের চোখও অস্থির নীলাশার চোখের চাহনি পড়তে ব্যস্ত। এইযে একটু আগের বেখেয়ালি, উদ্বেগহীন মেয়েটা তার নাম শুনেই কেমন খেয়ালি হয়ে উঠেছে। এতে অবশ্য আরাভ অবাক হয়নি। কারণ সে নীলাশার মুখটা দেখে অল্প হলেও ধারণা করতে পেরেছিল কিছু। আর যখন সে গরগর করে শিহাবের প্রতি রাগ দেখিয়ে উঠল। তখন যেন ধারণাটা বিশ্বাসেই পরিণত হয়ে গেল আরাভের। সে নীলাশার এরূপ অস্থিরতা দেখেও বলে উঠল,

“ বিষাদকন্যার চোখ দুটো স্বাভাবিক হয়েছে? না-কি এখনও বিষাদে ভরে আছে? ”

বিষাদকন্যা… কী নাম! নীলাশার মনে হঠাৎই উঁকি দেওয়া বেমানান শব্দটা আর বেমানান রইল না যেন। ছেলেটির মাঝে হয়তো সত্যিই কবি-কবি ভাব দেখতে পেয়েছিল নীলাশা। আরাভের মুখে ওই নামটা শুনে যে নীলাশার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠেছিল, তা আর চোখ এড়িয়ে গেল না কারোর। সবাই যেন সবার গোপনেই সাংঘাতিক কিছু কথা ভেবে নিল। সেই অনুযায়ী প্রশ্ন করতেই আরাভ খুব সুন্দর করে তাদের ভাবনাকে ঘুরিয়ে দিয়ে জানালো তাদের প্রথম দেখার কথা। কোনো এক অন্ধকার রাজ্যে অভিমানিনীর সাথে কাটানো কিছু মুহূর্তের কথা কেটে-ছেটে আরও বেশি হ্রস্বতর করে বলে ফেলল আরাভ। বুদ্ধিমতী নীলাশাও ব্যাপারটা বুঝে আরাভের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ আর না-তে না মিলালো। ঠিক তখনই নিশান বলে উঠল,

“ দেখছোস বান্ধবী, আরাভ ভাই-ও বুঝছিল তুই আলালের ঘরের দুলালি। ”

কথাটা শোনা মাত্রই ঠিক পাশে দাঁড়ানো বন্ধুর পায়ে নিজের জুতোর দ্বারা অসহনীয় আঘাত করার ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল নিশান। মুখে ব্যথাময় শব্দ এঁটেই বলল,

“ বেয়াদব মহিলা! মাইয়া মাইনষের আর কিছু থাকুক বা না-থাকুক, সর্বনাশী এক জোড়া জুতা থাকবোই থাকবো। মাইয়া মানেই জ্বালা! ”

নিশানের কথা শুনে দুই পক্ষই হেসে উঠল। কথায় কথায় জানা গেল, হাইস্কুলে কর্মরত শিক্ষক মঈনুল হোসেনের সাথে আরাভের বাবা প্রফেসর আহসান চৌধুরী ও আরাভের কী-সব দরকারি কাজ আছে৷ মঈনুল হোসেন নিশানদের বান্ধবীর বাবা জানতে পেরে আরাভের কাজটা করায় সুবিধা-ই হবে বেশ! তার জন্যই আরাভের মিশমির সাথে কথা বলা। সেই সাথে দুই বন্ধুদলের যে এভাবে পরিচয়টা হয়ে যাবে তা জানা ছিল না তাদের। আরাভ আর নীলাশারও জানা ছিল না যে, হঠাৎ দেখা হওয়া একদম অপরিচিত দু’জনার পরিচয়টা এত সহজেই হয়ে যাবে। মনে হয় একটু জলদিই ছুটে এলো তাদের পরিচিত হওয়ার সময়টা! সময়ের যেন খুব বেশিই তাড়া!

মিশমির কাছে কলটা এলো ঠিক মধ্যরাতে। যখন বাহিরে শনশন হাওয়ায় এলোমেলো হতে থাকা চুলগুলোকে খুব যত্নে বিনুনিতে বেঁধে ফেলতে মিশমি ব্যস্ত ছিল ঠিক সেই সময়েই। মিশমির রাত করে পড়াশোনা করার অভ্যাস রয়েছে। তাই ঘুমোতে-ঘুমোতে রাত একটা বা দেড়টা বাজা নতুন কিছু না। আজও হয়তো ঘুমোতে-ঘুমোতে একটা বেজে যেত। কিন্তু তার আগেই এই অপরিচিত নাম্বারের কলটি ধরে মিশমি যতটা পাগলপ্রায় হয়েছিল তা ব্যাখ্যা করে বোঝানোটা বেশ মুশকিল! মিশমি যখন ফোনটা কানে ধরে ব্যক্তির পরিচয় জানতে চাইলো তখন ওপাশের মোহাবিষ্ট পুরুষ কাব্যিক স্বরে বলে উঠল,

“ পারুলতা মিশমি, তোমায় প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিন তুমি ছিলে আস্ত একটা পারুল ফুল। তুমি তো পরী। তোমার কি আদৌ কোনোকিছুর কমতি রয়েছে? অথচ সেদিনের আমি তোমার মোহমাখা রূপের মোহে পড়তে পারিনি৷ খুব করে চেয়েছিলাম সেই মোহে নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখতে। কিন্তু পারিনি আমি। আসলে সুন্দরের প্রেমে পড়তে চাইনি৷ কারণ সুন্দরীরা না-কি সাধারণ ছেলেদের ধরা-ছোঁয়ার বাহিরে থাকে। তোমাকে দেখার অনেকগুলো দিন হয়ে গেল জানো? কিন্তু তোমায় ভুলে থাকা হলো না আমার। কত ছলনায় তুমি উঁকি দিতে লাগলে আমার মনে। অথচ কথা ছিল তোমাকে ভুলে থাকার। আমি যে ভীষণ অসুস্থ। তুমি কি জানো তোমার দেওয়া এই অসুস্থতার ওষুধ আমি কোথায় পাবো? মিশমি, তোমায় ভালোবেসে ফেলিনি তো আবার? তাহলে যে সেই পারুলতাতেই আমার মরণ নিশ্চিত! ”

সংযোগ কেটে গেল। এত রাতে কল করা কে এই প্রশ্নদাতা? মিশমি ত্রস্ত-মনে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই একটি অরুচিকর কাজ করে বসল। নাম্বারটিতে কল করে গেল একের পর এক। কিন্তু একি! কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলেই জানা গেল। উত্তেজনায় সুধীরতা থেকে অধীরতায় পরিবর্তন হওয়া মিশমির মন যেন নেশাসুলভ কিছু খুঁজে পেয়েছিল সেই পুরুষের কণ্ঠে। দেয়াল ঘড়িতে একের পর একেক ঘর অতিক্রমের ঘণ্টা বেজে উঠে। মিশমি শুনতে পায়। তবে মনের ব্যাকুলতা দূর হয় না তার। কে এই সুকণ্ঠ পুরুষ? না-জানা পর্যন্ত যেন মিশমির মনের এই অস্থিরতা দূর হয় না। সে অপেক্ষা করে। বিনিদ্র রাত্রি থেকে ভোরের প্রথম আলো ফুটতে দেখে। অথচ সংযোগ স্থাপন-ই ঘটাতে পারে না সে। নিজের অদ্ভুত ইচ্ছায় সে নিজেই অবাক হয়ে যায়। রাত্রি জেগে কোনো পুরুষের পরিচয় পেতে চাওয়ার মতো পাগলামোটা মিশমি এই জীবনে করেছিল কি-না সন্দেহ!

শারদীয় বর্ষণপূর্ণ রাত্রিটা মিশমির অনিদ্রায় কাটলেও সকাল হতেই রাজ্যের ঘুম ভর করল তার চোখে। বিদ্যুৎ-বিভ্রাটে মাখো-মাখো ঘামে জবজবে শরীরটায় যখন কারো স্পর্শে মিশমির চোখ প্রসারিত হলো, তখন তার মস্তিষ্কে যেন বিদ্যুৎপ্রভার মতো মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ধারণাশক্তি। সে তো সকালে ঘুমিয়েছিল। ভার্সিটিতে যাওয়ার সময় ফুরিয়ে গেল না-কি? মিশমি ত্রস্তব্যস্ত স্বভাবে উঠে বসে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাল। সাড়ে সর্বনাশ বেজে গেছে যে! পাশে দাঁড়ানো মায়ের বকুনি কম জুটল না তার কপালে। মা যেতেই চোখ থেকে ঘুমের চিহ্ন মুছে ফোনের স্ক্রিনে তাকাল মিশমি। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা বার্তাটি চোখে পড়তেই চমকে উঠল সে। কাল রাতের সেই অপরিচিত নাম্বার থেকে বার্তা পেয়ে মনটা আবারও ছটফটিয়ে উঠল মিশমির। সেখানে লেখা ছিল,

“ নবীনবরণে পারুলতাকে পারুল বেশেই দেখতে চাই ”

চলবে ইন শা আল্লাহ!

তারকারাজি- (০৫)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী

প্রথমবারের মতো নিজের জন্য বরাদ্দকৃত হলের ঘরে পা রেখেই বিস্মিত হলো পিহু। ঘরের খোলা জানালা দিয়ে সেখানকার যে টেবিলের উপর রৌদ্রদীপ্তি ছড়িয়েছে। ঠিক সেখানেই রাজ্যসম কাজে মগ্নতা নিয়ে কীসব আঁকিবুঁকির কাজ করে যাচ্ছে সানাম। মেয়েটা সানাম-ই তো? পিহুর মনে প্রশ্ন জাগতেই সে আরেকটু ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করে। শ্যামবর্ণার গায়ে বরাবরের মতো লেডিস শার্ট আর কাঁধেরও বেশ কিছুটা নিচে সমাপ্তি টানা ঘন চুলের খোঁপা-ই তো বলে দিচ্ছে ওটা সানাম। পিহু গলা উঁচিয়ে ডেকে উঠে,

“ আরে দোস্তো না-কি? ”

মেয়েটা যেন খুব আগ্রহ নিয়ে তাকাল পিহুর দিকে। বিস্ময়ের আমর্শ যে সেও খুব ভালোই পেয়েছে তা আর বুঝতে বাকি নেই পিহুর। সানাম পিহুর দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই দুই হাত বাড়িয়ে দিল। বন্ধুসুলভ কণ্ঠে বলে উঠল,

“ আরে ড্রামাকুইন যে! তুই এই রুমে না-কি? ”

বলেই একে-অপরের সাথে কোলাকুলি করে হেসে উঠল তারা। যেন বহুত পুরনো বন্ধুত্ব তাদের! ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে বলে একে-অপরের খোঁজ-খবর নেওয়া ছাড়া আর বেশি কথা হলো না তাদের। মুখে-মুখে বন্ধুত্ব তো আগেই হয়ে গেছে। কিন্তু এই মিশুক পিহু আর ছন্নছাড়া সানামের পরবর্তী দিনগুলো কেমন কাটবে? এই নামমাত্র বন্ধুত্বও কি পাল্টে যেতে পারে কোনো এক আত্মিক সম্পর্কে?

মেঘের শুভ্রতায় যখন রোদের সোনারঙা আলো দীপ্তিমান, তখন কেউ অত্যন্ত কলাকৌশলের সাথে তা ক্যামেরাবন্দী করতে ব্যস্ত। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে বহুক্ষণ আগে। অথচ তার উজ্জ্বলতা যেন বিন্দুমাত্র কমবার নয়! এই সূর্যকে কেন্দ্র করে, নিজের দক্ষতাকে বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে সানাম যেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। পিহু একমনে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ভাবে যে, সারাক্ষণ গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে রাখার কী হলো? কারো শখ কি এতটাই তীব্রতর হয়, যার জন্য সারাক্ষণ ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে ঘুরতে হবে? মেয়েটি তার শখের পিপাসা মিটিয়ে পিহুর কাছে এসে বসতেই পিহু বলল,

“ আচ্ছা, তোর চাচা-চাচি বলে তোর জন্য টাকা খরচ-ই করতে চায় না? তাহলে এই ক্যামেরা কিনলি ক্যামনে? টাকা জমিয়েছিলিস না-কি? ”

সানাম ক্যামেরার স্ক্রিনে তাকিয়ে ছবির মান দেখতে থাকে এবং পিহুকেও দেখাতে থাকে। পিহুর কথায় সে দায়সারাভাবে উত্তর দেয়,

“ আরেহ না। ওই অসভ্যগুলা নিজেদেরটাই দেখে টাইম পায় না, আর তো আমার চিন্তা করবে। এইযে আমার এই ক্যামেরাটা কেনা… এর পিছনের কাহিনিটা ছিল একদম-ই অন্যরকম। বলতে পারিস ফ্যান্টাসির মতো কিছু! ”

“ ফ্যান্টাসি? ঠিক কেমন? ”

“ আমি স্কুল লাইফে একটা সেকেন্ডহ্যাণ্ড অ্যান্ড্রয়েড কিনছিলাম। সেইটা থেকে নিজের নাম সুমনা ইয়াসমিন থেকে সানাম ইয়াসমিন নামে ফেক আইডি খুলে ইউজ করতে থাকি। তখন বাংলাদেশে ফেসবুক গ্রুপে ফটোগ্রাফির ট্রেন্ডটা একদম নতুন৷ আমি এগুলা সম্পর্কে অতো বুঝতাম না। তখন না-বুঝেই কয়েকটা কন্টেস্টে অ্যাটেন্ড করি আর তার বেশিরভাগ কন্টেস্টেই উইনার হই আমি। আমার সেই উইনার হওয়া থেকেই ফেসবুকে নিজের পেজ এন্ড গ্রুপ খোলা। দুই-তিন বছরে যখন আমার মোবাইলফোন ফটোগ্রাফি ও মোবাইলফোন এডিটিং বিষয়ক তথ্য বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ভাইরাল হলো, তখনই ধরা খাইলাম চাচ্চুর কাছে। একপ্রকার হাতাহাতি করেও নিজের সেই প্রথম ফোন, পেজ, গ্রুপ কিছুই বাঁচাতে পারলাম না। চাচ্চু সব নষ্ট করে দিল। সেখানে থেকে গেল শুধু সানাম ইয়াসমিন নামক এক মোবাইল ফটোগ্রাফারের খুবই সামান্য কিছু পরিচিতি। ”

এক দমে কথাগুলো বলেই থামল সানাম। মেয়েটার শেষ কথায় যে ক্ষোভটা ছিল, তা বুঝতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি পিহুর। সে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকে শুধু। সানাম যা বলল তা সত্যি তো? এইযে হুট করেই সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন পরিচিতিপ্রাপ্ত একজন ফটোগ্রাফার হয়ে যাওয়ার পরও তা হারিয়ে ফেলার দুঃখ, ক্ষোভ, হতাশা কি সানামের জন্য সহজ ছিল? হয়তো না৷ সহজ হলে সানাম এতটা মনোযোগী হতো না ফটোগ্রাফিতে। নিঃসন্দেহে সানামের ফটোগ্রাফিতে আগ্রহ বেশি আর তা পিহু খুব ভালো করেই বুঝতে পারে৷ পিহু কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “ তখন তুই কোন ক্লাসে পড়তি? ”

“ সিক্সে ”

সানাম সহজেই উত্তরটা দিয়ে দিলেও পিহু সহজভাবে তা গ্রহণ করতে পারল না। সেই সময় তো সে বন্ধুদের সাথে পুরো খেলার মাঠজুড়ে রাজত্ব করত। ফোনে টুকিটাকি গেম খেলতো আর কার্টুন দেখায় সময় ব্যয় করত। ফেসবুক, ফটোগ্রাফি এমনকি নিজের পরিচিতি গড়ে তোলার মতো স্বপ্ন, ইচ্ছা বা অনুভূতি তার ছিল না-কি? পিহুর মনে পড়ে না এমনকিছু ক্লাস সিক্সে পড়ুয়া তার মাঝে ছিল। অথচ সানাম…? পিহু আবারও জিজ্ঞাসা করল,

“ ওই সানু, তারপর কী হইছিল রে? ”

পিহুর কৌতূহল দেখে হেসে ফেলল সানাম। বলল,

“ শালার বেডি তুই একবারেই সব শুনতে চাস? দাঁড়া একটু। সব এখনি বলে দিলে তো আমার এতো এতো কর্মকাণ্ডের গুরুত্ব এখানেই ফিনিশ হয়ে যাবে। তুই বরং গেস করতে থাক যে, কী হইতে পারে বা আমি তখন কী করতে পারি। বুঝছিস? ”

পিহু বিরক্ত হলেও কিছু একটা ভাবে। বেশ বিজ্ঞতার সাথে বলে,

“ কী আর করতে পারতিস! সেদিন থেকেই ফটোগ্রাফিতে নিজের জান-প্রাণ দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগছিস৷ টাকা জমাইয়ে এই ক্যামেরা কিনছিস আর নিজের লাইফ নিজে এনজয় করতাছিস। এই ছাড়া আর কী হতে পারে? ”

সানাম খিলখিল করে হাসে। হাসি যেন থামে না আর তার! সানামের হাসি দেখে পিহুর মুখ কাঁচুমাচু হয়ে যায়৷ সে বুঝতে পারে যে, তার করা ধারণা আসলে ভুল। তখন সানাম বলল,

“ তুই তো দারুণ স্ক্রিপ্টরাইটার হতে পারবি রে ছেড়ি! এইরকম সিনেম্যাটিক কিছু ক্যামনে গেস করতে পারলি? আমাদের লাইফ এতো সিনেম্যাটিক হয় না-কি? সুমনা থেকে সানাম হওয়ার গপ্পোটাই আলাদা। বুঝলি মামু? ”

পিহুর ভ্রুযুগল কুঁচকে আসে। নাকে ভেসে ওঠা ভাঁজে কয়েকশ টন বিরক্তি। সে শুনবে সুমনা থেকে সানাম হওয়ার গল্পটা। সুমনা থেকে এমন সানাম হয়ে ওঠার গল্প কখনোই ওই সামান্য ফেসবুকের পরিচিতি নষ্ট করা হতে পারে না। পিহু আর কিছু বুঝুক বা না-বুঝুক, এই কথাটা বেশ বুঝেছে সে। সে আবারও জানতে চাইলে সানাম জবাব দেয়,

“ আরে ইয়ার এত চাপ নিতাছিস ক্যান? পরে বলব বাকিটা। আগে বল, কালকের প্ল্যান কী? ”

পিহু বিরক্তি চেপে ধরে। অনেকক্ষণ মুখে তিক্ততা এনে বসে থাকার পর হাই তুলে বলে,

“ নবীন বরণের আর প্ল্যান! শাড়ি-টাড়ি পরে ঘুরে বেড়াবো। আর তুই হবি আমাদের নিজস্ব ফটোগ্রাফার। আমরা এঁকে-বেঁকে পোজ দিব আর তুই খালি ক্লিক মারবি। ”

বলতেই পিহুর যেন কিছু একটা মনে পড়ে গেল৷ সে আদেশের স্বরে বলল,

“ ওই তুইও কিন্তু ঘুরবি আমাদের সাথে। ”

“ মামার বাড়ির আবদার! আমি এইসব ন্যাকামোতে নাই। তোরা ঘুরিস। আর এমনিতেও তোদের ন্যাকা-ন্যাকা ফ্রেন্ডসদের আমার পছন্দ না। মিশমিকে তাও মেনে নেওয়া যায়। বাট ওই নীলাশা আছে না, ব্রিটিইশ্শা মা*? ওর ভাব দেখলেই আমার… ”

সানাম নিজের কথা শেষ করার আগেই পিহু তীব্র প্রতিবাদ করে থামিয়ে দিল তাকে,

“ ছিঃ সানাম! এগুলা কী-ই ক্লাসলেস ওয়ার্ড ইউজ করিস তুই? কারো সম্পর্কে এইরকম করে বলাটা ঠিক না। তোর হুটহাট এমন ভাষা ইউজ করার জন্যই নীল তোকে পছন্দ করে না। কেমন বিশ্রী শোনায় বুঝিস কিছু তুই? ”

সানাম মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে বলে,

“ প্লিজ ইয়ার, আমাকে জ্ঞান দিস না। আমার এইসব জ্ঞান দেওয়া মানুষদের সহ্য হয় না। আর আমি এমন করেই কথা বলি। তোদের ওই ফালতু মাইয়ার জন্য নিজের ভাষা পাল্টাইতে পারব না। নিশানরা ঠিকি বলে, ওই একটা বড়োলোকি কুত্তা! বাপের টাকার ফুটানি মেরে চলা ছাড়া আর কিছু জানে না-কি ও? ”

“ না, ও ওর বাবার টাকার ফুটানি দেখিয়ে চলে না। বরং দিনকে দিন আঙ্কেলের নিজের টাকার ফুটানি দেখতে দেখতেই এমন খিটখিটে মহিলাদের মতো হয়ে গেছে নীল। ওর বাপ ওরে সুস্থ থাকতেই দিচ্ছে না। পাগল করে ফেলছে মেয়েটাকে। দেখিস না একটু কিছু হলেই রেগেমেগে অস্থির হয়ে যায়? আগে তো তাও ভালো ছিল। ইদানীং ওর এমন মামুলি ব্যাপারে রেগে যাওয়া দেখে নিজেরা বিরক্ত না-হয়েও পারি না, আবার ‘ওর কোনো দোষ নেই এতে’ এটা না-ভেবেও পারি না। ”

সানাম ক্যামেরা বন্ধ করে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে পিহুর দিকে তাকায়। পিহুর প্রতিক্রিয়া দেখে মোটেও মনে হচ্ছে না যে, সে কোনো ছোট-খাটো বিষয়ে কথা বলছে। অতঃপর সানাম ব্যাপারটা বুঝতে প্রশ্ন করতেই পিহু নীলাশার অতীতের সেই কথাটা বলে। হ্যাঁ, সেই কথাটা যার জন্য নীলাশার মানসিক রোগের চিকিৎসকের কাছে যাওয়া, বন্ধুদের প্রতি অভিমানের পাহাড় গড়া ও মাত্রাতিরিক্ত সঙ্গপ্রিয়তা থাকা। পিহু নীলাশার জীবনের এমন একটা কথা সানামকে জানায় যা অতি স্বাভাবিক হয়েও যেন অস্বাভাবিক কিছু! খুবই অস্বাভাবিক কিছু…!

শারদীয় কাদম্বিনীর বিশদ রঙের কাছে হার মেনেছে ক্রোধিত সূর্যের আক্রোশ। নিখাদ নীল আকাশে কাদম্বিনীর উপস্থিতি যেন বিশাল একেকটা সমুদ্রের ঢেউ। যেমন চঞ্চল তাদের রূপ, তেমন-ই চক্ষু শীতল করা ঐন্দ্রজালিক ক্ষমতায় মোড়ানো তারা৷ এই স্বচ্ছ, চক্ষু শীতল করা বিশাল আকাশের নিচে ভার্সিটির এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত জুড়ে মানুষের হৈচৈটা বেশ দৃশ্যমান। কতশত রঙিন কাপড়ে নিজেদের মুড়িয়ে নিয়ে সুখানুভূতি প্রকাশে ব্যস্ত তারা। তেমনই এই নীল আকাশের নিচে, নীল অপরাজিতা সেজে, কার্জন হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নীলাশা। চকচকে নীল শাড়িটা মায়ের পরিয়ে দেওয়া৷ নীলাশার কোনো শাড়ি নেই। সে নিজেও শাড়িতে অভ্যস্ত নয়। মিশমি, পিহুসহ নীলাশার শ্রেণিকক্ষের বেশিরভাগ মেয়ে-ই ঠিক করেছে আজ শাড়ি পরবে। ভার্সিটির অনুষ্ঠানে নারীদের গায়ে না-কি শাড়িই মানায় বেশি। নীলাশার কাছে কথাটা বেশ অদ্ভুত শোনালো। এমন কোনো নিয়ম কি ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে? শাড়িটা তার পরার কথা না। তবুও বান্ধবীদের সাথে তাল মিলিয়ে শাড়ি পরেছে সে। যেখানে আয়না পাচ্ছে সেখানেই নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পরছে নীলাশা। সে ফর্সা হলেও মিশমির মতো রূপবতী নয়। তবুও এই শাড়িতে যেন তার শালীনতা, তার সৌন্দর্য, তার বঙ্গীয় সত্ত্বা স্ফুলিঙ্গের মতন ছলকে ছলকে উঠছে। নীলাশা দুষ্টু স্বভাবে হাসে। বাসা থেকেই আজ ঠিক করে এসেছে যে, ভুলবশতও কোনো ইংরেজি বর্ণ উচ্চারণ করবে না সে। বরং কাব্যিকের মতো বাংলায় কথা বলবে নীলাশা। একদম রাবীন্দ্রিক বাংলা বলে নিজের গায়ে লাগা ‘ব্রিটিইশ্শা’ তকমাটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিবে সে। নীলাশা যখন এই কথাটা ভেবে নিজেকে এক খণ্ড ঝকঝকে আয়নায় দেখতে লাগল, তখন-ই সেই আয়নায় পরিচিত এক পুরুষের প্রতিচ্ছবি যেন জ্বলজ্বল করে তার মনে দীপ্তি ছড়াল। নীল সুতোয় কাজ করা সাদা পাঞ্জাবির আস্তিন গুটাতে থাকা ছেলেটি আরাভ না? নীলাশার প্রশ্নবিদ্ধ মন নিজেই উত্তর দিয়ে বলে ওঠে যে, ওটা আরাভ। ওইযে তার কাঁধে গিটারের ব্যাগ দৃশ্যমান! নীলাশা ডানপাশে তাকিয়ে একবার পিহুকে দেখল। সানামের থেকে ছবি উঠিয়ে নিতে তার অঙ্গবিক্ষেপের যেন কোনো শেষ নেই! এদিকে বা’পাশে বেগুনি শাড়িতে পারুলকন্যা মিশমির যে কীসের এত অধীরতা, কীসের এত প্রতীক্ষা তা বুঝে আসে না নীলাশার। ওদিকে বন্ধু দুটো তো অন্যান্য বন্ধুদের সাথে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত। তার কি বান্ধবীদের সঙ্গ দেওয়ার কথা মনে আছে? নীলাশা আবারও খানিকটা আশেপাশে তাকিয়ে, শাড়ির কুঁচি দুলিয়ে চলল আরাভের কাছে। আরাভের সাথে এই মুহূর্তে কেউ নেই। না-জানি তার কী হলো! ধীরস্থির যুবতীর পা দুটো কেমন চঞ্চল কিশোরীর ভূমিকা পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নীলাশা আরাভের নিকট পৌঁছে আরও একবার তাকাল তার আশেপাশে। আরাভ বিপরীতে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকায় নীলাশাকে দেখতে পায়নি। সে ওমুখো হয়ে কী যেন করছে! ঠিক এই মুহূর্তেই নীলাশা হাস্যোজ্জ্বল মুখে বিশদ বাংলাভাষায় ডেকে উঠল,

“ গায়কবাবু? ”

চলবে ইন শা আল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here