তারকারাজি-১৬,১৭

0
452

তারকারাজি-১৬,১৭
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
পর্ব:১৬

সন্ধ্যা তখন প্রবেশদ্বারে এসে থেমেছে। শুধু যেন তার প্রবেশের অপেক্ষাটাই রয়ে গেল প্রকৃতিতে। আকাশে তখন যত লাল-নীল রঙের খেলা! ধীর পায়ে নিজের লম্বা বিনুনি হেলিয়ে-দুলিয়ে ভার্সিটির এক পথ ধরে হাঁটতে লাগল মিশমি। রমণীর নিখাদ মনে হঠাৎই ভীষণ প্রণয়নের হাওয়া লাগল। মনোচ্ছবিতে ফুটে উঠল বেশ সুদর্শন, গৌরবর্ণের কৃশকায় ছেলেটি। কানের পিঠে চুল গুঁজে মিশমি ভাবতে লাগল সেই ছেলেটির কথা। আচ্ছা, সানামের দেওয়া শর্তের বাহানায় কি বলে ফেলা যায় তাকে ভালোবাসার কথাটা? কথাটা মনে হতেই ঠোঁটের মিঠে হাসিতে রঙ লাগল… লাল টুকটুকে লজ্জার রঙ। চঞ্চল দৃষ্টি ছুটোছুটি করল পিচঢালা রাস্তার রূঢ় গায়ে। তখনই এলো কারো পিছু ডাক,

“ মিশমি! ”

মিশমি চমকে উঠে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দাঁড়ায়। নিজ কল্পজগতে হারিয়ে যাওয়া মনটা আবার নিজের মাঝে ফিরিয়ে আনে। বুঝে ওঠার চেষ্টা করে বাস্তবতাটা। তখনই কেউ জুতোয় খটখট আওয়াজ তুলে এগিয়ে আসে তার দিকে। মিশমি চোখ তুলে তাকায়। দেখতে পায় অতি পরিচিত তাম্রবর্ণের পুরুষটিকে। সে হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্রশ্ন করে,

“ আমাকে ডাকছিলেন না-কি সায়ান ভাইয়া? ”

সায়ান হাসে। সন্ধ্যামুহূর্তের আরক্তিমে তরুণের হাসি দেখে মিশমি স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে, তাম্রবর্ণ সায়ানের হাসিটা খুব সুন্দর। সে হাসলে ঠোঁটের কোণের মৃদু ভাঁজটার গভীরতা নজরে পড়ে মিশমির। মুহূর্তেই সে কেঁপে উঠে আশেপাশে তাকায়। সন্ধ্যার হাওয়ায় তো শীতলতা নেই! তবে এ-কেমন শিরশিরে অনুভূতি তার? মিশমি দৃষ্টি নত করে। তখন সায়ানকে বলতে শোনা যায়,

“ একা-একা ভূতের মতো ঘুরছো কেন? বাসায় যাবা না? ”

মিশমি আরও একবার কানের পিঠে চুল গুঁজে নিল। দৃষ্টি নত করেই জবাব দিল,

“ জ্বি, বাসায়-ই যাচ্ছিলাম। ”

“ যেতে পারবা তো? না মানে শরীর ঠিক লাগছে এখন? ”

সায়ানের প্রশ্ন শুনে মিশমি মৃদু নিঃস্বনে হেসে উঠল। সায়ান বুঝল, মেয়েটি রূপে-গুণেই নিখুঁত না। আমাদের মানবজাতির একান্ত ব্যক্তিগত বা নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যা হয় স্রষ্টার দানকৃত অনন্য এক উপহার। এমনই একটি উপহার হলো হাসি। মিশমির হাসিটাও যে তার রূপ-গুণ ছাপিয়ে যাওয়ার মতো নিখুঁত তা সায়ানের আগে জানা ছিল না। অতিরিক্ত মানুষ-জনের সামনে মেয়েটি কেমন যেন মিইয়ে থাকে! ভাগ্যিস খুব নিভৃতে এই সুস্মিতার সাথে কথা বলার সুযোগ হলো তার! সে যাইহোক, পাশের রমণীকে নিয়ে সায়ানের এ-সকল জল্পনা-কল্পনা ভঙ্গ হলো সেই রমণীর পাল্টা প্রশ্নে,

“ সারাদিন শেষে এখন আমার খোঁজ নিচ্ছেন যে, আমি ঠিক আছি কি-না? খুব হাসালেন সায়ান সাহেব! ”

ব্যাপারটা বুঝে নিল সায়ান। অতঃপর মাথা চুলকে নিজের বোকামো ঢাকার বৃথা চেষ্টা করে বলল,

“ সারাদিন তো বন্ধু-বান্ধবের সাথে ছিলেন, ম্যাডাম। তাই আর কথা বলি নাই তখন। ”

“ আচ্ছা তাই না-কি? আমাদের মধ্যে কি দূরত্বটা এমন-ই ছিল যে, কাছে এসে আমার খোঁজটাও নিতে পারলেন না আপনি? ”

মিশমির প্রশ্নে হঠাৎই কেঁপে ওঠে সায়ানের বুক। কী যেন ছিল সেই প্রশ্নটাতে! ঘনঘন শ্বাস টেনে বুকে হাত রাখল সায়ান। মিশমি দেখছে না। সায়ান খেয়াল করেছে অনেক, মেয়েটা নিশান বা রিশান ছাড়া অন্যকোনো ছেলের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। এটা কি শুধুই ছেলেদের ক্ষেত্রে? না, এই ব্যাপারটা জানা নেই সায়ানের। তাই নিজের অস্থিরতা প্রকাশ পেলেও ধরা পড়ার ভয় করল না ছেলেটি। বরং সৎসাহস দেখিয়ে বলল,

“ সেই দূরত্বটুকুও ঘুচে দেওয়া উচিত! ”

তিহামের ভাবনায় অন্যমনস্ক মিশমি হঠাৎই সতর্ক হয়ে বলল,

“ হুম? কী বললেন? ”

সায়ান ঝটপট কথা ঘুরিয়ে নিল,

“ বললাম যে, এই সন্ধ্যায় একা বাসায় যাচ্ছ দেখে আন্টি কিছু বলবে না? রিশানদের থেকে শুনলাম তোমার আম্মু না-কি খুব কড়া? ”

মিশমি প্রথমে বিস্মিত ও পরে অভিমানী স্বরে বলল,

“ ওরা শুধু এটুকুই বলছে আপনাকে? ভাগ্যিস ওদের কথাগুলোর সমার্থক হিসেবে ভদ্র-নম্র একটা ওয়ার্ড ইউজ করলেন, কড়া! ওরা যে বাড়িয়ে-বাড়িয়ে কিছু বলেনি তা আমি কোনোদিনও বিশ্বাস করব না। ”

সায়ান হাসে, “ বন্ধুত্বে একটা অলিখিত নিয়ম হলো বাড়াবাড়ি করা। এদের বন্ধু বলে ঘোষণা করা হলে বাড়াবাড়ি করবেই। তবে যে যাই বলুক, আমি কিন্তু আন্টির ফুল সাপোর্টে! নিজের মেয়েকে তার ভালোটা দেখাবে, এটাই তো মায়ের উত্তম বৈশিষ্ট্য। তবে হ্যাঁ, তোমাকে ভালোটা দেখালেই তো আর হবে না! তোমার নিজেকেও নিজের ভালো-মন্দ বুঝতে শিখতে হবে। নয়তো পিছিয়ে পড়বে সবার থেকে। ”

আরে, এই একই কথা নীলাশাও বলেছিল না তাকে? মিশমির মনে পড়ল সেই কথা। কিন্তু এইদিক দিয়ে মিশমির অলসতার যেন শেষ নেই! মা তো আগেভাগেই বুঝে নিচ্ছে তার ভালো-মন্দ। তাহলে নতুন করে আর কী ভালো-মন্দ বোঝা যায় যা সে বোঝে না? মিশমি এমন কিছু খুঁজেছিল অনেকবার। কিন্তু লাভ বিশেষ হয়নি। ভাবনার মাঝেই শোনা গেল আযানের হৃদয় কাঁপানো ধ্বনি। রক্তিম আলোয় পরিপূর্ণ হলো মাগরিবের সময়ক্ষণ। মিশমির পড়ল তাড়া! বাংলাদেশের ঘরে-ঘরে এখনও এমন নিয়ম আছে যে, মেয়েরা বাহিরে যেখানেই থাকুক না কেন, মাগরিবের আযানের আগে গৃহস্থলে প্রবেশ করতে হবে তাদের। মিশমি অবশ্য এই নিয়মের বাহিরে! তবে সন্ধ্যা নামলেই একা-একা বাহিরে থাকতে ইচ্ছা করে না তার। অস্বাভাবিক ভয়ে কাতরে উঠে সে। এই শহরের সন্ধ্যা-রাত্রি যে মেয়েদের জন্য খুব একটা নিরাপদ নয় তা মিশমি খুব করে মেনে চলে। অবশ্য দিনই-বা কীসের নিরাপদ? সাথে কোনো বন্ধু কেন, একজন বান্ধবী থাকলেও হয়তো ভরসা পেত সে। তবে… না, আর দেরি করা ঠিক হবে না। কথাটা মাথায় আসতে না-আসতেই মুঠোফোনটা বেজে উঠল। ইংরেজি বর্ণে লেখা ‘আম্মু’ শব্দটি পর্দায় দেখেই বুক ধকধক করতে লাগল তার। ফোন না তুলেই হুড়মুড়িয়ে সায়ানকে বলে উঠল সে,

“ সায়ান ভাই, একটু রিকশায় তুলে দিবেন জলদি? আমাকে যেতে হবে। ”

সায়ান দেখেছে মিশমির মা ঝুমুর বেগমের কল করাটা। সেই সাথে দেখেছে মিশমির মুখে ভীতির ছাপ। সে উত্তর দিল,

“ শোনো, আন্টি কিছু বললে বলবা রাস্তায় জ্যাম ছিল। অবশ্য মিথ্যা-ও বলতে হবে না! আজকে ওইদিকে কীসের যেন মিছিল হচ্ছে। ভীড় অনেক। তুমি আসো আমার সাথে। দেখি রিকশা পাওয়া যায় কি-না! ”

কথাটা বলতে না বলতেই মিশমি সায়ানের পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটতে শুরু করল। যেন ত্বরান্বিত না হলেই বিপদে আছড়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে হাঁটতে পারে না একটুও। ফলস্বরূপ হোঁচট খেয়ে একদম বসেই পড়ল রাস্তাতে। পায়ের কনিষ্ঠ আঙুলে বোধহয় লেগেছে খানিকটা। ব্যথিত আর্তনাদ যেন আপনা-আপনিই অবস্থান করল তার ঠোঁটে। মুহূর্ত ব্যয়ে খিঁচিয়ে বন্ধ করা চোখ জোড়া মেলে মিশমি যখন তাকাল, তখন সে পরিপূর্ণ ভাবে অনুভব করার পাশাপাশি খেয়ালও যে, তার হাতটা সায়ান খুব শক্ত করে ধরে রেখেছে। তার আঙুলের ফাঁকে বদ্ধ হয়েছে মিশমির আঙুলসমূহ। সেই মুহূর্তে দৃষ্টি বিনিময় হতে না হতেই চোখ নামিয়ে নিল মিশমি। লাজে নিজের হাত সরাতে নিতেই সায়ান তার দুই হাত টেনে দাঁড় করিয়ে দিতে লাগল। সেই সাথে বিচলিত ভঙ্গিতে প্রশ্নও করল,

“ লাগল না-কি? ”

মিশমির লেগেছে। কিন্তু সে নঞর্থক মাথা নাড়িয়েই অবিজ্ঞভাবে প্রশ্ন করে বসল,

“ আশ্চর্য, এইটা নিয়ম হয়ে গেল না-কি যে, আমি পড়ব আর আপনি ধরবেন? সকাল থেকে আমরা দুজন এগুলাই করতেছি, তাই না? ”

মিশমির নির্বোধ প্রশ্নে হেসে ফেলল সায়ান। এক সাথে পথ চলতে চলতেই সায়ানের মনে হলো, বিরক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে মিশমি যে কথাটা বলল তা বাস্তবতায় পরিণত হলে খুব একটা মন্দ হয় না। সায়ান নিজেও মুখে-মুখে অস্বাভাবিক কিছুর সম্মুখীন হওয়ার অভিজ্ঞতা প্রকাশ করল। তবে মনের গহীন থেকে আওয়াজ এলো,

“ মিশমি? এই নিয়মটা আমাদের জন্যই বরাদ্দ থাক, তুমি পড়ে গেলেও আমি তোমার হাতটা ধরে থাকব। ”

বিকেলে সানামের সাথে ঘন্টাময় বাইকে ঘুরে ক্লান্তশ্রান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দেওয়ার সময় হয়নি নীলাশার। সানামের সাথে কাটানো সময়টাতেও ছিল তার ভালো লাগার কিছু বাহানা। মেয়েটা অন্যরকম বলে তার জানা ছিল। তাই বলে তার বন্ধুত্ব স্থাপনের ভঙ্গিমাটাও অন্যরকম হবে না-কি? যাইহোক, সে অনেক কথা…! এটা ছিল খুবই সুন্দর একটা মুহূর্ত। বর্তমানের এই বিষণ্ণ প্রহরে নীলাশার ইচ্ছা করে না সেই সময়টুকু তার কল্পনাতে আনতে। নীলাশা আলতো করে নিজের মাথাটা টেবিলের পাটাতনে রাখে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ওদিকে বাবার শান্ত কণ্ঠের বাণী শোনা যাচ্ছে। সেই বাণী শুনতে অনাগ্রহী নীলাশা কান চেপে ধরেও লাভ বিশেষ খুঁজে পেল না। সেই-তো স্পষ্ট শোনা গেল বাবার কথা,

“ নৌশিন, তোমার মেয়েকে বলে দাও ওর কোথাও যাওয়া চলবে না। এখনো ও এতটা বড় হয়নি যে, নিজের ইচ্ছা মতো চলবে। যেতে হলে ওকে আমার কথা মতোই যেতে হবে। আর যদি না যেতে চায় তো ভালো। আমি আরেকজন বেস্ট সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে কন্টাক্ট করেছি। ওর অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হয়েছে ত্রিশ তারিখ। ও যেন এইটা মিস না করে। আর হ্যাঁ, আমার বন্ধু ওর ফ্যামিলি নিয়ে আসছে৷ এখন যেন কোনো সিনক্রিয়েট না করে ও, ওকে বলে দিও। ”

কথাটা নীলাশার কান পর্যন্ত পৌঁছাতেই হাতের কাছে বই-খাতা, জিনিসপত্র, সবকিছু ছুঁড়ে ফেলল মেঝেতে। ভ্রমণযাত্রার দিন নির্ধারিত হয়েছে নভেম্বরের দুই তারিখ। অথচ আজ অক্টোবরের ছাব্বিশ তারিখ হওয়া সত্ত্বেও কি-না বাবাকে রাজি করাতে পারেনি সে? নীলাশা রাগে-ক্ষোভে জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে শুরু করে। ওপাশ থেকে কলিংবেলের আওয়াজটা কানে আসে না তার৷ নিজের রাগে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ফেলে মেয়েটি৷ কেন তার বাবা তার সাথে এমন করে সব-সময়? নীলাশা পারে না সেই রাগ নিয়ন্ত্রণে আনতে। হুড়মুড় করে ক্লোজেট থেকে ঘুমের পোশাকটি পাল্টে নেয় সে। চুলগুলো বেঁধে নিয়ে বাবার সাথে কথা বলার জন্য প্রস্তুত হয়। এই প্রস্তুতি কোনো সাধারণ প্রস্তুতি নয়। এই প্রস্তুতির মূখ্য হাতিয়ার হিসেবে রান্নাঘর থেকে অত্যন্ত তীক্ষ্ণ ছুড়িটা হাতে নিতেও ভুল হয়নি তার। আজ হয় বাবার নিয়ন্ত্রণাধীন স্বাধীনতা থেকে মুক্তি পাবে সে, নয়তো এই নিয়ন্ত্রণাধীনতার স্বাধীন জীবনটাই ত্যাগ করে ফেলবে অতিষ্ঠ নীলাশা!

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

তারকারাজি- (১৭)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী

ক্রুদ্ধ নীলাশা যখন ছুরি নিতে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল তখনও তার খেয়াল ছিল না যে, বসার ঘরে অতিথির উপস্থিতি রয়েছে। ওদিকে অতিথিদের-ও বোধহয় খেয়াল ছিল না কোনো রমণীর সিঁড়ি ভাঙার ব্যস্ততাতে। নীলাশা খুব কৌশলে ছুরিসহ নিজের দু’হাত পিছনে লুকিয়ে, এগিয়ে গেল বসার ঘরের দিকে। বসার ঘরে তখন রমরমা পরিবেশ। নীলাশা যখন ত্রস্তব্যস্ত পায়ে মুক্তির দাবী নিয়ে বসার ঘরে পৌঁছাল, তখন তার শীর্ণ পল্লবে ঢাকা চোখ দুটো যেন বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল! এই বিমূঢ়তা কাটাতে নীলাশার মাত্র কয়েক মুহূর্তই সময় লাগল। সামনে আরাভ, আরাভের বাবা আহসান চৌধুরী ও আরেকজন যুবকের উপস্থিতি যেন নীলাশাকে বিব্রত বোধ করতে বাধ্য করল। ইয়াসিন চৌধুরী তার হারিয়ে যাওয়া অতি প্রিয়তম বন্ধুকে পরিবারসহ দাওয়াত করেছিলেন। নীলাশা শুনেছে, নীলাশাকে প্রথম দিন ভার্সিটিতে ছাড়তে গিয়েই বহু বছর পর দেখা হয়েছিল দুই বন্ধুর। দুই জনের ব্যক্তিগত জীবনের ব্যস্ততার কারণে পরিকল্পিত ও একান্তভাবে দেখা করা সম্ভব হয়নি এতদিন। তবে আজ যখন দু’জনার সময় মিললো তখন আর দেরি করলেন না ইয়াসিন চৌধুরী। পরিবারসহ দাওয়াত করলেন বন্ধুকে। তবে কি আহসান চৌধুরীই তার বাবার বন্ধু? প্রশ্নটা মনে আসতেই এক লহমায় বুঝে নিল উত্তরটা। নীলাশা মাথা নত করে দাঁড়ালো। তার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাটা একদমই ভালো না। দুর্দমনীয় ক্রোধটাকে বুকে আগলে রাখার ভীষণ চেষ্টায় কাতর হয়ে পড়ল মেয়েটি। নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা বরাবরই অসাধ্য সাধনের রূপ ধারণ করে নীলাশার কাছে৷ নিজের এই চেষ্টা করার মাঝেই ইয়াসিন চৌধুরীকে তার বন্ধুর উদ্দেশ্যে বলতে শোনা গেল,

“ আহসান, মেয়েকে তো চিনিস-ই। আর নীলাশা, ও আমার বন্ধু আহসান, তোমাদের ভার্সিটির প্রফেসর। ওর বড় ছেলে অভ্র আর ছোট ছেলে আরাভ। আরাভ আর তুমি কিন্তু একই ভার্সিটিতে পড়ো। ”

নীলাশা মাথা নিচু করেই সালাম দিল। সম্বোধনে ডাকল ‘স্যার’। তার উত্তরে আহসান চৌধুরী হেসে বললেন,

“ আরে মামণি, আমি ভার্সিটিতেই তোমাদের স্যার। এখানে বাবার বন্ধু হিসেবে আঙ্কেল-ই ডাকবে তুমি, বুঝলে? ”

নীলাশা অল্প করে ওনার দিকে তাকিয়েই মাথা দোলায়। মেয়েটির চোখে ঢের পানি জমে থাকতে দেখে আহসান চৌধুরীর হাসিটা মলিন হয়ে যায়। এদিকে আরাভও প্রথম ধাপে অবাক হয়েছিল খুব। অতঃপর নীলাশার মতোই দুইয়ে-দুইয়ে চার করে বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। তবে নীলাশার এহেন অবস্থা চোখ এড়ায়নি আরাভের। সেই ক্রন্দনরত লালাভ চোখ, জাজ্বল্যমান মুখশ্রী এমনকি তার ঠোঁট চেপে কান্না নিবারনের চেষ্টাটাও চোখে পড়েছে আরাভের। বাবার থেকেও বেশি বিচলিত দেখায় তাকে। তবে দু’জন গুরুজনের উপস্থিতিতে প্রশ্ন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না সে আর তখনই যেন ইচ্ছাপূরণের উছিলার মতো আহসান চৌধুরী প্রশ্ন করলেন,

“ কী ব্যাপার, নীলাশা মামণি অসুস্থ না-কি? চোখ-মুখের অবস্থা এইরকম কেন? ”

নীলাশা তার দুই পাশে মাথা নাড়ায়। বলে, সে ঠিক আছে। আহসান চৌধুরী এই নিয়ে আর প্রশ্ন করে না। তবে নীলাশাকে বসতে বলার পরও বসতে না দেখে একটু খটকা-ই লাগে সবার। বন্ধুর সাথে আলাপ-আলোচনা করার সময় ব্যয় হয় মাত্র দুই মিনিট। ইতোমধ্যেই কথার রেশ ধরে আহসান চৌধুরীকে বলতে শোনা যায় যে, আরাভ ও তার বন্ধুরা মিলে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আগামী মাসের এক তারিখে ঢাকা ত্যাগ করবে। এই কথা শুনে নীলাশা সেই-যে ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকিয়েছে…! সেই দৃষ্টি আর সরায়নি মেয়েটা। ইয়াসিন চৌধুরীও মেয়ের কান্না দেখে নিষ্প্রভ হয়ে পড়েন। তার পরের দিনই-যে মেয়েটা তার বন্ধুদের সাথে ভ্রমণে যাওয়ার বায়না ধরেছে! তিনি বন্ধুর সাথে কথা বলতে বিব্রতবোধ করছেন। মেয়েটাকে এই মুহূর্তে সামাল দেওয়া উচিত! আর সেই সময় নিশ্চুপ নীলাশার কান্না দেখে আহসান চৌধুরী প্রশ্ন করলেন,

“ নীলাশা, অ্যানি প্রবলেম? তুমি… ”

কথা সম্পূর্ণ করার আগেই নৌশিন আহমেদের উপস্থিতি ঘটল বসার ঘরে। হন্তদন্ত নৌশিন আহমেদ ছুটে এলেন একদম স্বামীর নিকটে। বোঝা যাচ্ছে, জরুরি কিছু একান্তভাবে বলতেই এসেছেন তিনি। কিন্তু প্রচণ্ড চিন্তিত মাতৃবৎ মনের নৌশিন আহমেদ চাওয়ার পরও নিচু গলায় কথা বলতে পারলেন না। ওনার কথা নীরব ঘরটিতে স্পষ্ট শোনা গেল,

“ তোমার মেয়ে হাতে ছুরি ধরে রেখেছে, ইয়াসিন। মেয়েটা সুইসাইড করুক সেইটা দেখার জন্যই বসে আছো তুমি? ”

ইয়াসিন চৌধুরী হঠাৎই কেঁপে উঠলেন। সেই সাথে ধকধক করে উঠল উপস্থিত তিনজনের মন। তারা কিছু ভুল শুনেনি তো? উত্তেজনা আঁকড়ে রাখতে না পেরে আরাভ দাঁড়িয়েই পড়ল। নিশ্চিত হতেই নীলাশার লুকিয়ে রাখা হাত দুটো দেখে নেয় সে। নৌশিন আহমেদ সত্যি বলেছেন। কতটা চিন্তিত হলে একজন মা এভাবে ছুটে আসেন? মেয়েটি যে নিজেকে শেষ করতে একবারও ভাববে না তা আক্রোশে রিরি করে কাঁপতে থাকা নীলাশাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ইয়াসিন চৌধুরীকে দেখা যায় উঠে দাঁড়াতে। তিনি চিন্তিত ও অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে তাকিয়ে আছেন মেয়ের দিকে। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই প্রথমে স্ত্রীকে ও পরে মেয়েকে প্রশ্ন করেন তিনি,

“ তুমি কোথায় ছিলে যে ও ছুরি নিতে পারল? আর নীলাশা, দিন-দিন এতো ডেস্পারেট হয়ে যাচ্ছ কেন তুমি? কোনো সেন্স আছে যে, ঠিক কী কারণে তুমি সুইসাইড করতে চাচ্ছো? ”

নীলাশা উত্তর দেয় না। মায়ের কাজে সে বেশ অসন্তুষ্ট। সে তো চায়নি সবাই সবটা বুঝে যাক। কিন্তু মা তো… যাইহোক, বাবার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না নীলাশা। বরং পাশের সোফায় ছুরিটা রেখে নত মুখেই বলল,

“ আই’ম ওয়ার্নিং ইউ, ড্যাড। আই উইল কিল মাইসেল্ফ ইফ ইউ ডোন্ট লেট মি গো উইদ দেম। ”

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দ্রুত বেগে দোতলায় উঠে গেল নীলাশা। সবাই দেখছে সেই মেয়েটিকে যে কি-না রীতিমতো শাসিয়ে গেল তার বাবাকে। ইয়াসিন চৌধুরী চিন্তিত। না পারছেন একা ছাড়ার অনুমতি দিতে আর না পারছেন মেয়েকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সামলে রাখতে। তিনি হতাশ দৃষ্টিতে নৌশিন আহমেদের দিকে তাকাতেই দেখতে পান স্ত্রীর ক্রন্দনরত মুখটা। অতঃপর তিনি নিজেকে অতিষ্ঠ মনে করে ব্যথিত অনুভূতিটা প্রকাশ-ই করে বসলেন,

“ আমার মেয়েটা যে এমন হবে তা আমি কল্পনাও করি নাই। ফ্যামিলির যত অশান্তি সব ওকে ঘিরে। এই মেয়েকে ঠিক করব কীভাবে বলতে পারিস, আহসান? আমার পুরো জীবন লেগে যাচ্ছে নীলাশাকে স্বাভাবিক করতে। ”

বন্ধুর কথা শুনে আহসান চৌধুরী প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে তাকিয়ে বললেন,

“ নীলাশা কোথায় আর কাদের সাথে যাওয়ার কথা বলল? যদি খুব পার্সোনাল কিছু না হয় তো বলতে পারিস। মেয়েটা রাগের মাথায় যদি কিছু করে বসে তখন তো সমাধান খুঁজে লাভ নাই কোনো। ”

ইয়াসিন চৌধুরী মাথা চেপে ধরে বসে থাকেন। বয়সের সাথে সাথে শারীরিক যন্ত্রণাটাও বেশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে নীলাশাদের ভ্রমণে যাওয়ার কথা জানালেন তিনি। এ-ও জানালেন যে, তিনি ভ্রমণে যেতে দিবেন না বলেই নীলাশা রেগে আছে। তাই বলে আত্মহত্যা? নীলাশার এরূপ আচরণ ও তাকে ভ্রমণে যেতে না দেওয়ার কারণের উপর প্রশ্ন উঠতেই ইয়াসিন চৌধুরী নীলাশার অতীতের এক ঘটনা উন্মুক্ত করে বললেন,

“ ফ্রেন্ড ইন নিড ইজ আ ফ্রেন্ড ইনডিড… এই একটা বাক্যের জন্যই আমার চঞ্চল মেয়েটা এমন চুপচাপ, বদমেজাজি, রাগী হয়ে গেছে। বন্ধুই যেন ওর কাছে সব! বন্ধু ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না নীলাশা, কিচ্ছু না। বছর কয়েক আগে লন্ডনের দু’জন মেয়ে এক সাইকো কিলারকে ধরতে পুলিশকে হেল্প করেছিল, নিউজটা পড়ছিলি তুই? ”

আহসান চৌধুরী একটু সময় নিয়েই ভাবতে শুরু করেন। তিনি মনে করতে পারেন না এমন কোনো খবরের কথা। তখনই ওনার বড় ছেলে অভ্রকে বলতে শোনা যায়,

“ বাবা, আঙ্কেল মনে হয় ওই সাইকো কিলারের কথা বলতেছে যে টিনএজ মেয়েদের মাথা কেটে গাছে ঝুলিয়ে রাখতো। কিলারের নামটা মাথায় আসতেছে না! ”

ইয়াসিন চৌধুরী সম্মতি জানিয়ে বলতে শুরু করলেন,

“ হ্যাঁ, তার কথা-ই বলছি আমি। ওকে যখন লন্ডনের পুলিশরা হাতেনাতে ধরেছিল তখনও আমরা বুঝতে পারি নাই যে, যে মেয়েটার মাথা কাটা হয়েছিল সেইটা আমাদের নীলাশাও হতে পারত! সেদিন নীলাশারা স্কুল থেকে আউটিং-এ যায় সবাই। নিজের বেস্টফ্রেন্ড স্টেসির সাথে একা ঘুরতে-ঘুরতেই না-কি সেই কিলারের সামনে পড়ে গিয়েছিল ওরা। কে জানতো সামনের মানুষটা মানুষরূপী জানোয়ার? নীলাশা খুব ফ্রেন্ডলি ছিল। সেই ছেলে যখন নীলাশার সাথে কথা বলতে-বলতে নীলাশাকে নিজের আয়ত্তে এনে ফেলছিল, তখনই না-কি স্টেসির চোখে পড়ছিল ছেলেটার গায়ের শুকানো রক্ত। ও বুঝতে পেরেছিল যে, কিছু একটা ঝামেলা ছিল ছেলেটার মধ্যে। নীলাশাকে ফাঁদে ফেলা হচ্ছিল। ঠিক কীসের কথা বলছিল মনে নাই কিন্তু স্টেসি কিছু একটা বলেই নীলাশাকে সড়িয়ে আনছিল ওই কিলারের কাছ থেকে। দুইজনে মিলে স্টেসির ট্যাব থেকেই কোড নাম্বারে কল করে পুলিশকে জানায় ব্যাপারটা। তখনই না-কি… তখনই না-কি নীলাশাকে নিয়ে যেতে ওই ছেলে… ওই ম্যাক্স ছেলেটা আসছিল আয়রন মেটালিক কোনো অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে। নীলাশাকে যে কীভাবে মারছিল তা ওইসময় ওর হাত-পায়ের দাগ দেখলে তুই বুঝতে পারতিস, আহসান। ওই সাইকোটা আমার মেয়েকে সেদিন মেরেই ফেলত। কিন্তু না, স্টেসি বাঁচিয়েছিল আমার মেয়েকে। ওর ক্যারাটে ট্রেইনিং নেওয়া ছিল জানতাম। টেকনিক্যালি নীলাশাকে বাঁচিয়ে দিলেও নিজে বাঁচতে পারে নাই মেয়েটা। যখন নীলাশা আমাদের সবটা বলল তখন আমরা কী শুনছিলাম জানিস তুই? ও বলছিল ওর সামনে, তৎক্ষনাৎ-ই না-কি স্টেসির মাথাটা আলাদা করে ফেলা হয়েছিল। নীলাশার সামনেই টুকরা-টুকরা করে দেয় স্টেসির বডি পার্টস। শুনছিলাম, নীলাশাকে যখন পুলিশের মাধ্যমে রেসকিউ করা হয়েছিল তখন নীলাশার গায়ে স্টেসির রক্ত জবজব করছিল। ভাবতে পারিস স্টেসি মেয়েটাকে কীভাবে মারছিল ওই ম্যাক্স? এমন করে নিজের বেস্টফ্রেন্ডকে খুন হতে দেখে কেউ ঠিক থাকতে পারে? স্টেসি চালাকচতুর মেয়ে ছিল দেখে কৌশলে আমার মেয়েটাকে বাঁচিয়ে দিছে। নাহলে আজকে স্টেসির সাথে-সাথে আমার মেয়েটাও…! ”

ইয়াসিন চৌধুরী সম্পূর্ণ কথাটুকু বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বুকের অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে ওনার৷ তিনি বললেন তো খুব সহজ করেই কিন্তু সেদিন কী হয়েছিল তা অনুভব তো কেবল নীলাশাই করতে পারে! সেই ক’বছর সাইকো কিলার ম্যাক্সকে নিয়ে প্রতিবেদনটা কম লেখা হয়নি! সবকিছু জেনে যা বুঝতে পেরেছিলেন তা হলো- স্টেসির করুণ পরিণতি! ইয়াসিন চৌধুরী বিস্তারিত বলতে থাকেন যা তিনি জানেন। সবটা শুনে আহসান চৌধুরীকেও বেশ চিন্তিত ভঙ্গিতে নীলাশার ব্যাপারটা পরীক্ষণ করতে দেখা গেল। তারপর আহসান চৌধুরী প্রশ্ন করলেন,

“ নীলাশা কি সেই ট্রোমার জন্যই এমন বিহেভিয়ার করছে? কিন্তু সেই ট্রোমা তো এতদিন থাকার কথা না! হঠাৎ কী হলো ওর? ”

ইয়াসিন চৌধুরী আরও বিস্তারিত বলতে যান৷ তবে তার আগেই নৌশিন আহমেদ বলতে শুরু করলেন,

“ না, ভাইজান। সব হয়েছে আপনার বন্ধুর জন্যই। সেদিনের পর নীলাশা নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। প্রায়-প্রায়ই ঘুম থেকে উঠে বলতো স্টেসি এসেছে, ওকে ডাকছে, ওর কাটা হাত দুটো না-কি টানছে নীলাশাকে। সারা দিন-রাত এগুলো বলতো যে, স্টেসি তাকে বার-বার বলছে ‘ফ্রেন্ড ইন নিড ইজ আ ফ্রেন্ড ইনডিড। আই ডাইড ফর ইউ, নাও ইউ হ্যাভ টু ডাই ফর মি।’এমন সময় আপনার বন্ধু শুরু করল ডক্টর দেখানো। ডক্টর নিজেও বলছিল যে, বন্ধুর মৃত্যুকে এভাবে দেখেছে বলেই নীলাশা এমন করছিল। এইসব-ই ওর কল্পনা। এটা চিন্তার কিছু না। শুধু ওকে চোখে-চোখে রাখলেই হবে। কিন্তু আপনার বন্ধু কি তা শুনেছে? বরং সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে নীলাশাকে জোর-জবরদস্তি স্বাভাবিক করতে গিয়ে এমন চিরতরে অস্বাভাবিক করে ফেলছে। নীলাশা যখন প্রথম বার সুইসাইড অ্যাটেন্ড করেছিল তখনও আমরা সাইকিয়াট্রিস্টের কথামতো ইংল্যান্ড থেকে এখানে চলে আসি। নতুন পরিবেশ দিই আমার সেই পনেরো বছরের নীলাশাকে। স্টেসিকে নিয়ে এইসব কথা তখন বলতো না ঠিকি। কিন্তু সমস্যা হয়েছিল তখন যখন ওর ফ্রেন্ড, পিহুর সাথে ওর প্রথম আলাপ হয়। আমরা ভাবছিলাম পিহুকে পেয়ে হয়তো স্টেসিকে ভুলে গেছে নীলাশা। কিন্তু না, পিহুকে পেয়ে যেন ও ছোট বাচ্চাদের মতো করতে শুরু করল। নীলাশার জন্য আমরা বিশেষ কিছু করলে পিহুকেও তাতে সামিল করতো ও। এটা বন্ধুর প্রতি বন্ধুর ভালোবাসা বললে ভুল হবে। কারণ ওর সেইসব আবদার মোটেও বন্ধুর প্রতি আরেকজন বন্ধুর ভালোবাসার মতো স্বাভাবিক ছিল না। পিহু যদি কোনো কারণে স্কুল অ্যাটেন্ড করা বাদ দিত তো নীলাশা বাসায় এসে কান্নাকাটি শুরু করত। তখন ভেবেছিলাম ওর বয়সটাই চলছে আবেগ দিয়ে। সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে যখন ও টিনএজ লাইফের এই ইমোশোন কাটাতে পারবে। কিন্তু সেখানেও আপনার বন্ধু ডক্টর-টক্টর জোগাড় করতে পাগল হয়ে গেল। নীলাশার উপর মেনটাল প্রেসার ক্রিয়েট করল সে। পিহু ঢাকা থেকে চলে যাওয়ার পর একে-একে নীলাশা যখন একাধিক বন্ধু পেয়ে গেল, ঠিক তখনই আপনার বন্ধুর কেরামতি পুরোপুরি পাল্টে দিল আমার মেয়েটাকে। আপনার বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেন ভাই, আপনার বন্ধু কি নীলাশা আর তার বন্ধুদের মাঝে ইচ্ছাকৃতভাবে দূরত্ব তৈরি করে দেয় নাই? সে প্ল্যান করে বন্ধুদের সাথে নীলাশার এমন আত্মিক বণ্ডিংটা ভাঙতে চেয়েছিল৷ ভাবেন তো, আমার মেয়েটার মানসিক অবস্থাটা তখন কেমন ছিল যখন বুঝতে পেরেছিল তার বাবার চাহিদাটা? আমার সুস্থ মেয়েটাকে ও নিজেই অসুস্থ করে ফেলছে। মানুষ কি তার বন্ধুকে ভালোবাসতে পারে না? ও ভাবে, আমাদের নীলাশা স্টেসির জন্যই সুইসাইড করতে চেয়েছিল। আর তাই নিজের মেয়েটাকে ফোর্স করতে-করতে এখন আমাদের এমন ইমেজ তৈরি হয়েছে যে, আমাদের কথা ওর সহ্যই হচ্ছে না আজকাল! কথায়-কথায় রেগে যাচ্ছে, জেদ করছে আরও কত কী! ও ওর বাবার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছে বলেই তো এমন সব আচার-আচরণ করছে আর এই কথাটাই আমি ওর বাবাকে বোঝাতে পারি না। নীলাশা তো বলে যে, ও না-কি ওর বন্ধুদের সাথে থেকেই শান্তি খুঁজে পায় আর আমরা না-কি ওর অশান্তির মূল। এখানে আমি তো আমার মেয়েকে দোষারোপ করতে পারব না। ওর কী দোষ? আমাদের দোষেই আমরা আমাদের মেয়েটাকে এমন বানিয়ে ফেলেছি। আমাদের প্রাণোচ্ছল মেয়েটাকে আমরা নিজেরাই মেরে ফেলেছি! ”

কথাগুলো বলতে বলতেই নৌশিন আহমেদের চোখ ভরে এলো। এই কয়েক বছর ধরে নীলাশার ব্যবহারে আর ইচ্ছা করে না বেঁচে থাকতে। এমন অহেতুক অশান্তি কার সহ্য হয়? আহসান চৌধুরী সব কথা শোনার পর মলিনমুখে বসে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। অতঃপর প্রশ্ন করলেন,

“ আচ্ছা ভাবী, নীলাশা কি এমন কিছু ভাবছে যে, স্টেসি তাকে বাঁচাতে গিয়েই যখন মারা গিয়েছে তখন বন্ধুদেরকে এক্সট্রা প্রায়োরিটি দিয়েই… ”

তিনি কথা শেষ করার আগেই নৌশিন আহমেদ বললেন,

“ না ভাইজান, এই কথা তাকে আরও অনেকবার জিজ্ঞাসা করা হয়েছে। মেয়ের উত্তর ‘বন্ধুত্বের ঋণ শোধ করা যায় না। সেই বৃথা চেষ্টা কোনোদিনও করবে না সে।’এরপরও এমন কিছু কীভাবে ভাবতে পারে ও? ”

সবকিছু শুনে আহসান চৌধুরী সোজা হয়ে বসলেন। বেশ গুরুগম্ভীর ভঙ্গিমায় বললেন,

“ দেখ ইয়াসিন, আমি কোনো ডক্টর বা সাইকিয়াট্রিস্ট না। বাট প্রফেসর হওয়ায় আমি অনেক ছেলে-মেয়েদের দেখেছি। আর সেই থেকে এটা অন্তত বলতে পারি যে, দোষটা তুই করছিস। মেয়েকে সেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এতো-এতো আয়োজন না করে, তোর উচিত ছিল আগে মেয়েটার মন বোঝা। যাইহোক, যে ভুলটা করে তুই এতদিনে মেয়ের মন বিষিয়ে ফেলছিস সেই ভুলটা এইবার ঝেড়ে ফেল। পুরাতন কাসুন্দি ঘেঁটে তো লাভ নাই! মেয়েকে স্বাভাবিক করার একটাই উপায় আছে বলে আমি মনে করি। ”

বরাবরের মতোই মেয়েকে স্বাভাবিকভাবে ফিরে পাওয়ার প্রলোভনে এবারও নীলাশার বাবা-মা আশার আলো খুঁজতে মরিয়া হয়ে পড়ল৷ ইয়াসিন চৌধুরী নিজের অপরাধবোধে বিদ্ধ অন্তরে অস্থিরতা ঢেলে প্রশ্ন করে বসলেন,

“ কী উপায়? ”

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here