তারকারাজি-১৮,১৯

0
378

তারকারাজি-১৮,১৯
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
পর্ব:১৮

ইয়াসিন চৌধুরী নিজের অপরাধবোধে বিদ্ধ অন্তরে অস্থিরতা ঢেলে প্রশ্ন করে বসলেন,

“ কী উপায়? ”

সুপ্রশস্ত বসার ঘরে অবস্থানরত দুই টগবগে তরুণ, ও অসহায় মাতা-পিতাকে বড্ড বেশিই ভাবুক দেখায়। আহসান চৌধুরীর পরিকল্পনা কী হতে পারে তা ধারণা করাটাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে বাকিদের কাছে। অন্তরে শুধু প্রশ্ন আর প্রশ্ন। সকলের সেই প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে নিয়েই আহসান চৌধুরী বললেন,

“ ওকে ওর বন্ধুদের সাথে ট্রিপে যেতে দে। বন্ধুপ্রিয় নীলাশা ঘরের বাঁধা মানবে না। নীলাশা যেভাবে নিজের বন্ধুদের সাথে যেতে চায় ঠিক সেভাবেই ওকে যেতে দে। ”

ইয়াসিন চৌধুরী প্রথমেই নঞর্থক মনোভাব ব্যক্ত করলেন,

“ না, না। কী বলিস এগুলা? আমার মেয়ে-ই তো ভালো না। দেখা যাবে যে, বন্ধুদের সামান্য কথা কাটাকাটির জন্যই রেগেমেগে বসে আছে। যদি কোনো অঘটন ঘটায়? ওর বন্ধুরা ভালো। ওকে দেখে রাখবে। ওর দুই বান্ধবীর দ্বারা ওকে সামলানো অসম্ভব। বাকি দু’জন ছেলে। ওরা পারবে কিন্তু কতক্ষণ? এতো বড় মেয়ে যদি কোনো অঘটন ঘটানোর চেষ্টা করে তখন ওর বন্ধুরা ওইটা মেনে নিবে? ওদের-ও তো ট্রিপটা এনজয় করার তাগিদ আছে! ”

আহসান চৌধুরী চকিতেই নিজের ছাত্র জীবনের বন্ধুকে পুরনো দিনের মতোই ধমকে উঠলেন। ধমকানোর সুরটাই শুরু হলো এমন, ‘আরে ব্যাটা শোন আমার কথা! ’ অতঃপর নিজের পরিকল্পনা উন্মুক্ত করে বললেন,

“ নীলাশারা যদি দুই তারিখে ট্রিপে যায় তো আমি বলব ওরা আরাভদের সাথেই যাক। এতে কী হবে বুঝলি ইয়াসিন? ওরা যখন একসাথে থাকবে তখন একে-অপরের প্রতি একটা দায়িত্ব থাকবে। একজন কেয়ারলেস হলেই তো আর বাকি সবাই তা হবে না! আর ভার্সিটির সিনিয়রদের দেখে জুনিয়ররা বরাবরই কিছুটা ভয়ে-ভয়ে থাকে। নীলাশা আর যাইহোক, আরাভদের অমান্য করতে পারবে না। আরাভ, তুই কী বলিস? তোরা বন্ধুরা মিলে ট্রিপে যাচ্ছিস, আনন্দ-ফূর্তি করবি ঠিক আছে। তোদেরও তো প্রাইভেসি বলতে কিছু আছে! নীলাশাদের নিয়ে যেতে রাজি করাতে পারবি তো তোর বন্ধুদের? ”

বাবার পরিকল্পনা শুনে আরাভ বেশ অপ্রস্তুত হয়। যাচ্ছে বন্ধুদের নিয়ে আর সেখানে আরেকটা বন্ধুদল হাজির হবে? কিন্তু সে নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বাবার কথাটাও বিচার করে দেখে। নিমরাজি হয়ে বলে,

“ বাবা, নীলাশার ফ্রেন্ডস মানে নিশান-রিশানদের সাথে আমাদের বন্ডিংটা ভালো। ওদের রাজি করানো কোনো ব্যাপার না। কিন্তু তিনটা মেয়ে এতজন ছেলের মাঝে… মানে কী-করে কম্ফোর্ট ফিল করবে, বাবা? আর এতজনের মাঝে ওদের নিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? ”

ছেলেকে আমতা-আমতা করতে দেখে আহসান চৌধুরী মৃদু হাসলেন। বেশ আদুরে ভঙ্গিতে ছেলের পিঠে চাপড় মেরে বললেন,

“ আরে তুই এতো টেনশন নিতেছিস কেন? একসাথে যাবি, একসাথে ঘুরবি, খাওয়া-দাওয়া করবি আবার একসাথেই ব্যাক করবি। এর চেয়ে বেশি কিছু তো আর না! আর তুই থাকতে আমার মনে হয় না কোনো সমস্যা হবে। দেখ আরাভ, একটা মানুষকে একটা ভালো সময় উপহার দেওয়ার দায়িত্ব আমি তোর উপর চাপিয়ে দিচ্ছি। ওরা পাঁচজন যেমন সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে তোদের সাথে যাবে, ঠিক সেভাবেই ঘুরে-টুরে সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে ওদের ফিরিয়ে আনার ভরসাটা আমি তোর উপর রাখছি। তুই শুধু বল যে, তোর বন্ধুদের রাজি করাতে পারবি কি-না আর আমার ভরসার মান রাখতে পারবি কি-না। আমি বড়মুখ করে শুধু নীলাশা-ই না, নীলাশাসহ আরও দুজন মেয়েকে সাথে নেওয়ার কথা বলছি। আশা করি তুই এতো ছোট না যে বুঝবি না। তুই যদি আমাদের অভয় দিস তো ইয়াসিন দেখবে সে আমার কথাটা রাখবে কি-না। হাজার হোক ও মেয়ের বাবা। মেয়েকে কোথায় কীভাবে পাঠাতে হবে তা ওর ভালো জানা। ”

আরাভ উক্ত অভয়টি দেয় তাদের সবাইকে। কিন্তু সে এইটা বিশ্বাস করতে পারে না যে, ইয়াসিন চৌধুরী বিনা বাক্য ব্যয়ে বন্ধুর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে রাজি হয়ে যাবেন। এটা বন্ধুর প্রতি সম্মান? না-কি মেয়ের প্রতি করা অবিচারের প্রায়শ্চিত্ত করার মাধ্যমে, মেয়েকে আগের মতো দেখবার তীব্র বাসনা কেবল? বুঝতে পারে না আরাভ। তবে তার মনে সূক্ষ্মতম ভীতিটা থেকেই যায়। দায়িত্বটা ভালোয়-ভালোয় পালন করতে পারলেই হয় এখন! ওদিকে ছোট ভাই নাজিফের থেকে যখন পুরো বার্তাটি পেল তখন নীলাশা কেবল-ই হিম হয়ে বসেছিল নিজের শয়নকক্ষে। ঘটনা কি সত্য? অতঃপর ইয়াসিন চৌধুরী যখন হাজার টাকার নোটগুলো গুচ্ছে-গুচ্ছে তার হাতে তুলে দিয়ে আদর করে বললেন,

“ মাই প্রিন্সেস! তুমি জানো তুমি আমাদের কাছে কী। তোমাকে যেতে দেওয়া হচ্ছে কেবল একটা শর্তে- তুমি সেখানে যেমন বন্ধুদের সাথে এনজয় করতে-করতে যাবে ঠিক তেমনভাবেই ফিরে আসবে হাসিমুখে। একা একা কোথাও যাবে না। আর শোনো, তুমি কিন্তু সেখানে গিয়ে কোনো ঝামেলায় জড়াবে না আর বন্ধুদের সাথে তো আরও না। বুঝতে পারছো? ”

কথাটা শোনা মাত্রই নীলাশার চোখেমুখে লাবণ্যের দীপ্তি যেন তরতর করে বৃদ্ধি পেল। সংশয়াপন্ন মনে লাগল অত্যন্ত নমনীয় এক মিঠে হাওয়া। বাবা-মা এতো সহজেই রাজি হয়ে গেল? ব্যাপারটা ঘেঁটে দেখল সে। অনেক সমীকরণ মিলিয়ে যখন উত্তর এলো- কোনো ছলচাতুরী বিহীন বাবা-মায়ের স্নিগ্ধ কিছু অনুভূতি, তখন আর রেগে থাকতে পারল না নীলাশা। হন্তদন্ত হয়ে গোছগাছ শুরু করে দিল আজ থেকেই। বন্ধুরা থাকবে সাথে, সাথে থাকবে অত্যন্ত প্রিয় শ্যামবর্ণের পুরুষটিও। কেমন হবে সেই ভ্রমণ? নানান জল্পনা-কল্পনায় কেটে গেল গোটা রাতটা। পরের দিন ভার্সিটিতে এসে যখন অনুমতি পাওয়ার বিষয়টা বন্ধুদের কাছে উন্মুক্ত করল তখন সবার বিস্ময় যেন আকাশ ছোঁয়া! তারা তো জানতো ইয়াসিন চৌধুরী রাজি না হয়ে থাকতে পারবেন না। কিন্তু এর মাঝে যে এতো কিছু ঘটে যাবে তা অনুমান করতে পেরেছিল কি কেউ? নিশান মাত্রাতিরিক্ত নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলে বসল,

“ দোস্ত, তুই এইডা কী কাম করে ফেলছোস! আমি তো গর্বে গর্ভবতী হয়ে যাচ্ছি রে দোস্ত। ”

নিশানের কথা শুনে বন্ধুমহলে হাসির রোল পড়ে গেল। হাসির বেগ সামলাতে না পেরে পিহু পেটে হাত রেখে, গোড়ালিতে ভর করে বসে পড়ল প্রাঙ্গণে। এই নিয়েও কম তামাশা হলো না! রিশানও নাটুকে ভঙ্গিতে বলল,

“ কী-রে পিহু, খুব জোরে চাপছে না-কি? একটু কষ্ট করে আটকায় রাখ দোস্ত। সানাম রে কল করছি। ওই আসার আগে অন্তত জায়গাটা নষ্ট করিস না তুই। আর তুই জানোস না খোলা মাঠে এইসব করতে নাই? ”

সানামকে বিশেষ তাগিদে এখানে ডাকারও একটা বিশেষ কারণ রয়েছে। অবশ্য তা সানামের উপস্থিতিতেই বোঝা যাবে বেশ! বর্তমানে বন্ধুদের মশকরা দেখে পিহুর হাসিতে ফেটে পড়া নিয়েও হৈচৈটা কম হলো না। বন্ধুগণের আনন্দ দেখে চিন্তিত মিশমিকে বলতে শোনা গেল,

“ উফ, থাম না তোরা! আমার একটুও ইচ্ছা করতেছে না ভাইয়াদের সাথে যেতে। অতগুলো ছেলের সাথে আরামসে ঘোরা যায়? নীলের বাবা এটা মেনে নিতে পারে কারণ আঙ্কেল অন্য সংস্কৃতিতেও থাকছে। আমার আব্বু জানলে কী হবে ভাবছিস? ”

এই কথা শুনে রিশান নিজের বিরক্তি প্রকাশ করল,

“ আরে আহাম্মক, যখন বুঝতাছিস-ই তোর বাপ জানলে যেতে দিবে না তখন জানাইবি ক্যান? আর এমন করতাছোস যেন তুই একলাই একটা মেয়ে যাবি আমাদের সঙ্গে? দেখ মিশা, আমরা আছি না? হুদাই এখন ট্রিপটার বারোটা বাজাইস না তুই। তোদের আগেই বলছি যে, এইবার ছ্যাড়াব্যাড়া করলে তোদের চারটাকেই রেখে যাব। পরে যদি তোর জন্য আমাদের নীল সুইসাইড করতে যায় তখন কিন্তু… ”

কথা অসমাপ্ত রেখেই যেন রিশান ভয়ঙ্কর কিছু বুঝিয়ে দিল মিশমিকে। এদিকে রিশান আর নীলাশার চোখের ইশারাটাও মিশমির চোখের অগোচরে হলো। নীলাশা এবার দুঃখ আয়ত্ত করার চেষ্টায় বলল,

“ তোরা খালি-খালি আমার সাথে এমন করিস কেন? তোদের সাথে ঘুরতে চাই দেখেই তো ড্যাডের সাথে এতো ঝগড়া করে আসলাম। মিশমি, তুই পারতিস বন্ধুদের জন্য আন্টির সাথে এমন ঝগড়া করতে? অথচ আমি করলাম আর তোরা দাম-ই দিচ্ছিস না। ইট রিয়েলি হার্টস মি! এর থেকে কালকে ছুরিটা চালিয়ে দিলেই ভালো হতো! ”

কথাটা শেষ করে অনেক কষ্টে হাসি আটকে রাখল নীলাশার। নীলাশার অভিনয় দেখে বাকি তিনজন গড়াগড়ি খেলেও মিশমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েই থাকল যা! অতঃপর তাকে নরম কণ্ঠে বলতে শোনা গেল,

“ সুইসাইড একটা করার জিনিস হইলো? আমি যাব। আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তোদের এতো নাটক করা লাগবে না। শুধু আমার ছবি যাতে ভুল করেও নেটে না ছাড়া হয় সেইটা একটু দেখিস। আম্মু জানলে আমার কলিজা এমনিই ভুনা-ভুনা হয়ে যাবে রে দোস্ত। ”

মিশমি নিজের ভীতি প্রকাশ করতে না করতেই সানামের উপস্থিতি ঘটল। অত্যন্ত উত্তেজিত মেয়েটা এসে বোঝার চেষ্টা চালালো বাকি বন্ধুদের হাসি-ঠাট্টার কারণ। বলা বাহুল্য, সানাম এখন তারকারাজিতে একজন তারকা হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে বন্ধুদলের সাথে। অপরদিকে সানামের উপস্থিতি ঘটতেই বন্ধুদের মাঝে প্রস্তুতি নেওয়ার হুলুস্থুল বেজে গেল। তারা কীসের প্রস্তুতি নিতে এতো তরান্বিত তা বুঝতে পারল না সানাম। তবে আন্দাজটা ঠিকই করে নিয়েছে সে। আজ তার জন্মদিন। সকালেই একসাথে দেখা করার কথা ছিল তাদের। কিন্তু পিহু তাকে এই-সেই বুঝিয়ে রেখে এসে একটু তো সন্দেহটা বাড়িয়েই দিয়েছিল বলা চলে! তবে যাইহোক, সানামের আন্দাজশক্তি যে এতটাও দূর্বল না তা প্রমাণ করে দিতেই হাজির করা হলো একটি কাপকেক। এই কেকের সাথে যখন নিশান তার লাইটার জ্বালিয়ে সানামকে তা নিভিয়ে দেওয়ার আদেশ করল, তখনই যেন মেজাজ চোটে গেল পিহুর৷ বাঘিনীর মতো গর্জন তুলে বলল,

“ বলি লাইটার জ্বালানির কী দরকার ছিল? একটা সিগারেট-ই মোমবাতি হিসেবে খাঁড়া করায় দিতি। ”

নিশান সরল মনে হেসে উত্তর দিয়েছিল বেশ,

“ মনে ছিল না রে বোইন। না-হলে কি মোমবাতি আনতাম না? ”

পিহু ক্ষেপে গেল। সেই বহুদিন আগের সানাম ও সাইফের বিতণ্ডার পরমুহূর্তের ঘটনা…। তখন সানামের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল না নীলাশার। তবুও বেশ কয়েকদিন হাতে রেখে সানামকে চমকে দেওয়ার মতো নিখুঁত পরিকল্পনা এঁটেছিল তিন বান্ধবী। কিন্তু তা বাস্তবায়নে খরচা হবে বহুত! এই একটা ‘কিন্তু’তেই আঁটকে গিয়েছিল নিশান ও রিশান। পরিকল্পনা খুবই আবেগপ্রবণ। তবে তা বাস্তবায়ন কোনোমতেই সম্ভব না৷ তাই তারা দুই ভাই অনাগ্রহ প্রকাশ করল ঠিকি। কিন্তু তা ধরে রাখতে পারল না পিহুর দেখানো সেই ছবিটা দেখে, যা দেখে সাইফরাও চুপ হতে বাধ্য হয়েছিল সেদিন। সানামের জন্মদিন আসছে মনে হতেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কর্মঠ হয়ে উঠেছিল বন্ধুদল। অতঃপর আজ সকাল সকালই দারুণ একটা খরচা করে সানামকে চমকে দিতে সক্ষম হলো তারা। নামমাত্র কেকটা কাটার পর, বন্ধুদের কেনা উপহারটি যখন সানামের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হলো তখন সানাম থম মেরে দাঁড়িয়েই থাকল যা! উপহার দেখে সানামের চক্ষুছানাবড়া! বন্ধুদের দ্বারা যে এমন কিছু আয়োজন করা বা উপহার দেওয়া কল্পনীয় তা ভাবতেও অদ্ভুত লাগছে সানামের কাছে। তার বুকে চাপা দুর্দমনীয়, প্রণয়ী অনুভূতিটা উন্মুক্ত হলো ছলছলে চোখের মাধ্যমে। সে বন্ধুদের প্রত্যেকের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখছে যেন, উপহারটা পাওয়ার পর নিজের অবস্থা এমন হিমের মতো হবে তা বন্ধুরা আগের থেকেই জানত। সানামের হাত কাঁপতে থাকে, পা কাঁপতে থাকে… উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে পুরো সানামটাই। অতঃপর সেই সানামকে কম্পিত ধ্বনিতেই বলতে শোনা যায়,

“ এইটা কী করে ফেলে দিছোস তোরা! ”

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

তারকারাজি- (১৯)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী

সেই কল্পনাতীত উপহারটার দিকে বিভোর নয়নে চেয়ে থাকা চঞ্চল রমণী পারে না নিজের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণে আনতে। হ্যাঁ, এটা ঠিক উপহারের ক্যামেরাটা তার পূর্বের ক্যামেরার চেয়ে দামে খুব কম হবে। ওতে নিজে যতটা না টাকা বিনিয়োগ করেছিল, তার থেকেও বেশি টাকা বিনিয়োগ করেছিল তার বিদেশে অবস্থানরত চাচাতো ভাই রাহাত। সানামের এই একমাত্র ত্রিশোর্ধ্ব ভাই বিনাকারণে তাকে খুব ভালোবাসে। বিদেশ থেকে টুকিটাকি জিনিস পাঠানো, প্রয়োজনীয় টাকা প্রদান আর নিজ দায়িত্বে দিনে একবার হলেও বোনের খোঁজ-খবর নিতে ভুলে না রাহাত। অথচ তার-ই বাবা-মা সানামকে বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারে না। সে যাইহোক, কোনো এক নিগূঢ় কারণেই নতুন ক্যামেরা কেনার জন্য রাহাতের থেকে টাকা চাইতে পারেনি সানাম। বর্তমানে উপহারের ক্যামেরাটা পর্যবেক্ষণ করেই সে অনুমান করতে পারছে এর পিছনের খরচটা। ব্যাপারটা বুঝে উঠতে না উঠতেই নীলাশাকে বলতে শোনা গেল,

“ তোর পছন্দ হয়েছে সানাম? এইটা তোর ক্যামেরার তুলনায় কিছুই না বাট তোর হাত খালি দেখতেও ভালো লাগে না। এর জন্যই এটা কিনলাম সবাই মিলে। ”

এখানে বলে রাখা ভালো যে, ইয়াসিন চৌধুরীর গত রাতে দেওয়া টাকাগুলো এই ক্যামেরার পিছনেই খরচা করেছে নীলাশা। দলীয়ভাবে যে কুড়ি হাজার টাকা হয়েছিল তাতে কি আর মেয়েটির অন্তরে প্রশান্তি আনার মতো ক্যামেরা ক্রয় করা যায়? সবাইকে না জানিয়ে নীলাশা কাজটা করে ফেললেও ইতোমধ্যেই তা জানা-জানি হয়ে গিয়েছে। তবে তা অত্যন্ত নিভৃতেই রাখা হয়েছে যাতে সানাম না জানতে পারে বিষয়টা। এদিকে নীলাশা সানামকে প্রশ্ন করার সাথে সাথেই নিশানকে বলতে শোনা গেল,

“ বোইন দেখ, তোর এই একটা ক্যামেরা কিনে দেওয়ার জন্যে আমি আমার বাইকে তেল ভরাই নাই। তাছাড়াও আমার আর রিশানের আরেকটা বাইক কেনার জন্য জমানো টাকার অর্ধেক লুটে নিছে তোর এই ক্যামেরা। বোইন আমার, তোরে অনুরোধ করি! তুই মইরা যাইস তাও ক্যামেরার গায়ে ফুলের টোকা লাগাইস না। নিজেদের বাইকে তেল না ভরায়ে, তোরে এই যন্ত্র-টন্ত্র কিনে দিছি দেখে আমার অন্তরডা ছ্যাত করে উঠতাছে। ”

বাকিরা হেসে উঠলেও সানামের খেয়াল নেই বন্ধুর কথাতে। সে ক্যামেরাটা ব্যাগ থেকে বের করে উল্টেপাল্টে দেখতেই ব্যস্ত ঠিক যেমন কোনো বই কেনার আগে তা দৃঢ়ভাবে দেখে নিতে হয়। মূল পটভূমিতে এখন নীলাশাদের বন্ধুদলে তুমুল হাসাহাসি চলছে। নিশান একটার পর একটা কথা বলে যাচ্ছে আর তা শুনে পিহুর প্রায় লুটোপুটি খাওয়ার মতো অবস্থা! তবে এবার ঘটনা ঘটল বিপরীত কিছু। পিহুকে ছাপিয়ে নীলাশা এইবার এমন করেই হাসল যে, হাসির বশে নীলাশাকে দু-এক কদম পিছিয়ে গিয়ে নিজের টাল সামলাতে হলো। ফলস্বরূপ নিজের স্টেলেটো জুতোর অসহনীয় আঘাত সহ্য করতে হলো তার পিছনের কোনো এক আগন্তুককে। আগন্তুকের পায়ে হাত দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠাতে বন্ধুমহলের হাসাহাসি থামলেও সানাম যেন ইচ্ছে করেই হাসিতে ফেটে পড়ছে এখন। কারণ সেই আগন্তুক আর কেউ না বরং সাইফ আর সাইফের সাথে আছে তাদের গোটা বন্ধুদল। সাইফের অবস্থা নাজেহাল! এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে নীলাশার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিল। তার কীভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত বা কী বলে সবটা সামলে নেওয়া উচিত তা ভাবতে ভাবতেই পার হয়ে যাচ্ছে মুহূর্তক্ষণ। বিষয়টি নিয়ে তাদের ছয় জনের মধ্যে থেকে সর্বপ্রথম রিশানের-ই রূঢ় কণ্ঠ শোনা গেল,

“ হায় হায় রে! ভাইয়ের পা বোধহয় ছিদ্র করে ফেলে দিছোস তুই, নীলু। তোর এগুলা চার ইঞ্চি, পাঁচ ইঞ্চি না পড়লে চলে না? দিলি তো অকাম করে? ”

নীলাশা বোকার মতো রিশানের দিকে তাকিয়েই সাইফের দিকে তাকাল। তখনই চোখ পড়ল সাইফের পাশে থাকা দিবাস্বপ্নের সেই পুরুষ, আরাভের দিকে। তার গভীর দুটো চোখ যেন নীলাশার চোখেই গেঁথে যেতে চাইছে। খুব তৃষ্ণা পেল নীলাশার। গলা শুকিয়ে এলো মুহূর্তেই। সেই গভীর চোখ দুটো যেন প্রণয়িনীকে শুষে নিলো গাঢ় প্রণয়নের সায়রে। তবে এই মৌনতা টিকলো না বেশিক্ষণ। ভাবলেশহীন তনয়কে বলতে শোনা গেল,

“ ঘটনা কী রে সাইফ? তুইও খালি মাইয়া মাইনষের উপ্রে পড়িস আর মাইয়া মাইনষেও তোর উপ্রেই পড়ে? সেইদিন সানাম আর আজকে সানামের বান্ধবী নী… ”

আর বলতে পারল না তনয়। সাইফের রক্তচক্ষু দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসা ছাড়া কোনো নিরাপত্তাও খুঁজে পেল না সে। হাসির রোল পড়ল। খুব কৌশলে আরাভ তার অনুভূতি ঢেকে ফেললেও নীলাশা অস্থির নয়নে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। সে পারে না আরাভের সেই চাহনীকে ভুলতে। এমন সময় সানামের রূঢ় কণ্ঠ এলো কানে,

“ ঘটনা কী তনয় ভাই? সেইদিন আমার সাথে কিলিক লাগালেন আর আজকে নীলের সাথে কিলিক লাগাতে চাইছেন যে? ভার্সিটির কিলিকবাজ হিসেবে নিজের নাম লিখাতে চাইছেন না-কি? দাঁড়ান, ক্যামেরাটা চার্জ দিয়ে সবার আগে আপনার ছবিই তুলব আমি। তারপর আমাদের ভার্সিটির পেজে সুন্দর করে আপলোড করে দিব ‘কিলিকবাজ তনয়’ ক্যাপশনে। তখন আর জনে-জনে কিলিক লাগিয়ে প্রমাণ করতে হবে না যে, আপনি পাক্কা কিলিকবাজ! আইডিয়াটা ভালো না, তনয় ভাই? ”

কথা সমাপ্ত করেই সানাম মেকি হাসি দিয়ে ক্যামেরার ব্যাগটা গোছগাছ করতে ব্যস্ত হলো। এদিকে আরাভ সানামের সাথে সহমত পোষণ করে বলল,

“ তনয়ের প্রাপ্য সম্মান! ”

হাসল সকলেই। অতঃপর মুখোমুখি বসে বৈঠক শুরু করল তারা। আরাভের থেকে ব্যাপারটা জেনে অনেক হ্যাঁ-না করার পর রাজি হয়েছে সকলে। আরাভ তার বন্ধু সাহেলকে দিয়েই বাসের শেষাংশ নিজেদের দখলে রাখার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। যাত্রা, নির্ধারিত হোটেল ও হোটেলের ঘর সংক্রান্ত বিভিন্ন কিছু নিয়ে একটি সিদ্ধান্তের জন্যই তাদের একত্রিত হওয়া। বিষয়টা আর কেউ না-হলেও নিশানকে জানানো হয়েছিল যে, তারা যেন এই সময় এখানেই থাকে। কিন্তু এখানেও কারো পালিয়ে বেড়ানোর ঝোঁক রয়ে গেল ভীষণ। আজকাল আরাভের সামনে থাকতে নীলাশা যে বেশ অপ্রস্তুতবোধ করছে তা ধীরে-ধীরে সবাই-ই বুঝে গিয়েছে এখন। এই নিয়েও আকারে-ইঙ্গিতে কম কথা হয়নি বৈঠকে। তবে আরাভ-নীলাশার এই ‘হয়েও হচ্ছে না’ বিষয়টি ছাপিয়ে গেছে সায়ান-মিশমির বিষয়টি। নিজেদের বন্ধুদের কাছে গতকাল-ই উন্মুক্ত হয়ে গেছে সায়ানের প্রেমানুভূতি। অত্যন্ত নিভৃতে এই নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল যে, আগেই মিশমিকে নিজের অনুভূতি সম্পর্কে জানিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না সায়ানের। বন্ধুদের মতে মিশমি সুন্দরী। সায়ানের অনুভূতি কি শুধুই প্রণয়পূর্ণ, সুন্দরী মিশমির প্রতি আকর্ষণ না-কি বিশুদ্ধ ভালোবাসা তা সায়ানের সময় নিয়ে বোঝা উচিত। মিশমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না! পূর্ণমনস্ক আরাভ ও বুদ্ধিমান সাহেলের কথামতোই বন্ধুদের মাঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, যতদিন না সায়ান নিজের অনুভূতি সম্পর্কে পরিপূর্ণভাবে বিজ্ঞত্ব লাভ করবে, ততোদিন ব্যাপারটা গোপন রাখা সহ এই নিয়ে কথা-ও বলবে না তারা। কিন্তু বন্ধুদের মাঝে এমন পরিপক্ব নিয়ম আবার বহাল থাকে না-কি? সেই তো শিহাব আর তনয় মিলে এখনো খুঁচিয়ে যাচ্ছে সায়ানকে। কথায় কথায় নানান ইঙ্গিতে সায়ানের সাথে মশকরা করে গেলেও ব্যাপারটা অপর বন্ধুমহলের মস্তিষ্কে খেলল না। আলাপ-আলোচনায় সময় অতিক্রম করার মধ্যিখানে যখন কেউ এসে আরাভদের উদ্দেশ্যে সালাম দিল তখন মিশমির বক্ষে প্রচণ্ড কম্পনের আবির্ভাব হলো। এই কণ্ঠ যে মিশমির সুপরিচিত তা আর নতুন করে বোঝানোর কিছু নেই। পিহু মৃদু নিঃস্বনে কলি গেয়ে উঠল,

‘ তুনে মারি এন্ট্রিয়া রে/
দিল মে বাজি ঘান্টিয়া… ’

অসমাপ্ত কলিতেই পিহুর উরুতে চিমটি কাটল মিশমি। সে পইপই করে নিষেধ করেছে যে, তার আর তিহামের কথা যেন তাদের ছয় জনের মাঝেই থাকে। কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা আর মানে কে? এর-ই মাঝে এক কাণ্ড ঘটে গেল। আরাভদের সাথে কথা শেষ করে তিহাম নিজের প্রিয়তমার উদ্দেশ্যে মসৃণ কণ্ঠে ডাকল,

“ মিশমি, একটু শুনে যাও তো। ”

এই কথা শুনে মিশমি যেন হাঁসফাঁস করতে লাগল। ভীষণ লজ্জায় একদম কুঁকড়ে গেল সে। বড় ভাইদের সামনে আলাদা করে কেউ ডাকে না-কি? মিশমি পারে না চোখ তুলে তাকাতে। মাথা ঝাঁকিয়ে মতামত জানায় যে, সে আলাদাভাবে শুনবে না তার কথা। অতঃপর সেই মিশমির কুঁকড়ে যাওয়া দেখে তিহাম হেসে বলল,

“ আসবা না? আমি কিন্তু এখনি রওনা দিচ্ছি মামার বাসায় যাওয়ার জন্য। ”

মিশমি চকিতেই চোখ তুলে তাকায়, “ এখনি? ”

তিহাম আবারও ইশারায় ডাকতেই রিশান ধমকে উঠে,

“ আরে, গিয়ে শুনে আয় না ভাই কী বলে! প্রেম করার আগে মনে থাকে না আর এহন নতুন বউয়ের মতো লজ্জায় মরে যাচ্ছিস একেবারে, হাহ্! ”

মিশমি চোখ গরম করে তাকাতেই তারা হেসে উঠল সবাই। হাসল না শুধু অপর বন্ধুদল। কেউ যেন সায়ানের বুকে তীর বিঁধিয়ে দিল খুব করে। সে যেন জগৎময় অন্ধকার দেখতে লাগল তার সামনে। মিশমি মাথা নিচু করেই উঠে গিয়ে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়াল তাদের থেকে। সায়ান দেখতে পায় সেই দুজনকে। তিহাম কথা বলছে আর মিশমি শুনছে। মাঝে মিশমিকে দেখা গেল বিড়বিড়িয়ে কী যেন বলে তিহামের গায়ে ফুঁ দিতে। বোধহয় সূরা পড়ল কোনো! অতঃপর তিহাম আলতো হাতেই মিশমির হাতটা ধরতেই আরও বেশি কুঁকড়ে যেতে দেখা গেল মিশমিকে। খুব কৌশলেই নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে দাঁড়ায় মিশমি আর এইসব দেখে সায়ানের নিভৃত কেঁপে-কেঁপে শুধু একটাই কথা বলে উঠল,

“ পথের ঠিকানাটাই কি ভুল? ”

উত্তরটা যেন নিখোঁজ! সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়েই সে লক্ষ্য করল যে, তার বন্ধুরা একবার তাকে তো একবার মিশমিদের দেখছে। একটা রাত কাটতেই যে এমন ধোঁকার সম্মুখীন হতে হবে তা মনেহয় সায়ান কল্পনাও করেনি। বিব্রতবোধ করতে করতেই শিহাব নিশানদের প্রশ্ন করল যে, মিশমি ও তিহামের সম্পর্ক কতদিনের। নিশানরা উক্ত সময় জানালো। সেই সাথে রিশানকে দাঁত কেলিয়ে বলতে শোনা গেল,

“ ভাবা যায় এইটা আমাদের মিশমি? এই মেয়েরে কোনো ছেলে নাম জিজ্ঞাসা করলেও টেনশনে জ্বর তুলে ফেলে। আর সে কি-না… পুরাই অসাধ্য সাধন মার্কা কাম করে ফেলছে ও! অবশ্য ওই যে পরিমাণ হাবলি! ওরে পটায় নেওয়া তিহাম ভাইয়ের কাছে কিছুই না। ”

সায়ান হাসল না একটুও। তবে বাকি বন্ধুদের মিথ্যে হাসিটা ফ্যাকাসে হলেও লুটিয়ে পড়ল ঠোঁটের ফাঁকে। সায়ান কড়া চোখে তিহাম-মিশমির দিকে তাকায়। গলায় দলা পাকায় অহেতুক সব যন্ত্রণা। অতঃপর এই তাম্রপুরুষটিকে অত্যন্ত কঠিন ও সতর্কতার সাথে বলতে শোনা যায়,

“ ওকে সামলে থাকতে বলিস। তিহাম কিন্তু ভার্সিটিতে পা রেখেই বাজিমাত করে দেখাইছে। আ… আমার একটু বাইরে যাওয়া লাগবে। তোরা কথাবার্তা বল তাহলে। ”

বলেই সায়ান উঠে দাঁড়াল। হন্তদন্ত হয়ে পালানোর চেষ্টা করতেই পিছু ডাক এলো আরাভের,

“ তুই ট্রিপে যাওয়াটা বাতিল করতেছিস না তো? এই ট্রিপ নিয়ে কিন্তু আমাদের অনেক প্ল্যান ছিল, সায়ান! ”

সায়ান জানে আরাভের এই প্রশ্ন করার কারণ। মন সায় দেয় না একটুও। মিশমির মুখ না-দেখাটাই উত্তম বলে মনে হয় নিজের কাছে। কিন্তু মস্তিষ্ক যে হার মানে না! সে বলে, একটা মেয়েকে চব্বিশ ঘণ্টায় এমন কী ভালোবেসে ফেলল যে, নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছা এক করে ফেলতে চাইছে সে? সায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরাভের চোখে চোখ রাখে। দৃঢ় গলায় উত্তর দেয়,

“ যাব। আমার ট্রিপে না যাওয়ার কোনো কারণই থাকতে পারে না। ”

সে চলে গেল। রেখে গেল এক দল বন্ধুদের মাঝে দীর্ঘশ্বাস ও অন্য দল বন্ধুদের মাঝে হৈচৈ। সায়ানকে ছাড়াই খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো সবার মাঝে। নিশান জানায় তারা বাসট্যান্ডে মিশমিকে নিয়ে পৌঁছে যাবে। নীলাশাকে যে ইয়াসিন চৌধুরী ছাড়তে যাবেন তা সকলের জানা। সেই সাথে যেহেতু ভার্সিটি থেকে পিহু আর সানাম যাচ্ছে তাই তারা সেদিন বিকেলেই নীলাশাদের বাসায় চলে যাবে। রাত নয়টায় ভার্সিটির বাহিরে বের হওয়া তাদের জন্য সম্ভব হবে না। অনুরূপভাবে সায়ান, সাইফ ও শিহাবকেও আশ্রয় নিতে হবে সাইফের বাসায়। এখানে বলা বাহুল্য, সানামের ভ্রমণে যাওয়া নিয়ে ছিল ভীষণ জটিলতা। বিদেশ থেকে রাহাত তার প্রয়োজনীয় খরচা পাঠাতে পারবে কি-না, চাচা-চাচিকে মানিয়ে নিতে পারবে কি-না… ইত্যাদি সংশয়ের শেষে আজ সকালেই সে জানায় যে, সে যেতে পারবে ভ্রমণে। অবশ্য এর দ্বিতীয় পন্থাও ভেবে রেখেছিল নীলাশারা। যদি সানাম উক্ত টাকা দিতে না পারে তো নীলাশা তা বহন করবে। তারপর না-হয় সানাম তা শোধ করে দিবে তবে সানামকে যেতেই হবে। ছয়জনের এই ভ্রমণ আবার কবে আসবে তা বলা যায় না! তাই সানামও হাজার দ্বিরুক্তি করার পর এতে রাজি হয়েছিল এবং অপরদিক থেকে নিজেও চেষ্টা করেছিল যাতে টাকাটা সে নিজের ভাই রাহাতের থেকেই নিতে পারে। যাইহোক, নানান আলাপ-আলোচনা শেষে, সারাটাদিন বাহিরে কাটিয়ে নিশানরা যখন নিজেদের বাসায় পৌঁছাল, তখনই তাদের একমাত্র বোন ঈশাকে দেখা গেল মুখ গোমড়া করে বসে থাকতে। ঈশাকে জিজ্ঞাসা করা হলে সে উত্তর দেয়,

“ ভাইয়া, সামনে কিন্তু আমাদের স্কুল থেকে পিকনিকে সোনারগাঁওয়ে নিয়ে যাবে। তোমরা তোমাদের বন্ধুদের সাথে যেমন যাচ্ছ, আমিও কিন্তু আমার বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাব। ”

নিশান তাচ্ছিল্য করে উত্তর দিল,

“ অ্যাঁহ্, শখ কত! হা করে আব্বা বল দেখি? পড়িস ক্লাস নাইনে আর ভাব দেখে মনেহয় ভার্সিটিতে পড়িস। শোন, ছোট বাচ্চাদের বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়া লাগে না। ”

“ কেন? এটা কি সংবিধানে লেখা আছে? ”

রিশান হাসে। বোনের মাথায় আদুরে হাত রেখে বলে,

“ আরে পাগলি, এখন গেলে মজা পাবি না। ভার্সিটিতে উঠে যত ইচ্ছা বন্ধুদের সাথে ঘুরিস। তখন তোরে কেউ আটকাবে না-কি? ”

ঈশা মানে না। মুখ ভার করে দেখতে লাগে দুই ভাইয়ের ভ্রমণে যাবার প্রস্তুতি। ভ্রমণের জন্য নির্ধারিত দুটো ব্যাগও কিনে এনেছে দুজন। সেই কি হৈচৈ করে তা গোছানোর ঝোঁক তাদের! যেন আজ-ই তাদের গন্তব্যে যাওয়ার দিন। এরই মাঝে কলিংবেল পড়ল। নিশান গিয়ে দরজা খুলতেই দেখা মিলল প্রৌঢ়বয়সী সুঠাম দেহী এক পুরুষ, রুবেল আহমেদ। নিশান সৌজন্যতার হাসি দিয়ে স্বাগত জানালো ওনাকে। প্রশ্ন করল,

“ আঙ্কেল, আপনি এখানে? আপনার না এখন রাজশাহীতে থাকার কথা? ”

রুবেল আহমেদ হাসেন। নিশানের পিঠে চাপড় মেরে বলেন,

“ আজকেই ব্যাক করেছি। আবার রাতের ট্রেনেই দিনাজপুর যেতে হবে অফিসের কাজে। ব্যবসায়ী মানুষদের অনেক ঝামেলা, বুঝেছ? শুনলাম তোমরা না-কি ঘুরতে যাচ্ছ? তাই দেখা করতে চলে আসলাম। ”

নিশান কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই রান্নাঘর থেকে মিলা রহমান ছুটে আসেন। আজ অফিস থেকে তাড়াতাড়িই ফিরেছেন বিধায় এই গোধূলি লগ্নে বাসায় তার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রুবেল আহমেদকে দেখেই মিলা রহমান গাল ভরে হাসেন। ওনারা দুজন যেমন দূরসম্পর্কের মামাতো-ফুপাতো ভাই-বোন তেমনই রুবেল আহমেদের কোম্পানিরই একজন উঁচু পদের কর্মী হলেন মিলা রহমান। দুজনের জন্মসাল এক হওয়ায় নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, তাদের সম্পর্কও খুব ভালো। সেই ক্ষেত্রে রুবেল আহমেদের এই বাসায় আসা-যাওয়াটা লেগেই থাকে। উনি রুবেল আহমেদের সাথে কথা বলার মধ্যিখানেই ঈশা ও রিশান এসে দেখা করে যায় ভদ্রলোকটির সাথে। রুবেল আহমেদকে বলতে শোনা গেল,

“ ঈশাকেও নিয়ে যেতে পারতে তোমরা। মেয়েটা একা বাসায় থেকে কী করবে? ও তো ওর দুই ভাই বলতে অজ্ঞান। ”

রিশান মুচকি হাসলেও নিশানকে হাসতে দেখা যায় না। সে কারো প্রতি নিজের ভালোবাসা সহজেই প্রকাশ করতে পারে না। বিধায় নিজের বোনের প্রতি অসীম ভালোবাসা থাকলেও তা অন্তরে চেপে রাখে নিশান। বোনটা মাকে যতটা না ভালোবাসে, তার থেকেও বেশি ভালোবাসে তাদের। বাসায় থাকলে দুই ভাইয়ের ঘর থেকে নড়াচড়া করার নামও নেয় না মেয়েটি। এই বোনটা নিশান ও রিশানের খুব প্রিয় একজন। রিশান রুবেল আহমেদের কথার উত্তর দেওয়ার আগেই নিশান তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

“ না, না আঙ্কেল এইসব ঝামেলা নিয়ে আরামসে ঘোরা যায় না। ”

ঈশা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। ছোট ভাই খুব আদর করলেও বড় ভাইকে নাক সিঁটকাতেই বেশি দেখে সে। কেন, নিশান কি একটু ভালোবাসতে পারে না? তখন শোনা যায় মিলা রহমানের কণ্ঠ,

“ ওইরকম করে বলিস কেন? নিয়ে যা না ওকে?নীলাশাদের সাথেই তো থাকতে পারবে ও। ও কি ছোট বাচ্চা যে, কোলে নিয়ে ঘুরতে হবে? বাসায় থাকলে তো ‘ভাইয়ারা কবে আসবে’ করে-করেই আমাকে পাগল বানিয়ে ফেলবে। ”

ঈশার স্পষ্ট উত্তর, “ না, মা। ওরা সমুদ্রে গিয়ে ডুবে মরলেই আমার শান্তি হবে একটু। কেন আসছে ওরা এই পৃথিবীতে বলো তো? আমার এমন মানুষ দেখলেই অসহ্য লাগে। ”

“ অসহ্যই যখন লাগে তখন দেখিস ক্যান? আয় তোর চোখ কানা করে দেই। তাহলে আর দেখা লাগবে না। ”

বলেই সে ছুরি হাতে নিয়ে ঈশার দিকে যেতে লাগল। এই ছুরিতে ঈশা যে খুব ভয় পায় তা নিশানের জানা। ঈশা উঠে দৌড়ে চলে যেতেই বাকিরা হেসে উঠল। কিন্তু নিশান ক্ষান্ত হলো না! সে বোনকে ভয় দেখাতেই ব্যস্ত রইল। এদের এরূপ কাণ্ডকারখানা রিশানকে একটা কথা বরাবরই খুব ভাবায় যে, ঈশাকে যখন তাদের থেকে দূরে থাকতে হবে তখন কার বেশি কষ্ট হবে? তার নিজের? নিশানের? না-কি ভাইপাগল এই আদুরে ঈশার?

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here