তারকারাজি- (২৩ প্রথমাংশ)

0
383

তারকারাজি- (২৩ প্রথমাংশ)
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী

শেষ রাতে আরো একটি কাণ্ড ঘটে গেল চলন্ত বাসে। শোঁ শোঁ করে হাওয়া এসে ব্যাপক হিমশীতল করে তুলেছে বাসের হালচাল। সাইফ কেঁপে ওঠে হাওয়ার শীতলতায়। তখন জাগ্রত সানাম খুবই তিক্ত কণ্ঠে সাইফকে ডাকল,

“ সাইফ ভাই? ও সাইফ ভাই? আরে শুনেন না? ”

সাইফ ঘুমুঘুমু চোখেই তাকাল সানামের দিকে। সানাম বলল,

“ তাত্তারি সরেন। আমার বমি আসছে। এক্ষুনি জানালা দিয়ে বমি করা লাগবে। ”

সুষুপ্ত সাইফ ধরতে পারেনি সানামের ছলাকলা। সে উঠে যেতেই সানাম বহু কাঙ্ক্ষিত জানালার ধারের সীটটায় বসে সাইফকে তার পাশে বসতে বলল। বেচারা নিদ্রামগ্ন সাইফ তখন সানামের সীটটায় বসে পড়েছিল ঠিকি। তবে ভোরে কক্সবাজার পৌঁছে যখন বন্ধুদের ডাকে ঘুম ভাঙলো তার, তখন সে দেখতে পেল সাড়ে সর্বনাশী কাণ্ডটি। সানাম জানালার ধারের সীটে বসে তার দিকে তাকিয়েই ঠোঁট চেপে হাসছে। সাইফ গলা উঁচিয়ে নির্বোধের মতো প্রশ্ন করল,

“ তুমি আমার সীটে কী করো? আমাকে এই সীটে দিছো কেন তুমি? ”

আচম্বিতে উঠে দাঁড়াল সাইফ। আখম্বা পুরুষটির চোখে চোখ রাখতেও সানামকে মাথা উঁচিয়ে তাকাতে হলো। অতঃপর সে নির্ভীকভাবে বলল,

“ আজব! এখন নিশ্চয় বলবেন না আমি আপনাকে কোলে করে এই সীটে সরাইছি? আপনি তো নিজেই এই সীটে বসছেন। আপনি এতো সুইট কেন সাইফ ভাই? কী সুন্দর আমাকে মান্য করেন আপনি। ”

সাইফের এখনো মনে পড়ছে না শেষ রাতের কথা। শুধু এইটুকু ভালোই বুঝতে পেরেছে যে, সে না চাইলে সানাম তাকে জোর করে এই সীটে বসাতে পারতো না। কিন্তু কী এমন হয়েছিল যে, সে এই সীটে বসল? না, মাথায় ধরছে না তার। সীট বিষয়ক এই হাঙ্গামাটা স্থায়ী হলো তাদের বাসস্ট্যান্ডে নেমে দাঁড়ানো অবধি। তেরো জনের জন্য ঠিক করা হলো দুটো অটো। নিশান প্রস্তাব দিল,

“ ভাই, তোমরা তোমাদের ব্যাগগুলা দিয়ে দাও। আমি আর রিশান এক অটো দিয়ে সব মালপত্র নিয়ে যাই। আর তোমরা সাতজন এক অটো নিয়ে যাও। ”

পিহু বিস্ময়াবিষ্ট কণ্ঠে বলে উঠল,

“ মানে কী? আমরা ক্যামনে যাব? ”

নিশানের স্পষ্ট জবাব,

“ বললাম না মালপত্র সব আমরা নিয়ে যাব? তোরা মালপত্রের থেকে কম কী? সেই তো ঠেলা দিলেই চলিস খালি। ”

চার যুবতী কটমট করে নিশানের দিকে তাকাতেই বাকি সদস্যদের হাসির আওয়াজ শোনা গেল। নিশানের কথা মতো সব করা হলেও দেখা যাচ্ছে বসায় ভীষণ অসুবিধা হলো সবার। যে যার যার ব্যাগ হাতে রাখলেও বিপত্তি ঘটে গেল। জায়গা হচ্ছে না! রিশান ধমকে উঠে বলল,

“ তোদের চারটারে কুপায়ে মারতে ইচ্ছা করতাছে। একটা মাইনষের কয়টা করে ব্যাগ লাগে রে? আমরা একটা নিয়ে আসার পরেও ব্যাগে ঢের জায়গা আর তোরা চারটা ডাবল-ডাবল ব্যাগ নিয়ে আসছিস। ”

শেষমেশ দুটো অটোর সাথে একটা রিকশাও ডাকা হলো। কিন্তু কে যাবে রিকশায়? সানামকে বলতে শোনা গেল,

“ আচ্ছা, ওই একটা অটোতে সাতটা ছেলে ক্যামনে বসে? তনয় ভাই তো একলাই দুইজন। আর এখানেও দুনিয়ার ব্যাগ দিয়ে জায়গা হইতাছে না। তাহলে ওই অটো থেকে আরাভ ভাই আর এই অটো থেকে নীলবাতি রিকশায় চলে যাক। আর আমরা না-হয় আরামসে যাই? ”

সানামের প্রস্তাবনা শুনে আর কারোরই বুঝতে বাকি নেই যে, সানাম কী করতে চাইছে। নীলাশা থম মেরে সকলের সম্মতি লক্ষ্য করল এক মুহূর্তের জন্য। কিন্তু এটা অস্বীকার্য নয়, নীলাশা আরাভের সাথে যেতে চায় না। নিজেকে এবং নিজের বন্ধুদের এবার বেশ হ্যাংলা মনে হচ্ছে তার। সে নিষেধ করতেই যাবে তখন সাইফকে রূঢ় গলায় বলতে শোনা গেল,

“ সব কিছু তোমার কথায় হবে, তাই না? এত বেশি মাতব্বরি করো কেন তুমি? ”

বাসের সেই কাণ্ডটির জন্য সানামকে ক্রোধ দেখাতে গিয়ে, সাইফ যে এমন কথা বলে বসবে তা সানাম নিজেও ভাবেনি। সে মহা বিরক্তির সাথে উত্তর দিল,

“ কোন পাগল-ছাগলের পাল্লায় পড়ছিলাম! আবাল মার্কা কথা বলেন কেন আপনি? ”

“ ওই তোমার লজ্জা করে না তুমি আমার সাথে বেয়াদবি করো? তোমার মুখ দেখে সকালে উঠছিলাম না? পুরা দিনটাই মাটি হয়ে গেল আমার। ”

সানাম দাঁত কিড়মিড় করে উত্তর দিল,

“ তাহলে বোঝেন আপনার মুখ দেখে ঘুমানো আর ঘুম থেকে উঠে আমার কেমন কাদা-কাদা অবস্থা। এই সাইফ ভাই, আপনারে দেখলেই-না নিজেরে বদনা নসিব টাইপ লাগে। চোখের পিছে যান তো। ”

সানামের নাটকীয়তা দেখে হো হো করে হেসে উঠল সবাই। কিন্তু সাইফ নিজের খিটখিটে মুখভঙ্গিটা পরিবর্তন করতে পারল না কোনোভাবেই। সে নাক সিঁটকে তীব্র বিরক্তি প্রকাশ করতে নিতেই পিহুকে বলতে শোনা গেল,

“ কারো যাওয়া লাগবে না। সাইফ ভাই আর সানাম চলে যাক রিকশায়। কিছুক্ষণের জন্য হলেও তো আমার কানটা বেঁচে যাবে! ”

রিশান পিহুর মাথায় চাটি মেরে বলল,

“ সঙ্গে তুইও যা। আমাদের কানটাও বেঁচে যাবে। এতো কেউ কথা কয় ফোনে? ”

হাসল সবাই। পরিশেষে মিশমিই বলল,

“ আচ্ছা শোন, এই রোদের মধ্যে দাঁড়ায়ে থাকতে আর ভালো লাগতাছে না। আমি আর নীল না-হয় রিকশায় যাই। আর তোরা কে কীভাবে আসবি দেখ। ”

নীলাশাও সহমত পোষণ করল। কিন্তু রাজি হলো না নিশানরা। তাদের মতে তারকারাজির মহলে অত্যন্ত বলদ তারকা যদি কেউ থেকে থাকে তবে তা হলো মিশমি আর নীলাশা। দুই বলদকে একসাথে রিকশায় ছাড়া যাবে না। এই কথাকে কেন্দ্র করেই মিশমি আর নিশান রিকশায় যাবে বলে ঠিক হলো। নিশান একটি লাগেজ নিয়ে রিকশায় উঠে পড়েছে ঠিকি কিন্তু মিশমি উঠে দাঁড়ালেও বসতে পারল না। পিছন থেকে কোনো এক রিকশার মাধ্যমে তাদের রিকশায় ধাক্কা লাগতেই দাঁড়ানো মিশমির পড়ে যাওয়ার লক্ষ্যণ দেখা দিল। নিশান ধরেছিল মিশমিকে। কিন্তু তার হাত নিশানের হাত থেকে ছুটে কোনো এক দায়িত্বশীল পুরুষের কাঁধ ছুঁয়ে ফেলল নিমিষেই। সায়ান এবারও মিশমির হাত ধরতে পিছুপা হয়নি। তার কাঁধে ভর করেই লজ্জায় জবুথবু মিশমি যখন রিকশায় বসল তখন সায়ানের অলস প্রশ্ন শোনা গেল,

“ আর কত পড়বা মিশমি? ”

মিশমি লজ্জায় লাল হয়ে যায়। খুটখুট করে কামড়ে চলে নখের উদ্বৃত্ত অংশ। ভীষণ নরম স্বরে সকলকে অবাক করেই বলে ফেলে সে,

“ সেই তো সামলেই নেন আবার খোঁটাও দিচ্ছেন? রাত্রে কখন চলে গেছিলেন আপনি? সেই তো গেছেন, পাশে পিহুকে বসিয়ে দিয়ে ঘুমটাও হারাম করে দিয়ে গেছেন। ”

সায়ান বেশ অপ্রস্তুত হলো। মিশমি বোকা হলেও বাকিরা যে কিছু সন্দেহ করবে না তা একেবারেই নিশ্চিন্তে বলা যায় না। কিন্তু ‘পেট পঁচা পুঁটিমাছ ’ উপাধি প্রাপ্ত মিশমির পেটে কি কথা থাকে? সে রাগ দেখিয়ে বলে বসল,

“ কী হতো পিছে না গেলে? খুব বেশি কথা বলছিলাম না-কি? ভাইয়ারা কত সুন্দর আপনাকে বার্থডে সারপ্রাইজ দেওয়ার প্ল্যান করছিল আর আপনি এখানেও আমাকে অকর্মা বানিয়ে দিলেন সায়ান ভাইয়া। ”

সর্বনাশ! হাঁটে হাড়ি ভাঙার অপ্রস্তুত প্রহর যে এতো জলদি ঘনিয়ে আসবে তা কল্পনাতীত ছিল সকলের কাছে। সায়ানের মুখ চুপসে গেল। বন্ধুদের মনে ‘হায়-হায়’ স্তম্ভিত ধ্বনির কম্পন সৃষ্টি হলেও বাহ্যিক দৃষ্টিতে তারা ছিল স্বাভাবিক। সকলকে সামলে নেওয়া যাবে। কিন্তু সুপরিচিত ছোটভাই নিশান-রিশান তো জানে যে, চলন্ত মাসে সায়ানের জন্মদিন না। আর কথায় আছে না, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়? তা-ই অবশ্য ঘটে গেল চোখের পলকে। নিশান বলল,

“ কী কয়! সায়ান ভাইয়ের জন্মদিন না একুশে ফেব্রুয়ারির পড়ে-পড়েই? ”

প্রচণ্ড বিস্ময়ে গোলমেলে হয়ে গেল নিশান আর রিশানের মস্তিষ্ক। রিশান আরেকটু সময় নিয়ে ভাবার চেষ্টা করল। ঘুরেফিরে ফেব্রুয়ারী মাসটাই হানা দিল মাথায়। ঘটনা কী? আর কাউকে কিছু বলার বা ভাবার সুযোগ না দিয়ে নীলাশা গড়গড় করে বলে গেল,

“ আরেহ আর বলিস না কী হইছে! ভার্সিটির-ই কোন সায়ানের সাথে সায়ান ভাইয়ার বার্থডে গুলিয়ে ফেলছে তারা। ভাগ্যিস সব প্ল্যান-প্রোগ্রাম করার আগেই জানাজানি হয়েছিল যে, এইটা আমাদের সায়ান ভাইয়া না বরং অন্য সায়ান। ফেসবুক নোটিফিকেশন দেখে বন্ধুকে সারপ্রাইজ দিতে গেলে যা হয়। এই তনয় ভাইটা ভেজালের এক শ্যাষ! একটা কিছুও ঠিকঠাক হয় না ভাইয়ার। ”

তনয় ড্যাবড্যাব করে তাকাল নীলাশার দিকে। নীলাশার কথাটা যেন আরাভদের সবার কাছে বোমা বর্ষণের মতোই কিছু ছিল। তখন সায়ানদের ভীত দৃষ্টির কেন্দ্র হলো আরাভ ও তনয়। চোখের ইশারায় প্রশ্ন করা হলো তাদের যে, তারা কিছু বলেছে কি-না। উত্তরে আরাভ মাথা নাড়াল। না, সে কিছু বলেনি। আর তনয়? সেও ব্যাকুবের মতো তাকিয়ে থাকতে-থাকতেই নঞর্থক উত্তর দিল। তবে রহস্যটা কী? বন্ধুদের এই মুহূর্তে চুপ-ই থাকতে বলল আরাভ। নীলাশা যা বলেছে তাতে তো তাদের সুবিধাই হলো। নিশানদের দেখে মনে হচ্ছে না যে, তারা কথাটা বিশ্বাস করেনি। তখন স্বয়ং নিশানকেই বলতে শোনা গেল,

“ হ, সবাই তো তোর মতো বন্ধুর জন্মদিন, মৃত্যুদিন, মুসলমানির দিনসহ সবদিন-ই মনে রাখবে। ”

নীলাশা বিশ্রীভাবে মুখশ্রীতে বিরক্তি আনল,

“ ছিঃ! হুয়াই আর ইউ সো অকওয়ার্ড ব্রো? তোদের ফালতু বকবক আর সহ্য হচ্ছে না আমার। দয়া করে হোটেলে যাবি এইবার? ”

নীলাশার তাড়ায় কৃত্রিম তাড়া পড়ল আরো অনেকের। তবে সমাধান মিলল না এই রহস্যটির। নীলাশা কি সব বুঝে ফেলল? না-কি জেনে গিয়েছিল সায়ানের বন্ধুদের ছলচাতুরী? মুখে হাসি থাকলেও সায়ানদের অন্তরে প্রশান্তি মিলল না একটুকুও। হোটেলে পৌঁছে অত্যন্ত কৌশলে নীলাশাকে জিজ্ঞাসা করেছিল শিহাব যে, সে কী-করে জানল তারা দুই সায়ানকে গুলিয়ে ফেলছিল। উত্তরে নীলাশা খিলখিলিয়ে হেসে বলেছিল,

“ গুলিয়ে ফেলেন নাই বুঝি? তাহলে হয়তো আমার মনের ভুল। কী বুঝতে কী বুঝে গেছি! ”

নীলাশার ফিকে কথায় শিহাব সত্যিই আগাগোড়া গুলিয়ে ফেলেছিল তখন। মেয়েটা সত্যিই কিছু বুঝেছে না-কি বুঝেনি তা স্পষ্ট না হলেও সবটা স্বাভাবিক ভাবেই চলতে লাগল। দুপুরের অবিক্ষুদ্ধ রোদেই সমুদ্র সৈকতে পৌঁছে গেল সকলে। দুই দল বন্ধুদের নানান আয়োজন-বিয়োজনের সমুদ্রস্নানের নীরব দর্শক ছিল মিশমি। সে হাঁটুজল থেকেই উঠে এসেছে চকচকে বালির পাড়ে। এতগুলো পরিচিত যুবকের সামনে হৈ-হুল্লোড় করতে বেশ লজ্জা লাগছিল মিশমির। সে দূর থেকেই সকলকে দেখতে লাগল বেশ। এর মাঝে মেদবহুল তনয়কে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যেতে দেখে মিশমি যেন পিহুর মতো অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। তারপর এক ঝাঁক অতৃপ্তির বেহায়া হাওয়ায় মনটা মুচড়ে উঠল তার। খানিকক্ষণের জন্য মনে হলো যে, এই ভ্রমণে তিহামের সাথে সমুদ্র তীরে কাটানোর মতো কিছু মুহূর্ত যদি থাকত তবে মন্দ হতো না। মূল কথা, দীর্ঘসময় তিহামকে না-দেখে মনটা একদমই ভালো নেই মিশমির। তিহাম এখনো তার মামার বাসায় অবস্থানরত। সে ঢাকা ফিরলেও তো মিশমিরা ছয় দিনের আগে ঢাকায় ফেরার নাম নিবে না। প্রিয়তম মানুষটির খেয়ালে ভীষণ ব্যথায় কুঁকড়ে গেল মিশমির মন। সে ফোন হাতে নিয়ে তিহামকে বার্তা লিখল,

“ তোমাকে খুব মিস করছি। ”

বার্তা প্রেরণ করা হলো কিন্তু নেটওয়ার্কের বেহাল দশায় বার্তাটি কখন পৌঁছাবে তা জানা নেই মিশমির। সে ভাবল যে, সে কবে এতোটা দূর্বল হলো তিহামের প্রতি? কবে এতোটা ভালোবেসে ফেলল তাকে? উত্তর খুঁজে পায় না মিশমি। সম্পর্ক শুরুর দিন গোণা যায়। কিন্তু ভালোবেসে ফেলার দিন কি আদৌ গোণা যায়?

#চলবে ইন শা আল্লাহ!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here