বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ আটাশ(রহস্য উন্মোচন)

0
1651

বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ আটাশ(রহস্য উন্মোচন)
মম_সাহা

সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কেউ কোনো কিছু বুজছে না।আফসানা রহমান ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে অবশেষে বেশ তেঁতে বললেন
-‘অনেক হয়েছে হেয়ালি এবার নিরুপমা তুমি সব ক্লিয়ার ভাবে বলো।’

নিরুপমা বাবার দিকে তাকালো বাবা তাকে চোখ দিয়ে সম্মতি জানালেন।সবটা বলার অনুমতি পেয়ে নিরুপমাও বলা শুরু করলো
-‘নীড় আর বর্ণ ভাইয়া আমাদের বাসায় এসেছিলো প্রায় একবছর আগে মনে আছে মা?তখন থেকেই নীড়ের সাথে আমার পরিচয়। আর খুব ভালো পরিচয়। তখন নীলু শহরে ছিলো।

নীলু বেশি বেশি বাড়ি আসা শুরু করলো নীলুর হঠাৎ পরিবর্তন আমার চোখে আসা শুরু করলো।রাহাত ভাইয়ের নীলুর সাথে ভালো আচরণ আমার সন্দেহকে আরও তাজা করলো।তারপর যা সন্দেহ করেছি তা ঠিক বের হলো রাহাত আর নীলুর সম্পর্ক আছে।

আমি খুশিই হলাম।কারণ আমি জানতাম নীলু রাহাত ভাইকে পছন্দ করে।নীলুর এক ডায়েরিতে রাহাত ভাইয়ের সম্পর্কে লিখা ছিলো আর সেটা দেখার পর থেকেই বুজেছিলাম নীলুর মনের খবর।কিন্তু রাহাত ভাইয়ের নীলুর সাথে দূরদূর আচরণে আমারও মনঃক্ষুণ্ন হতো।

তো ভাবলাম নীলুকে জিজ্ঞেস করবো ওদের সম্পর্কের ব্যাপারে।তবে এই কথাটা আমি নীড়কেও বলেছিলাম।খুশি হয়েছিলাম বোন নিজের পছন্দের মানুষকে অবশেষে পেয়েছে ভেবে।

একদিন নীড় আমাকে কল করলো।সেদিনই রাহাত আর নীলু ঘুরতে গিয়েছিলো।নীড়ও সেদিন কোনো কাজে সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় রাহাত আর নীলুকে দেখেছিলো।রাহাতের আচারণ তার সন্দেহজনক লাগে।তাই আমায় কল দেয়।আমি তাকে নীলুর পিছে ঘুরে যেতে বলি।

তারপর ও গিয়ে দেখে রাহাত ভাইয়া নীলুর সাথে জোড়া জুড়ি করছে।তখন ও রাহাত ভাইয়ার হাত থেকে নীলুকে বাঁচায়।ওর হেলমেটের জন্য ওরে নীলা চিনতে পারে নি।

তারপর থেকেই নীলুকে ভেঙে যেতে দেখলাম।সে ঐ ঘটনাটা কাউকে বলে নি।আমি ভেবে ছিলাম নীলু বলবে কিন্তু নীলুর নিরবতায় আহত হলাম।ততদিনে নীলু শহরে চলে গেলো আমি নীড়কে বললাম ওর খেয়াল রাখতে।

দিন যায় মাস যায় নীলু কিছু বলে না।তারপর আমিই বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখি।তখন অবশ্য বাবাকে বলি নি সবটা।ভেবে ছিলাম নীলা সবটা শুনলে রাহাত ভাইয়ের অন্যায়ের কথা প্রকাশ করে ফেলবে।কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে নীলা চুপ করে রইল।

তারপর বুঝলাম নিশ্চয়ই নীলুর চুপ হওয়ার পিছে কোনো কারণ আছে।সবটা বাবাকে জানাতে হবে।তাই সব বাবাকে জানালাম।বাবাও নীলার ভিতর থেকে সবটা জানার জন্য সাঁই দিলো।কিন্তু আমরা ভাবতে পারি নি রাহাত ভাই এত বিশ্রী কাজ করেছে।’

নিরুপমার কথা থামতেই রাহাতের বাবা ঠাস করে একটা চড় লাগিয়ে দিলো রাহাতের গালে।চেঁচিয়ে বললেন
-‘ছিঃ তোর মতন কুলাঙ্গার আমি দেখি নি।আরে সব কিছু পরে আগে তো ওরা তোর আপন মানুষ।কীভাবে পারলি এসব করতে? কীভাবে পারলি ছিঃ।

রাহাত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।তার কিছু বলার মুখ নেই।আর ও তো সবটা করেছে আরেকজনের কথাতে।অবশ্য নিজেকে নির্দোষ সে দাবি করে না।বরাবরই নীলাকে অপছন্দ ছিলো তার।তাই সে আরেকজনের কথায় রাজি হয়েছে।তার সাথে লোভ তো ছিলোই।

আজিজুর রহমান এতক্ষণে মুখ ফুটে বলল
-‘পুলিশ অফিসার নিয়ে যান ওরে।’

রাহাত এবার কূল কিনারা না পেয়ে বাবার কাছে হাত জোড় করে বলল
-‘বাবা এবারের মতন মাফ করে দেও আমি আর করবো না প্লিজ বাবা।’

রাহাতের বাবা মুখ ফিরিয়ে নিলো রাহাতের থেকে।রাহাত দিশা হারা হয়ে তার মাকে ডাকা শুরু করল
-‘আম্মু কোথায় তুমি প্লিজ বাঁচাও আম্মু তুমিই একমাত্র আমাকে ভালোবাসো।প্লিজ আম্মু বাঁচাও।’

রাহাতের বাবা পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল
-‘ওরে তাড়াতাড়ি নিয়ে যান।আমার ওয়াইফ এসব জানার আগে ওরে এখান থেকে নিয়ে যান।আমরা পরে আমার ওয়াইফকে সামলাবো।এই বিশ্বাসঘাতককে সড়ান এখান থেকে।’

রাহাতকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো।রাহাতের বাবা বসে পড়লো তার পাশের চেয়ারটায়।

নীলা হেলেদুলে কোনো মতে শারমিন চৌধুরীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর দু হাত জোড় করে হাঁটু মুড়ে বসে পরলো।কেঁদে দিয়ে বলল
-‘আন্টি গো আমাকে নিজের বোনের বিয়ে ভাঙার কলঙ্ক থেকে তুমিই বাঁচাতে পারবে।আন্টি হেল্প মি।’

শারমিন চৌধুরী নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
-‘তুমি চিন্তা করো না নীলা।নিরুপমার বিয়ে হবে। এবং আজই হবে।’

আফসানা রহমান অবাক কন্ঠে বলল
-‘বিয়ে হবে?কিন্তু কার সাথে?’

শারমিন চৌধুরী হেসে বললেন
-‘আমার ছোট ছেলের সাথে।নীড়ের সাথে বিয়ে হবে নিরুপমার।আপনারা সম্মতি দিলেই হবে।’

আফসানা রহমান পরম তৃপ্তিতে চোখের জল ছেড়ে দেয়। বর্ণের বাবা এগিয়ে গিয়ে নীলার বাবা মানে আজিজুর রহমানকে বললেন
-‘ভাই সাহেব আপনি রাজি তো আপনার মেয়েকে আমার বাড়ির বউ বানাতে?’

আজিজুর রহমান জড়িয়ে ধরলেন বর্ণের বাবাকে খুশিতে ।নীলা রঙকে পাঠালো নীড়কে ডাকতে।সে এখানে উপস্থিত নেই।বাড়ির পাশে পুকুরের দিকটাতে বসে আছে।তাই এতক্ষণের খবর সে জানে না।অবশ্য নীলা দিগন্তকেও পাঠিয়ে ছিলো সেখানে।গত কাল রাতেই নীলা সবটা দিগন্তকে জানিয়ে ছিলো। নীড় জেনো কোথাও চলে না যায় তাই দিগন্তও সেখানে আছে।

বর্ণ এতক্ষণ পর নীলার দিকে এগিয়ে এসে বলল
-‘সব বুঝলাম নীলা।কিন্তু তুমি কীভাবে নীড় আর নিরুপমার সম্পর্কের কথা জানলে।’

নিরুপমারও এতক্ষণে হুঁশ হলো।সেও এগিয়ে এসে বলল
-‘হ্যাঁ নীলু আমাদের ব্যাপারে জানলি কীভাবে?’

নীলা বাঁকা হেসে বলল
-‘গত দুই তিনদিন যাবত আমার কাছে চিরকুট আসছিলো।যেখানে প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ ভাবে বিয়ে ভাঙার কথা বলা ছিলো। লেখা গুলো বেশ চেনা চেনা লাগছিলো কিন্তু বুঝতে পারি নি কার লেখা।গায়ের হলুদে সকালে স্টেজের সামনে এসে দেখলাম আজ নিরুপমার গায়ের হলুদ লেখা আর চিরকুটের লেখাটা সেইম।যখন জিজ্ঞেস করলাম লেখাটা কে টানিয়েছে দিগন্ত ভাই বলল সে। আর কিছু জিজ্ঞেস করার আগে দিগন্ত ভাই চলে গেলো।তারপর আবার রাতে দিগন্ত ভাইয়ার শরীরে সেই হুডিটা দেখেছিলাম যেটা ঐ আমাকে বাঁচিয়ে ছিলো সেই ছেলের শরীরে পড়া ছিলো।সব সন্দেহ দিগন্ত ভাইয়ার দিকে যাচ্ছিলো তাই রাতে দিগন্ত ভাইয়াকে ছাদে ডাকি।

কিন্তু তখনই দিগন্ত ভাই বলল লেখাটা নীড় ভাইয়ের আর হুডিটাও নীড় ভাইয়ার। তখনই সব সন্দেহ পরিষ্কার হলো।’

নীলার কথা শেষ হতেই নীড় হন্তদন্ত হয়ে হাজির হলো।এসেই নীলার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি দিলো।

নীলা এবার জড়ানো কন্ঠে বলল
-‘তাড়াতাড়ি বিয়েটা সেড়ে ফেলো প্লিজ হাতে সময় নেই আর।’

তিমা ভ্রু কুঁচকে বলল
-‘সময় নেই মানে?’

নীলা আমতাআমতা করে বলল
-‘আরে মেহমান সব গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করছে।তাই বললাম আর বিকেলও নেমে আসছে।’

সবাই নীলার কথায় সম্মতি দিয়ে বিয়ে শুরু করল। রাহাতের বাবা নির্জীব বসে রইল।রাহাতের মা এখনো বাড়ির ভিতরে। সে হয়তো শুনে নি সবটা।আজিজুর রহমান ভাইয়ের পাশে ভাইকে শক্ত করে ধরলো।

নীলা তার সাথে থাকা চেয়ারটা শক্ত করে ধরলো।বর্ণ নীলার পাশে এসে দাঁড়াতেই ও একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।বর্ণ নীলার আচরণে ভ্রু কুঁচকে ফেলল।

বিয়ে সম্পন্ন হলো।নীলা তার বাবার কাছে গিয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল
-‘বাবা’

আজিজুর রহমান মেয়ের এমন অদ্ভুত ডাকে উঠে দাঁড়ায়।বিচলিত কন্ঠে বলল
-‘মা তোমার কি শরীর অসুস্থ? চোখ এমন লাল হয়েছে কেন আম্মা? ঘামে চুল লেপ্টে আছে পিঠে? কি হয়েছে আম্মা?’

নীলা সবার দিকে একবার তাকালো তারপর আকাশ পানে চেয়ে বলল
-‘যখন পরবে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইবো না,আমি বাইবো না মোর খেয়া তরী,,,
এই হাঁটে গো,
যখন পরবে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
তখন তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাই বা আমায় ডাকলে,,,,’

শেষের লাইনটা বলেই নীলা ঠাস করে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।সবাই ছুটে আসলো নীলার দিকে।ততক্ষণে নীলার দু হাতে জড়িয়ে রাখা চাদর টা হাত থেকে ফসকে পড়ে যায়। পুরো পিঠ রক্তে মেখে আছে।সাদা জামা লাল বর্ণ ধারণ করেছে।

আজিজুর রহমান মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।সবাই আৎকে উঠে বলে
-‘রক্ত?’

এর মাঝেই ঘর থেকে কাজের বুয়া ছুটে এসে বলল
-‘বড় বাবা দেখে যান বড় মা সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছে।বড় মা কথা বলছে না।’

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here