বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ একত্রিশ

0
1559

বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ একত্রিশ
মম_সাহা

নীলার জ্ঞান হারানোর পর বেশ চিৎকার চেঁচামেচি পড়েছিলো।নিরুপমা আর ওদের ফ্লাটের সবাই ছুটে এসেছিলো। নীড় তার ভাইকে ফোন করে বাসায় আনিয়েছিলো। বর্ণ ডিউটিতে ছিলো।সাথে নীলার ডাক্তারকেও আনানো হয়।

গভীর পর্যবেক্ষণের পর নীলার ডাক্তার জানালেন নীলার হাতে আর তত সময় নেই।যদি দ্রুত চিকিৎসা শুরু নাহয় তাহলে নীলাকে বাঁচানো সম্ভব না।

আজিজুর রহমান আর নিতে পারছে না তার কলিজার মেয়েটার এই দশা।আফসানা রহমান স্বামীর অবস্থা বুঝে অসহায় বোধ করলো।সে তো মা তার ভিতর দিয়ে কি যে যাচ্ছে।

নীলার ঘুমন্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাদের মেয়েটার জন্য কত কিছু করার আছে কিন্তু কিছুই করতে পারছে না বলে নিজেকে কতটা নিরুপায় লাগছে তাদের।

বর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোফায় বসে পড়লো।তার শরীর আর দিচ্ছে সাথে মনও।প্রিয় মানুষের এমন দশা কেই-বা মানতে পারবে।

নীলা ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে আর বাকি সবার ঘুম হারাম হয়ে গেছে।
______
মাঝে আরও দু’দিন কেটে গেলো। আজিজুর রহমান ব্যস্ত ভিশা পাসপোর্ট তৈরী করতে।খুব শীঘ্রই মেয়েটাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতে হবে।মেয়ের জন্য পাড়ি দিবে ভিনদেশ।

নীলা বুঝতে পেরেছে তার ভিতরে বাসা বেঁধেছে। তাই সে যতটা পারে সবার সাথে হাসিখুশি থাকে।কথা বলে সবার সাথে। আজকাল তাকে একটা ব্যাপার খুব ভাবায় সেটা হলো বর্ণ। ডাক্তার সাহেব অনেক ভেঙে পড়েছে।তার দিকে কেমন নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে।জেনো হাজার বছর তাকে দেখার তৃষ্ণা পূরণ করছে।

একটা শুভ্রময় সকাল।নীলা দাঁড়িয়ে আছে তার বারান্দায়। আজকাল পৃথিবীটাকে নতুন লাগে। রঙিন লাগে সব কিছু।সে খেয়াল করেছে আজকাল তার বিরক্তি আসে না।স্বার্থপর মানুষের ভীরে আছে বলে মনে হয় না।

নীলা কালো গোলাপ গাছটার দিকে তাকায়। বাবা কত শখ করে গাছটা এনে দিয়েছিলো বলেছিলো গোলাপের সৌন্দর্যে সে নাকি নিজের সৌন্দর্য টা অনুভব করতে পারবে।তাই গোলাপ গাছেও ফুল ফুটে নি।মুচকি হাসে নীলা।তাহলে গোলাপও তাকে উপহাস করে আজকাল।

নীলা তার ভাবনায় ব্যস্ত এমন সময় গেটের দিকে নজর যায়। বর্ণ জগিং করতে হয়তো বাহিরে যাচ্ছে।নীলা আর অপেক্ষা করে না।চাদর টা শরীরে জড়িয়ে নেমে যায় বাহিরের উদ্দেশ্যে।

বর্ণ নিজের মতন হাঁটছে। হঠাৎ পিছন থেকে একটা মায়াবী মেয়েলী স্বরে কেউ ডেকে উঠলো
-‘ডাক্তার সাহেব?’

বর্ণ ডাক শুনে দাঁড়িয়ে যায়। আকষ্মিকভাবে পরিচিত কন্ঠ টা শুনে মুখে মুচকি হাসি চলে আসে তার।এই সুন্দর সকালটা, এই খোলা রাস্তাটা,এই কুয়াশায় নামা শিশির আর এই উন্মাদ প্রেমিক এই রমনীরই অভাববোধ করছিলো এতক্ষণ।

নীলা বর্ণে পাশে এসে দাঁড়িয়ে বর্ণে দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বলল
-‘আজকে আমি চলে এসেছি আপনার একাকীত্ব দূর করার জন্য। চলেন আজ একসাথে ঘুরতে যাই।’

বর্ণ হেসে মাথা নাড়ালো।তারপর দুইজন কপোত-কপোতী হেঁটে যায় নিরুদ্দেশে।

বর্ণ আর নীলা একটা পার্কে এসে বসলো।বর্ণ প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল
-‘আচ্ছা নীলা আপনি আজ এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলেন কেনো?আপনার কিন্তু এখন বেশি বেশি ঘুমানো উচিত নাহলে মাথা ব্যাথা করবে।এখন অনেক রেষ্ট নেওয়া উচিত।’

নীলা কৌতুক হেসে বলল
-‘কেনো কেনো?আমার ঘুমানো উচিত কেনো? অসুস্থ বলে নাকি?’

বর্ণ চুপ করে যায়।তারা সবাই নীলাম্বরীকে তার রোগের কথাটা জানতে দেয় নি।যখন পাসপোর্ট একবারে তৈরী হয়ে যাবে তখন কিছু একটা বুঝিয়ে দেওয়া যাবে।

বর্ণ কথা ঘুরানোর জন্য বলল
-‘আরে না কিছুদিন আগে মাত্র এতবড় একটা দুর্ঘটনা থেকে বাঁচলেন।তাই বললাম।’

নীলা একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন
-‘আরে ডাক্তার সাহেব কথা ঘুরাচ্ছেন? মাকে মামার বাড়ি গল্প শুনাচ্ছেন? আমার থেকেই আমার রোগ লুকাচ্ছেন?’

বর্ণ ভড়কে যায়। আমতা-আমতা করে বলল
-‘আরে আপনার আবার কিসের রোগ? রোগ থেকে মুক্তি পেলেন তো মাত্র।’

নীলা সদ্য কিশোরীর ন্যায় খিলখিল করে হেসে দেয়। হাসতে হাসতেই বলল
-‘আমি ডাক্তারের সব কথাই শুনেছি।যেদিন ডাক্তার আমাকে রিলিজ করে ছিলো সেদিন বাবাকে যা যা বলেছে সবটাই আমি শুনেছি যে। এটা কিন্তু সিক্রেট। আমি যে জানি সবটা আপনি কাউকে বইলেন না।’

বর্ণ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অবাক কন্ঠে বলল
-‘আপনি সবটা জানেন? তাহলে সেটা সবাইকে জানাতে না করেছে কেনো?’

নীলা বুক ভরে শ্বাস নীলো।অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-‘সবাই যদি জানে আমি রোগটার ব্যাপারে জানি তাহলে হয়তো আমার এই রোগটা নিয়ে আমার সামনেই আলোচনা করবে।আর সেটা আমাকে আরও দুর্বল করে দিবে।তাই যতদিন আছি যতদিন বাঁচি দুর্বলতা ছেড়ে বাঁচতে চাই।’

বর্ণ নীলার পাশে বসলো।তারপর সোজা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল
-‘আচ্ছা আপনার এই শরীরের অবস্থা কীভাবে হয়েছে, কে বা কারা করেছে জানেন?’

নীলা বর্ণের দিকে ঘাড় ফিরালো।পা দুটো উপর নিচ ঝুলাতে ঝুলাকে বলল
-‘পিছন থেকে ছুড়ি সবসময় আপন মানুষই মারে।’

বর্ণ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বিষ্ময়মাখা কন্ঠে বলল
-‘তাহলে আপনি জানেন এসব কে করেছে?’

নীলা উত্তর দেয় না বরং পাল্টা আবদার করে
-‘হাওয়াই মিঠাই কিনে দিবেন আমাকে ডাক্তার সাহেব?’

বর্ণ উত্তর দেওয়ার বদলে ছুটে গিয়ে হাওয়াই মিঠাই কিনে আনে।নীলার হাতে এনে দুটো হাওয়াই মিঠাই ধরিয়ে দিলো বর্ণ।নীলা হাওয়াই মিঠাই গুলো পরম যত্নে আগলে নেয়।আবার হাঁটা শুরু করে বাড়ির উদ্দেশ্যে।

নীলাকে হাওয়াই মিঠাই গুলো এভাবে জাপ্টে ধরে হাঁটতে দেখে বর্ণ ভ্রু কুঁচকে বলল
-‘ওমা আপনি হাওয়ায় মিঠাই না খেয়ে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন কেনো?’

নীলা মুচকি হেসে বলল
-‘কিছু জিনিস আকড়ে ধরার মাঝে আনন্দ আছে জানেন তো?’

বর্ণ কোমড়ে হাত দিয়ে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-‘আপনি এত এত কঠিন কথা কেনো বলেন আপনি? আর অনেক লুকোচুরি করেন আপনি।আপনার মতন রহস্য আর কারো মাঝে নেই।’

নীলা গোল গোল চোখে তাকিয়ে বলল
-‘প্রতিটা মানুষের মাঝেই রহস্য আছে।কেউ সেটা প্রকাশ করে কেউ প্রকাশ করে না।আপনার মাঝেও তো রহস্য আছে।তাই না?’

বর্ণ কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল
-‘আমার মাঝে রহস্য আছে? কই আমিই তো জানিনা।কি রহস্য মেডাম?’

নীলা সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল
-‘এই যে আপনার প্রাণের প্রিয় বন্ধু শুভ্রম আজ বড্ড অচেনা।পরিচিত মানুষটাকে আজ দেখা হলে আপনি অপরিচিতির মতো ট্রিট করেন। সেটা রহস্য না?’

বর্ণ থমকে যায়। নীলাম্বরী জানলো কীভাবে এটা?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here