সমাপ্তির_পূর্ণতা,পর্ব-৫
লেখনীতে: নুরুন্নাহার_তিথি
সময় নদীর স্রোতের মতোই বহমান। সময়ের সাথে ঘটে অনেক অনাকাঙ্খিত উত্থান পতন। ঠিক তেমনি বিভান ও অদ্রির জীবনে চলছে কিছু দুঃসময়। বিভান অদ্রিকে বাচ্চার কথা বলার প্রায় তিনমাস হয়ে গেছে। অদ্রি এখনো কনসিভ করে নি। এদিকে বিভানের মা অনবরত বাচ্চার কথা বলে বলে মুখের ফেনা তুলে ফেলছে। তাছাড়া উনার এরকম বাচ্চার জন্য অধৈর্য হবার কারণটা সত্যি বলতে পুরোপুরি ভুল নয়!
বিভান ও অদ্রির বিয়ের তিন বছর প্রায় হতে চলল এবং বিভান সেদিন তার মা কে আশ্বাস দিয়েছে তারা জলদি বাচ্চা নেওয়ার প্লেন করছে।
বিভানের মা একদিকে ছেলের কথায় আশায় আছে আরেকদিকে শিমুর প্রতিনিয়ত উস্কানি মূলক পরামর্শ।
অদ্রি আবার বাসার দুই জায়গায় সিক্রেট ক্যামেরা ফিট করেছে সাথে কিছু মাইক্রোচিপ। এই সিক্রেট ক্যামেরার রেকর্ডিং অদ্রি অফিস থেকে ফেরার পথে দেখে এবং বাসায় এসে বিভান না ফেরার আগ পর্যন্ত দেখে।
সিক্রেট ক্যামেরা ড্রয়িং রুমে এবং বিভানের মায়ের রুমে লাগানো। আর মাইক্রোচিপ আরো কয়েকটা জায়গায় এক্সট্রা লাগানো আছে। এসবের বদৌলতে অদ্রি জানতে পারে বাড়িতে কি হচ্ছে।
অদ্রি আবারো ডাক্তারের কাছে গেছে। চেকআপ করে ডাক্তার বলল,
–মিসেস অদ্রি, আপনি কিছুটা রিকোভার করছেন তবে অনেক স্লো ভাবে। সিস্টটা ক্রমশ ছোট হচ্ছে। আল্লাহ চাইলে আর তিন মাস পর কনসিভ করতে পারবেন যদি আপনারা কোনো প্রিকোয়েশন না নিন তবে। কিন্তু আমি বলবো আপনারা যখন এতো সময় অপেক্ষা করেছেন তাহলে আরো কয়েক মাস অপেক্ষা করুন।
–জ্বী ডাক্টর, আমি অপেক্ষা করবো।
–বাই দা ওয়ে, মিসেস অদ্রি। আপনি আগেরবারো একা এসেছেন এবং এবারো একা আসলেন! আপনার হাসবেন্ড কোথায়?
অদ্রি ডাক্টারের কথায় থম মেরে যায়। কি জবাব দিবে সে? সে তো বিভানকে জানায় নি এই ব্যাপারে কিছু! অদ্রির জবাব না পেয়ে ডাক্টার আবার বলে,
–আপনার হাসবেন্ডকে আমার এ বিষয়ে জানানো প্রয়োজন। হাসবেন্ড বা বাড়ির কাউকে নেক্সট এপোয়েনমেন্টে নিয়ে আসবেন। আমরা রোগীকে তার রোগ সম্পর্কিত অবগত করতে চাই না। কারণ এতে রোগী অনেকটাই মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে।
–জ্বী ডাক্টার, পরেরবার থেকে কাউকে সাথে করো নিয়ে আসবো।
–ঠিক আছে। আর ওষুধগুলো ঠিক মতো খাবেন।
অদ্রি ডাক্টারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসে। অদ্রি নিজের মনে দীর্ঘশ্বাস লুকাতে ব্যস্ত আর এদিকে কেউ একজন অদ্রিকে গাইনি বিভাগ থেকে বের হতে দেখে ফেলেছে। আর সেই মানুষটা ভাগ্যকরে রিমু।
রিমু দ্বিতীয় বারের মত প্রেগনেন্ট। তাই সে ডাক্তারের কাছে এসেছে চেকআপ করতে। রিমুর সাথে অবশ্য তার স্বামী বিভানের বড় ভাই ইভান এসেছে। ইভান একটা জরুরি কল আসার কারণে হসপিটালের ভিতরে ওয়েটিং রুমে রিমুকে ও রিহাবকে রেখে বাহিরে গেছে। ইভান অদ্রিকে দেখেনি। এমনকি অদ্রি হসপিটাল থেকে বের হচ্ছে আর ইভান ভিতরে ঢুকছে তারপরেও না অদ্রি খেয়াল করেছে আর না ইভান।
রিমু অদ্রিকে যেই ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হতে দেখেছে, সে নিজেও সেই ডাক্তারের কাছে এপোয়েনমেন্ট নিয়েছে। রিমু যেনো হাতির পা দেখে ফেলেছে! সে এবার ধামাকা করবেই। রিমু জানে তার শাশুড়ি অদ্রির উপর নারাজ। আর দুই দিন আগের সে রিমুর দ্বিতীয়বার প্রেগনেন্সির কথা শুনে অনেক খুশি হয়েছেন এবং সেই সাথে রিমুর সাথে ফোনে কথা বলা অবস্থায় অদ্রিকে কিছু কটু কথা শুনিয়েছে। তাহলে এত বড় একটা সুযোগ তার হাতে এসেছে, সে কি সেটা ছেড়ে দেবে!
—–
অদ্রি বাড়িতে এসে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নেয় তারপর রান্নাঘরে যায় দুপুরের খাবার বানাতে। অদ্রি আজকে অফিসে যায় নি। আসলে শরীর খারাপ সাথে মন খারাপ তাই আজ ছুটি নিয়েছে। ছুটি যেহেতু নিয়েছে তাই ডাক্টারের কাছ থেকেও চেক আপ করে আসলো। দুপুরের রান্না প্রায় শেষ। আজকে আবার ইভান ভাইয়া, রিমু ভাবি ও রিহাব আসবে।
হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে অদ্রি গ্যাস অফ করে দরজা খুলতে যায়। দরজা খুলে অপরপাশে ভাসুর, ভাসুরের বউ ও তাদের ছেলেকে দেখে অদ্রির মুখে হাসি ফুটে উঠে। অদ্রি তাদের সালাম দিলে, ইভান খুব হাসি মুখে সালামের জবাব দেয় কিন্তু রিমু মুখ ভেংচি দিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে যায়। অদ্রি রিমুর ব্যাবহারকে পাত্তা না দিয়ে রিহাবকে হাতে ধরে নিয়ে বসার রুমে যায়। ইভান যেয়ে তার মা কে সালাম দেয়। অদ্রি ওদেরকে বসতে বলে শরবত আনতে যায়।
অদ্রি শরবত এনে সোফার সামনের টেবিলে রাখলে তখনি রিহাব তার কাকিমণির কোলে চড়ে বসে। রিহাব মাত্র পাঁচ বছরের। রিহাব দেখতে তার বাবার মত হয়েছে। রিহাবকে অদ্রির কোলে যেতে দেখে হয়তো রিমুর ভালো লাগেনি, তাই সে বাঁকা চোখে অদ্রির দিকে তাকিয়ে আছে। অদ্রি এসব দিক ঠিকি লক্ষ্য করেছে। তাছাড়া রিমু এ বাড়িতে আসবে আর তার শ্বাশুড়ীর কান ভাঙ্গাবেনা তা তো আর হয় না!
দুপুরের একটু আগে বিভানও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে এসেছে। আজকে পুরো পরিবার একসাথে। বিভান এসে থেকে রিহাবের সাথে খেলছে। ওদের দেখে মনে হচ্ছে না ওরা চাচা-ভাতিজা, দেখে মনে হচ্ছে বাপ-ছেলে। এসব দেখে অদ্রির মনে অনুশোচনা হলেও তার কিছু করার নেই! সে বাধ্য এসব করতে। অদ্রি কখোনোই বিভানকে ছাড়তে পারবে না, আর ডাক্তার তো বলেছে সুস্থ হচ্ছে সে। প্রায় নয়-দশ মাস যাবত সে চিকিৎসা নিচ্ছে এবং অনেকটা ইম্প্রুভ হয়েছে।
দুপুরের খাবারের পর্ব শেষ হবার পর রিমু এমন একটা কথা বলল যে সবাই স্তব্ধ হয়ে গেছে। রিমুর হাতে অদ্রির রিপোর্ট!
অদ্রি সেটা দেখে অবাক কারণ কোনো হসপিটাল অনুমতি ও প্রমান ব্যাতিত কারো রিপোর্ট অন্য কাউকে দেয় না। তাহলে রিমু পেলো কোথা থেকে!
রিমু হয়তো অদ্রির হাবভাবে অবাক হওয়াটা বুঝতে পেরেছে। তাই রিমু বলে,
–আমি আজকে হসপিটালে যখন চেকআপ করাতে গেলাম তখন অদ্রিকে দেখলাম ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হলো। আর তাই ডাক্টার ও নার্সদের বাড়ির লোক বলার পরেও অনেকবার তাদেরকে বলার পরে আমাকে রিপোর্ট দিল। আজকে যদি রিপোর্টটা হাতে না পেতাম তাহলে তো জানতেই পারতাম না যে অদ্রি মা হতে পারবেনা!
রিমুর কথায় বিভান নিষ্পলক ভাবে অদ্রির দিকে তাকিয়ে আছে। বিভান জানে না আজকে কি ঘটতে চলেছে! তবে এটুকু বুঝতে পেরেছে আজকে তার বড় ভাবি কোনক্রমেই ক্ষান্ত হবে না। বড় ভাবি আজকে কোমড় বেঁধেই নেমেছে অদ্রিকে অপমান করে কষ্ট দিতে। তাছাড়া বিভানের মা, সে তো তার ছোট ছেলের ঘরে নাতি-নাতনি দেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছে। মা কে কিভাবে বুঝাবে বিভান! সে তো নিজেকেই সামলাতে পারছে না।
বিভান সেদিন অদ্রিকে বাচ্চা নেওয়ার কথা বলেছিলো তার মায়ের কথায়। নাহলে অদ্রিকে সে বাচ্চার কথা বলতো কি না তা সে জানে না। বিভান বাচ্চা নিতে চায়না বিষয়টা এমন না। বিভান বাচ্চা নিতে চায় তবে ভয় হয় দুই ধরনের!
প্রথম ভয়,
বিভান স্বচক্ষে দেখেছে তার বড় ভাবিকে। তার বড় ভাবি রিহাবের জন্মের পর থেকেই কেমন যেন বদলে যেতে শুরু করেছিলো। বড় ভাবির রিমু রিহাবের জন্মের আগে মায়ের সাথে সাহায্য করতো, মা কে অনেকটাই মেনে চলতো তবে রিহাবের জন্মের পর থেকে যেনো মা কে মানতেই চায় না! এমনকি বড় ভাই কেও সবসময় চুপ করিয়ে রাখে।
সারা জীবন তার মা তিন ছেলেমেয়েকে আদর ও আদব দিয়ে মানুষ করেছে, কখনো যেনো কারো সাথে অন্যায় না করে। কিন্তু সে নিজে কি পেলো? শেষ বয়সে এসে বড় ছেলের বউয়ের অবহেলা। অদ্রি কখনো মায়ের মুখের উপর কিছু বলেনি কারণ অদ্রিকে বিভান বিয়ের আগেই বলে দিয়েছে যেনো তার মা কে তার বড় ভাবির যেমনটা ট্রিট করে সে (অদ্রি) যেন এরকমটা না করে।
অদ্রি ঐসময় বলেছিলো,
” তোমার মা মানে, আমারও মা। আমি কেনো তাকে অন্য চোখে দেখবো? তাকে আমি আমার মায়ের মতোই ভালোবাসব যদি সে আমাকে মেয়ে ভাবতে পারে। ”
বিভান সেদিন হেসেছিলো তৃপ্তির হাসি। হ্যাঁ, সে পেরেছে একটা সঠিক মেয়েকে নিজের জীবনসঙ্গীনী বেছে নিতে।
দ্বিতীয় ভয়,
অনেকের প্রেগনেন্সিতে কম্প্লিকেশন থাকে। যদি অদ্রিরো কম্প্লিকেশন হয় তো! ওই সময় যদি মা ও বাচ্চাকে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে বলে! তাহলে বিভান কি করবে?
—-
আর আজ যখন বিভান জানতে পারল অদ্রির মা হতে পারবে না তখন সে কি করবে? বিভান জানে, তার মা ইদানিং কয়েক মাস যাবত অদ্রিকে বাচ্চা নেওয়া নিয়ে অনেক কথা বলেছে। অদ্রি তাও তার (বিভান) মায়ের উপর একটা কথাও বলেনি। বিভান বুঝতে পারত অদ্রির মন খারাপ কিন্তু সে কি করবে? তাও অদ্রির মন ভালো করার জন্য যা লাগে তাই করত।
হঠাৎ আবার রিমু ভাবির কোথায় নিরবতার পতন ঘটে। রিমু ভাবি বলে,
–একটা বাজা মেয়েকে আমাদের বিভানের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে এই মেয়ের পরিবার।
ইভান এতক্ষন যাবৎ তার স্ত্রীকে ইশারাতে থামতে বলছিল কিন্তু এখন মা, ছোট ভাই ও ভাইয়ের বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রিমুকে একটা ধমক দেয়।
–চুপ করো রিমু। তোমাকে কতক্ষন যাবত বুঝাচ্ছিলাম যে এগুলো বলো না, কিন্তু তুমি তাও বলে যাচ্ছ!
–কেনো? আমি চুপ করবো কেনো? এই মেয়েটা মা হতে পারবে না, তো এটা কি আমার দোষ! এই মেয়েটার জন্য আমার বোনকে মুখের উপর অপমান করেছে বিভান। এই মেয়েটার থেকে আমার বোন কোন অংশে কম?
ইভান যেনো রিমুর কথার কোনো তালগোল পাচ্ছে না তাই বলে,
–এখানে তোমার বোন কেনো আসছে রিমু? আমরা সবাই জানি বিভান অদ্রিকে বিয়ের তিন বছর আগে থেকে ভালোবাসত। আর তখনো তোমার সাথে আমার বিয়ে হয় নি আর না তোমাকে বা তোমার বোনকে আমরা দুই ভাই চিনতাম!
রিমু হয়তো ক্ষেপে যায় তাই ইভানকে বলে,
–ওহো! এখন তুমিও এই মেয়েটার পক্ষ নিবে? তোমার মা, ভাই কি কম ছিলো যে এখন তুমিও!
ইভান বুঝতে পারছে না রিমুকে সে কিভাবে বলে বুঝাবে। এর মধ্যেই তাদের মা বলে উঠে,..
চলবে ইনশাআল্লাহ,