সমাপ্তির_পূর্ণতা,পর্ব-৬
লেখনীতে: নুরুন্নাহার_তিথি
ইভান বুঝতে পারছে না রিমুকে সে কিভাবে বলে বুঝাবে। এর মধ্যেই তাদের মা বলে উঠে,
–তোমরা সবাই একটু থামো। আর ছোট বউমা? তুমি আমাদের এ বিষয়ে জানাওনি কেনো?
শাশুড়ির কথায় রিমু চুপ করে গেলেও মনে মনে সে যে খুশি তা তার হাবভাবে লক্ষনীয়। অদ্রি লম্বা শ্বাস নেয় তারপর বলে,
–মা, ডাক্তার আমাকে সরাসরি বলে নি যে, আমি মা হতে পারবো না! ডাক্তার বলেছে, আমার বাম ফ্যালোপিয়ান টিউবে সিস্ট আছে এবং সেটা অপসারন সম্ভব নিয়মিত মেডিকেশনের মাধ্যমে। আমি নয় মাস যাবত মেডিসিন নিচ্ছি এবং আজকে ডাক্তার বলেছে আর তিন মাস পর আমি বেবী কনসিভ করতে পারবো। তবে আরো কয়েক মাস যদি অপেক্ষা করি তবে ভালো। আপনাদের বলিনি যাতে আপনারা টেনশন না করেন। তার জন্য আমি স্যরি।
অদ্রি কথাটা বলে চুপ হয়ে যায়।
বিভান যেনো অদ্রির কথায় নিজের জান ফিরে পায় কারণ তার মনে ভয় হচ্ছিলো যদি তার মা অদ্রিকে ছেড়ে দিতে বলে! সে তো অদ্রিকে ভালোবাসে। তার মনে, অদ্রির জায়গায় অদ্রি আর তার মায়ের জায়গায় মা।
অদ্রির কথায় তার শাশুড়ি আর কিছু বলে না। তবে রিমু! তার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে রাগে কটমট করছে। আর অদ্রি সেই হাবভাব দেখে মনে মনে আউরায়,
” তুমি চলো ডালে ডালে তো আমি চলি পাতায় পাতায়! ”
এরপর মনে মনেই বলে উঠে,
” রিমু ভাবি আপনার প্রতিটা চালের জন্য আমার কাছে তা কাটার জন্য চাল রেডি। দেখি আর কি করতে পারেন। ”
অদ্রির শাশুড়ি তার বড় ছেলে ও ছেলের বউকে বলে,
–তোমরা না হয় এখন এ বাড়িতে চলে এসো, যতদিন না পর্যন্ত বৌমার ডেলিভারি হয়।
রিমু তো মহাখুশি! অন্তত তার মুখ দেখে তাই মনে হচ্ছে। রিমু খুশিতে ডগমগ হয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই ইভান বলে,
–না মা। আমরা আসবো না। রিমু তো আলাদা বাসা নিয়েছে নিজের মতো করে থাকতে আর অদ্রির সাথে ওর জমে না বলে। তাছাড়া সত্যি বলতে রিমু এমনিতে অদ্রির সাথে বিয়ের পর থেকে ভালো ভাবে কথা বলে নি আর এখন তো রিমু অদ্রিকে প্রতিনিয়ত কথা শুনাতে ছাড় দিবেনা। আমি তো রিমুকে চিনি! সে এখানে আসলে পরিবারে অশান্তি ছাড়া আর কিছু হবে না। রিমু সারাদিন বসে থাকবে অদ্রির দোষ খুঁজে বের করতে। আমি চাইনা আমার বউয়ের জন্য আমার ছোট ভাইয়ের সংসারে সমস্যা হোক। আমার মাকে তো আমি আমার সাথে রাখতে পারিনি আমার বউয়ের জন্যই! সেখানে যখন আমার মা তার ছোট ছেলে ও ছেলের বউয়ের সাথে ভালো আছে তাহলে সেই সংসারে ঝামেলা হোক আমি চাইনা।
রিমু নাকের পাটা ফুলিয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান রিমুর রক্তচক্ষু দেখেও কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। রিমু প্রতিউত্তরে কিছু বলতে নিবে তার আগেই ইভান রিমুকে চুপ করিয়ে বলে,
–তোমার কোন কথা এখন শুনতে চাইছি না। এখনই বাসায় চলো। বাসায় গিয়ে তোমার কথা শুনবো।
রিমু বসা থেকে উঠে রাগে গজগজ করতে করতে সদর দরজার বাইরে চলে যায়। বিভানের মা রিমুকে আটকাতে চেয়েছিল কিন্তু তার আগেই ইভান তাকে ইশারায় মানা করে দেয়। অদ্রি তার ভাসুরকে ধন্যবাদ জানায় তার জন্য রিমু ভাবিকে বোঝানোর জন্য। ইভান তার মা, ভাই ও ভাইয়ের বউয়ের উদ্দেশ্যে বলে,
–তোমরা হয়তো ভাবছো, আমি আমার বউয়ের কথায় উঠি বসি! তাই বাড়ি ছেড়ে ভিন্ন বাসা নিয়ে থাকছি। কিন্তু না! আমি ভিন্ন বাসা নিয়ে থাকছি কারণ রিমুর কারণে সংসারে অনেক মনমালিন্য সৃষ্টি হবে তাই আমি ওর আলাদা বাসা নেওয়ার ব্যাপারে রাজী হয়েছি। আমার মা কে তো আমি আমার বউয়ের কাছে শান্তিতে রাখতে পারলাম না তাই যদি আমার মা তার ছোট ছেলের বউয়ের কাছে মায়ের মর্যাদা পায় তাহলে কেন আমি বাধা সৃষ্টি করবো? আমার মা তার এক ছেলের বউয়ের কাছে তো সুখে থাকবে!
কথাগুলো বলে ইভান মলিন হেসে ছেলেকে নিয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে যায়।
—–
বিয়ের তিন বছর পূর্ণ হয়েছে কিছুদিন আগে অদ্রি ও বিভানের। রিমু ভাবির সাথে ওইদিনের পর আজ তিনমাস পেরিয়ে গেছে। তিন মাস পূর্ণ হবার পরেই শাশুড়ি অদ্রিকে বলছে বাচ্চা নেওয়ার কথা। যখন চতুর্থ মাসে পড়লেও তাও পিরিয়ড মিস হয়নি মানে প্রেগনেন্ট না। শাশুড়ি তো হতাশায় ডুবে গেছে আর এদিকে শিমু ও রিমু প্রায় প্রতিদিনই খবর রাখে। শিমু ও রিমু বিভানের মায়ের কানে এবার অদ্রিকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা তুলে। বিভানের মা আরো একমাস অপেক্ষা করার কথা বলে।
রিমু যেদিন সবাইকে সব জানিয়েছে সেইদিনের পর পাঁচ মাস কেটে গেছে। এবার আর বিভানের মা অপেক্ষা করবেন না। তার মনে এটাই ঢুকানো হয়েছে যে, অদ্রির আর বাচ্চা হবে না। বিভান তার মা কে অনেক বুঝিয়েছে যে অদ্রির এতে কোনো দোষ নেই। বিভান যেহেতু এটুকু সময় অপেক্ষা করতে পেরেছে তো সে আরো অপেক্ষা করতে পারবে।
এদিকে শিমু অদ্রির শাশুড়ির কাছে এসে তার হাতে ডিভোর্স পেপার দেয় বলে, এটাতে অদ্রি ও বিভানের সাইন নিয়ে নিতে। শিমু সাথে এটাও বলেছে, সে এখনো বিভানকে বিয়ে করতে রাজি আছে।
বিভান তার মা কে বুঝাতে পারেনি। আর অদ্রিকে সে বলেছে যেনো একটু সহ্য করে কারণ এই বয়সে মা কে একা রেখে সে অদ্রিকে নিয়ে চলে যেতে পারবে না।
অদ্রি বিনিময়ে হাসি দেয়। অদ্রির মনে বিভানের জন্য ভালোবাসা আরো বেড়ে যায় যখন বিভান তার মা কে নিয়ে কোন কম্প্রোমাইজ করতে রাজি হয় না তখন।
শিমুর প্ররোচনার শিকার হয়ে অদ্রির শাশুড়ি অদ্রির কাছে ডিভোর্স পেপার দেয়। অদ্রি সেদিন হতভম্বের মত তাকিয়ে ছিল শাশুড়ির মুখের দিকে। তারপর একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে ডিভোর্স পেপারে সাইন করে নিজের রুমে গিয়ে বিভানের জন্য একটা চিঠি লিখে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।
__________
চিঠি হাতে বিভান নিজের রুমের ফ্লোরে বসে আছে।
বিভান একটু আগেই বাড়িতে এসেছে। আর এসেই ড্রয়িংরুমে রিমু ভাবি ও তার ছোট বোনকে দেখে কিছুটা অবাক হয় তবে অদ্রিকে না দেখে তার কেমন যেনো সন্দেহ লাগছিলো তাই তড়িঘড়ি করে নিজের রুমে আসে। নিজের রুমে এসেও অদ্রিকে না দেখে সে ওয়াশরুম ও ব্যালকনিতেও দেখে, তাও না পেয়ে সে ভয় পেয়ে যায় কিছুটা। এরপর ড্রেসিং টেবিলে পারফিউমের বোতল দিয়ে চাপা দেওয়া কাগজ দেখতে পায়। কিন্তু সেটা খুলে দেখে সেটা একটা চিঠি!
বিভান পড়তে শুরু করে চিঠিটা,
প্রিয় অর্ধাঙ্গ,
আমাকে বাড়িতে সব জায়গায় খুঁজে না পেয়ে এখন তুমি নিশ্চয় ভয় পেয়ে আছো? আমি চলে যাচ্ছি। তোমার সাথে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত হয়তো আমি থাকতে পারবো না। আমার জায়গা দখল করে নেবে অন্যকেউ। আজ মা আমাকে ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে বলেছে। অনেকদিন যাবত ইনডাইরেক্টলি ডিভোর্সের কথাই আমাকে বোঝাতো তবে আজকে ডিভোর্স পেপার সামনে এনেই দিয়েছে। আমিতো অপয়া মেয়ে যে তার ছেলেকে বাবা হওয়ার সুখ দিতে পারলাম না! মা নিশ্চয়ই তোমার জন্য কোন মেয়ে দেখে রেখেছে, তাই আজ আমাকে ডিভোর্স পেপারে সাইন করতে বলল। তোমার জীবনে আমার পথযাত্রা হয়তো এতোটুকুই ছিলো।
চলে যেহেতু যাচ্ছি, তাই তোমাকে কিছু কথা বলেই যাই। তোমার বড় ভাবি রিমু, তার ছোট বোনকে প্রায়ই আমাদের বাড়িতে পাঠাতো। আমি আবার জবে জয়েন করার পর থেকেই শিমু এ বাড়িতে আনাগোনা বেড়ে গেছে। তাজের খালা আমাকে বলেছে, শিমু যেদিনই আসে মা কে নিয়ে নাকি মায়ের রুমে দরজা বন্ধ করে অনেক কথা বলে। আমাদের বিয়ের দুই বছর পূর্ণ হবার দুই মাস আগে থেকে মা আমাকে বাচ্চা নেওয়ার কথা বলেই যাচ্ছে।
বিয়ের আগে তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, “তোমার মাকে নিজের মা মনে করব।” আল্লাহর রহমতে ওই কথা আমি রাখতে পেরেছি। ভবিষ্যতেও যেন আমি ওই কথা রাখতে পারি তাই আজ আমার এই সিদ্ধান্ত। আমি কিন্তু চাইলে পারতাম উচ্চবাচ্য করতে!
এতদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর ডাক্তার বলেছে, আমি সুস্থ।
রিমু ভাবির তো প্রথম থেকেই আমাকে পছন্দ না। সে তার ছোট বোনের সাথে তোমার বিয়ে দিতে চেয়েছিল। মা হয়তো এখন তোমার সাথে শিমুর বিয়ে ঠিক করবে!
তোমারও যদি আমাকে নিয়ে অভিযোগ থাকে তাহলে সাইন করে দিও ডিভোর্স পেপারে, তিন মাস পর ডিভোর্স হয়ে যাবে।
কথায় আছে না,
” খাঁচার পাখিকে মুক্ত করে দেখো, সে উড়ে চলে যায় না কি তোমার কাছে আবার দিন শেষে ফিরে আসে। যদি দিন শেষে তোমার খাঁচায় আবার ফিরে আসে তাহলে ভেবে নিও সে তোমার পোষ মেনেছে। ”
ঠিক তেমনি, তোমাকে আমি খাঁচা থেকে মুক্ত করলাম। এখন তোমার পালা!
ইতি
তোমার অর্ধাঙ্গিনী
বিভানের চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ থম মেরে ফ্লোরে বসে থেকে এরপর ড্রয়িং রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। ড্রইং রুমে যেয়ে মা কে জিজ্ঞাসা করে,..
চলবে ইনশাআল্লাহ,