বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ বত্রিশ
মম_সাহা
সকালে বর্ণের সাথে ঘুরে এসে নীলা আবার ঘুমিয়েছে।এক ঘুমে দুপুরবেলা উঠেছে। খাবার খেয়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকদিন সে ছাদে যায় না। আজ ফ্রেশ মনে ছাদে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
সকালে শুভ্রমের কথা বলার পর থেকেই বর্ণ তার পিছে পিছে ঘুরছে কীভাবে সে জানলো সেটা জানার জন্য কিন্তু নীলা ঐ কথা বলার পর থেকে যে মুখে তালা লাগিয়েছ এখন অব্দি সেই তালা লাগানো।
নীলা দাঁড়িয়ে আছে এমন সময় হাজির হয় নিরুপমা। নীড় ছাদে কত গুলো কবুতর পালে।সে গুলো কেই খাবার দিতে তার ছাঁদে আসা।এখানে নিজের অসুস্থ বোনকে দেখে অবাক হয়ে যায়। নীলা তখন ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে।নিরুপমা আলগোছে গিয়ে নীরার কাঁধে হাত রাখে।
হঠাৎ নিজের কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠে নীলা। সে এতক্ষণ আপন মানুষ গুলোর বেইমানীর কথা ভাবছিলো।মানুষ কত স্বার্থপর প্রাণী। নিজের স্বার্থ রক্ষার্থে এত এত পুরানো সম্পর্ক গুলো কীভাবে এক নিমিষে নিজের লোভ,ক্ষোভ বজায় রাখতে নিজের আপন মানুষের ক্ষতি করতে পিছ পা হয় না।
নীলাকে চমকে যেতে দেখে নিরুপমা তড়িঘড়ি করে বলল
-‘নীলু আমি তোর আপাই।’
নীলা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। ছোট্ট শ্বাস ফেলে তার আপাইয়ের দিকে তাকায়। নিরু বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল
-‘কি ভাবছিস নীলু?’
নীলা হেসে ডানে বামে মাথা নাড়ায় যার অর্থ কিছুই না।
নিরু বোনের হাত ধরে ছাদের এক কিনারে নিয়ে গিয়ে বসে।তারপর পরম মমতায় বোনকে দুহাতে আগলে নেয়। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে
-‘নীলু জীবন আমাদের কোন মোড়ে নিয়ে দাঁড়া করিয়েছে তাই না? আমার ছোট বোন আমার জীবন সুন্দর করতে নিজের জীবন বাজি রেখেছিলো।ভাবতেই অবাক লাগে ছোট্ট নীলু কতটা বড় হয়ে গিয়েছে তাই না?’
নীলু হাসে।তার আপাইকে জড়িয়ে ধরে বলে
-‘সময়,পরিস্থিতি মানুষকে বড় করে দেয় আপাই।কখনো সবার ভালো করতে কঠিন কাজ করাতেও বাধ্য করে।কিন্তু প্রিয় জনের ভালোর জন্য দু একটা কঠিন কাজ করাই যায়। দুনিয়ার মানুষের কাছ থেকে কিছু জিনিস লুকানোই যায় তাই না?’
নিরু বোনের কথার মানে বুঝে না।শুধু আনমনে মাথা নাড়ায়।
_______
আগামী শুক্রবারে নীড় আর নিরুপমার বৌ ভাত।যেহেতু বর্ণদের আত্মীয় স্বজন বিয়ের কথা জানে না সেইজন্য বড় করে বৌ-ভাতের আয়োজন করা হয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার। কাল অনুষ্ঠান বাড়িতে। তাই পুরো বিল্ডিং আলোয় আলোকিত করা হয়েছে।বর্ণদের বাসায় মেহমানে ভরপুর হয়ে গেছে।বর্ণের খালা,মামা,মামি,ফুপু,চাচা, চাচী সব এসেছে।
আজিজুর রহমানও অনুষ্ঠানে সাঁই দিয়েছে।কিছুদিন পর ছোট মেয়েকে নিয়ে ভিনদেশে পাড়ি দিবে তাই বলে বড় মেয়ের প্রতি দ্বায়িত্বে হেলাফেলা সে করবে না।আর এই অনুষ্ঠানের আবদারটা করেছেই ছোট মেয়ে।
নীলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। মেহমানে গমগম করছে তাদেরও বাসায়।ফুপু আর দাদী বাদে সবাই এসেছে।হয়তো বাবাই তাদের আসতে মানা করেছে।
-‘আসবো নীলাম্বরী?’
পরিচিত কন্ঠে ফিরে তাকায় নীলা।তার ডাক্তার সাহেব দাঁড়িয়ে আছে তার দরজায়। নীলা হাসিমুখে ভিতরে আসার পার্মিশন দিলো।
বর্ণ নীলার সাথে গিয়ে দাঁড়ায়। নরম স্বরে বলে
-‘আমায় বললেন না শুভ্রম আর আমার কথা আপনি কীভাবে জানলেন?’
নীলা হাসে।আজকাল রমনী কাজে অকাজে হাসে। বর্ণ বুঝে না রমনীর হাসির কারণ কিন্তু রমনী জানে তার কোনো কিছুই অকাজের না।কিন্তু সবটাই রহস্য।
নীলাকে চুপ থাকতে দেখে বর্ণ বললো
-‘বলবেন না?’
-‘আপনার আর শুভ্রম ভাইয়ার একটা ছবি আমি শুভ্রম ভাইয়ার ড্রয়ারে দেখে ছিলাম।সেখান থেকেই আন্দাজ করে ছিলাম।আপনাকে তাই সরাসরি জিজ্ঞেস করে সিউর হলাম।’
নীলার কথায় বর্ণ অবাক হয়। অবাক কন্ঠেই জিজ্ঞেস করে
-‘শুভ্রমের কাছে এখনো আমাদের ছবি আছে?’
নীলা চোখ দিয়ে হ্যাঁ জানালো।তারপর নিজেই ভ্রু কুঁচকে বলল
-‘মনে তো হয় খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো তা কি এমন হলো যে এখন দুজন দুজনকে চেনেনই না?’
বর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পুরোনো ক্ষতটা সময়ের বিবর্তনে শুকিয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু আজ আবার তাজা হলো।দূর আকাশে তাকিয়ে বলে
-‘ব্যাপরটা খুবই ঠুনকো তবে আজ বড্ড দামী। একটা সম্পর্ক ভেঙে দিতে পারে এমন জিনিস তো আর ঠুনকো হতে পারে না তাই না?’
নীলা মাথা নাড়ায়। জিজ্ঞেস করে
-‘কি ব্যাপার ছিলো?’
-‘আমি আর শুভ্রম একই ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতাম।ডিপার্টমেন্ট আলাদা হলেও দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব বেশ গাঢ়ো ছিলো।একদিন শুভ্রম জানালো আমাদেরই ডিপার্টমেন্টের এক মেয়েকে ও পছন্দ করে।আমি তো মহাখুশি। শুভ্রম আমাকে একটা চিঠি দেয় মেয়েটাকে দেওয়ার জন্য। আমি নিয়ে মেয়েটাকে চিঠি দেই কিন্তু একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে যায়। মেয়েটা আমাকে পছন্দ করতো চিঠি দেওয়ায় ও ভেবেছিলো চিঠিটা আমার দেওয়া আর সেটা ভেবেই ও আমাকে প্রপোজ করে বসে।দুর্ভাগ্য ক্রমে শুভ্রম আমাকে ভুল বুঝে আর এই ঝামেলা থেকেই আমরা আলাদা।’
নীলা হা হয়ে যায়। সামান্য কারণে কেউ বন্ধুত্ব নষ্ট করে।পরক্ষণেই আবার নিজের কথা মনে পড়ে।তার আপাইও তো যখন রাহাতের সাথে বিয়েতে রাজি হয়েছিলো তখন সেও আপাইকে ভুল বুজে ছিলো।
বর্ণ নীলার দিকে তাকিয়ে বলে
-‘আপনার মতন আমিও একটা জিনিস জানি?’
নীলা অবাক হয়ে বলে
-‘কি জানেন?’
-‘এই যে প্রায় বছরখানিক আগে শুভ্রম আপনাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ছিলো।’
বর্ণের কথায় নীলা বিষ্ময়মাখা কন্ঠে বলল
-‘কীভাবে জানেন আপনি?’
বর্ণ উচ্চস্বরে হেসে বলে
-‘আমি জানবো না তো কে জানবে?শুভ্রম জেনে গিয়েছিলো আমি আপনার পিছু নেই নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।তাই পুরাতন কষ্ট যেটা সে পেয়েছিলো সেই সেইম কষ্ট আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই আপনাকে প্রপোজ করে ছিলো।’
নীলা ভ্রু কুঁচকে ফেলে বর্ণ ততক্ষণে চলে যায়।আনমনেই হেসে ফেলে নীলা।ডাক্তার সাহেব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাকে কত কিছু বুঝানোর চেষ্টা করছে।আর শুভ্রম সেও কিনা শুধু প্রতারণার জন্য তাকে প্রপোজ করেছিলো? সত্যি মানুষ স্বার্থপর। নিজের স্বার্থে নীলাকে কেবল ব্যবহারই করে গেলো।
________
ঘর ভর্তি মেহমানে গিজগিজ করছে। আজ রিসিপশন ছিলো।আড্ডা হৈ চৈ আশে পাশে।নীলা এতক্ষণ অনুষ্ঠানের ওখানে ছিলো।মাত্রই রুমে এসে বসলো।ড্রয়িং রুম থেকে কথাবার্তার শব্দ আসছে।সব ছেলে কন্ঠ।তার বাবা, বর্ণ,নীড়,বর্ণের বাবা,ফুপা,খালু ওরা বসে কিছু নিয়ে অনেক কথা বলছে।
নীলার মাথা ধরেছে কিন্তু বুজা যাচ্ছে কিছু নিয়ে বেশ ঝামেলা হচ্ছে।নীলা ক্লান্ত শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।নিজের ঘর থেকে বের হতেই বর্ণে বলা একটা কথা তার কানে আসলো
-‘স্যার আমি নীলাকে বিয়ে করতে চাই।আপনারা চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়ার আগেই আমি নীলাকে বিয়ে করতে চাই এবং আমিও আপনাদের সাথে যাবো।’
পুরো ড্রয়িং রুম নিস্তব্ধ। এখানে বর্ণের খালা, মা,ফুপুও ছিলো।নীলার মা, তিমা,তিমার হাসবেন্ড, চাচীরাও ছিলো।সবাই বেশ চুপ হয়ে যায়।
আজিজুর রহমান নিরবতা ভেঙে বলে উঠলো
-‘যা বলছো ভেবে বলছো তো মাই সান?নীলার কন্ডিশন তো জানো।’
বর্ণ প্রখোর কন্ঠে বলল
-‘আমি সব জানি।এবং সব জেনেও আমি নীলাকে চাই।তাই ঘরভর্তি মানুষের সামনেই বলেছি আমি নীলাকে বিয়ে করতে চাই।’
বর্ণের বাবা-মা কোনো কথা বলে নি।তারা চুপ করেই রয়েছে।বর্ণের খালা উঠে বললেন
-‘শারমিন তোর ছেলে কি পাগল হয়ে গিয়েছে?তোর ছেলের সাথে আমাদের মুনিয়ার বিয়ের কথা বলে ছিলাম না তোকে? আর নীলা কে? তোদের ছোট বউয়ের বোন টা না? এ মেয়ে দেখি ভীষণ রোগা,অসুস্থ। গায়ের রঙও চাঁপা।মানুষের মুখে মুখে যতটুকু শুনলাম মেয়ের নাকি মাথায় সমস্যা হয়েছে।বিদেশ নিয়ে যাবে? চিকিৎসা করানোর পর বেঁচে যেতেও পারে আবার মরেও যেতে পারে এই মেয়েকে তোর ছেলে বিয়ে করবে বলছে?’
বর্ণের জেনো শরীরে আগুন জ্বলে উঠলো।শক্ত কন্ঠে কিছু বলার জন্য পিছে ফিরলেই দেখে তার নীলাম্বরী দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আকাষ্মিক এত গুলো কথা শুনে নীলা থ হয়ে যায়। নীলাকে দেখে বর্ণও দাঁড়িয়ে যায়। এত কটুক্তি নীলা কীভাবে নিবে সেটাই ভয়ের কারণ।
আজিজুর রহমানও নিজের মেয়েকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়।উপস্থিত সবাই ভড়কে যায় নীলা কিছু শুনে ফেলে নিতো। বর্ণ আমতা আমতা করে বলল
-‘আসলে নীলা,,’
আর কিছু বলার আগেই নীলা বর্ণকে হাত দিয়ে থামিয়ে দেয়। ধীর গতিতে নিজের বাবার কাছে এসে দাঁড়ায় তারপর শান্ত স্বরে বলল
-‘আপনার খালা ভুল কিছু বলে নি।আপনার খালা না বললেও আমি এসব বলতামই।সত্যি টা তো সবাই জানেই তো বললে সমস্যা কি?আর এমনেতেও আমার দয়ার প্রয়োজন নেই ডাক্তার সাহেব। এই জীবনটা খুব ক্ষণস্থায়ী আমি হয়তো ফিরে নাও আসতে পারি।এমন অনিশ্চিত জীবনের সাথে আমি কাউকে জড়াতে চাই না।তাই এই বিয়ে হচ্ছে না।’
কথা শেষ করে নীলা কাউকে চোখ দিয়ে আশ্বস্ত করলো যে সে তার অনিশ্চিত জীবনের সাথে কাউকে জড়াবে না।নীলার কথা শুনে ইশারা বুঝে কেউ গোপনে স্বস্তির শ্বাস ফেলল।বর্ণকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাত থেকে বাঁচাতে পেরেই জেনো তার স্বস্তি মিললো।
চলবে