বিবর্ণ_নীলাম্বরী,পর্বঃ তেত্রিশ
মম_সাহা
সেদিন ড্রয়িং রুমের আলোচনার পর আজ দুদিন হলো বর্ণের সাথে নীলার কোনো কথা নেই।বর্ণ সেদিন রাগ হয়ে বের হয়ে গিয়ে ছিলো তারপর রাতে বাসায় ফিরে নি।পরের দিন সকালে বাসায় এসেছিলো।নীলা সবটাই জানে কিন্তু তবুও কিছু বলে নি।আর না নীলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নীলাকে আর কেউ কিছু বলেছে।শুধু বর্ণের মা শারমিন চৌধুরী নীলাকে আরেক বার ভেবে দেখতে বলেছে।
নীলা ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে টিভি দেখছিলো।এমন সময় নিরুপমা তাদের ফ্লাটে এসে নীলার পাশে ধপ করে বসলো।নীলা টিভির থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তার বোনের দিকে তাকালো। নিরুপমা অতি আনন্দে উৎসাহিত হয়ে বলল
-‘জানিস নীলু একটা দারুণ খবর আছে।’
নীলা বোনের এত উচ্ছ্বাস দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল
-‘কী খবর আপাই?’
নিরুপমা আগের ন্যায় উৎসাহিত হয়ে বলল
-‘কাল শুভ্রম ভাইয়ার হবু বউ মানে সোহার ননদ রাজের সাথে পালিয়ে গেছে।’
আফসানা রহমান তখন রান্নাঘরে যাচ্ছিলো।নিরুর কথা শুনে দাঁড়িয়ে যায়। অবাক হয়ে বলে
-‘কীহ্? ঐ মেয়ের সাথে না শুভ্রমের এনগেজমেন্ট হয়ে ছিলো? তাহলে রাজ কীভাবে পারলো এটা?’
নিরু মায়ের দিকে ঘুরে বলল
-‘দু’জন নাকি দু’জনকে আগে থেকেই পছন্দ করতো।কিন্তু পরিবারের জন্য বলতে পারে নি তাই পালিয়ে গেছে।’
আফসানা রহমান ‘নাউজুবিল্লাহ’ বলে উঠলেন।নিজেরই বড় ভাইয়ের নাক ছোট ভাই কীভাবে কাটলো।তারপর সে আবার জিজ্ঞেস করলো
-‘তুমি কীভাবে জানলে নিরু?’
নিরুপমা মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-‘আজ মৌ ফোন দিয়ে সবটা জানালো।মানুষের সাথে খারাপ করলে নিজেদের সাথেও খারাপ হয় এখন সেটা বুঝবে ওরা।নাক যেভাবে কেটেছে।’
আফসানা রহমান ইশারা দিয়ে নীলার দিকে তাকাতে বলল নিরুপমাকে।নিরুপমা নীলার দিকে তাকিয়ে দেখে সে এক ধ্যানে টিভি দেখছে।জেনো এত চাঞ্চল্যকর খবরও তার কাছে স্বাভাবিক।
নিরুপমার বিষ্ময়ে কপাল কুঁচকে গেলো।সন্দিহান কন্ঠে বলল
-‘কিরে নীলু তুই অবাক হোস নি খবর টা শুনে? এত স্বাভাবিক কীভাবে?’
নীলা টিভির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলল
-‘না অবাক হবো কেন? আমি তো জানতাম এমন কিছুই হবে।’
নীলার কথায় জেনো নিরুপমা আর তার মা থ বনে গেলো।আফসানা রহমান এগিয়ে এসে বলল
-‘তুমি জানতে মানে?’
নীলা টিভিটা বন্ধ করে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তারপর নিজের ঘরে যেতে যেতে বলল
-‘হ্যাঁ ওদের সম্পর্ক তো সেই কবে থেকে।কতবার ওদেরকে আমি এক সাথে দেখেছি।এমন যে হবে তা আগে থেকেই ধারণা করেছিলাম।’
আফসানা রহমান জেনো নিজের কানে শুনেও বিশ্বাস করতে পারছে না।অবাক কন্ঠে বলল
-‘তুমি যেহেতু জানতে তাহলে ওদের পরিবারকে জানালে না কেনো?’
নীলা মুচকি হেসে বলল
-‘জানালে কি আর এত দারুণ ভাবে নাকটা কাটা যেতো? তোমার বোনের ছেলে শুভ্রম সবসময় রূপের পিছনে ঘুরে এখন সে বুঝুক সব সুন্দর সবসময় সুন্দর হয় না।’
নিরুপমা আর আফসানা রহমান অবাকের সপ্তম আকাশে উঠে গেছে।যে নীলা কিনা অন্যের বিপদে সবসময় ছুটে যায় আর আজ সে আরেক সুর গাইছে।
________
বিকেল নেমেছে ধরণীর বুকে।আফসানা রহমান তার রুমে ঘুমিয়ে আছে।এই সুযোগে নীলা বাহিরে চলে গেলো।এখন তাকে একা কোথাও যেতে দিতে চায় না সবাই।তাই সবার আড়ালে সে বের হয়ে গেলো।
অনেকদিন পর চেনা রাস্তা,চেনা শহর সে দু চোখ মেলে দেখতে পারছে।আগে যে গুলো স্বাভাবিক, সাধারণ মনে হতো আজ সেগুলো অসাধারণ মনে হয়।সাধারণে আজকাল মুগ্ধ হচ্ছে সে।তাহলে কি আর বেশি দিন এগুলো দেখার সুযোগ নেই?
নিজের মনে মনে প্রশ্ন করে নীলা কিন্তু উত্তর খুঁজে পায় না।তবে আজকাল বেঁচে ফিরতে মনে চায়।যারা তার এ দশা করেছে তাদের দেখিয়ে দিতে ইচ্ছে করে তাদের হাজারো চেষ্টা নীলাকে মারতে পারে নি।আর, আর কত গুলো বসন্ত একটা মানুষের হাত ধরে কাটাতে ইচ্ছে করে তার।
নীলা একটা বিল্ডিং এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।ব্যাগ থেকে মোবাইল টা বের করে কাঙ্খিত নাম্বারে কল লাগায়।দুই, তিন,চার বার কল দেয় কিন্তু ফোন রিসিভ হয় না।বরং প্রতিবারই ফোনটা কেটে দিচ্ছে।নীলার মাথায় দুষ্টবুদ্ধি খেলে গেলো।তারপর কিছু একটা টাইপ করে পাঠিয়ে দিলো কাঙ্খিত নাম্বারটাই।
বেশি সময় লাগে নি কাঙ্খিত মানুষটার এখানে পৌছুতে। এসেই সে নীলার বাহু ধরে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করছে
-‘আপনি বাহিরে বের হয়েছেন কেনো একা একা? এত শরীর অসুস্থ নিয়ে কে বের হতে বলেছে? এখনও কি মাথা ঘোরাচ্ছে? বলেন কি সমস্যা হচ্ছে? আমার টেনশন লাগছে।’
নীলা নিজের সামনে ব্যতিব্যস্ত বর্ণকে দেখে মুচকি হাসলো।হ্যাঁ এতক্ষণ সে বর্ণকেই ফোন দিচ্ছিলো কিন্তু বর্ণ ফোন রিসিভ না করায় সে ম্যাসেজ পাঠায় “আমি এই রাস্তায় আছি ভীষণ অসুস্থ লাগছে তাড়াতাড়ি আসেন।”ব্যস এতটুকু কাজই যথেষ্ট ছিলো।
বর্ণ নীলাকে চুপ থাকতে দেখে আবার বলল
-‘শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে? কথা বলছেন না কেনো? কী হয়েছে প্লিজ বলুন।এমন করছেন কেনো? এখানে কেনো এসে ছিলেন?’
নীলা বর্ণের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে।এ মানুষটাকে প্রত্যাখ্যান করার সাহস কীভাবে দেখিয়েছে সে এটাই ভেবে পাচ্ছে না।সে বড্ড ভুল করেছে সাহস দেখিয়ে। তার ভুল সে শুধরে নিবে।মুচকি হেসে নীলা বলল
-‘আমি এতক্ষণ ঠিক ছিলাম না।আপনার দেখার অসুখটাই তো বড় অসুখ।এখন চলে এসেছেন অসুখও কমে গেছে।আর একটা কাজ করলে পুরো অসুখ সেড়ে যাবে।’
বর্ণ নীলার কথার ধরণে ভ্রু কুঁচকায়।কারণ নীলা এমন ভাবে কখনোই কথা বলে না।সে অবাক কন্ঠে বলে
-‘কি হয়েছে নীলা আপনার? কি সব বলছেন?’
নীলা বর্ণের হাত ধরে বলে
-‘একটা কাজ করতে হবে ডাক্তার সাহেব।তাড়াতাড়ি আমার সাথে চলুন।এই বিল্ডিং টাতে।আমার অসুখটা তাড়াতাড়ি সাঁড়ানো লাগবে।’
বর্ণ নীলার দেখানো বিল্ডিং টা দেখে অবাক হয়ে যায়। ভ্রু কুঁচকে বলে
-‘এটা তো কাজী অফিস।এখানে কি কাজ?’
নীলা হেসে ফেলে খিলখিল করে।তারপর সেই হাসি বজায় রেখে বলে
-‘আমার আপনাকে পাওয়ার দীর্ঘ অসুখটা একবারে সাড়ানোর কাজ।’
বর্ণ জেনো ধাপে ধাপে অবাক হচ্ছে।বিষ্ময়ে তার কথা আসছে না।নীলা বর্ণকে চুপ থাকতে দেখে বলল
-‘এই আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান? কাজী অফিসের সামনে এসে হা হয়ে আছেন।বিয়ে কি করার ইচ্ছে নেই? তাহলে চলেন চলে যাই।’
নীলার কথা বর্ণের মস্তিষ্ক অব্দি পৌঁছানোর সাথে সাথে বর্ণ বলে উঠলো
-‘হ্যাঁ হ্যাঁ বিয়ে করবো কিন্তু সেদিন না আপনি না করে দিলেন তবে আজ কেনো? আর সবার অগোচরে কেনো? সবাই তো রাজি।’
নীলা বাঁকা হেসে বলল
-‘আগে বিয়েটা করি তারপর সব প্রশ্নের উত্তর দিবো।এখন চলেন।’
বর্ণের জেনো সবটা স্বপ্নের মতন লাগছে।স্বপ্ন হোক আর বাস্তব সে এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চায় না।প্রেয়সীকে পাওয়ার এই একটা সুযোগ তার।তারপর খুব সাদামাটা ভাবে হয়ে যায় বর্ণ আর নীলার বিয়ে। নীলার এখানে পরিচিত দুজন স্বাক্ষী হিসেবে ছিলো।দুজনই তার স্যার। নীলার কথা রাখতে নীলাকে সুন্দর জীবন দিতে স্বাক্ষী হতে তারা দ্বিধাবোধ করে নি।
বর্ণের জেনো ঘোরই কাটছে না।পরশু অব্দি যে মেয়ে তার অনিশ্চিত জীবনের সাথে কাউকে জড়াবে না ভেবেছে আজ সে মেয়ে কিনা হুট করে তাকে বিয়ে করে ফেলল।
নীলা বর্ণকে নিয়ে একটা রেষ্টুরেন্টে বসলো।এতক্ষণে বর্ণ সুযোগ পেলো সবটা জানার।তাই সবার প্রথমেই সে নীলাকে প্রশ্ন করলো
-‘আমাকে বিয়ে করলেন কেনো?’
নীলা মুচকি হেসে বলল
-‘আপনি বিয়ে করতে চেয়েছেন তাই।’
বর্ন ভ্রু কুঁচকে তাকালো।আজ নীলা বেশ হেয়ালি করে কথা বলছে।নীলা এভাবে কখনোই কথা বলে না।বর্ণ গম্ভীর স্বরে আবার জিজ্ঞেস করলো
-‘তাহলে সেদিন কেনো আমাকে বিয়ে করবেন না বলেছিলেন? তাও আমার ফুপুর কথাতে? রঙের মা মানে আমার ফুপুই তো আপনাকে বলে ছিলো সুস্থ হওয়ার পর বিয়ে করতে।আপনার অনিশ্চিত জীবনের সাথে জেনো আমাকে না জড়ান।সুস্থ হলেই জেনো জড়ান তাই না?’
নীলা অবাক হয়ে যায়। অবাক কন্ঠে বলল
-‘আপনি কীভাবে জানেন ফুপি বলেছে।’
বর্ণ আর গম্ভীর থাকতে পারে না।আজ তার খুশির দিন গম্ভীর হলে হবে নাকি।সে হেসে বলল
-‘রঙ আমাকে সবটা বলে ছিলো।ফুপি আপনাকে আড়ালে নিয়ে যা যা বলেছিলো সবটা রঙ শুনে ছিলো।সেদিন আপনাদের ফ্লাট থেকে বের হতেই ও সবটা আমাকে জানায়।’
নীলা আড়চোখে চেয়ে মুখটা ফুলিয়ে বলল
-‘তাও আপনি আমার সাথে এই দুই দিন কথা বলেন নি।সবটা জেনেও!’
বর্ণ মাথা নাড়ায়। তারপর বলে
-‘আমার খারাপ লেগে ছিলো।আপনি ফুপির কথা শুনলেন একবারও আমার কথা ভাবলেন না।আপনি সেদিন বললেন আমি নাকি আপনাকে দয়া করছি।সবার সামনে বিয়ে করবেন না বলে জানিয়েছেন। আমার খারাপ লাগে নি?’
নীলা মুচকি হেসে বলে
-‘সেদিন হ্যাঁ বললে আজ হঠাৎ এত চমক পেতেন?’
বর্ণ মাথা নাড়িয়ে “না” জানালো।তারপর কিছু একটা ভেবে ভ্রু কুঁচকে বলল
-‘সেদিন ফুপির কথা শুনলেন।কিন্তু আজ কি এমন হলো যে বিয়ে করতেই চলে আসলেন?’
নীলা কিছু বলতে নিবে এর মাঝেই রেষ্টুরেন্ট দুজন প্রবেশ করলো।নীলা তাড়াতাড়ি মাথা নামিয়ে ফেলে জেনো তাকে তারা দেখতে না পারে।আর বর্ণ তো বিষ্ময়ে হা হয়ে আছে।এই দুজন একসাথে কেনো?
চলবে