অন্তরালে তোমার বসবাস,পর্বঃ-০১

0
3625

অন্তরালে তোমার বসবাস,পর্বঃ-০১
সাদিয়া_সৃষ্টি

–প্লিজ বুনু রাজি হয়ে যা।
–বুবু আমি কি করে ভাইকে বিয়ে করব? এটা সম্ভব নয়। উনি আমার দুলাভাই।
–দেখ আমার চলে যাওয়ার পর ওকে দেখে রাখার মতো কেউ থাকবে না। তুই একমাত্র ওর খেয়াল রাখতে পারিস। তাই না করিস না বুনু।
–তুই তো চলে যাচ্ছিস, তো আমার উপর ভাইকে চাপিয়ে দিয়ে যাচ্ছিস কেন বল?
–আমি জনই তুই জাহিনকে…
–দেখ বুব, সব অতীত ছিল। আর তুই কেন চলে যাচ্ছিস? অন্তত আমাকে বলে যা। আমি সব ঠিক করে দেব। ভাই এর সাথে কথা আমি বলব না হয়।
–সেটা আর সম্ভব না বুনু। আমার কাছে বেশি সময় নেই । আমাকে চলে যেতে হবে। তারপর আর তোদের সামনে আসতে পারব না। আর এই সময় একমাত্র তুই ওকে সামলাতে পারবি তোর উপর আমার এই বিশ্বাস আছে।
–কিন্তু বুনু তুই না গেলেই তো হয়। আমাকে এর মধ্যে টেনে আনছিস কেন? আমিই বা কি করব? আর তুই কোথায় যাবি বল না বুবু বল।
–আমি তোকে কিছু বলতে পারব না বুনু। আমাকে কথা দে তুই জাহিনকে বিয়ে করবি, কথা দে। আমার কাছে সময় নেই।
বলতে বলতে শ্রাবণী পিছনে চলে যেতে থাকল। শ্রুতি কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়ল, আর বলতে থাকল,
–যাস না বুবু, আমাকে ছেড়ে যাস না। আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারব না। আমি তো মরে যাবো বুবু। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাস না। আমি রাজি হয়ে যাবো তোর সব কথায়। কিন্তু তাও থেকে যা বুবু।
কিন্তু ধীরে ধীরে শ্রাবণী পেছাতে থাকল। শ্রুতির থেকে তার দুরুত্ব বারতে থাকল। আশেপাশে অন্ধকার ছাড়া কিছুই নেই। চারপাশে কালো দেওয়াল। সেই অন্ধকার ধীরে ধীরে শ্রাবণীকে ঢেকে দিচ্ছে। হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল সে।
.
–বুবু।
চিৎকার করে শোয়া থেকে উঠে বসল সে। ঘরে ফ্যান চলছে তবুও শ্রুতির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। পুরো শরীরে ভেজা ভেজা ভাব আছে বলে মনে হচ্ছে তার। আশেপাশে তাকাল। সে এখন নিজের রুমেই আছে। আর কেউ নেই সেখানে। তার মানে এতক্ষণ সব স্বপ্ন দেখছিল শ্রুতি । তার বুবু সত্যিই ফিরে আসে নি।
.
.
মিসেস মাহবুব ছুটে এলেন শ্রুতির রুমে। মুলত রান্না ঘরে ছিলেন তিনি। রান্না করছিলেন। মেয়ের চিৎকার শুনে হাত থেকে খুন্তি না রেখেই এক দৌড়ে ঘরে চলে আসেন। এসে শ্রুতির পাশে বসে তার কপালে হাত ঠেকিয়ে দেখতে থাকেন আর অস্থির কণ্ঠে বলে ওঠেন,
–তুই ঠিক আছিস তো বাচ্চা। তোর কি হয়েছে? চিৎকার করলি কেন?
মেয়ের দিকে আরেকটু নজর বলাতেই খেয়াল করলেন যে শ্রুতি ঘেমে গিয়েছে। মিসেস মাহবুব নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে শ্রুতির মুখ গলা মুছে দিতে থাকেন আর বলেন,
–তুই আজও ওকে দেখেছিলি স্বপ্নে ? তাই না?
শ্রুতি কোন উত্তর দিতে পারে না। শুধু কোনোমতে মাথা উপর নিচ নাড়ে। হয়তো মাকে এই কথা বলত না। কিন্তু মা আগে থেকেই সব জানেন। আর শ্রুতি কিছু লুকানর চেষ্টা করলেও সেটা মিসেস মাহবুব ধরে ফেলেন। তাই পরে আর কিছু লুকানোর চেষ্টা করে নি সে। সবই মাকে জানায়।
মিসেস মাহবুব পোড়া পোড়া গন্ধ পেয়ে আশেপাশে তাকায়।
–কি হল মা? কিছু খুঁজছ?
মিসেস মাহবুবের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে ওঠে শ্রুতি।
–পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি।
চিন্তিত হয়ে বলে ওঠেন উনি।
–মনে হয় চুলায় কিছু বসিয়ে চলে এসেছিলে।
–ওহ তাই তো। আমি যাই ।
বলে চলে যেতে থাকেন মিসেস মাহবুব। কি একটা ভেবে আবার দরজার কাছে এসে পিছনে ঘুরে তাকায় উনি। শ্রুতির দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন,
–আর এসব নিয়ে ভাবিস না। আজ তোর বিয়ে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে। সারাদিন অনেক ধকল যাবে।
শ্রুতি মুচকি হেসে মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। মাকে কোনোভাবেই এখন দুশ্চিন্তায় ফেলতে চায় না সে।
.
.
.
ঘর থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরের দিকে পা বাড়ান মিসেস মাহবুব। রান্না ঘরে গিয়ে দেখেন কি হয়েছে । সব সামাল দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন তিনি। বেশি পুড়ে যায় নি খাবার। তবে আরেকটু হলে পুড়ে যেত।
আবার মেয়ের কথা মাথায় আসতেই চোখে মুখে অন্ধকার নেমে আসে তার। তিনি জানেন যে শ্রুতির দেওয়া শেষ হাসিটি নকল ছিল। কিন্তু এতে কিছুই করার নেই তার। তারা বাধ্য এই বিয়ে দিতে। কথা দেওয়া যে হয়ে গিয়েছে। বিয়েটা হয়েই ছাড়বে।
বাড়িতে মানুষে ভরে আছে। চাইলেই এখন তিনি নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারবেন না। তাই নিজের দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন মিসেস মাহবুব।
.
.
.
শেষমেশ বিয়েটা হয়েই গেল। জাহিন এসেছিল বর হয়ে। আজ কিনা তার শালীকেই বিয়ে করতে হল। বাধ্য হয়েই। কিন্তু তার মধ্যে কোন অনুভূতি ছিল না। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে যেন একটা রোবট। অনুভূতি শূন্য প্রাণী।
কাজই কবুল বলতে বললে দেরি না করে সাধারণ ভাবেই কবুল বলে দেয়। শ্রুতির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। যারা যারা বিয়ে তে এসেছেন, তারাও অবাক যে এ কেমন বিয়ে? এখানে পরিবারের লোকই কোন আনন্দ করছে না। সবাই চুপ চাপ। যেন শোক দিবসের অনুষ্ঠানে এসেছে। সবাই বিয়ে দেখে খাওয়া দাওয়া করে চলে গেল। জাহিন ও শ্রুতিকে নিজের নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল। যাওয়ার আগে শ্রুতির চোখে পানি ছিল। কিন্তু সেটাকে সে পড়তে দেয় নি। শুধু জ্বলজ্বলে চখতাই সবাই দেখেছেন। মিস্টার আর মিসেস মাহবুব কিছু বলেন নি। কারণ তারা চায় না মেয়েটা আরও ভেঙে পড়ুক।
.
.
.
জাহিনের বাড়ি পৌঁছে শ্রুতিকে ঘরে নিয়ে আসলেন জাহিনের নানি মিসেস রায়মা রেজওয়ান আর তার ২ মামি , ২ মামা আর কাজিনরা। শ্রুতিকে জাহিনের রুমে বসিয়ে দেওয়া হল।
শ্রুতি আশেপাশে তাকিয়ে ভাবল, এই রুমের সাথে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আই রুমে ও আগেও এসছে। অনেক বার এসেছে। ওর বুবুর সাথে জাহিনের বিয়ের আগেও এসেছে। এই রুম ওর মুখস্ত এখন ওর। কিন্তু এভাবে এই রুমে আসতে চায় নি সে।
শ্রুতি ভাবতে থাকল আজ থেকে সে শ্রুতি মাহবুব থেকে মিসেস শ্রুতি জাহিন রেজওয়ান হয়ে গেল। কি সহজে না? কিন্তু ব্যাপার টা জাহিন বা শ্রুতি কারোর জন্যই সহজ ছিল না। নিজের দুলাভাইকে কি করে বিয়ে করল ও। ভাবতেই নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল।
.
.
.
অনেকসময় পর জাহিনকে ঠেলে ওর রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে গেল ওর কাজিনরা।
.
জাহিন রুমে ঢুকতেই শ্রুতি বিছানা থেকে উঠে তার কাছে গেল আর সালাম করল । তবে মুখে , পায়ে ছুঁয়ে না। তখন জাহিন বলে উঠল,
–দেখ শ্রুতি তোমাকে আমার কিছু বলার আছে।
তার মাঝেই শ্রুতি বলে উঠল,
–আগে আপনি বসুন, আর আমার কথা শুনুন। তারপর আপনার কথা বলবেন।
জাহিন শ্রুতির এ কথা শুনে বিছানা বরাবর রাখা সোফায় বসে পড়ল।
শ্রুতি জাহিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল,
–আমি জানি যে আপনি বিয়েটা নিজ ইচ্ছায় করেন নি। আপনার পরিবার জোর করে করিয়েছে। আর আমিও এই বিয়ে নিজ ইচ্ছায় করি নি। সো আমাদের মধ্যে দুরুত্ব বজায় রেখে চলবেন। বাড়ির মানুষগুলো বেশ কয়েকদিন থাকবেন। তাই সেই কয়দিন সবার সামনে নাটক করে চলতে হবে যে আমরা একে অপরের সাথে খুশি আছি। তারা যাতে সন্দেহ না করতে পারে। আর এক্কি ঘটনা ঘটবে আমার পরিবারের সামনেও। এই রুমের বাইরে কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না যে আমরা বিয়ে নিয়ে খুশি নই। কারণ তাদের জন্য যেহেতু বিয়েতে রাজি হয়েছেন, তাই তাদের খুশির জন্যই এটুকু করতে হবে। আমরা আমাদের মতো থাকব। এই রুমে থাকার সময় কেউ কাউকে নিয়ে চিন্তা করব না। আপনি মনে করবেন আপনি একাই এই রুমে আছেন। শ্রুতি নামের কারো অস্তিত্ব নেই এখানে। আমিও তাই মনে করব। আর কালই এই বয়েদ টা সরিয়ে এখানে ডাবল বেড আনার ব্যবস্থা করুন। যেটাকে আলাদা ভাবে রাখা যায়। আবার পপ্রয়োজনে একসাথে লাগিয়ে রাখলে কেউ বুঝতেও পারবে না যে এটা ২ টা সিঙ্গেল বেড। কারণ আমি বিছানা শেয়ার করে শুতে পারব না। আমাকে ভুল করেও আজ সোফায় বা বারান্দায় শুতে পাঠানোর কথা ভাববেন না।
–কিন্তু…
–আমার কথা এখনো শেষ হয় নি। আমার উপর স্বামীর অধিকার নয়ে কোন দাবি রাখবেন না। আর আমিও কোনোদিন স্ত্রীর অধিকার নিয়ে আপনার কাছে যাবো না।
.
.
.
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here