অন্তরালে_তোমার_বসবাস,পর্বঃ-০২,০৩

0
1950

অন্তরালে_তোমার_বসবাস,পর্বঃ-০২,০৩
সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ-০২

–আরে মিয়া করেন কি? সিগারেট টা ফেলেন। একে তো সহ্য করতে পারি না। এদিকে দেবদাস হয়ে বসে আছে। ঠিক আছে। আজ আপনি বিছানায় শুয়ে পড়ুন। কিছু বলব না। শেয়ার করে নিব। কিন্তু প্লিজ এই দেবদাস গিরি বন্ধ করুন। আই হেইট দিস থিং।
যেন এই কথার অপেক্ষাতেই ছিল জাহিন। শেষ হতেই দ্রুত পদে ঘরে ঢুকে বিছানায় উঠে এক কোণে শুয়ে পড়ল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তলিয়ে গেল ঘুমের রাজ্যে। এদিকে জাহিনের সাথে এক বিছানায় শুতে চায় নি শ্রুতি। কিন্তু কি আর করার। কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে করতে থাকল।
_____________________
–আমার কথা এখনো শেষ হয় নি। আমার উপর স্বামীর অধিকার নয়ে কোন দাবি রাখবেন না। আর আমিও কোনোদিন স্ত্রীর অধিকার নিয়ে আপনার কাছে যাবো না।
–আমি তো…
–আমার কথা এখনো শেষ হয় নি। আমাকে শেষ করতে দিন।
বলেই জাহিনের দিকে তাকাল শ্রুতি। জাহিন ও মাথা নাড়িয়ে ওকে বলতে বলল।
–আমি চাকরি করব। এতে আপনি না করতে পারবেন না। আমি কারো বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। আর এই কথা টা সবসময় মনে রাখবেন যে আমি আপনাকে আমার ভাই এর নজরে দেখি। তাই ভুলেও আমার কাছে আসবেন না। মাইন্ড ইট , ভুলেও না। দুনিয়া উল্টে গেলেও না। অন্য দের সামনে যেটুকু দরকার তার বাইরে একদমই না। আরও কিছু থাকলে সময় মতো আমি ই বলে দিব। এখন আপনি শুয়ে পড়ুন। আর হ্যাঁ। আমাকে সোফায় বা বারান্দায় পাঠানোর কথা মাথায় আনবেন না। নিজে সোফায় শোন অথবা বারান্দায় চলে যান। বিছানা থেকে বালিশ নিয়ে। আমার অনেক ধকল গিয়েছে। আমি রেস্ট নিব। আমি আগেই বলে দিচ্ছি, আমি বেড শেয়ার করতে পারব না। সো ইউ ক্যান গো নাউ। গুড নাইট।
জাহিন এতক্ষণ শ্রুতির সব কথা শুনছিল আর ভাবছিল,
–কি মেয়ে রে বাবা ! আগে তো দেখে কখনো এমন মনে হয় নি। শান্ত ই তো ছিল। আজ যেই কথা গুলো আমি বলতে আসছিলাম, আমার আগে সব কথা আমাকেই উল্টো শুনিয়ে দিল। তোমার জন্য এখন তালি বাজাতে ইচ্ছা করছে আমার। কিন্তু বাজাবো না।
কিন্তু শেষ এর দিকের কথা গুলো শুনে ভাবল,
–হোয়াট? আমার রুমে আমাকেই বলছে বেডে শুতে দেবে না? এতো বেশি সাহস দেখাচ্ছে কেন? একে ছাড় দেওয়া যাবে না। না হলে মাথায় উঠে নাচবে।
যেই ভাবা সেই কাজ। জাহিন রাগী স্বরেই বলে উঠল,
–কি পেয়েছ হ্যাঁ? তোমার সব কথা আমি এমনি নিজেই বলতাম। তার আগে তুমি বলে আমার কষ্ট কমিয়ে দিলে ভালো কথা। কিন্তু এখন এসব বলে কি প্রমাণ করতে চাইছ? আমি তোমার সুযোগ নিব? ইমপসিবল। তোমার দিকে আমি ফিরেও তাকাব না। আর এটা আমার রুম , সো কাইন্ডলি এখান থেকে তুমি বের হয়ে গেলে আমি খুশি হব। আমার রুম থেকে আমি বের হতে যাব কেন? আমি এখানে শুব আর এই বিছানায়। চাইলে তুমি বালিশ নিয়ে চলে যেতে পারো , যেখানে ইচ্ছে হয়। এই বাড়িটা অতোও ছোট না। তাই লিভ নাউ।
শ্রুতি ওর কোন কথাকে পাত্তা না দিয়ে নিজে বিছানায় শুয়ে পড়ল আর বলল,
–গুড নাইট।
–গুড নাইট মানে কি?
–শুভ রাত্রি।
শ্রুতির সোজা সাপ্টা উত্তর। এটা জাহিন কে থামানোর বদলে ওর রাগের আগুনে ঘি ঢালার কাজ করল।
.
জাহিন রেগে গিয়ে সোফার পাশের টেবিল টা হতে লোহার ভারী ফুলদানি টা হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলল বারান্দার দিকে। বারান্দা টা ঘরের সাথেই ছিল তবে সেখানে ইটের দেওয়াল ছিল না। তার বদলে দেওয়াল টা ছিল কাঁচের। ফলাফল ভাঙ্গা কাঁচ। পুরো না ভাঙলেও যেই জায়গা টুকুতে লেগেছে সেখান থেকে ভেঙেছে।
.
তারপর জাহিন তেঁতে উঠে বলল,
–মানে কি? আমি জানতে চাইছি এখানে শুয়ে পড়লে কেন? অন্য রুমে যাও।
–আমি এখান থেকে যাচ্ছি না। আর আপনিও এই রুম থেকে বের হবেন না ।
–কেন?
–বিয়ে করার আগে জানতেন না এমন হবে? এখন রুম থেকে কেউ বের হই আর ওদের মধ্যে কেউ দেখতে স্টার জলসার সিরিয়াল শুরু হয়ে যাবে। আমি অতো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চাই না। তাই চুপচাপ সোফায় শুয়ে পড়ুন। কোন কথা না বলে। এমনিই কোণ গেস্ট আসে নি। তাদের সামনে কোন সিনক্রিয়েট করবেন না। আর পারলে সবার চোখের আড়ালে কাল ডাবল বেডের ব্যবস্থা করে ফেলুন। আপনি চাইলে এ কাজে আপনাকে হেল্প করতে পারি। এর বেশি কিছু না। আপাতত ঘুমাতে দিন।
বলেই বাম হাতের পিঠ মুখে ধরে হাই তুলল শ্রুতি।
.
রাগ হচ্ছে এখন তার নানুর উপর। কেন এই মেয়েকে পছন্দ করেছিলেন উনি। শ্রুতির দিকে অর্থহীন চোখে কিছুক্ষ ন তাকিয়ে থেকে বেড সাইড টেবিল এর ড্রয়ার থেকে সিগারেট এর প্যাকেট আর লাইটার নিয়ে বারান্দায় চলে গেল। সিগারেট টা জ্বালিয়ে বারান্দার দরজা ভিড়িয়ে দিল। তারপর তার ধোঁয়া নিজের দেহে চালান করল।
.
কিন্তু কাঁচের দেওয়াল টা ভেঙে যাওয়ায় সেখান থেকে সিগারেটের ধোঁয়া ঘরের ভিতর প্রবেশ করছিল। এতেই শ্রুতির মাথা গরম হয়ে যায়। আর যাই হোক না কেন, এই সিগারেটের ধোঁয়া সে সহ্য করতে পারে না। এটা প্রচণ্ড বিরক্তি কর। আর তার বর মানে এক্সিডেন্টলি হওয়া বর এটাই কি আনন্দের সাথে গিলছে। এটা জানলে জীবনে ও বিয়ে করত না। কিন্তু জাহিন সিগারেট কবে থেকে ব্যবহার করতে শুরু করেছে?
.
আপাতত এসব জানার কোন সুযোগ বা পরিস্থিতি কিছুই নেই। তাই অজথা প্রশ্ন না করে সেটা ফেলে দিতে বলেছিল। কিন্তু জাহিন শুনে নি। নিজ জেড নিয়ে বসে ছিল। কিন্তু সময় যত বাড়ছিল, শ্রুতির ততই কষ্ট হচ্ছিল। তাই জাহিনকে বেড শেয়ার করার অনুমতি দেয় সে। আর জাহিন ওকে অবাক করে সাথে সাথেই বিছানায় শুয়ে পড়ে। শ্রুতি ভেবেছিল আরও ঝগড়া করবে। কিন্তু তা হয় নি। শ্রুতি মুচকি হাসল। বেচারা অনেক ক্লান্ত মনে হয়। তবুও কি সুন্দর ঝগড়া করছিল। আমার নিজের হাসি সাথে সাথেই হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। এই হাসি তার জন্য নয়।
_____________________
সকালে ঘুম থেকে উঠে জাহিন নিজেকে যে অবস্থায় পেল, সেটা সে অবশ্যই আশা করে নি। অন্তত এ সময় তো একদম ই না। কিন্তু অজান্তেই হয়ে গিয়েছে।জাহিন দেখল সে শ্রুতির বুখে মাথা রেখে শুয়ে আছে। মুখ উঁচু করে বুঝল শ্রুতি এখনো ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ ওর মনে হল কাল রাতে অনেক শান্তির ঘুম ঘুমিয়েছে ও। এই অনুভূতি ওর আগেও হয়েছিল। কিন্তু কবে? কোথায়? মনে করতে পারছে না জাহিন। হঠাৎ ওর চোখ আটকে যায় শ্রুতির ঠোঁট জোড়ায়। হালকা কেপে কেঁপে উঠছে ওষ্ঠ অধর উভয়ই। নিজের আগের চিন্তা ভুলে সে দিকেই চেয়ে থাকল সে। কিছু সময় এভাবেই থাকার পর তার মনে হল যে এটা ঠিক নয়। একদমই না।
.
তাই নিজে সেখান থেকে উঠার চেষ্টা করতে যায়। কিন্তু নরতেই দেখে শ্রুতি চোখ খুলছে। তাই ঝটপট চোখ বুঝে ফেলে জাহিন। আবার আগের মতো শুয়ে পড়ে। সে এখন সরে অন্য দিকেও যেতে পারবে না। কারণ সে ভুলে শ্রুতিকে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছিল, আর হাত দুটো এখন শ্রুতির পিঠের নিচে আটকে আছে। চোখ বুঝে নিজেই নিজেকে গালি দেওয়ার মতো মহান কাজে লেগে পড়ে জাহিন।
.
শ্রুতি চোখ পিটপিট করে পুরোটাই খুলে ফেলে। ডান হাত দিয়ে চোখ মুছতে থাকে। যাতে ঘুম ঘুম ভাব টা চলে যায়। কিন্তু হঠাৎ মনে হল বুকের উপর ভারী কিছু আছে। কাল রাতের জন্য জাহিন তাহলে ওর উপর কোন ভারী জিনিস তুলে দিয়েছে না কি?
.
ভাবতে ভাবতে সে দিকে তাকায় শ্রুতি । জাহিন কে নিজের বুকের উপর শুয়ে থাকতে দেখে তার চোখের আকার বড় হতে শুরু করেছে। দাগর দাগর চোখ এর মাধ্যমে তার বিস্ময় প্রকাশ করছে সে যেন।
.
একটু পর নিজেই ভেংচি কেটে বলতে শুরু করল,
–ইশ, ঢং কত? আমি তোমার কাছে স্বামীর অধিকার নিয়ে যাব না। (একটু টেনে টেনে) হুহ আর দেখো, প্রথম রাতেই একেবারে বুকের উপর উঠে বসে আছে। কোথায় আমি মাসুম, সিধা সাধা বাচ্চা, আর কোথায় এই ১০০ কেজির ডালের বস্তা। এখন থেকে আপনাকে এই নামেই ডাকব। হুহ। এখনো সরে না কেন? ঘুমের মধ্যে একটু নরতেও তো পারে। নাকি স্ট্যাচু হয়ে থাকবে। ইশ আজ আমার এক্স রে করাতে হবে। কে জানে কয় টা হাড় ভাঙল।
দেখল জাহিন একটু নড়ে উঠছে। সাথে সাথে শ্রুতি উঠে পড়ে। আর সোফা থেকে একটা কুশন নিয়ে ঘুমন্ত জাহিনের দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল,
–আজ যদি বেডের ব্যবস্থা না করেন তাহলে আপনাকে আপনাকে কি যে করব, হ্যাঁ নানুর রুমে পাঠিয়ে দেব। ওখানে থাকবেন। যে যা বলার বলুক। হুহ…
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বাথরুমে ঢুকে পড়ল।
.
.
তখন শ্রুতিকে বাথরুমে ঢুকতে দেখে সাথে সাথে জাহিন উঠে পড়ে। তাকে কি না ১০০ কেজির বস্তা বলল? এতো বড় অপমান? তার উপর বকছিল।
.
ওর ভাবনার মাঝেই বাথরুমের দরজা খোলার সব্ধ পেল সে। সাথে সাথেই আবার আগের অবস্থান নিল সে। শুয়ে পড়ে ঠিকই কিন্তু কান খোল রাখে। না জানি আবার কি বলে। বেশি কিছু বললে কাউন্টার এট্যাক তো দিতে হবে।
.
শ্রুতি আলমারি থেকে একটা শাড়ি নিয়ে আবার বাথরুমে চলে গেল। এটা নিতে ভুলে গিয়েছিল সে। জাহিন আবার উঠে বসল। আর মনে মনে শ্রুতিকে কথা শোনাতে লাগল। সামনাসামনি বললে আবার লঙ্কা কাণ্ড বাঁধাবে মেয়েটা। বিশ্বাস নেই। তবে ওর মনে আবার ভর করল প্রথম ভাবনা টা। কেন তখন অমন অনুভব হল তার। কেন মনে হল যে আজ রাতে তার শান্তির ঘুম হয়েছে। আগেও সে এমন টা অনুভব করেছে? যদি করেই থাকে, তাহলে মনে করতে পারছে না কেন।
.
.
কানে আবার বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ পেল সে। সামনে তাকাতেই চোখ আটকে গেল তার।
.
শ্রুতি বাথরুম থেকে বের হয়ে বিছানার দিকে তাকায় নি। তাই সে এখনো জানে না যে জাহিন ঘুম থেকে উঠেছে আর তার দকেই তাকিয়ে আছে। সে তার ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে মুছছে আর ঘরের এদিকটায় চোখ বুলাচ্ছে। এই ঘরের সম্পূর্ণ টা ওর মুখস্ত। এই ঘর সে তার নিজের হাতে সাজিয়েছিল। জাহিনের সাথে শ্রাবণীর বাসর উপলক্ষ্যে। ভাবতে চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
.
.
রুমটা বাড়ির দোতলায় একেবারে কোণায়। বাড়িটা ডুপ্লেক্স। তবে বেশ সুন্দর। সাজ দেখেই বোঝা যায় যে যে সাজিয়েছে সে অনেক শৌখিন। এটা নিঃসন্দেহে জাহিন ই । কারণ ওর বাবা মায়ের সাথে ও থাকে না। এই ডুপ্লেক্স বাড়িতে সে একাই থাকে। বিয়ের জন্য নানি আর বাকিরা এসেছিল।
.
এই বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর রুমটা জাহিনের। রুমটা বেশ বড়। রুমের দরজা দিয়ে ঢুকলেই নজরে পড়বে মাঝ বরাবর রাখা খাট টি । সেই খাট বরাবর রয়েছে একটি সোফা যেটি অপর প্রান্তের দেওয়াল ঘেঁষে। বেশ সুন্দর করে ঘর সাজানো। শো পিছ আর ঝাড়বাতি ঘরটির সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। ঘরের এক প্রান্তে রয়েছে বুকশেলফ যেখানে শখানেক বই রয়েছে। এই বাড়িতে আলাদা রুমে বই রাখার ব্যবস্থা আছে। সেটাকে ছোটখাটো লাইব্রেরি বলা চলে। তবুও জাহিন নিজের রুমে আলাদাভাবে বই রাখার ব্যবস্থা করেছে। রুমের সাথে বারান্দা রয়েছে। বারান্দা দিয়ে সামনের দিকে তাকালে দেখা যাবে গাছগাছালির সমাহার। এগুলোর পরিচর্যা করার জন্য আলাদা লোক রাখা হয়েছে। তবে সময় পেলে জাহিন নিজেই এই কাজ করে থাকে। রা রয়েছে একটা সুইমিং পুল।
.
.
শ্রুতি নিজের চুল মুছে তোয়ালে বারান্দায় মেলে দিল আর সেদিকে থেকে সুইমিং পুলের দিকে তাকিয়ে থাকল। চোখ নাড়িয়ে পাশের বাগানটাও দেখে নিচ্ছে সে।
.
.
কিন্তু এদিক এ জাহিনের হয়েছে বেহাল দশা। তার শ্বাস প্রশ্বাস অনবরত বাড়ছে। শ্রুতিকে এতক্ষণ সে পিছন থেকেই দেখেছে। কিন্তু এই দৃশ্যই তার কাছে মোহনীয় লাগছে। ভেজা চুল গুলোর জন্য পিঠ টা সম্পূর্ণই ভিজে গিয়েছে। ছুল যখন ঝাড়ছিল তখন পানি গুলো ছিটকে পড়ছিল চারপাশে। আর ওর উপর এসে পড়ছিল সূর্যের আলো। এতেই অপূর্ব লাগছিল তার কাছে। হঠাৎ শ্রুতিকে বারান্দায় যেতে দেখে সে নিজেও বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আর পিছু পিছু যেতে থাকে। কিন্তু পথিমধ্যে মনে পড়ে
–এটা সে কি করছে?
তাই নিজেকে সামলে বাথরুমে ঢুকে পড়ে ফ্রেশ হতে।

চলবে।

#অন্তরালে_তোমার_বসবাস
#সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ-০৩

–আপনি আমার দুলাভাই, দুলাভাইয়ের মতো থাকবেন।
–আর তুমিও আমার শালিকা , শালিকার মতো থাকবেন।
–আমি যদি আর ৫ টা সালিকার মতো থাকি না, তাহলে আপনিই বলবেন যে আমি আপনার মগজ চিবিয়ে খাচ্ছি।
–হোয়াটএভার।
.
.
.
কিছুক্ষণ আগে,
সাধারণত জাহিন ওয়াসরুমে জামা কাপড় নিয়ে ঢোকে না। তোয়ালে পরেই বেরিয়ে আসে। সেভাবে আজও এসেছিল। কিন্তু পার্থক্য এই যে আজ সেই ঘরে শ্রুতিও ছিল। শ্রুতি জাহিন কে এই অবস্থায় দেখে মুখে এক হাত চেপে ধরেই জোরে চিৎকার করে ওঠে। ফো স্বরুপ কেউ শুনতে না পারলেও জাহিন পেরে ছিল। তাই সেদিকে তাকাতেই শ্রুতিকে দেখতে পায়। তারপর নিজের দিকে তাকাতেই লজ্জা পেয়ে যায়। আলমারি থেকে দ্রুত একটা টিশার্ট আর একটা ট্রাউজার বের করে সেটা নিয়ে বাথরুমে চলে যায়।
.
বের হয়ে শ্রুতিকে কথা শোনানো শুরু করে। যার ফলে প্রতিবাদী শ্রুতি গর্জে ওঠে আর উপরের কথা গুলো শুনিয়ে দেয়। জাহিন ও রাগে গজগজ করতে করতে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
.
.
.
জাহিনের নানু বাড়ি ভারতে। তাই নানুর আচার আচরণে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে। সেটা শ্রুতি বেশ ভালভাবেই জানে। বেশ কয়েক বছর ধরেই চেনে তারা একে অপরকে। বিশেষ করে জাহিনের কাজিন দের সাথে শ্রুতির বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। বড় মামির জমজ ২ মেয়ে। ইউসরা আর রাদিয়া। ছোট মামার ২ ছেলে , এক মেয়ে। বড় ছেলে শুভ, মেজ ছেলে কাব্য, আর মেয়েটা ছোট নাম লামিয়া। মামা মামিরা নানুর সাথেই ভারতেই থাকেন। সাথে কাজিন রাও। তবে ছুটিতে পুরো পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসে ছিলেন আর নানু তো শপথ করে এসেছিলেন যে এই বার জাহিনের বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। তাই শ্রুতির সাথে এই বিয়ে ঠিক করে এবং সফল ও হয়। কিন্তু তারা জানেন না যে শ্রুতির বড় বোন শ্রাবণীর সাথে জাহিনের বিয়ে হয়েছে। শ্রাবণী তো চলে গিয়েছে। বিয়েটা নিজেদের মধ্যে হওয়ায় আর কেউ জানে না। অবশ্য সেটা নিজেদের মধ্যে বলা ঠিক না। হঠাৎ করেই হয়েছিল।
.
জাহিন এর নানু ভারতীয় হওয়ায় ওদের পরিবারে বিয়ের পর মুখ দেখানোর একটি প্রথা আছে। সেটাই পালন করতে আজ নানু শ্রুতিকে একটি শাড়ি ধরিয়ে দিয়েছে।
.
.
শ্রুতি সেই শাড়ি নিজের রুমে রেখে আগে সবার জন্য ব্রেকফাস্ট বানিয়ে নেয়। তারপর একসাথে নাস্তা করে তখন জাহিন নেমে ছিল ঠিকই কিন্তু নাস্তা করতে নয়। ওর জন্য নাস্তা সব সময় ওর রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ও কাজ করতে করতে নাস্তা কোনোমতে করতে থাকে। আজ এর ব্যতিক্রম হয়েছে দেখে নানুর মনে মনে অনেক খুশি। কিন্তু সেটা প্রকাশ করেন নি। এদিকে জাহিনকে খেতে বসাতে শ্রুতি একটি সহজ পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল। সোজা গিয়ে সবার আড়ালে জাহিনের হাতে চিমটি বসিয়ে দেয় আর বলে,
–এখন যদি খেতে না বসেন তাহলে আপনাকে চিমটি দিয়ে দিয়ে চিমটি দিয়ে দিয়ে একেবারে ক্ষত বিক্ষত করে দিব। আর আমি আমার কথা করে দেখাই। আই হোপ বুঝতে পেরেছেন?
জাহিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে হেসে হেসে এমন আক্রমণাত্মক বার্তা প্রেরন করায় সে এদিক ওদিক না তাকিয়ে সোজা টেবিলে বসে যায়। শ্রুতি আলাদা ভাবেই বসতে চেয়েছিল কিন্তু নানু জোর করে ওকে জাহিনের পাশে বসিয়ে দেয়।
.
নাস্তা শেষে শ্রুতি জাহিনের পাশে পাশে হেঁটে নিজে র রুমে প্রবেশ করে। রুমে গিয়ে বিছানায় বসে পড়ে আর শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজেকে বাতাস করতে থাকে। এটা দেখে জাহিন বলে উঠে,
–এতো যখন কষ্ট হচ্ছে তখন রান্না করতে গেলে কেন?
–শুনুন আমার কষ্ট রান্না করে হয় নি। হয়েছে আপনার সাথে অভিনয় করে । আর রান্না করা আমার রোজকার অভ্যাস । এটা কে আপনার জন্য বদলাতে পারব না। এমনিই রান্না করে নিজের রুমে ঢুকে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকা হয়। কিন্তু এখানে একেবারে খেয়েই উঠতে হল। আমি তো চলে আসতাম। নানু যে কেন জোর করল?
–তাহলে আর রান্না করার দরকার নেই।
–বলেছিলাম কি? আমি আপনার জন্য আমার অভ্যাস বদলাতে পারব না। এক কাজ করুন। আমার সাথে উপরে উঠে সোজা বেলকনিতে চলে যাবেন আর আমি না বলা পর্যন্ত বের হবেন না।
–ওকে।
–তো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চলে যান।
–হুহ…
জাহিন বেলকনির দিকে পা বাড়াল।
–আর শুনুন রান্না কেমন হয়েছিল?
–আমার কাছ থেকে এসব এক্সপেক্ট করো না।
–আরে আরে ভাই, আপনি কি ভাবছেন? আমি তো শুধু বলছিলাম যে খারাপ হয় নি তো? সবাই খেলো, আপনি খান না খান তাতে আমার কি?
এই কথায় কেন জানি জাহিনের মন খারাপ হল তাও বলল,
–খারাপ না। ভালো।
–ওকে তাহলে এবার যান।
জাহিন বেলকনিতে চলে গেল।
.
.
অনেক সময় কাটানোর পর মন ভালো হলেও অবাক লাগছে যে শ্রুতি এখনো তাকে ডাকে নি কেন? এতক্ষণ বাইরে থাকতে হবে জানলে ল্যাপটপ নিয়ে যেত সে। আর বেশি না ভেবেই রুমে ঢুকে পড়ল জাহিন।
.
কিন্তু আবার জাহিনের বেহায়া চোখ শ্রুতিতে আটকে গেল।
.
মেয়েটার কি নিজের দিকে কোন খেয়াল নেই?
.
.
শ্রুতি বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল। ফ্যান ফুল স্পিডে চলছে। এতে করে শ্রুতির কোমর থেকে শাড়ি সরে গিয়ে ছে। জাহিন নিজেকে বকতে বকতে সেখান থেকে চলে যেতে গেল। কিন্তু তাও থেমে শ্রুতিকে ডাকল,
–শ্রুতি?
— (নিশ্চুপ)
–শ্রুতি?
–হ্যাঁ?
ধড়ফড়িয়ে উঠল শ্রুতি।
–কি হয়েছে?
–সেটা তো আমার জিজ্ঞেস করা উচিত। তোমার কি হয়েছে?
–তেমন কিছু না। শুধু ওই একটু মাথা ব্যথা করছিল। শুয়ে থাকলে সেরে যাবে। ওহ আমি তো আপনার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আপনি তো এখন কফি খেতেন। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
বলে শ্রুতি উঠে পড়ল।
–কোথায় যাচ্ছ?
–আপনার কফি পাঠাতে। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি আর পাশের রুমে আছি। কিছু লাগলে বলবেন।
–দরকার নেই। আমার লাগবে না।
–কি বলছেন লাগবে না। আমি মনে হয় জানি না যে এই সময় কফি না খেলে আপনার মাথায় কি পরিমাণ যন্ত্রণা হয়?
–সমস্যা নেই আমি নিজে যাচ্ছি। তোমার উঠতে হবে না। তুমি এখানেই শুয়ে রেস্ট করো।
–কিন্তু…
আর বলার সুযোগ দিল না শ্রুতিকে। তার আগেই অকে ধরে বিছানায় পুনরায় সুইয়ে দিল জাহিন। তারপর বের হয়ে গেল। শ্রুতিও চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকল। সত্যিই বড্ড খারাপ লাআগছে তার। সে এতো সব কিছু সামলাতে পারবে তো? না কি তার আগেই … ?
.
.
.
অনেকক্ষণ পর লামিয়া আর রাদিয়া শ্রুতিকে ডাকতে আসে। এসে দেখে শ্রুতি ঘুমিয়ে আছে। ওকে ডেকে তোলে।
–ভাবি এখন ঘুমাচ্ছ? দাদি সেই কখন তোমাকে শাড়ি পরে নিচে আসতে বলেছে।
–ওহ হ্যাঁ। ভুলেই গিয়েছিলাম।
–তোমার কি খারাপ লাগছে? তোমার কথা এমন শোনাচ্ছে কেন?
–তুমি চাইলে আমরা দাদিকে আর এসব করতে বারণ করে দেব। দাদি না বলবে না।
— সমস্যা নেই। আমি পারব। তোমরা শুধু আমাকে সাজিয়ে দিও। এসব সাজ গোঁজ আমার দ্বারা হয় না।
–ঠিক আছে ভাবি।
রাদিয়া আর লামিয়া সেখানে বসে অপেক্ষা করতে থাকল আর শ্রুতি শাড়ি নিয়ে ওয়াস রুমে চলে গেল। হাত মুখ ধুয়ে শাড়ি বদলে নিল সে।
.
বেরিয়ে এসে দেখে ওরা বসে আছে। আর ইউসরাও চলে এসেছে। ওরা ৩ জন মিলে হালকা সাজিয়ে দিল শ্রুতিকে। তারপর ওকে নিয়ে নিচে গেল।
.
.
.
সবার সব অনুষ্ঠান শেষে শ্রুতিকে বেশ পছন্দ হয়েছে সবার। তারপর শ্রুতিকে নিজের রুমে যেতে বললেন নানু। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে পড়ে যেতে গেল শ্রুতি ।
.
তবে তার আগেই শুভ এসে ওকে ধরে ফেলল।
–আর ইউ ওকে শ্রুতি?
–হ্যাঁ আমি ঠিক আছি?
–তোমাকে তো অসুস্থ লাগছে।
–না না শুভ আমি ঠিক আছি।
[শুভ আর শ্রুতি একই বয়সী হওয়ায় ওরা একে অপরকে তুমি করে ডাকে]
এদিকে জাহিন এর আশপাশ থেকে পোড়া পোড়া গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। জাহিন ও নিচেই ছিল। কিন্তু সোফায় বসে বসে যখন শুভ আর শ্রুতিকে এক সাথে দেখল তখন ওর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল। তার উপর জখ কথা বলা শুরু করল, জাহিন এর সেই রাগ আরও বেড়ে গেল। কেন রাগ হল? জানা নেই জাহিনের। কিন্তু এখন সে জানতেও চায় না। কেন শ্রুতি অন্যকে ধরবে? দরকার হলে ওকে ধরবে। কিন্তু অন্য কে কেন?
–তোমাকে কি ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যাবো?
–এত কিছুর সত্যিই দরকার নেই। আমি এখন রুমে গিয়ে রেস্ট নিচ্ছি। আজ তো আবার বৌভাত আছে। তখন বাবা মাও আসবে। ওদের জন্য এক্সাইট্মেন্ট থেকেই পা পিছলে গিয়েছে। তাই আর কি?
–ওকে তুমি রেস্ট নেও।
–হুম আমি যাচ্ছি।
বলে শ্রুতি আবার উপর উঠতে শুরু করল। জাহিন নিজের ল্যাপটপ অফ করে সেটা নিয়ে শ্রুতির পিছু পিছু গেল। আজ সকাল থেকেই এমন লাগছে শ্রুতিকে । আবার যদি সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যায়? সেই ভেবেই গেল জাহিন।
.
আর ওর ভাবনাই সঠিক ছিল। শ্রুতি আবার পড়তে গেলে জাহিন অকে ধরে ফেলে। তারপর ওকে ধরে ধরেই রুমে নিয়ে যায়। আর সোজা সুইয়ে দেয় ওকে। রেস্ট নিতে বলে চলে যায়।
.
.
শ্রুতি চোখ বুজে রেস্ট নিচ্ছিল। জাহিন রুমে আবার এসে ভাবে যে শ্রুতি ঘুমিয়ে পড়েছে। কিছু না ভেবেই ওর মাহায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। ওর ইচ্ছে হল তাই এমনটা করল। কিন্তু কেন ইচ্ছে হল, সে জানে না।
.
শ্রুতি নিজের মাথায় হাতের ছোঁয়া পেয়ে বুঝে যায় যে এটা কে? ওর চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। যা জাহিনের চোখের আড়াল না হলেও ও এখন শ্রুতিকে ঘুম থেকে তুলতে চায় না।

চলবে।

[ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here