অন্তরালে_তোমার_বসবাস,পর্বঃ-০৪,০৫
সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ-০৪
নানু আর মামিরা জাহিনকে জোর করছে যেন সে শ্রুতির সাথে ওদের বাড়ি গিয়ে থেকে আসে। কিন্তু জাহিন মানতে চাইছে না। তার এক কথা। ‘ দরকার হলে শ্রুতি একাই গিয়ে ওই বাড়ি থেকে ঘুরে আসুক। ‘ কিন্তু তাও সে যাবে না। ও বাড়িতে গেলে শ্রাবণীর স্মৃতি তারা করে বেরাবে। আগের বার যখন শ্রাবণীর সাথে গিয়ে ছিল তখন কত খুশি ছিল সে। কিন্তু এখন আবার সেই বাড়িতে যেতে হবে । তাও কার সাথে? শ্রাবণীর ছোট বোনের সাথে। তার উপর এখন সে শ্রুতির স্বামী। নিজেকে ওখানে মানাতে পারবে না জাহিন।
.
অনেক বুঝিয়েও জাহিনকে রাজি করাতে পারল না কেউ। তবে ওদের না যাওয়াতে কাজিন রা বেশ খুশি। তারা কয় দিন ই বা থাকবে এখানে? পরে সময় শেষ হলে তো আবার বাড়ি ফিরে যেতে হবে। আবার চাইলেই এসে দেখা করতে পারবে না জাহিনের সাথে, নতুন ভাবির সাথে। শ্রাবণীর ব্যাপার না জানায় ওরা ভাবে যে এটাই ওর ভাই এর প্রথম বিয়ে। তাই ওরা এতোটা স্বাভাবিক আচরণ করছে। নাহলে বাড়ির পরিবেশ এমন হওয়ার কথা ছিল না। হয় তো এতো হাসিখুশি পরিবেশ দেখতে পারতো না ওরা। না নিজেদের স্বাভাবিক রাখতে পারতো। ওর সারাটা দিন ই মেতে আছে শ্রুতিকে নিয়ে। তার উপর আজ শ্রুতির বৌভাত। সেই নিয়ে নানান আয়োজন।
.
বিকালে অনুষ্ঠান হয় ঠিকই কিন্তু ওদের সাথে শ্রুতি ফেরত যায় নি। এমন টা হওয়ার কথা ছিল কিন্তু ওদের বিয়ে টা তো আর পাঁচ টা বিয়ের মতো স্বাভাবিক না। এই ভেবেই শ্রুতির পরিবার নিজেদের সান্ত্বনা দেয়। তবে এর মাঝে দেখা যায় এক ভিন্ন দৃশ্য।
.
শ্রুতির খালাতো বোন কেয়ার সাথে কাব্যের মেলামেশা। বিয়ের শুরু থেকেই ওরা একে অপরের সাথে পড়ে আছে। সেখানেই যাওয়া হয়, দু জনকে একসাথে পাওয়া যায়। যেন বেস্ট ফ্রেন্ড ওরা। কিন্তু সেটা একদমই ঠিক না। দূর থেকে যদি দেখা হয় তাহলে সবাই মনে করবে। ওরা কি সুন্দর হেসে হেসে একে অপরের সাথে কথা বলছে ! ওদের কথোপকথন দেখেই মানুষের মন ভোরে যায়। কথার মাঝে হেসে হেসেই একে অপরের হাতে হালকা বাড়ি মারছে। লামিয়া ও নিজেও তাই ভেবেছিল। কিন্তু ওদের কাছে গিয়ে যা শুনল তাতে ওর বিশ্বাস হল না যে ও নিজে এতক্ষণ কি দেখেছে।
–আপনি এখনো বেঁচে আছেন?
–কেন কেয়া? আমি মরে গেলে খুশি হতে? তবে আমি ভাবছি তুমি এখনো বেঁচে আছো?
–না, আমি তো ভাবছিলাম যে আপনি হয় তো নিজের দেশে চলে গিয়েছেন। কম তো জ্বালান নি আমাকে। বিয়েটাও ঠিক মতো উপভোগ করতে পারলাম না আপনার জন্য।
–তো আমি কি করব? তুমিই তো রোজ ঝগড়া করতে চলে আসো।
–শোনেন এটা আমার বোনের বিয়ে , আমি আসতেই পারি।
–তাহলে এটা আমার ভাই এর বিয়ে। আমিও আসতে পারি।
–ব্লেন্ডার চিনেন?
–হুম চিনি। কিন্তু কেন?
–ওটা তে আপনাকে রেখে আদা পেয়াজ দিয়ে জুস বানাতে ইচ্ছে করছে আমার।
–কেন কিছু দিন আগের ইচ্ছে পূরণ করবে না?
–কি বলছেন?
–হলুদের দিন তো বললে যে আমাকে শিল পাটায় বাটবে। এখন প্ল্যানিং চেঞ্জ করে ফেললে।
–সমস্যা নেই। প্রথমে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করব। তারপর আপনাকে শিল পাটায় বাটব। এতে করে আমার ক্লান্তি কমে যাবে। কষ্ট কম হবে।
–আমি আমার দেশে থাকলে এতক্ষণে তুম বেঁচে থাকতে না।
–কেন? কি করতেন আপনি কাব্য?
–তোমাকে গান পয়েন্টে রেখে শুট করে দিতাম।
–আপনি কি বাচ্চা?
–বাচ্চা কেন হব?
–তাহলে আমাকে খেলনা পিস্তল দিয়ে গুলি মারার কথা বলছেন যে?
–ওহ। ওটা খেলনা নয়। আসল। বেশ কয়েক জনকে মারতে হয়েছে ওটা দিয়ে।
–তার মানে আপনি খুনি?
–এটা মনে হওয়ার কারণ?
–আপনি মানুষ মেরেছেন যে।
–মারলেই খুনি হয়ে যায় না কি? ওদের জখম করতে মেরে ছিলাম। কিন্তু মনে হচ্ছে তোমাকে সত্যি সত্যি মারতে হবে।
–আমি কিন্তু আম্পানে ছাড়ব না।
–তো ছাড়তে মানা করেছে কে? ধরে রাখো। এই নেও আমার হাত।
বলেই নিজের হাত কেয়ার দিকে বাড়িয়ে দিল কাব্য। কেয়াও হাসতে হাসতেই ওর হাতে হালকা করে বাড়ি মেরে সরিয়ে দিল কেয়া।
লামিয়া এসব দেখে অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা। সে ওদের কাছে গিয়ে বলল,
–আপনাদের হুমকি বার্তা দেওয়া হয়ে গেলে চলুন, ছবি তুলতে হবে।
শুনে লজ্জা পেয়ে কেয়া চলে গেল। আর কাব্য লামিয়ার মাথায় হালকা করে মেরে বলল,
–খুব পেকে গিয়েছিস না?
–আমাকে বলছিস কেন? আমি তো দূর থেকে দেখে ভাবছিলাম কেয়া আমাদের ভাবি হবে। কিন্তু এখান এ এসে সব শোনার পর এখন মনে হচ্ছে তোদের জোর করে বিয়ে দিলে তোরা বাসর ঘরে একে অপরকে শুট করে দিবি।
–সমস্যা নেই। আচ্ছা তোর কেয়াকে কেমন লাগে?
–জোস।
–ঠিক আছে। তাহলে কেয়া তোর হবু ভাবি।
–সত্যি?
–হ্যাঁ যাহ্ এখন।
–আমি যাচ্ছি , তুইও আয়।
.
বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে শ্রুতির বাবা মা বেশ কাঁদছিলেন। কারণ তারা চান নি তার মেয়ের এভাবে বিয়ে হোক। মেয়েটা বাইরে থেকে নকল হাসি ঝুলিয়ে রাখলেও ভেতর থেকে অনেক কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু কিছুই করার নেই তাদের। বেশি কষ্ট পাচ্ছেন মিসেস মাহবুব। কারণ শ্রুতি সবার থেকে লুকালেও সত্যিটা তার সাথে শেয়ার করেছেন। যেখানে মেয়ের কষ্টের কথা শুনে নিজেই সহ্য করতে পারেন নি, সেখানে মেয়ে সেই কষ্ট পেয়েও কি করে এখন বেঁচে আছে সেটা ভাবতেই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে চায়। তাও মেয়েকে বুঝতে দেন নি। নিজেকে শক্ত রেখেছেন। যেন মেয়েকে শক্তি জোগাতে পারেন।
.
যাওয়ার সময়ও কেয়া আর কাব্যের চোখে চোখে কথা হয়েছে। এটা কে কথা কম, ঝগড়া বেশি বলে।
.
.
.
পরের দিন সকালে জাহিনকে ডেকে তুলল শ্রুতি। এতো সকালে ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্ত হল জাহিন।
–কি হয়েছে? সকালে কি ঘুমা তেও দিবে না?
–না জলদি রেডি হয়ে নিন, যেতে হবে আমাদের।
–আমি তো কাল বলেই দিয়েছিলাম যে আমি ওই বাড়িতে যাবো না তাহলে…
বলতে বলতে জাহিন শ্রুতির দিকে তাকাল, মেয়েটার কোন খেয়াল নেই ওর কথার প্রতি। নিজ মনে কাজ করে যাচ্ছে। ওইদিন ডাবল বেড আনার পর থেকেই ওরা ঘরে যখন একা থাকে তখন বেড দুটি আলাদা করে রাখা হয়। আপাতত সেটাই গোছাচ্ছে শ্রুতি। নিজ মনে চাদর ঠিক করে বালিশ ঠিক জায়গা মতো রাখল। তারপর বলে উঠল ,
–নিন এবার বাকি কাজ টা আপনি করে ফেলন। আর রেডি হয়ে নিন। আমি আপনার জামা কাপড় বের করে দিয়েছি। আমি শুধু আগে ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি। সেজন্য ওয়েট করুন । আর কোন কাজ না পেলে এই বিছানা দুটো টানাটানি করে খেলা করুন। আমাদের বের হতে হবে।
–কিন্তু আমি ওই বাড়ি যাবো না।
–ওই বাড়ি যেতে আপনাকে এক বলেছে?
–কেন ? তুমি?
–আমি কখন বললাম?
–এইতো এখন।
–আমি কি আর ওই বাড়ি যাওয়ার কথা বলেছি?
–তাহলে যে বললে রেডি হতে।
–তো অফিসে যাবেন না আপনি? না কি আপনার যে অফিস আছে সেটা ভুলেই গিয়েছেন। জলদি রেডি হয়ে নিন।
–তাহলে তুমি কোথায় যাবে?
–আপনার সাথে, আপনার অফিসে।
–কেন? আমার সাথে কেন যাবে?
–কেন যাবো না? আপনি কি ভুলে গিয়েছেন যে আমি আপনার অফিসে আপনারই পিএ পদে কর্মরত আছি। আর দয়া করে আমার মাথা খাবেন না। চুপচাপ ঘর গোছান।
বলে আলমারি থেকে শাড়ি বের করে নিজে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। এদিকে জাহিনের মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠল। এটা নতুন কিছু না। প্রতি অভ্যাস ই পুরনো। জাহিনের অফিসে ওর পিএ পদে আসার পর থেকেই এই ঘটনার সাথে ও পরিচিত। তবে এখন শুধু একটু রাগ বেশি হয়ে গিয়েছে শ্রুতির। শ্রাবণীর সাথে বিয়ের পর থেকে এই সকাল গুলো আর দেখেনি জাহিন। তবে শ্রুতির সাথে বিয়ের পর এমন সকাল যেন আবার ফিরে পেল। আগে হলে শ্রুতি রাগ দেখাত, তবে সেটার পরিমাণ এখন একটু বেশিই বেড়েছে। এখন তো তাই রাগের পাশাপাশি ঝাড়ি ও খেতে হচ্ছে তাকে।
.
‘চুপচাপ বিছানা গোছাও’
.
নিজের মনে মনে একবার শ্রুতির নকল করে আওড়ে নিয়ে হাসল জাহিন। তারপর লেগে গেল দুটো বিছানাকে এক করে বাকি গোছগাছ করতে। এসবে সাথে অভ্যস্ত নয় সে। নিজের কোন কাজ নিজেকে করতে হয় নি তার কখনো। তবে সেই বিজনেস আইকন মিঃ জাহিন রেজওয়ান নিজের বিছানা গোছাচ্ছে। স্ট্রেঞ্জ।
.
.
শ্রুতি বাথরুম থেকে বের হতেই আজও সেই একই দৃশ্য দেখল জাহিন। নিজেকে সামলাতে পারছে না কেন জানি। অনুভূতিরা পাখির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে। সে কি তাহলে নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারয়ে ফেলছে?
.
শ্রুতিকে পিছন থেকে দেখেই ‘জলপরী’ কথাটা মনে মনে কয়েক বার আওড়ে নিল। তবে হুঁশ ফিরতেই ভাবতে থাকল যে কি ভাবছে সে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। নিজের উপর রাগ দেখানোর মতো মহান কাজটা আজ আবার করতে করতে ড্রেস নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল।
.
.
রেডি হয়ে বের হয়ে দেখল, প্রতিবারের মতো এবার ও শ্রুতি ব্রেকফাস্ট বানিয়েছে। গতকালের কথা মনে পড়তেই শ্রুতিকে বোকা শুরু করে দিল। কেন এমন করল সে জানে না। কিন্তু এখন জানতেও চায় না। এখন মূল কাজ হল শ্রুতিকে বকা। মেয়ে টা কি কখনো নিজের খেয়াল রাখতে পারে না। কয়েক দিন রেস্ট নিলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত কে জানে?
.
শ্রুতিও মাথা নিচু করে শুনে যাচ্ছে। সত্যিই আজও ওর খারাপ লাগছে। তবু ও বাইরে থেকে এমন দেখাচ্ছে যে কিছুই হয় নি ওর। ও একদম ফিট আছে।
.
জাহিনের নানু আর মামা মামিরা জাহিনের এ রুপ দেখে খুশি হলেন। তারা ভাবছেন যে জাহিন তাহলে শ্রুতিকে নিয়ে টেনশন করে। কিন্তু ঘটনা তো আসলে তাদের অনুকূলে নয়।
.
ব্রেকফাস্ট করে দুজনে একসাথে বেরিয়ে পড়ল শ্রুতি। কত দিন পর আজ সে আবার জাহিনের সাথে এক গাড়িতে আছে। ভাবতেই এক পশলা ভালোলাগা এসে ভিড় করল শ্রুতির মনে । কিন্তু বুবুর কথা মনে পড়তেই সে নিজের মনকে বোঝাল,
–এ ভালো লাগা তার জন্য নয়। এটা অন্য কারো।
জাহিন গাড়ি চালাচ্ছে আর শ্রুতি জাহিনের পাশেই বসে আছেয় আর নানান কথা বলে যাচ্ছে। প্রথমে চুপ করেই ছিল কিন্তু জাহিন বলল কথা বলতে। আর শুরু হল শ্রুতির কঠিন কঠিন বার্তা।
–আপনি মনে করবেন না যে আমাদের বিয়ে কখনো হয়েছে। আগে যেমন আপনার পি এ ছিলাম, এখনো তাই আছি। আপনি যে যে কাজ দিবেন সেসব আমি করে দিব। অন্য স্টাফ রা কোন কথা বললে এড়িয়ে চলবেন অথবা মুখের উপর বলে দিবে ন যে পার্সোনাল লাইফ আর প্রফেশনাল লাইফ গুলিয়ে না ফেলতে।
জাহিন আসলে সময়েই ব্যবধানে হয়তো ভুলতে বসে ছিল যে শ্রুতি মেয়েটা শান্ত হলেও যখন ওকে কথা বলতে বলা হয় তখন ও সব কিছু ছাড়িয়ে যেতে পারে।
.
আগেও কথা হত। তবে এখ কথার জায়গায় মহামূল্যবান বাণী শোনায়। আচ্ছা বিয়ের পর সব মেয়েই কি এমন হয়ে যায়?
–আর হচ্ছে…
–থাক চুপ থাক আমি বুঝতে পেরেছি।
–সত্যিই বুঝতে পেরেছেন তো?
–হুম পেরেছি।
–কি বুঝেছেন বলেন।
–অফিসে এমন ভাবে চলব যেন মনে হয় যে আমরা একে অপরকে চিনিই না।
–হুম ঠিক আছে। তবুও যদি আপনি চান আমি পুরো ব্যাখ্যা আবার রিপিট করতে পারি।
–থাক লাগবে না। আমি ঠিক ভাবেই বুঝেছি।
সেদিন সাধারণ ভাবেই সারাটা দিন কেটে যায়।
কাজিনরা তো বাসায় পুরো মাতিয়েই রেখেছে। ভাবি ভাইকে পেয়ে। ওরাও ওদের বেশি করে সময় দিচ্ছে। কারণ কিছু দিন পর ওরাও চলে যাবে। তাই এই মুহূর্ত টা কে মিস করতে চাচ্ছে না ওরা।
.
.
.
রাতে হঠাৎ জাহিনের ঘুম ভেঙে যায় আওয়াজ শুনে। টেবিল ল্যাম্পের কাছের ঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে দেখে রাত দেড় টা বাজে তখন।
চলবে।
[ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। Happy Reading]
#অন্তরালে_তোমার_বসবাস
#সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ-০৫
রাতে হঠাৎ জাহিনের ঘুম ভেঙে যায় আওয়াজ শুনে। টেবিল ল্যাম্পের কাছের ঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে দেখে রাত দেড় টা বাজে তখন।
.
শব্দ টা র উৎস খুঁজতে গিয়ে দেখল পাশে থেকেই আসছে। শ্রুতি হয়তো ঘোরেই কিছু বলছে, কিন্তু কি বলছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। জাহিন বিছা থেকে উঠে ওর কাছে গেল আর ভালোমতো শোনার চেষ্টা করল। তবে কিছু বুঝতে পারল না। আসলে কি বলছে শ্রুতি। অস্পষ্ট ভাবে শোনা যাচ্ছে সব। কথাগুলো কেমন জড়িয়ে আসছে তার। হঠাৎ জাহিনের মনে হল যে শ্রুতি ঘমের মধ্যে জাহিনের নাম নিল। তাই আরও ভালোভাবে শোনার জন্য ওর কাছে গেল। তবুও লাভ হল না। এবার কথা গুলো আরও জড়িয়ে আসছে।
.
তবে একটা কথা সে পরিষ্কার শুনতে পারল । সেটা হল ‘বুবু’। জাহিন বুঝল যে শ্রুতি নিজের বোন শ্রাবণীকেই স্বপ্নে দেখছে এখন। কিন্তু শ্রুতির ছটফটানি বেড়েই চলেছে। কিভাবে শান্ত করবে বুঝতে না পেরে শ্রুতির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল।
.
কিন্তু এতেও শ্রুতির ছটফট করা কমলো বলে মনে হল না জাহিনের। কি করা উচিত তার বুঝতে না পেরে শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরে ওর বিছানায় শুয়ে পড়ল। স্রুতিএ মাথা নিজের বুকে রেখে। জাহিন কে দেখে এখন মনে হবে না যে সে নিজের মধ্যে আছে। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। চিন্তা শুধু একটাই, শ্রুতিকে কিভাবে থামান যায়। নাহলে নিজে এক বার হলেও ভাবত যে যার থেকে সে দূরে থাকতে ছায়, আজ নিজ থেকেই সে তাকে বুকে টেনে নিয়েছে। নাহলে কখনই এমন করত না হয়তো। আবার হয়তো করত কিন্তু পরিস্থিতি তাকে করতে দিত না।
.
ধীরে ধীরে শ্রুতি থেমে আসে। ঘমের ঘোরে থাকায় হয়ত নিজের কিছুই খেয়াল নেই। তাহলে শ্রুতি কি জাহিনের হার্ট বিট শুনে থেমে গেল। ঘুমের ঘোরেও নিজেকে শান্ত করল। সেটার উত্তর জানে না জাহিন। অনেকক্ষণ এভাবে থাকার পর নিজেই ওই অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পড়ল।
.
.
.
প্রতি বারের মতো আজ সকালেও জাহিনের ঘুম শ্রুতির আগেই ভাঙল। এতে করে সে নিজেকে অন্যের বিছানায় আবিষ্কার করল। সাথে আবিষ্কার করল নিজের বুকে বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে ঘুমিয়ে থাকা শ্রুতিকে। এতেই গত রাতের কথা মনে পড়ল। কেন শ্রুতি এমন করছিল গত রাতে? আগে তো এমন করে নি। তাহলে হঠাৎ কাল করার কারণ কি? বাজে স্বপ্ন দেখলেও এমন করার কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে স্বপ্নে কি দেখেছে সেটা জানতে মন চাইছে জাহিনের।
.
জাহিনের ভাবনার মাঝে শ্রুতি নড়ে উঠল। এতেই ছেদ ঘটে তার ভাবনার। আগে শ্রুতিকে সরিয়ে নিজের ওঠার ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রুতি ঘুম থেকে উঠে এই অবস্থা দেখলে ঝগড়া শুরু করে দেবে।
.
”মেয়েটা ঝগড়া করতে ভালোই পারে।”
.
ভেবে হাসল জাহিন আনমনে। আবার নিজেকে ঠিক করে শ্রুতিকে ধীরে ধীরে নিজের উপর থেকে সরিয়ে বিছানায় ঠিক মতো শুইয়ে দিল। তারপর নিজের বিছানায় চলে গেল নিঃশব্দে।
.
”বিড়াল ছানা একটা।”
.
বলেই আবার চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে থাকল।
.
.
.
তবে এই চেষ্টা দীর্ঘ স্থায়ী হল না জাহিনের। বেশ কিছুক্ষণ পর শ্রুতির ও ঘুম ভাঙল। সে নিজে উঠে বিছানা গোছাতে লাগল আর জাহিনকে ডাকা শুরু করল।
–স্যার ও স্যার, স্যার ও স্যার, উঠে পড়ুন। জলদি জলদি উঠে পড়ুন।
নিজের কানে আগের আওয়াজ পেয়ে মুচকি হাসল জাহিন। তবে চোখ খুলল না সে। শ্রুতির কাছে ধরা পড়া যাবে না।
–এই যে মিস্টার, কি হল উঠুন। তাড়াতাড়ি উঠুন। রেডি হয়ে নিন আমাদের যেতে হবে।
”রেডি হয়ে নিন, যেতে হবে।”
এই টুকু তার কান থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাতেই ধড়ফড় করে উঠে পড়ল জাহিন।
–কে যেতে হবে? কোথায় যেতে হবে? আজ না শুক্রবার। শুক্রবারে কোথায় যাবো? আর রেডিই বা কেন হব? রেডি হওয়ার কি আছে।
.
.
শুক্রবারে অফিস বন্ধ থাকায় এই দিন দেরি করে উঠা জাহিনের বেশ পুরনো অভ্যাস। এই দিন হঠাৎ করে যখন শুনল যে যেতে হবে, জাহিন তখনই উঠে পড়েছিল। মূলত সে ভয় পেয়েছিল। কোথায় যেতে হবে? যার জন্য শ্রুতি রেডি হতে বলল তাকে? শ্রুতি আবার বাবার বাড়ি যাওয়ার বায়না ধরবে না তো?
.
তাই ভেবেই এতো প্রশ্ন একসাথে করে বসে। কিন্তু শ্রুতির উত্তরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ও।
–যাবেন না মানে? অফ ডে তো কি হয়েছে? আপনার অফিস, আপনি যখন ইচ্ছা যেতে পারেন। তাই বলে কি কাজ করবেন না? অবশ্যই যাবেন আপনি। জলদি রেডি হয়ে নিন।
–তুমি কি আমাকে ছুটির দিনেও অফিসে পাঠানোর প্ল্যানিং এ আছো?
–নিঃসন্দেহে।
.
বিছানায় বসে থাকা অবস্থাতেই মাথা চুলকালো জাহিন। মেয়েটা তো নিজের বাবার বাড়ি যাবে না এটা শিউর কিন্তু তার পরিবর্তে জাহিন কেই অফিসে পাঠাবে? এ কেমন কথা? জাহিন যাবে না, কিছুতেই না। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো ফেস করে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে রইল। এখনো সে ডান হাতের এক আঙুল কাম্রিয়ে যাচ্ছে।
.
শ্রুতি বিছানা গোছানো শেষে জাহিনের দিকে তাকাল। জাহিনের মুখের অবস্থা দেখে ফিক করে হেসে দিল সে না চাইতেও। সত্যি সত্যি জাহিন বাচ্চাদের মতো জিদ করছে।
–আরে বাবা…
–আমি তোমার বাবা নই।
–ওকে স্যার, আমি তো মজা করছিলাম। আপনাকে রেডি হতে বলছিলাম মানে ফ্রেশ হয়ে নিচে যেতে বলছিলাম। আপনি কি না কি ভেবে বসে আছেন।
–ওহ তাহলে ঠিক আছে।
বলে মুখ থেকে আঙুল সরিয়ে সেভাবেই বিছানাতে শুয়ে পড়ল।
–আপনি আবার শুয়ে পড়লেন?
–হুম।
–উঠবেন না?
–না
–সত্যি উঠবেন না?
–না
–আরেক বার বলেন।
–আমি উঠবো না, নেও আরেক বার বললাম।
–আপনি খাবেন ও না।
–নাহ।
–ঠিক আছে তাহলে আজ আপনার সাড়া দিনের খাবার না দেওয়ার ব্যবস্থা আমি করছি। আজ সারাদিন আপনি খাবার পাবেন না। আর বাইরে থেকে কিনে আন্তেও পারবেন না।
–দিস ইজ নট ফেয়ার শ্রুতি।
.
জাহিন জানে শ্রুতি কিছু বললে অবশ্যই করে দেখাতে পারবে। ওর এই যোগ্যতার জন্যই তো এতো গুলো মানুষ ইন্টার্ভিউ দেওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে থেকে শ্রুতিকে বাছাই করেছিল তার পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট হিসেবে।
.
–উঠে পড়ুন।
–আচ্ছা ঠিক আছে উঠছি।
বলে উঠে বসল।
–গুড বয়।
বলে শ্রুতি আলমারি থেরে শাড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে গেল।
.
শ্রুতি চলে যেতেই জাহিন আবার শুয়ে পড়ল। শ্রুতি আবার চেক করার জন্য বের হতেই জাহিন কে দেখল। সে আবার শুয়ে পড়েছে। তাই সে জোরে জোরে বলল,
–আচ্ছা আপনি সারাদিন ঘুমান কিন্তু তার আগে বিছানা ঠিক করুন। আমি ফ্রেশ হয়ে এসে দরজা খুলে দিব। তখন যদি সবাই দেখে যে বিছানা দুই টা তখন কি হবে…
বলতে বলতে সে বাথরুমে চলে গেল আর জাহিন উঠে পড়ল।
.
.
সে ভাবল বিছানা এক করে দিয়ে ফের ঘুমাবে। কিন্তু সেটা আর হল কোথায়। বিছানা এক করতে গিয়ে যে পরিমাণ শক্তি খরচ হল তাতেই তার ঘুম উড়ে গিয়েছে। যদিও বিছানায় চাকা লাগানো, সেটা সরানো সহজ। কিন্তু তারপর বাকি বিছানা গোছাতে হয়েছে তার। তাই চোখে আর ঘুম নেই জাহিনের।
.
শ্রুতি বাথ রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখে জাহিন মুখ ফুলিয়ে বিছানায় বসে আছে। ওর ফোলা মুখ দেখে হাসতে গিয়েও নিজেকে আটকাল শ্রুতি। নিজের ভেজা তোয়ালে টা বেলকনিতে নেড়ে দিয়ে আবার ফিরে এসে দেখে জাহিন তখনও মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।
”লোকটা কতক্ষণ থেকে এভাবে বসে আছে?”
মন এ মনে ভেবে মুখেই প্রশ্ন করল,
–কি হল ? ঘুমাবেন না?
–নাহ।
–কেন?
–ঘুম আসছে না।
–তাহলে এক কাজ করুন। রেডি হয়ে নিচে নামুন। সবাই একসাথে ব্রেকফাস্ট করবেন।
বলেই মনে মনে হাসল শ্রুতি। সে জানত জাহিন কে দিয়ে কজা করালে ওর ঘুম চলে যাবে। তাই বলেছিল। বলেই চলে যেতে গেলে জাহিন ওকে আবার ডাকল।
–শ্রুতি?
–জ্বি বলেন?
–কাল রাতে কি খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলে?
–কেন?
–মাঝ রাতে কি যেন বিড়বিড় করে বলছিলে?
শ্রুতি এবার ভয় পেয়ে গেল। জাহিন সব শুনে ফেলল না তো? তবু সেটা প্রকাশ না করে প্রশ্ন করল,
–কি বলছিলাম?
–মেইবি বুবু বলে কিছু বলছিলে।
শ্রুতি চিন্তা মুক্ত হল। সে ঘুমের ঘোরে সব বলে দেয় নি তাহলে।
–কি হল ? কোথায় হারিয়ে গেলে আবার?
–না কিছু না।
–বললে না তো, কেন এমন করলে?
–কাল মনে হয় ঘুমের ওষুধ খাওয়া হয় নি তাই।
আনমনে বলে উঠল শ্রুতি।
–তুমি ঘুমের ওষুধ খাও না কি? এনি প্রবলেম?
–ওহ, না তেমন কিছু না। ডাক্তার সাজেস্ট করেছেন। আপনি তাহলে ফ্রেস হয়ে খেতে চলে আসুন।
বলে জাহিনকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিচে নেমে এলো।
.
.
.
জাহিন ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে শ্রুতিকে দেখে রেগে গেল। মুলত সে শুধু শ্রুতিকে দেখে রাগে নি। শ্রুতি আর শুভ একসাথে হেসে হেসে কথা বলছিল। সেটা দেখেই রেগে গিয়েছে। কিন্তু এই রাগ তার কেন হচ্ছে, সেটা জানে না জাহিন। কিংবা হয় তো জেনেও জানতে চায় না সে।
.
শ্রুতি নিচে নেমে ব্রেকফাস্ট বানাতে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু নানুর কড়া আদেশ এর কথা মনে পড়ে। উনি শ্রুতিকে রান্না করতে মানা করেছেন। বিশেষ করে কিচেনে ঢোকাই মানা করে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু শ্রুতির জোরাজুরিতে আর সেটা করতে পারেন নি। তবু রান্না করতে মানা করেছেন। আগের দিন তিনি শ্রুতিকে পড়ে যেতে খেয়াল করেছিলেন। আর তার আগে তিনি জাহিনের থেকেও খবর নিয়েছিলেন। তার ধারণা অধিক চিন্তা করার জন্যই এমন হচ্ছে তার। কিন্তু কিসের এতো চিন্তা জানেন না রায়মা রেজওয়ান । তবু প্রশ্ন করেন নি। একেবারেই রান্নাঘরে যাওয়া মানা করে দিয়েছেন।
.
তাই শ্রুতি কোন কাজ না পেয়ে কি করবে ভাবছিল। এমন সময় শুভ চলে আসে আর তার সাথে কথা বলা শুরু করে দেয়। সেই একই সময়ে জাহিন ও নিচে নামছিল। শ্রুতি আর শুভকে একসাথে দেখে তার মনে অজানা এক রাগ হানা দেয়। এর কারণ জানে না। শ্রুতির দিকে কটমট করে তাকিয়ে ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে আর খাবার দিতে বলে।
.
এদিকে জাহিনের দুই মামি এসে জাহিনের কপালে গলায় হাত দিয়ে চেক করা শুরু করে দেন। এটা দেখে কাব্য, লামিয়া ইউসরা রাদিয়া সহ বাকি সবাই হেসে ওঠে। আর শ্রুতি তো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।
–কি হল? খাবার দিতে বলেছি তোমাদের। আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
এটা শুনে বড় মামি বলে ওঠেন,
–জাহিন, বাবা তুই ঠিক আছিস তো?
ছোট মামিও সুর মিলিয়ে বলেন,
–যে ছেলে কি না খাবার দেখলে খেতেই চায় না, সে আজ নিজে থেকে খাবার চাইছে?
শ্রুতি তো এখনো অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে দেখছে। কারণ কিছুক্ষণ আগেও জাহিনের খাওয়া নিয়ে সে ঝগড়া করে এসেছে জাহিনের সাথে।
.
.
জাহিন এবার বুঝতে পারল যে আসলে কি হয়েছে। আর সে কতটা ভয়ানক এক কাজ করেছে? সে আসলে এমন এক কথা বলে ফেলেছে যে সবাই তাকে এলিয়েন ভাবছে আপাতত। অএ ছোট ভাই বোন যে কয়েক মিনিট পর পুলিশেও কল করতে পারে এটা বুঝতে দেরি নেই তার। কারণ তারা হয়তো না, সত্যিকারে ভাবছে এটা তাদের ভাই না। আর এতগ্ল মানুষের কথা সত্যি ধরে পুলিশ ওকে এরেস্ট করে নিতে দু বার ও ভাববেন না। তাই সে নিজেই বলে উঠল,
–আরে সবাই কি খাবে না? আমি আবার অফিসের কাজ নিয়ে বসব, তাই খাবার আগে আগে দিতে বললাম।
চলবে।
[ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। Happy Reading]