রাঙিয়ে দিয়ে যাও,পর্ব:০২,০৩

0
1455

রাঙিয়ে দিয়ে যাও,পর্ব:০২,০৩
লেখনীতে- মাহি আফরোজ
[২]

“ফোর্থ সাবজেক্টের বই না দেওয়ার কারণে প্রথম প্রথম তেমন জোরালো ক্লাস হতো না।ছুটি দিয়ে দিতো নিদিষ্ট সময়ের আগেই।আমি আগের মতোই ছুটে বেড়াতাম সৌমির সাথে।তবে আগের থেকে কেমন জানি একটা হয়ে গেলো।স্কুলে যাওয়ার সময় আগে কত কথা বলতাম দুজনে।অথচ এখন সে চুপ থাকে। স্কুলে গিয়ে শুধু ভালো করে কথা বলে।বিকেলে আমার সাথে ঘুরতে চায়না।আমার দৃষ্টিতে আমি আমিই ছিলাম।কিন্তু আমি বাদে সবার চোখে আমি একজন ডিভোর্সি মেয়ে ছিলাম।আর সমাজে ডিভোর্সী মেয়ে মানেই খারাপ।আমায় না কেউ ছুঁয়ে দেখল আর না কেউ শরীরের ভাঁজে ভাঁজে মোহাবিষ্ট হলো।তবুও কলঙ্ক আমার সারা শরীরে আষ্টেপৃষ্টে বিঁধে থাকল।”

মাহির চোখের পানি গাল বেয়ে চলে যাচ্ছে।তবুও খুবই স্বাভাবিক ছন্দে সে বলে যাচ্ছে, “আশেপাশের মানুষের উস্কানিমূলক কথাবার্তা শুনলে মনে হতো মরে যাই।কত মানুষ বাজে কথা বলেছে সহ্য করতে না পেরে বাড়ি এসে কান্নাকাটি করেছি।দাদা সবসময় আমার মাকে দোষারোপ করত।মা মাঝে মাঝে আব্বাকে বলত ভালো কোনো ছেলে দেখে আমাকে আবারও বিয়ে দেওয়ার কথা।আব্বা শুধু চুপ করে শুনে যেতেন।কোনো প্রতুত্তর করত না।স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে এসে প্রায়ই দেখতাম বাড়িতে দাদার সাথে মায়ের ঝগড়া চলত।”

মালিহা চুপ করে সবটা শুনল।মাহি মাথাটা নিচু করে নিরবে কেঁদে যাচ্ছে। সে মাহির মাথায় হাত রেখে কাঁদতে বারণ করে।মালিহার খুব কষ্ট হচ্ছে মাহির জন্য। দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য একসঙ্গে বসেছিলো তারা রেস্টুরেন্টে।মাহি নিজেই আগবাড়িয়ে তাকে ওর জীবনের গল্প শোনাতে চেয়েছে।মেয়েটার চেহেরা খুব মিষ্টি। অথচ কি বিষাক্তই না তার জীবন উপন্যাসের প্রতিটি অতীত পাতা।

নিজেকে সামলে মাহি বলে,”দাদা প্রায় বিভিন্ন সমন্ধ নিয়ে আসত।মা বলত এখন আমায় বিয়ে দেবে না।দাদা বলত মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে কোন জজ ব্যারিস্টার বানাও তা পরে দেখব।যখন বাড়ি থেকে বের করে দেবো তখন কে বিয়ে করতে আসে তোমার মেয়েকে তা আমি দেখব।”

“তোমার গ্রান্ডপা তোমাদের বাসা থেকে বের করতে চায় কেনো?তার প্রপার্টির লিগ্যাল হিয়ারশীপ।”

মাহি সামান্য হাসে।শরৎকালে যেমন এই বৃষ্টি এই মেঘ।ঠিক তেমনই মাহির জীবনের আজকের দিনটায় একবার হাসছে তো একবার কাঁদছে। বলে,”দাদা তার ছোট ছেলেকে খুব ভালোবাসত।ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে তার সম্পত্তি সব ছোট ছেলেকে দিয়ে দেয়।আমার আব্বা বড়।সে চাইলেই কাজ করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।এই বিশ্বাসে সে আমাদের সর্বহারা করে দেয়।”

“তোমার বাবা চাইলে কোর্টে কেইস করতে পারত।এতে সে কিছুটা হলেও পেতো।”

“আমার আব্বা তার পিতাকে খুব ভালোবাসত। তাই আর ঘাটায়নি।”

“সো স্যাড।তারপর কি হলো?”

“মার্চ মাসে স্কুল থেকে শিক্ষাসফরের আয়োজন করা হলো।আমি খুবই আশাবাদী হয়ে বাড়িতে জানিয়েছিলাম।এটা শুনে দাদা ও আব্বার মাঝে কথা কাটাকাটি হয়।এক পর্যায়ে দাদাবাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন আব্বা।”

“তারপর.”

“তারপর আব্বা একই এলাকায় সামান্য জায়গা কিনে নিলো।বিনিময়ে মায়ের গয়না বিক্রি হলো, বহু দিনের সযত্নে রাখা পোড়া মাটির ব্যাংক ভেঙে গুড়িয়ে গেলো,লোকের কাছে থেকে কর্জ নেওয়া হলো।মাত্র ৩৭০ টাকার অভাবে আমার শিক্ষা সফরে যাওয়া হলো না।।তারপর একরকম পাড়ায় বের হওয়া বাদ দিয়ে দিলাম আমি।স্কুল থেকে সোজা বাড়ি এমন করেই চলতে লাগল।”

মানুষের জীবনে অনেক না বলা কথা থাকে।যা চাইলেও আপন মানুষের সাথে শেয়ার করা যায় না।কাছে থেকেও কেউ কেউ তীব্র মনোকষ্টে ভোগে।এই কথাগুলোর মর্মার্থ মালিহা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে মাহিকে দেখে।

প্রকৃতিতে সন্ধা নামানোর তীব্র আয়োজন চলছে চারদিকে।হাতের ঘড়িতে সময়টা দেখে নেয় মাহি।কাঁধে ঝুলিয়ে রাখা চিকন ফিতার ব্যাগ থেকে একটা ডায়রি বের করে।মালিহা একটু ইতস্তত করে বলে,
“মাহি তোমার জীবনে এমন কেউ আসেনি, যাকে দেখে তোমার ভালো লেগেছে।আমি বলতে চাইছি যে তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই?”

“মিথ্যে বলব না। ক্লাস নাইনের দ্বিতীয় সেমিস্টারের পর একটা ছেলের সাথে আমার পরিচয় হয়।প্রথম দেখাতেই আমার তাকে ভালো লেগেছিলো।আবেগের বশে তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম।আসলে আমার মাথায়ই থাকত না যে আমি একজন ডিভোর্সী মেয়ে।আমি আর পাঁচজনের মতো চলতাম।কিন্তু আমার ভুলটা ভেঙে গেলো।আমি বুঝলাম আমি ভুল।”

“ছেলেটা কি পরে জেনে গিয়েছিলো তুমি ডিভোর্সী? ”

“ছেলেটা আগে থেকেই জানত।”

“তাহলে সমস্যা কোথায়?”

“পুরুষের প্রথম প্রেমিকা হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।কিন্তু আমি ভাগ্যবতী ছিলাম না।আমি তার জীবনে প্রথম ছিলাম না।সে প্রায় সবার সাথেই ফ্লার্ট করত।অনেকেই আমাকে বলেছিলো।আমি সাবধান হয়ে যাই।এক মুহুর্তের জন্য ভুলে গিয়েছিলাম আমার অতীত।কিন্তু সে সবসময়ই বলত,” বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ভালোবাসি।কিন্তু আমার কাছে তার প্রতি কোনো বিশ্বাস ছিলো না। ”

“তারমানে হতে হতেও তোমাদের লাভ স্টোরির স্যাড এন্ডিং হলো।”

“এটা পরিসমাপ্তি নয়।এটা উপন্যাসের মাঝের পাতা।প্রায় ছয়মাস সে চেষ্টা করে সবকিছু নতুন করে শুরু করার।আমি একজন মেয়ে ছিলাম।আমার জীবনে সেই প্রথম যাকে আমি জীবনসঙ্গী হিসেবে কল্পনা করেছিলাম।আমি বান্ধবীদের কাছে লুকিয়ে তার সাথে সম্পর্ক কন্টিনিউ রাখলাম।”

মালিহা খুব আগ্রহ সহকারে শুনছে।মাহি একটু অবাক হয়।নেহাত সে বিদেশে বড় হয়েছে।একটা মেয়ের প্রতি এমন সিমপ্যাথি দেখিয়ে কারো দুঃখ শেয়ার করার মতো সময় তাদের নেই।
মাহি বলে,

“তারপর সবকিছু দ্রুত এগিয়ে যেতে লাগল।এলাকার সবাই জেনে গেলো বিষয়টা।সবাই ছি ছি করতে লাগল।স্বামী পরিত্যক্ত একটা মেয়ে কি করে আবার কারো সাথে…ছি!আমি অবাক হয়ে সেদিন আমার আব্বাকে দেখেছিলাম।তিনি আমায় কিছুই বলেনি।মা বলেছিলো।গায়ে হাত অবদি তুলেছিলো।এতদিনে আমাকে নিয়ে এলাকায় বন্ধ থাকা সমালোচনা ফের শুরু হলো।কিন্তু আমার এত এত সাধের ভালোবাসা ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো।আরো একবার আমি কলঙ্কিনী হলাম।”

এতক্ষণ মালিহা স্বাভাবিক থাকলেও আর পারছেনা।আসলেই এমন অনেকেই আছে যারা জীবনে বাঁচতে গিয়ে বারবার হোঁচট খাঁয়।মাহি তাদেরই একজন।

“লোকের কথার ঘৃনায় মনে হতো গলায় দড়ি দেই কিন্তু আমি পারিনি। বাহিরে এত কিছু হলেও আমার বাড়িতে ছিলো শান্তি।রাতে যখন সবাই খেতে বসতাম আব্বা গল্প করতেন।বলতেন আমি কলেজে গেলে আমাকে কি কি কিনে দিতে হবে।আমায় বলত আমি যেনো ভালো করে পড়ে পরিক্ষা দেই।

আব্বা তখন দিনমজুর। প্রতিদিন কাজ করলে টাকা না করলে নেই।দিনপ্রতি পাঁচ’শ টাকা।মায়ের সংসার মানিয়ে নিতে কষ্ট হতো।তার ওপর আমার পড়াশোনার খরচ আর কর্জের টাকা পরিশোধ করা।আমি সবকিছু ভুলে চেষ্টা করলাম নতুন উদ্যেমে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে।ভুলে যেতে চাইলাম তাকে।কিন্তু পারিনি।রাতের অন্ধকারে কত কেঁদেছি তার জন্য। তার সাথে কোনো যোগাযোগ ছিলো না।যে সময়টাতে আমার তার দরকার তখন সে ছিলো না।

সময়ের সাথে সাথে আমি নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করলাম।সে আমার প্রথম ভালোবাসা। মনের ভেতরে জমিয়ে রাখা এক মিষ্টি অনুভূতি। ভালোবাসাকে চেপে রাখলাম ভেতরে।তীব্র মনোকষ্টে হাসতে চেষ্টা করলাম।এসএসসি পরিক্ষার আগে আব্বা আরও দুইটা প্রাইভেটে ভর্তি করে দিলো।আমার এখনও মনে আছে।সেই কুয়াশা মাখা ভোরে আব্বা আমায় সাথে করে নিয়ে পৌছে দিয়ে আসতেন।কাজের অসুস্থ শরীর নিয়েও ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে পথ চলতাম বাবা মেয়ে।

যেদিন দাদার বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম,আমার সাতবছর বয়সী বোন কেঁদে কেঁদে বলেছিলো,”আব্বা তোমার বাপ খুব খারাপ।”আব্বা সেদিন হাসতে হাসতে বলেছিলো,”জীবনে চলার পথে বহু খারাপ মানুষ দেখতে পাবে,কিন্তু তুমি একটাও খারাপ বাবা দেখতে পাবে না।”

সত্যি আমি কোনো খারাপ বাবা দেখিনি।সেই কুয়াশার মাখা ভোরে আব্বার সাথে পথ চলতে গিয়ে অনুভব করলাম।আমার স্বপ্নপুরণে এই বাবা নামক মানুষটা ছাড়া কাউকে পাবো না আমি।কাউকেই না।সত্যি আমি কাউকেই পাইনি।এমনকি মাকেও না।”

“তোমার মম তোমার এ্যগেনস্টে ছিলো?”

“ঠিক আমার না, আমার এইম,আমার ড্রীমের..”

চলবে…….

রাঙিয়ে দিয়ে যাও
লেখনীতে~ মাহি আফরোজ

[৩]

“একে একে এসএসসি পরিক্ষা দিয়ে কলেজে গেলাম।এইচএসসি দিয়ে নিজ জেলার এক ভার্সিটিতে ভর্তিও হওয়া হলো।ইচ্ছে ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার।কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে হয়ে উঠেনি।লেটার মার্কস নিয়ে অনার্স শেষ করার পরে দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয় খোঁজ দিলো ওদের স্কুলে সহকারী শিক্ষকের পোস্ট ফাঁকা আছে।আমি চাইলে তিনি যোগাযোগ করিয়ে দেবেন।আমি আর হিমু মিলে এপ্লাই করলাম।আল্লাহ’র রহমতে আমরা দু’জনেই টিকে গেলাম।কিন্তু এখানে এসে আমার হাড়ে হাড়ে টের পেলাম টাকা ছাড়া সিভি এই টেবিল থেকে ও টেবিল নড়ে না।থমকে গেলাম আমি।হিমানি তো এমনিতেই এপ্লাই করেছিলো।তাছাড়া তার বাবার সামর্থ্য ছিলো।কিন্তু লাখ টাকার যোগান দেওয়া তখন আমার ফ্যামিলির পক্ষে অসম্ভব ছিলো।”

“কারো থেকে হেল্প নিতে।কিংবা কোনো অরগানাইজেশান থেকে লোন নিতে পারতে।”

“আমার তেমন পরিচিত ছিলো না।আর থাকলেও তারা সাহায্য করত না।প্রথমে আমরা যে জায়গায় বাড়ি তুলে থাকতাম ওটা অনেক স্বল্প পরিসরের।তাই মাত্র কয়েকদিন আগে জমানো টাকা দিয়ে পাশের কিছুপরিমাণ বসতভিটা কেনা হয়।পরেছিলাম অকূল পাথারে।বাড়িতে বসে না থেকে মাস্টার্সে ভর্তি হলাম।”

“এর মধ্যে ওই ছেলেটা কোনো যোগাযোগ করেনি?”

“না তার সাথে আমার আর কোনোদিন কথা হয়নি।”

চারদিকে সব চুপচাপ। মালিহা মনে মনে ভাবে ঠিক কি করেছিলো মাহি তখন।তার মনে খুব আফসোস হয়।মাহি নিজের ঘড়িতে সময় দেখে নেয়।বাহিরের অন্ধকারকে ছাপিয়ে জ্বলে আছে শত শত দোকানের লাইট।সোডিয়ামের ক্ষীণ আলোকে উপভোগ্য করা দায় এখানে।

“শেষমেশ তুমি কি চাকরি পেয়েছিলে?”

“হুম”

“কিভাবে?”

“আমাদের পুরো বাড়িটা বন্ধক দিয়ে আব্বা চাকরির কয়েক লাখ টাকা জোগাড় করেছিলো।যদিও ধার দেনা আবারও করতে হয়েছিলো।তবে শেষমেষ অ্যাপন্টমেন্ট লেটার আমার হাতে এসেছিলো।এরই মধ্যে আমার শুকিয়ে যাওয়া ক্ষতে নতুন ব্যাথা শুরু হলো।পিটিআই শেষ করার পরে আমাকে জয়েনিং লেটার দিয়ে জয়েনডেট জানিয়ে দেওয়ার কথা।পিটিআই এর এক সপ্তাহ আগে সে হঠাৎ করে ফিরে আসে।তা নিয়ে এলাকায় নতুন করে সমালোচনা শুরু হয়।তবে আগের তুলনায় এখন আমাকে প্রায় সবাই খুব ভালোবাসা দেখায়।জানিনা সেটা অন্তরের নাকি মুখের।”

“সে কি তোমার সাথে মিট করেছিলো?”

“আমি নিজেই চাইনি তার তার সাথে দেখা করতে বা কথা বলতে।সে যখন এসেছিলো আমার মনটাকে রাঙিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু যাওয়ার সময় ফেলে দিয়ে গিয়েছিলো অন্ধকারে।পুরো সাত বছর আমাদের যোগাযোগ ছিলো না।কিন্তু আমি এই সাত বছরে আমি আর কখনও কোনো ছেলের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকায়নি।আসলে আমার ভয় করত সবসময়।আমি চরম ভাবে ভালোবেসে নির্মমভাবে ব্যার্থ হওয়া একজন মানুষ। আমারও ইচ্ছে করে কাউকে ভালোবাসতে।ভরসাযোগ্য কোনো হাত ধরে হাঁটতে। কিন্তু ভাবতাম সেও যদি আমায় ধোঁকা দেয়।নিভৃতে নিরজনে এই সাতবছর ধরে আমি মনে মনে চেয়ে এসেছি সে আসুক।আমায় বলুক সে আমায় ভালোবাসে।আমি সাত বছরের অভিমান সাত সেকেন্ডে ভুলে তাকে জড়িয়ে ধরব।”

মাহি নিঃশব্দে কান্না করছে।মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে।মালিহার নিজের অজান্তে চোখের পানি গাল বেয়ে পরছে।সত্যিই তো ভালোবাসার মধ্যে স্পেশালিটি হলো অপরজনকে বিশ্বাস করা,অপেক্ষা করা।সাত বছর কিন্তু কম সময় নয়।মাহি মেয়েটা দেখতে কিন্তু একটু বেশিই সুন্দর।কেউ প্রপোজ করেনি এটা কিন্তু ভুল।কিন্তু মেয়েটা নিজের অনুভূতি সকলের কাছে লুকিয়ে অপেক্ষা করে গেছে।মালিহা ভাবে এমন মানুষও আছে যারা এতটা নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসতে পারে।

“আচ্ছা সে তোমার সাথে কথা কেনো বলত না?সে কি আদৌও জানতো তুমি তাকে ভালোবাসো?”

“সে জানত।কিন্তু এক অজানা কারণে তার ফ্যামিলি রাজি ছিলো না।আর ফ্যামিলির লোকজন রাজি না হলে কিছুই ঠিক হতো না।”

“সত্যিই কারণটা অজানা?”মালিহা ভ্রু কুঁচকে তাকায় মাহির দিকে।মাহি ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
” আপনি যা ভাবছেন তা নয়।একদিন ওরা বলেছিলো দরকার হলে ওদের ছেলেকে তারা ডিভোর্সী কেনো দুই বাচ্চার মায়ের সাথে বিয়ে দেবে, তবুও কোনোদিন কোনোসময় তারা আমায় মানবে না।তারা সুযোগ পেলেই আমাদের অপমান করত।রাস্তা-ঘাট সর্বত্র জায়গায়।ওদের ব্যাবহারে আমি হয়রান ছিলাম।”

“তুমি এটা তো বললে না যে সে আসার পরে কি হয়েছিলো?”

“শুনেছিলাম সে বিয়ের ব্যাপারে পরিবারকে রাজি করাতে চেয়েছিলো।কিন্তু কেউ রাজি হয়নি।উপরন্তু তারা ওর বিয়ে ঠিক করেছিলো।”

“ও কি বিয়েতে রাজি হয়েছিলো?”

“প্রথমে রাজি ছিলো না।কিন্তু শেষমেশ রাজি হয়েছিলো।”

“তারপর বিয়েটা হয়ে গেলো তাই না।” মালিহা টেবিলে হাত টান করে তাতে মাথা ঠেকিয়ে দেয়।একটা মিষ্টি মেয়ে এতটা ভালোবাসে তাও হেরে গেলো।

“সেদিন বৃহস্পতিবার ছিলো।আমি পিটিআই এর উদ্দেশ্য বাড়ি থেকে রওনা দিই।কেননা শনিবার থেকে পিটিআই শুরু।শুক্রবার আবার হরতাল ছিলো।আর শুক্রবারেই ওর বিয়ের দিন ছিলো।যেদিন রওনা দিয়েছিলাম সেদিন দেখলাম কি সুন্দর করে বিয়ের গেইট সাজানো হয়েছে।না চাইতেও তাকিয়েছিলাম। ওই মেয়েটার জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম।কিন্তু আমার ভাগ্যে বোধহয় অন্যকিছু ছিলো।আমরা এক রুমে দুজন ছিলাম।টানা দুইদিন সারারাত কেঁদেছি।খেতে পারিনি।খেতে গেলে কান্নার চোটে হিচকি উঠতো।রুমমেটকে বুঝিয়েছিলাম কখনও বাবা মাকে ছেড়ে থাকিনি তাই।সে কি বুঝেছিলো জানিনা।কিন্তু আমি ঠিকই বুঝেছিলাম আমি হেরে গিয়েছি।

শুক্রবার রাত দশটার দিকে সিকিউরিটির এক লোক এসে জানায় কারা জানি আমার সাথে দেখা করতে এসেছে।আমি প্রথমে আমার আব্বাকে কল দিয়ে শিওর হই যে আব্বা এসেছে কিনা।কিন্তু দিশা আর মায়ের কথা শুনে বুঝতে পারি ওরা বাড়িতে আছে।একজন নয় সাত আটজন ছেলে।আমি ভয় পেয়ে যাই।ওরা কেউ নিজের পরিচয় দিতে নারাজ।আমি সরাসরি হেড কোয়ার্টার এ কল করে জানিয়ে দেই আমার বাবা মা ছাড়া আমার কোনো রিলেটিভ যেনো এলাও না করা হয়।

তার পরের দিন কেউ ফোন করে আমায় বাজে ভাষায় গালিগালাজ করে।তাদের কথায় আমি কিছু বুঝতে পারিনি।পরে জেনেছিলাম ও বিয়ের দিন সকালেই কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে আসে।ওদের ফ্যামিলি মনে করেছিলো বোধহয় আমাকে নিয়েই পালিয়েছে।তাই ফোনে আমায় গালিগালাজ শুনতে হলো।

এরপর তার রাঙিয়ে দেওয়া ভালোবাসার রং কেন জানি ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।আমি জোড়পুর্বক তা ধরে রাখার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হলাম।পিটিআই শেষ করে স্কুলে জয়েন করলাম।বাচ্চাদের পড়া শিখিয়ে,ফ্রেন্ডস,ফ্যামিলির সাথে সময় কাটিয়ে আমি তাকে ভাবার সময় কই পেলাম।কিন্তু কোনো কথায় হাসতে হাসতে হঠাৎ কান্না পায়।কেউ প্রশংসা করুক বা ভালো বলুক আমার ভীষণ কান্না পায়।মাঝে মাঝে আয়নার নিজেকে দেখে নিজেই নিজের ওপর বিরক্ত হই।মনে হতো এতকিছু পেয়েও আমি ব্যার্থ।আমি যদি যোগ্যই হই তবে তাকে পেলাম না কেনো।এভাবে কিছুদিন, কয়েকদিন,তারপর তাকে ছাড়া বহুদিন। কল্পনায় তাকে ছাড়া আমি নিজেকে মানিয়ে নিলাম।ভাবলাম অনেক হয়েছে আর নয়। আমি কেনো একা একা কাঁদব। ”

মালিহা একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকে।মেয়েটা এখনও কাঁদছে।ওর চোখ বলছে সে এখনও মনে মনে তাকেই চায়।মালিহা ওর হাতে হাত রেখে বলে,

“সে যদি সামনে এসে দাড়ায় নিজের ভালোবাসার দাবি নিয়ে।তাহলে কি করবে?”

“দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলব,”আমি আপনাকে ভালোবাসি কিনা তা সঠিক জানিনা।কিন্তু আমার মনে আপনার জন্য সুন্দর কিছু অনুভূতি জমানো আছে।আপনি চাইলে আপনি আর আমি আমরা হতে চাই।” এটাই এতদিন ভাবতাম।

কিন্তু জানেন কি কান্না দেখাবেন কিংবা ভালোবাসি বলে দেখবেন অপরপক্ষ আপনার দুর্বলতা খুঁজে পাবে।আমি একজন নারী হয়ে নিজের দুর্বলতা কাউকে দেখাতে পারিনা।আমার আত্মসম্মান আছে।আগে সবাইকে ভালোবেসে তাদের অপমান নিরবে গিলেছি। কিন্তু আমি এখন আমায় অপমান করলে বা আত্মসম্মান এ হাত দিলে তাকে জবাব দেওয়ার মতো ক্ষমতা আমি রাখি।”

শেষের কথা গুলো বেশ কঠিন শোনালো।মালিহা বলে,

“সবই বুঝলাম।কিন্তু এত মানুষ রেখে তুমি আমাকেই কেনো তোমার পাস্ট,লাভস্টোরি শোনালে?”

“মানুষের জীবনে এমন কিছু কথা আছে যা পরিচিত কারুর সাথে শেয়ার করা যায় না।মনের সকল কথা প্রাণ খুলে বলার জন্য একদম অপরিচিত মানুষই বেস্ট।যেমন আপনি। আমি বলেছি আপনি শুনেছেন।পরে একটু ভাববেন তারপর ভুলে যাবেন।কিন্তু পরিচিত ব্যাক্তি হলে আমায় সব কথা বলার আগে একশ বার ভাবতে হতো।একদিন হয়তো আপনি এটাও ভুলে যাবেন কোনো এক মেয়ের সাথে এভাবে দেখা হয়ে কিছু ঘন্টা সময় অপচয় হয়েছিলো। এই অন্ধকার রাত,চুপচাপ রেস্তোরাঁ, আর এই থমথমে পরিবেশ জানুক,আমিও ভালোবেসে ছিলাম কাউকে।তার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষাও করেছিলাম।সারারাত ভর কেঁদেছিলাম।”

মালিহা অবাক চোখে চেয়ে থাকে। সত্যি মেয়েটার যেমন ধৈর্য্য ঠিক তেমন বুদ্ধিও আছে।লন্ডন ফিরে গেলে এই কথা মনে তার থাকবে কিনা সন্দেহ। কিন্তু কথাগুলো বলে সে হয়ত নিজেকে হালকা করেছে।অতিরিক্ত কষ্ট চেঁপে রাখা উচিত নয়।

বিল মিটিয়ে তারা রাস্তায় নেমে আসে।সাবিদ অনেকক্ষণ ধরেই একনাগাড়ে তাকে কল দিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে একটা কালো রংয়ের গাড়ি এসে ওদের সামনে থামে।ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে এক সুদর্শন পুরুষ। মালিহা এগিয়ে গিয়ে হাগ করে।মাহির সাথে সাবিদের পরিচয় করে দেয়।মালিহার কথায় ও জেনেছে মাহির চেয়েও বড় ওদের ছেলেমেয়ে আছে।অথচ সাবিদকে দেখলে মনে হয় সবে সাতাশে পা দিলো।

হালকা কিছু কথা বলে ওরা গাড়িতে উঠে বসে।মিনিট পাঁচেক পরেই মালিহা গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দেখতে চায় মাহিকে।কিন্তু ওরা ওই জায়গাটা ছেড়ে চলে এসেছে।সাবিদকে বলে ওরা আবারও ওইখানটায় যায়।রেস্তোরাঁর সামনে তন্নতন্ন করে খুঁজেও মাহিকে পাওয়া যায় না।সাবিদ জিজ্ঞেস করে কিছু কি হারিয়েছে নাকি।মালিহা না বলে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসে।সাবিদ অনেক কথা বললেও সে চুপচাপ ভাবতে থাকে।

মাহি ওর বাবাকে ভয়ও করত আবার ভালোবাসতো।তাহলে কি এমন হয়েছিলো যে মাহিকে ডিভোর্স করিয়ে নিয়ে এত পড়াশোনাও করিয়েছেন।তাছাড়া সবাই মাহিকে নিয়ে বাজে কথা বললেও তিনি কেনো চুপ থেকে সবটা সয়ে মাহিকে একজন টিচার বানিয়েছে।ছেলেটার নামই বা কি ছিলো।নিজের ওপর প্রচুর রাগ হচ্ছে মালিহার।অস্ফুটস্বরে সে ধ্যাত বলে ওঠে।

সাবিদ বলে,”কি হয়েছে?”সে উত্তরে বলে,”তেমন কিছুই নয়।হঠাৎ কি জানি ভেবে বলে,”তৃণা কি ফিরেছে সিলেট থেকে?”সাবিদ বলে, “না”। এখন মালিহার রাগ যেন সাবিদের ওপর।রাগস্বরে বলে,” কেমন বাবা তুমি মেয়েকে কন্ট্রোল করতে পারো না।লজ্জা হওয়া উচিত সাবিদ।তৃণা এখানকার কিছুই চেনে না।”সাবিদ উত্তর দেয়,”তৃণার সাথে কথা হয়েছে আমার।ও কাল চলে আসবে।তাছাড়া তুমিই বা কি চিনো এখানকার।সত্যি করে বলো কার রাগ কার ওপর ঝাড়ছো?”

মালিহা একটু চুপ থাকে। সত্যি তো রাগটা হচ্ছিল তার নিজের ওপর।অথচ তার রেশ তুলছিলো বেচারা সাবিদের ওপর।

রাতের গাড়িতে বাড়ি ফিরছে মাহি আর ওর বাবা।জরুরি কাজে বাবা মেয়ে দুজনে ঢাকায় এসেছিলো।কাজ বিকেলেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো।বিকেলে গাড়িতে উঠলে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত দুটো তিনটে বাজত।তখন বাজারে গাড়ি পাওয়া যাবে না।বাজার থেকে বাড়ি ওতোদুর একা তরুণী মেয়েকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরা যায় না।তাই বাধ্য হয়ে তারা নাইট কোচে বাড়ি ফিরছে।বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল আটটা নয়টা বাজবে।এর মাঝের সময়টুকু মাহি এক বাঙালি বিদেশিনীকে নিজের বহুদিনের জমানো মনের অব্যাক্ত কথা বলেছে।মাহি জানে পরিচিত কাউকে বললে সব কথা বলাও যেতো না,আবার সব বলার পরে অস্বস্তি হতো।মনের মধ্যে একটা খুঁতখুঁতে ভাব হতো।যদি সে কাউকে আবার বলে দেয়,এমন বিশ্রী এক মনোভাব হতো সর্বক্ষণ।

একটা মেয়ের সাথে মাহির সিট পড়েছে। আর ওর বাবা পাশের লাইনের সিটে বসে বারবার মেয়ের দিকে তাকাচ্ছে। পাশের মেয়েটা এতক্ষণ মোবাইল ম্যাসেন্জারে চ্যাট করছিলো।এখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।

মাহি বাহিরে তাকিয়ে দেখে রাতের অন্ধকারে যমুনা সেতুতে দেওয়া বিভিন্ন রংয়ের বাতিগুলো রাঙিয়ে দিয়ে গিয়েছে চারপাশ।কি মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। স্নিগ্ধ চাঁদের আলো,লাল নীল আলোর প্রতিফলিত ঢেউ বইয়ে যাওয়ার যমুনার পানি,নির্মল বাতাস আর হালকা অন্ধকার যেনো প্রকৃতির সাথে রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে মাহির মন।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here