রাঙিয়ে দিয়ে যাও,পর্ব:০৪,০৫

0
1127

রাঙিয়ে দিয়ে যাও,পর্ব:০৪,০৫
লেখনীতেঃমাহি আফরোজ
[৪]

“এই মিষ্টি তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়।কয়টা বাজে সে খেয়াল আছে। স্কুলে যেতে আবারও দেরি হয়ে যাবে।”

মায়ের কথা শুনে বিছানা ছেড়ে লাফ দিয়ে ওঠে সে।বিছানার পাশে মাথার দিকে থাকা টি-টেবিল থেকে চশমাটা নিয়ে চোখে দিয়ে ঘড়িতে সময় দেখে সকাল আটটা বাজে।তড়িঘড়ি করে বিছানা ছেড়ে নেমে গিয়ে আবারও ফিরে এসে মোবাইলটা হাতে নেয়।সাইডে ক্লিক করে দেখতে পায় অনস্কীনে সময়ের পাশাপাশি তারিখের নিচে সংক্ষিপ্ত ইংরেজীতে লেখা ” Fri, মায়ের ওপর বিরক্ত হয়ে আবারও কাঁথাটা জড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে।মিনিটের মধ্যেই ঘামে পুরো শরীর ভিজে যায় তার।ওপরে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে ফ্যানটা বন্ধ হয়ে আছে।ঠিক ঢাকা টু গাজিপুর জ্যামে আটকে থাকা গাড়িগুলোর মতো।বিরক্তমাখা স্বরে সে বলে উঠে,
“মা ফ্যান কেনো বন্ধ করেছো?”

মেয়ের কথা শুনে রান্নাঘর ছেড়ে আর এ ঘরে আসেন না নাজমা।তিনি এখন ব্যাস্ত হাতের রুটিকে পুর্ণিমার চাঁদের মতো গোল করতে।ব্যালন দিয়ে রুটিটাকে ৩৬০° ঘোরাতে ঘোরাতে ব্যাস্ত গলায় বলেন,
“হাতমুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি খেতে আয়।বিছানা গুছিয়ে কাঁথা ভাঁজ করে আসিস।”

একটু পর হেলতে দুলতে খাবার টেবিলে এসে ধপ করে বসে পড়ে সে।তার লম্বা চুলগুলো বিনুনি আর তেলের অভাবে অযত্নে রোদে শুকানো পাটের আঁশের মতো পিঠে ছড়িয়ে আছে।গায়ে ওয়নার জায়গায় শোভা পাচ্ছে তোয়ালে।ঘুমু ঘুমু চোখে সে রুটির প্লেটে হাত দিতেই ওর হাতটা খপ করে ধরে ফেলে দিশা।চোখে দ্বিগবিজয়ের হাসি এনে বলে,

“মা তোমার মেয়ে কিন্তু আজ ব্রাঁশ করেনি!”

ছোট মেয়ের কথায় মোতাহার খাওয়া বন্ধ করে তাকায় নিজের বড় মেয়ের দিকে।নাজমা ঘর থেকে ওড়না এনে মেয়ের গায়ে দিয়ে তোয়ালেটা নিয়ে যায়।রুটির একপাশ ছিড়ে মুখে পুড়ে বিরক্তিভাবে খেতে থাকে ও।আজ শুক্রবার কোথায় সে বারো একটা অবদি পড়ে পড়ে ঘুমাবে তা না।ওর মা এমন ভাবে স্কুলে যাওয়ার কথা বলল মনে হয় যেনো সে এখন খেয়েদেয়ে নীলরংঙা ফ্রক জামাটা পড়ে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে দৌড়াবে।মেয়ের ভাব দেখে মোতাহার বলে,
“রুটি বোধহয় পেটের মধ্যে যায়নি এখনও।খেতে বসে কি এত ভাবিস?”

কাল রাত দুটো অবদি জেগে জেগে বন্ধুরা মিলে গ্রুপ কলে আড্ডা দিয়েছে। রাত দুটো থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত ঘুমালে কত ঘন্টা ঘুম হয় তারই হিসেব করছিলো সে।বাবার কথায় আঙুলে হিসেব বাদ দিয়ে টেবিলের নিচে থেকে হাত বের করে বলে,
“মা কে বলে দেবে আমি এখন আর প্রাইমারিতে পড়ি না।সকাল সকাল এমন কায়দায় ঘুম ভাঙায়। মাঝে মাঝে আমি কনফিউজড হই।”

মেয়ের কথায় হেসে ওঠে বাবা।চেয়ারে রাখা তোয়ালেতে হাতটা মুছতে মুছতে ওনার বড় মেয়ে আবারও বলে,
“আরে বাবা আমি যে এখন টিচার তা কি ভুলে গেলে চলবে।তাছাড়া মাস্টার্স শেষ করে রেজাল্ট কার্ডও ঘরে আনলাম।বাহিরে সবাই কি সুন্দর করে মাহি ম্যাডাম বলে ডাকে।স্কুলে মিস বলে ডাকে।অথচ মা যখন তখন যার তার সামনে মিষ্টি মিষ্টি বলে আমায় শেষ করে দেয়।”

মেয়ের কথায় মোতাহার বলে,
“তোর জন্মের সময় তোকে দেখে সবাই বলত,মেয়েটা দেখতে খুব মিষ্টি। তাই…..”

“না আব্বা মিষ্টি নয় মাহি।তুমি জানো হর্টিকালচারে গিয়ে এই চিনি মিষ্টি নিয়ে কত কান্ড হয়েছে।”

“মিষ্টি তো ঠিক আছে, তাহলে চিনি আবার কেনো?”

“দুর থেকে মা হাঁক পেঁড়ে আমায় মিষ্টি বলে ডেকেছে।অমনি এক অনামুখো বাদরছানা দিশাকে বলে মামুনি তোমার নাম কি তাহলে চিনি?আর যায় কোথায়,হাতের জুসের বোতলের পুরো জুস দিশা ওদের গাড়িতে আর খোলা জানালা দিয়ে ভেতরে বসার সিটে ফেলে দিয়ে চলে এসেছে।”

“চিনি কেনো বলল?সে বললে দোষ নাই আর আমি জুস মাখিয়ে দিলে দোষ।”দিশা

” দেখেছো কেমন ঝাঁসির রানি লক্ষ্মী বাঈ”

“তবে কি তোর মতো হবো”

মাহি দিশা দুজনেই চলে যায়।মাহিকে নিয়ে অতটা ঝামেলা পোহাতে হয়নি মোতাহারের। কিন্তু দিশা একেবারে বিপরীত।কেউ কিছু বললে তাকে কথা না শোনানো পর্যন্ত সে ওখান থেকে এক বিন্দু নড়বে না।একটা কথা বা কাজ করার সময় মিষ্টি যেমন ভাবে যে লোকে কি বললে বা কেউ হাজারটা কথা শোনালেও বাড়ি এসে দরকার হয় কাঁদবে। কিন্তু মুখের ওপর উত্তর দেবেনা।কিন্তু দিশা সেসবের পরোয়া করে না।

________

স্পীডের বোতলটা জোড়ে ঘুরিয়ে দিতেই তা ছিপিওয়ালা মাথা এসে থেমে গেলো মাহির সামনে।

“ট্রুথ না ডেয়ার”

টেবিলে রাউন্ড হয়ে বসে থাকা চার চারটা মুখ এখন মাহির দিকে তাকিয়েই নিউটনের চতুর্থ সুত্র আবিষ্কার করছে।আজ তারা প্ল্যান করেই মাহিকে ফাঁসিয়েছে।মাহি চোখটা সরু করে তাকিয়ে বলে,

“ডেয়ার।বল কি করতে হবে?

রাশেদ এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু বলতে গেলেই তার আগে স্নেহা বলে ওঠে,

“ওই যে বটগাছটার নিচে একটা সাদা কার দাড়িয়ে আছে।পাশেই দ্যাখ একটা লোক দাড়িয়ে আছে।গাড়িটা তারই।তুই সোজা গিয়ে লোকটাকে বলবি
তোর পার্স হারিয়ে গেছে। পঞ্চাশ কিংবা বিশটাকা হলেও তার কাছে থেকে আনতে হবে।”

“দ্যাখ আকাশে কেমন মেঘ করছে।যখন তখন বৃষ্টি নামবে।বৃষ্টিতে ভিজলে আমার জ্বর আসবে।তোরা এতটা নির্দয়।আল্লাহ্ কি তোদের কাউকে দয়া দেখাতে বারণ করেছে।প্লিজ মাফ কইরা দে ভাই।লোকটা তো টাকা দিয়ে আবার পিক তুলে ফেসবুকেও ছাড়তে পারে।ক্যাপশন দিবে হয়ত,”দান করুন বেশি বেশি,হোক টিচার বা বিদেশি।”

“কোনো মাফ নাই।”

সত্যি আকাশে অনেক মেঘ।যখন তখন বৃষ্টি নামতে পারে।হলুদ ওড়নাটা মাথায় ভালো করে দিয়ে এগিয়ে যায় মাহি।চোখের চশমাটা আবারও ঠিক করে নেয় সে।লোকটা গাড়ির দরজা খুলে ফেলেছে ইতিমধ্যে। মাহি পেছনে তাকিয়ে কফি হাউজে বসে থাকা চারজনকে দেখে নিলো।ওরা হাত ইশারা করে দ্রুত যেতে বলছে।মাহি লোকটার কাছে গিয়ে দাড়িয়ে যায়।মিষ্টি কন্ঠে বলে ওঠে,

“এক্সকিউজ মি!”

লোকটা চকিতে পেছন ফিরে তাকালো।মাহি হাইটে লোকটার কাঁধ অবদি।বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা হয়তবা ইতিমধ্যে জমিনে পতিত হয়েছে।এবার দ্বিতীয়,তৃতীয় করে সবাই একসঙ্গে পড়ছে।গাছে,ছাদে,গাড়িতে,মাটিতে সব জায়গায়।লোকটার চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ গাঢ় হয়ে উঠল এবার।ইতিমধ্যে সে দুবার হ্যাঁ বলুন কথাটা বলেছে। কিন্তু মাহি চুপ।হঠাৎ করে কোনো পরিস্থিতিতে মাহি কেনো জানি কথা বলতে পারে না।

মাহিকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে সে আবারও বলে উঠে,
“আপনি কি বোবা?”

মাহির এবার হুঁশ হয়।সে একটু সামাল হয়ে বিস্ময়সুরে বলে,
“আশ্চর্য আমি বোবা হবো কেনো?”

কথা শুনে ড্রাইভিং সিট থেকে কালো মতোন একটা লোক জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে বলে উঠে,
“বৃষ্টি পড়তেছে স্যার।গাড়িতে উঠে বসেন।”

লোকটার কথা শুনে মাহি আর এক মুহুর্ত দেরি করল না।সেখান থেকে প্রায় আধাদৌড়ে চলে গেলো।ড্রাইভার নেমে এসে বলল,
“স্যার মেয়েটা কি চশমা পড়ে ছিলো?”

“হুম, কেনো বলোতো?”

রইস বিঙ্গানীর মতো একটু ভেবে অতি উল্লাসে বলল,
“স্যার এটাই সেই চিনি মিষ্টির মামলা।”

“চিনি মিষ্টির মামলা মানে?”

“মনে নাই হর্টিকালচারে আপনার গাড়িতে জুস এই ফালাইছিলো।”

রিয়াদ মেয়েটার ফিরে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।হলুদ ওড়নাটায় বৃষ্টির পানিতে প্রায় ভিজে গিয়েছে।জোড়ে হেঁটে যাওয়াতে পায়ের চটির ময়লা সাদা সেলোয়ারে কিঞ্চিৎ আশ্রয় পেয়েছে। লম্বায় কোমড় অবদি ঝুলে থাকা বিনুনির মাথায় সাদা পাথর বসানো কালো একটা রাবার।

“মেয়েটার নাম কি আসলেই চিনি?”

“না স্যার ওর নাম মিষ্টি। ”

বন্ধ জানালার বাহিরের বৃষ্টি দেখে মুগ্ধ হওয়া রিয়াদ অস্ফুটস্বরে বলে মিষ্টি। তারপর ল্যাপটপ কোলের ওপর নিয়ে ডুবে যায় নিজের কাজে।মিষ্টি দেখতে সেই মিষ্টি নামের মেয়েটার স্মৃতি সে রেখে আসে চার মাথার মোড়ের ওই শতবর্ষী বটগাছের কাছে।

চলবে…..

রাঙিয়ে দিয়ে যাও
লেখনীতে~ মাহি আফরোজ

[৫]

দুপুরের খাঁ খাঁ রোদের মধ্যে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে সবাই।একে তো মাথার ওপর গ্রীষ্মকালের তেজস্বী সুর্য। তার ওপর পাকা রাস্তায় পুরু করে ধানের ছড়া বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।কোনোটা ধানসুদ্ধ, তো কোনোটা ধান ছাড়াই খড় শুকানোর জন্য। বাম হাতে বই দুইটা বুকের সাথে জড়িয়ে ডান হাতে বোরকাটা একটু উঁচু করে ধরল মিষ্টি। কাঁচা ভেজা ধানের ছড়া বোরকার সাথে বেঁধে পথ চলায় অসুবিধা হচ্ছে ওদের।গরমে শরীর ঘেমে গিয়ে পিঠের দিকের বোরকা চুপছে গিয়েছে একদম।বাড়ি থেকে এতক্ষণ পর্যন্ত সৌমি আর অর্পা চুপ ছিলো।মিষ্টিও চুপচাপ আছে।মিষ্টি,অর্পা,নুর আর সৌমি একজায়গায় থাকবে আর সেখানে কোনো কথা হবে না, হাসি হবে না এমন ইতিহাস ইতিপূর্বে কখনও কেউ দেখেনি।শুধু যখন তারা কোনো বিষয়ে অধিক বিরক্ত হয় বা একঘেয়েমি লাগে তখন চুপ থাকে।

আজ স্কুলে গিয়েও কোনো ক্লাস করেনি তারা।সকালের ব্যাচে প্রাইভেট পড়ে ক্লাস না করে চলে এসেছে।স্কুল ছুটির পরে দ্বিতীয় ব্যাচে নাবিল স্যারের কাছে ওরা গণিত পড়বে।তিনি স্কুলে গনিতের ক্লাস না করালেও জটিল অংক খুব সহজেই সবাইকে বুঝাতে সক্ষম।
নির্বাক মিষ্টির দিকে তাকিয়ে গম্ভীর স্বরে অর্পা জিজ্ঞেস করে,
“মিষ্টি তোকে একটা কথা বলি?”
“হুম বল,”
“আবির ছেলেটা কিন্তু ভালো নয়।”
“আমি জানি।” মিষ্টি আনমনেই জবাব দেয়।মিষ্টির এমন গা ঝাড়া উত্তর জ্বালা ধরিয়ে দেয় অর্পার মনে।সে ক্ষিপ্ত হয়ে বলে,
“তুই জানিস ও কি করেছে?”
ভ্যাপসা গরমে নিরবে পাশ কাটিয়ে যাওয়া মেয়েদের দলগুলো ফিরে তাকায় ওদের দিকে।অর্পা একটু জোড়েই কথাটা বলেছে।সে আবারও ফিসফিসিয়ে বলে,
“তুই কি সত্যি জানিস ও কি করেছে?”

“যার যা ইচ্ছে তাই করুক।তোর তাতে কি অর্পা?বাদ দে না এইগুলো কথা।রাস্তার মধ্যে এসব কথা ভালো লাগে না।”

“বুঝলাম মিষ্টি পাগল হয়ে গিয়েছে।কিন্তু সৌমি তুই কেনো ওকে সাপোর্ট করিস।”

“তো কি করব?রাস্তার মধ্যে মাইকিং করব।মিষ্টিকে যতই কিছু বলিস না কেনো ও শুধু আমাদের হ্যাঁ তে হ্যাঁ আর না তে না মেলাবে।কিন্তু শেষে কি হবে জানিস?শেষে হবে সাতখন্ড রামায়ন পড়ে সীতা রামের মাসি।”

সৌমির সাথে মিষ্টির বন্ধুত্ব একেবারে ছোটবেলা থেকে।পাশাপাশি বাড়ি ওদের।সৌমি বরাবরই চুপ স্বভাবের মেয়ে।ও খুব মানে মিষ্টিকে।কিন্তু আজ সে এমন কথা বলবে ভাবতে পারেনি মিষ্টি। সে আওয়াজ নিচু করে বলে,

“সৌমি অর্পা বিশ্বাস কর তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নাই।”

“মিষ্টি দরকার হয় আমার পায়ের জুতো খুলে তুই দুটো বাড়ি দে আমার গালে,কিন্তু আমায় এটা বিশ্বাস করতে বলিস না।আমি পারবো না।কারণ কাল বিকেলবেলা তুই যখন ওর সাথে কথা বলছিলি তখন ও আমার সামনে ছিলো।”

মিষ্টি দাড়িয়ে যায়।মিষ্টিকে ভাবতে দেখে অর্পা আবারও বলে,
“ঘটনা এখানেই শেষ নয়।আমার কাজিন সীমাকে তো চিনিস।”

“ওই সীমা যে আমাদের স্কুলে পড়ে?”

“হ্যাঁ। আবির এতটাই শয়তান আর মিথ্যেবাদী ছেলে যে সবসময় মিষ্টিকে মিথ্যে বলে যায়।সীমার পেছনে সে গত দুইমাস ধরে ঘুরছে।”

“অর্পার কথা একবার ভাব মিষ্টি। তুই কি মনে করবি তাই বলিনি।পাড়ায় যে তোর আর আবিরকে নিয়ে কথা হচ্ছে, সেটা অন্য কেউ নয় আবিরই সবাইকে বলেছে।”

সৌমির কথায় মিষ্টি অবাক চোখে তাকায়।ও ভাবত অর্পা তো সবসময়ই বেশি বেশি বলে।কিন্তু সৌমি তো বানিয়ে বা মিথ্যে বলার মেয়ে নয়।

কথা বলতে বলতে ওরা মন্ডল বাড়ির সামনে এসে দাড়ায়।ওখানে প্রকান্ড কৃষ্ণচুড়া গাছের নিচে ইট সিমেন্ট দিয়ে বসার জায়গা করা।মিষ্টি ওখানে বসে পড়ে।মাথায় হাত দিয়ে ফুঁপাতে শুরু করে সে।কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,
“বিশ্বাস কর, আমি যখন ওকে সীমার কথা জিজ্ঞেস করি ও সম্পুর্ণ এড়িয়ে যায়।সীমাকেই যদি তার পছন্দ তাহলে আমাকেই বা কেনো নিজের কথার জালে ফাঁসায়।”

“কারণটা হলো ও ছেলেটা এমনই।এই কাগজটা দ্যাখ।”

সৌমির কথায় মিষ্টি কাগজটা নিয়ে পড়তে থাকে।খুবই আবেগমাখা ভাষায় আবির অর্পাকে চিঠি লিখেছে।অর্পা মিষ্টির পাশে বসে।মিষ্টি নিঃশব্দে কাঁদছে। সৌমি ওর সামনে দাড়িয়ে ওকে আড়াল করে আছে।

“মিষ্টি এই বয়সে তোর ওপরে যে সমালোচনার ঝড় গিয়েছে তাতে তোর উচিত এসব থেকে দুরে থাকা।”

মিষ্টি স্হান,কাল ভুলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।সে নিজেকে ধিক্কার দিতে থাকে এমন একটা বোকামি করার জন্য। মিষ্টি সরলমনে আবিরকে যে বিশ্বাস করেছিলো তা নিমিষেই অবিশ্বাসের সাগরে নিমজ্জিত হলো।কিন্তু সে ভালোবেসে কাউকে প্রথমবারের মতো।কারো চোখের মায়ায় হারিয়েছে।চাইলেও সে ছাড়তে পারছে না আবার আঁকড়ে রাখতেও পারছে না।সে বসে থেকে অনবরত কেঁদেই যাচ্ছে।একটা মানুষ কতটা নিচে নামলে একটা মেয়ের সাথে এমন করতে পারে।এটা ভাবতেই মিষ্টির কান্না পাচ্ছে।সে ভেবে পাচ্ছে না সবকিছুতে ওর নিজের দোষ কোথায়।ভালোবাসাই কি তবে দোষের।

_________

দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করে একটা ঘুম দিয়েছিলো নাজমা।কিন্তু তার ঘুম ভেঙে গেলো কারো কান্নার আওয়াজে।চোখ মেলে দেখে মাহি শুয়ে থেকে অনবরত ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। তড়িঘড়ি করে মেয়ের গায়ে হাত দিয়ে ঘুম ভাঙায় সে।ব্যাস্ত আর উৎকন্ঠিত হয়ে বলে,

“মিষ্টি, এই মিষ্টি। কি হইছে।মাহি মা আমার।চোখ মেলে তাকা একবার।এই দিশা…

মায়ের চেঁচামেঁচিতে মাহি চোখ মেলে তাকায়।কাঁদতে কাঁদতে আবারও জড়িয়ে ধরে মাকে।কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলে,

” আমায় ও ঠকিয়েছে মা।আমায় মিথ্যে বলেছে।আমি তো হেরে গিয়েছি…।”

____________

“সৌমি তোর ছেলে কিন্তু তোর মতোই হয়েছে দ্যাখ।”

মিষ্টির কথায় একটু হাসে সৌমি।দু’মাস আগে সৌমির একটা ছেলে হয়েছে।আগে সারাদিনে কত কথা বলত অর্পা,মাহি,সৌমি আর নুর।কিন্তু এখন কারো সাথে তেমন যোগাযোগ নেই।পাশাপাশি বাড়ি হওয়ার সুবাদে সৌমির সাথে দেখাটা হয়ে যায়।কিন্তু অর্পা আর নুরের সাথে দেখা হয়নি কত বছর।কথা হয়নি।অবসরে কত কথা জমে যায় কি কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না।

এসএসসি দেওয়ার পরেই একে একে মাহি বাদে সকলেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে।তিনবছর আগে অর্পার সাথে দেখা হয়েছিলো।জেলা হাসপাতালে কি জানি দরকারে গিয়ে হঠাৎ দেখা হলো।কিন্তু কথা বেশিক্ষণ আর হলো না।নিজের সিরিয়াল আসতেই বিদায় জানিয়েই ইতি টানতে হলো।অথচ আগে স্কুলে যাওয়ার সময় ও আসার সময় কত কথা বলবে। তবুও মনে না পুষালে বাড়ি এসে ফোনে কথা বলবে।অথচ সেই তারাই সাড়ে তিন মিনিটে নিজেদের কথা শেষ করে নিজ গন্তব্যে চলে গেলো।

নুরের সাথে দেখাটা হয়েছিলো চলন্ত গাড়িতে।সড়কের পাশে ধানের খোলায় সেদ্ধ ধানে পা দিচ্ছিলো নুর।পড়নে আনফিটিং সেলোয়ার কামিজ।রোদে পুড়ে গালদুটো তার লাল হয়ে গিয়েছে।গায়ের রং সে আগের মতো নেই।পর পর দুটো ট্রাক একসাথে আসায় এই ক্ষণিকের স্বাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলো মাহি।গাড়িতে বসে থাকা এক মেয়েকে নিজের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে কিংবা কাকতালীয় ভাবেই নুর তাকিয়েছিলো ওর দিকে।কড়া রোদের রশ্নি ভেদ করে মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা দেওয়া মাহির মুখটা হয়ত নুরের চোখে ধরা দেয়নি।তাই দৃষ্টি ফিরিয়ে আবারও নিজের কাজে মনোযোগ দিয়েছিলো সে।সেদিন চোখ থেকে মাইনাস পাওয়ারের চশমাটা খুলে খালি চোখেই মাহি তাকিয়ে ছিলো নুরের দিকে।

স্কুল জীবনে নুর ছিলো ওদের দলের সবচেয়ে রূপচর্চায় আগ্রহী মানবী।কোন ক্রীমের কি কাজ,কোন ক্রীম দিলে ত্বকটা ফ্রেশ থাকবে আরও হাবিজাবি ছিলো ওর চিন্তায়।গায়ের জামা এমন তেমন হলে তার মাথা ঠিক থাকত না।পড়াশোনার চেয়ে সে বেশি ফ্যাশানে মরিয়া ছিলো।আজ বিয়েটা তার ভালো বাড়িতেই হয়েছে।তবে নিজের সংসার নিজেকে বুঝে নিতে গিয়ে সময়ের সাথে ত্বকের প্রতি যত্নশীল নুর বোধহয় দুদিনে একবারও আয়না সামনে দাড়ানোর সময় পায়না।

আর সৌমি তো বিয়ের পরও পড়ার জন্য কত অশান্তি করে ভর্তি হওয়ার পরেও কলেজ গেলো না।বাসার কাজ আর রান্নাঘরেই হাতা খুন্তিতেই সে পার করে দিলো এত বছর।

মাহির ভাবনার মাঝেই দিশা কই থেকে জানি এসে বলে,
“মা ডাকছে তোকে চল?”

“কেনো?”

“ঘুমের মধ্যে একবার হাসিস আবার কাঁদিস।তাই হুজুরের কাছে গিয়ে ঝাড় ফুঁক দিয়ে নিয়ে আসি?”

দিশার কথায় অবাক হয়ে বলে সৌমি,”ভুতে ধরছে নাকি তোকে?”

বিছানা ছেড়ে নিচে নেমে মাহি বলে,”ভুত নয়,জ্বীন।বড্ড জ্বালিয়ে মারছে।”

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here