রাঙিয়ে দিয়ে যাও,পর্ব:১৬,১৭
লেখনীতেঃ মাহি আফরোজ
[১৬]
পানির বোতল হাতে গাড়ির কাছে এসে মাহিকে না পেলেও রিয়াদ স্টিয়ারিং এর কাছে সাদা চিরকুটটা পেলো।চিরকুটের ভাঁজ খুলতেই কালো রঙের কালিতে মাহির হাতের লেখা জ্বলজ্বল করে উঠল।কি জানি লেখাটা লিখতে গিয়ে তার চোখটাও বুঝি জ্বলে গিয়েছিলো বিষাদে।
…..
I have long hair,good job and also smart look.I am never identified about my this quality. But always the knownable person called,”Mishti is a divorce girl”.I am so afraid about to trust of love.
………
সময় পেরিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ।গাড়ির জানালার স্বচ্ছ কাঁচটা নামিয়ে ড্রাইভিং সিটেই বসে আছে রিয়াদ।ওর মনে জমা থাকা সুন্দর এই অনুভূতিগুলো কেনো জানি ভেঙে গুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে।মাথাটা কেমন জানি ফাঁকা লাগছে।আরও দুইঘন্টার মতো সে গাড়িতেই বসে থাকলো তবুও ভেবে পেলো না কি করবে।কথাগুলো কাকে বলবে।ভালোবাসা কারণ দেখিয়ে হয়না।পথ চলতে চলতে গড়ে ওঠে মনের সখত্ব।একে ওপরকে ভালোলাগা তারপরই ভালোবাসা।কিন্তু অতীত জীবনের বড় ক্ষত মনে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া মাহিকে সে কি করে সবটা বোঝাবে।সে তো ভয় পায় ভালোবাসতে।
________________
সেদিন রাতে আর কারোরই কিছু খাওয়া হলো না।মোতাহার খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে।মাহির রুমের বাতিটা নিভিয়ে ধীরপায়ে নিজের ঘরে এলো নাজমা।ও চেয়েছিলো আজকের রাতটা মেয়ের কাছে ঘুমাতে।মাহি কোনো প্রতুত্তর করেনি।কিন্তু মোতাহারই নাজমাকে নিষেধ করেছে।নাজমার মনে বড় ভয়।যদি মেয়েটা কিছু করে বসে।বিষাদগ্রস্ত মনে সে স্বামীর পাশে গিয়ে বসে।এমন হাউমাউ করে কান্না বোধহয় মাহি সেই বিয়ের সময়ই কেঁদেছিলো।তারপর এমন আহাজারি করে কান্না করতে দেখা যায়নি তাকে।নাজমা ক্ষীণ কন্ঠে বলে,”মিষ্টির আব্বা, আমার অনেক ভয় করছে।মেয়েটা যদি কিছু…..আর বলতে পারে না সে।আঁচল মুখে চেপে ধরে কন্ঠ নিঃসৃত কান্নার শব্দকে প্রতিরোধ করে।তবুও ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে ওঠে ওর সর্বাঙ্গ।
“আমার মেয়ে খুব সাহসী নাজমা।নিজের কষ্ট,চোখের পানি এগুলো বাহিরের লোকের কাছে থেকে লুকাতে সে নিজেকে একটা শক্ত খোলসে আবৃত করেছে।কিন্তু সেই খোলসের অভ্যন্তরে শিশুসুলভ কোমল হৃদয়টা আছে, তা আমি জানি জানি।জীবনে বেঁচে থাকতে গেলে যতটা সাহস লাগে,মরতে গেলে তারচেয়েও অনেকগুন বেশি সাহস লাগে।” স্বামীর কথায় নাজমা বলল,”কিন্তু আজ আপনিও নিজের চোখে ওর চোখের পানি দেখেছেন।আমার মেয়েটার সাথে কি হয়েছে তা বুঝতে পারছেন কি কিছু?আদৌও কি তার চোখের পানি আর কষ্টের আহাজারি স্পর্শ করেছে আমাদের হৃদয়। ”
“মিষ্টির মা তুমি কিন্তু আজ খুব শক্ত শক্ত কথা বলতেছো।এত শক্ত কথা আমার বোধগম্য হয়না।আমার মেয়েটাকে আমি খুব ভালোভাবে চিনি।সবকিছু থেকে পালাতে পারলেও নিয়তি থেকে পালানো যায়না।হয়তো নিয়তির লিখন ওর বানানো শক্ত আবরণ ভেদ করে হৃদয়ে আঘাত করেছে।তাই সহ্য করতে না পেরে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে।ওকে সময় দাও।মনের জোর বাড়াতে দাও।নিজেকে সামলে ও আবার উঠে দাড়াবে।এটাতো ওর দীর্ঘ দিনের পথ চলার বিরতি।যে যাই বলুক,আমি ওর অনিচ্ছায় আর বিয়ে দিতে চাই না।”
নাজমা বিছানায় ঠাঁই বসে থাকে।আজ প্রথম ওর মনে হচ্ছে মোতাহার বাবা বলে মেয়ের কষ্টটা বুঝতে পারছে না।অথচ এতদিন মেয়ের পাশে সেই ছিলো।নিরবতা ভেঙে মোতাহার বলে,
“মিষ্টির মা,তোমার মনে আছে।মিষ্টি যখন হাইস্কুলে পড়ত তখন ওদের স্কুলে শিক্ষা সফরের আয়োজন হয়েছিলো?” নজমা সম্মতি জানিয়ে বলল,”মনে আছে আমার।টাকার অভাবে মিষ্টি যেতে পারেনি।”মোতাহার বলে,”মাত্র ৩৭০ টাকার অভাবে মিষ্টি সেইদিন সবার সাথে শিক্ষা সফরে যেতে পারেনি।কিন্তু তার পরে আমার কাছে ৩৭০ টাকার চেয়েও বেশি টাকা ছিলো।মিষ্টিকে আমি তার দুমাস পরেই এক হাজার টাকা দিয়েছিলাম।অথচ সে সন্তুষ্ট ছিলো না।কোনো হাসি ছিলো না তার মুখে।কিন্তু শিক্ষা সফরে যাওয়ার আবদার নিয়ে মেয়েটা যেদিন আমার কাছে এসেছিলো কি খুশিই না সে ছিলো।এই শিক্ষাটাই আমার যথেষ্ট ছিলো।যখন দেখলাম আমার মিষ্টি সব ভুলে নতুন উদ্যমে পড়া শুরু করল।একজন শিক্ষকা হবে বলে আমার কাছে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলো।সেদিন আমি প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলাম আমি আমার মেয়েটাকে পড়াবো।আমার যতই কষ্ট হোক না কেনো তার ইচ্ছেটা পুরণ করব।আজ হয়ত আমার কাছে টাকা নেই।কিন্তু ভবিষ্যতে একদিন হবেই হবে।আজ যদি মেয়ের ইচ্ছেটা পুরণ না করি তাহলে সেদিনের টাকা আমার কাজে লাগবে না।আমার ভাবনা মিথ্যে ছিলো না নাজমা। আজ সত্যি আমার কাছে যথেষ্ট টাকা আছে।আর আমার মেয়ের খুশিও আছে।”
নাজমা মোতাহারের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে।ভাবে আজ বোধহয় ওর স্বামী পাগল হয়ে গিয়েছে।মেয়েটার কি অবস্থা অথচ সে বলছে মেয়ে খুশি।মোতাহার কিছু বলতে গিয়ে পারে না।গুছিয়ে রাখা কথাগুলো গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে।কন্ঠনালী শুকিয়ে যায়।হাসফাস করতে থাকে বুকের ভেতর।সে নাজমার দিকে চেয়ে অশ্রুসজল চোখে বলে,
“আমাকে তোমার নির্দয়, পাষাণ মনে হচ্ছে নাজমা।কি ভাবছো তুমি, যে আমি বাবা বলে মেয়ের কষ্ট বুঝিনা।বিশ্বাস করো বুকটা ফেটে যাচ্ছে আমার।তুমি তো কেঁদে কেটে হালকা হলে আমি কি করব বলো।আমার কষ্টগুলো তো কমে না।আমার সামনে মেয়েটা হাউমাউ করে কাঁদল আর আমি এতটাই কঠিন মানুষ যে আমার কিছুই হবে না।”
রাতের প্রহর একের পর এক কেটে যায়।কিন্তু বুকের ভেতর বাসা বেঁধে থাকা কষ্টরা বিদায় হয়না।রাতের নিশাচররা লুকিয়ে পড়ল,আঁধার কাটিয়ে পৃথিবীতে আলো ফুটলো,তবু তাদের কষ্টের ভাগটা কমলোনা।
__________
আরো তিনদিন সময় পার হয়ে যায়।রিয়াদ মাহিকে ফোনেও পায়না।বোধহয় ফোন অফ।স্কুলে খবর নিয়ে জানতে পারে সে পুরো সাতদিনের ছুটি নিয়েছে।রাশেদের কাছে থেকে জানতে পারে মাহি নিজ বাড়িতেই আছে।তবে রাশেদের সাথে বেশি কথা হয়নি।সবদিক থেকেই রিয়াদ মাহির থেকে আলাদা।হুট করে তো আর কারোর বাসায় যাওয়া যায় না।তাছাড়া রিয়াদের জানামতে মাহির আশেপাশের লোকজন খুব একটা ভালো নয়।একটা অজানা ছেলে বাড়ি বয়ে খবর নিতে আসাটা ভালো নজরে দেখবে না বোধহয় কেউ।
অফিস থেকে বাসায় মাত্র এসেছে রিয়াদ।মন অস্থির থাকলে কাজে মন বসে না।তাই আজ একটু আগেই বাড়ি ফিরেছে সে।তার একটু পরেই ওর কাছে ড্রাইভার আসে চাবি নিতে।রিয়াদ চাবি দিয়ে দিলেও রইস সরে না।সে ঠাঁই দাড়িয়ে থাকে।রিয়াদ ক্লান্ত শরীরটা কাউচে বিছিয়ে দেয়।ইশারায় রইসকেও বসতে বলে।কিন্তু সে না বসে আগের মতোই দাড়িয়ে থাকে।রিয়াদ বলে,”কিছু কি বলতে চাও?”রইস মাথাটা নিচু করে বাধ্য ভৃত্যের মতো বলে,
“আজকে বড় স্যার আপনার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে গিয়েছিলো?”
রিয়াদ অবাক হয়না, তবে ভ্রু জোড়া কুচকে থাকে।ওর বাবা যে মেয়ে দেখছে তা ওর অজানা নয়।কিন্তু এই কথাটা ড্রাইভারের থেকে একা আলাদা জেনে নেওয়াটা ওর ভালো লাগল না।তাই পরে এ নিয়ে কথা বলব বলে ওকে চলে যেতে বলে।রইস দরজার কাছে গিয়ে আবারও ফিরে আসে।মোবাইলের গ্যালারী থেকে একটা সেভ করা ছবি বের করে দেখায় রিয়াদকে।ছবিটা দেখে তেমন আর্কষণ হয়না তার।কি এমন স্পেশালিটি আছে এর মধ্যে। গায়ে শাড়ি জড়িয়ে আর হালকা কিছু গয়না।লম্বা চুলগুলো খোলা পড়ে আছে।হঠাৎ সে উঠে গিয়ে রইসের হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নেয়।ভালো করে দেখে এটা আর অন্য কেউ নয় বরং মাহি।সালোয়ার -কামিজ,কুর্তি, চুরিদার সাথে বেণী করা চুল এমন গেটআপেই সে সবসময় মাহিকে দেখেছে ও।শাড়ি পড়ে বা খোলা চুলে কখনও তাকে দেখা হয়নি বিধায় প্রথমে বুঝতে পারেনি।
রইস চলে যায়।নিয়তির খেলা বোঝা বড় দায়।জীবন আমাদের কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে আসে।আমরা যা চাই তা হয়তো আমাদের নাগালেই থাকে।কিন্তু আমরা টের পাইনা।আমাদের কেউ হারিয়ে গেলে আমরা সব জায়গা খুঁজি, অথচ নিজের বাড়িতে খুঁজি না।চাহিদার জিনিসটা সহজেই পেতে চাই না আমরা।রিয়াদ অফিসের শার্টেই বসে থেকে ভাবে মাহি কি আদৌও জানে সবটা।নাকি সবটাই তার অগোচরে।
চলবে…….
রাঙিয়ে দিয়ে যাও
লেখনীতে -মাহি আফরোজ
[১৭]
মেইন রোডের থেকে সাত আট মিনিট পায়ে হাঁটা রাস্তায় নিরিবিলি পরিবেশে এই কফি হাউজটা অবস্থিত। একদম খোলামেলা পরিবেশ।জমিনে বিছিয়ে রাখা সবুজ রঙের কার্পেটাকে মাহি ঘাস ভেবে ভুল করেছিলো প্রথমদিকে।খোলা মাঠের মতো জায়গা। শুধু প্রবেশপথের গেটটা সুন্দর করে ডেকোরেশন করা।সাথেই ছোট একটা রুম।ওখানে বোধহয় কফি তৈরি করে।চারদিকে প্লাস্টিকের বেতের তৈরি হাফ প্রাচীর আর তাতে জড়িয়ে আছে ছোট ছোট স্বর্ণলতা গাছ।বেতের সাথে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে সে তৈরি করেছে তার দুনিয়া।বিকেলের মুক্ত বাতাস এনে হানা দিচ্ছে চোখে মুখে।সবাই যে যার মতো বসে আছে।ওপরে খোলা নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা সাদা মেঘ।মেইন রোডে চলাচল করা গাড়ির তীব্র শব্দ ক্ষীণমান হয়ে শোনা যাচ্ছে এখানে।পুর্বদিকের কোনায় একটা গাছ।পাতাগুলো সিঁদুরে রঙ আর গাছের কান্ড, ডালপালা সব খয়েরি রঙের।গাছটা আগে কখনও দেখেনি সে।গাছে বসে থাকা পাখিটা ডেকে চলেছে অনবরত।
নির্দিষ্ট সময়ের কিছু আগেই এসেছে মাহি।গায়ে তার টকটকে লাল রঙের শাড়ি,তাতে মোটা কালো রঙের পাড় দেওয়া।কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে তার।সেদিন রাতের পর ও নিজেই ওর মাকে বলেছে ও বিয়ের জন্য রাজি।উড়োভাষায় ও শুনেছে আবিরের নাকি বিয়ে।মাহি চায়না সে আবিরের বিয়ে ওর বিয়ের আগে হোক।যদি এমনটাই হয় তবে লোকজনের কাছে থেকে আবারও কথা শুনতে হবে।আমাদের আশেপাশের মানুষগুলো সমালোচনা করতে করতে এমন পর্যায়ে মানুষকে নিয়ে যায় যে সেই ব্যাক্তি আত্মহত্যাও করতে পারে।অথচ প্রতিবেশীর কর্তব্য হচ্ছে অসময়ে মানুষকে সান্তনা দেওয়া।মোতাহার নাজমার থেকে কথাটা শুনে মোস্তফার সঙ্গে যোগাযোগ করে।মোস্তফা ইতিপূর্বে একবার এসে মোতাহারকে বলেছিলো মাহির বিয়ের কথা।কিন্তু সে মেয়ের কথা ভেবে না করে দিয়েছিলো।কিন্তু আজ যখন মেয়ে রাজি তখন তিনি দেরি করতে চান না।একজন ভালো মনের মানুষের সান্নিধ্যে থাকলে মাহি নিশ্চয়ই সুখী হবে।
একঘন্টা পার হয়ে গেলো তবুও ছেলেটা আসল না।অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত মাহি।বাবার মুখে শুনেছিলো যে ছেলেটা চাকুরিজীবি আর অবিবাহিত। শুধু ছেলের বাবা এসেই দেখে গিয়েছিলো ওকে।এমনকি উনিই ফোন করে এখানে আসতে বলেছিলেন আর উনার ছেলেকে এখানে পাঠাবে বলেছিলো।কথাটা মনে হতেই স্মিত হাসলো মাহি।বোধহয় লোকটা নিজের ছেলেকে রাজি করাতে পারেনি এখানে আসতে।আজ একজন সেল্ফ ডিপেন্ডেড আনম্যারিড মানুষ কখনওই চায়না একজন ডিভোর্সী মেয়েকে বিয়ে করতে।ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে সে ওই আকাশের দিকে তাকায়।চোখে তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলের কণা।ঘনীভূত মেঘের মতো তারাও বৃষ্টির প্রস্তুতি নিচ্ছে।আমাদের জীবনটা খুবই অদ্ভুত। সময় খারাপ এলে জোড় করেও খুশি থাকা যায়না।হাজারও ভালোর মধ্যে মানুষ আমাদের অতিক্ষুদ্র ভুলও উপস্থাপন করে।জীবন আমাদের পদে পদে শিক্ষা দেয়।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমরা শিক্ষা নেই জীবন থেকে।
ছোট্ট কোমল হাতের ছোঁয়ায় ধ্যান ভাঙ্গে মাহির।শাড়ির আঁচলে চোখটা মুছে নেয় সে।আজকাল সে খুবই ছিঁচকাদুনে হয়েছে। কথায় কথায় চোখে পানি হাজির।ছয়-সাত বছরের একটা ছোট্ট ছেলে মাহির হাতটা ধরে আছে।বাম হাতে তার হলুদ খাম আর একটা বেলি ফুলের মালা।ওগুলো টেবিলে রেখে দৌড়ে চলে যায় সে।মাহি মালাটা হাতে নিয়ে গন্ধ নেয়।বেলির সুভাসে মনে প্রশান্তির হাওয়া বইয়ে যায়।সুন্দর কথার একটা গান মৃদু আওয়াজে বেজে চলেছে সাউন্ডবক্সে।জীবন কেনো এত সুন্দর হয়না।এই ফুল, গন্ধ গানের কথা কত সুন্দর। জীবন যদি গানের কথার মতো, ফুলের সুবাসের মতো এত সুন্দর হতো তবে আমি গলা ছেড়ে গাইতাম। যদি গলা নিসৃত আওয়াজে পাওয়া যেতো সেই বেলি ফুলের সুবাস তবে কত সুন্দর না হতো।
মালা রেখে খামটা হাতে নেয় সে।খামটা খুবই সাধারণ। ভেতরের সাদা কাগজখানাও খুব সাধারণ। আগুন্তক ব্যাক্তি বোধহয় খাম আর কাগজের চেয়ে কালো কালির লেখার বিষয়বস্তুকেই বেশি প্রাধান্য দিতে চেয়েছে।পুরো এক পৃষ্ঠার চিঠি।কোনো সম্বোধন নেই যাতে প্রেরকের সম্পর্কে জানা যেতে পারে।মাহি সম্বোধনহীন চিঠিটা পড়তে শুরু করে।
……..
আমাদের জীবনটা খুব সুন্দর। খুব সরল আর খুবই আরামদায়ক। যদি আমরা এমনটাই ভাবি তবে দুঃখ,কষ্ট, ক্লেশ আমাদের স্পর্শ করতে পারবে না মাহি।নশ্বর পৃথিবীর ক্ষণস্থায়ী জীবন আমাদের। প্রতিনিয়ত আমরা হাজারও মানুষ দেখি।তাদের সাথে পরিচিত হই,কথা বলি।কাউকে ভুলে যাই,আবার কাউকে ভুলতে পারিনা।আসলে হঠাৎ কাজের ফাঁকে তাদের কথা মনে পড়ে।আমরা চাইলেও কাউকে ভুলতে পারিনা।এই ভাবি যে নাহ্ আর তাকে ভাববো না।কিন্তু পরক্ষণেই তার কথা আবার মনে পড়ে।হয়ত তাকে নাও পেতে পারি এমন কথা জেনেও আমরা তাদের পছন্দ করে থাকি।আপনমনে কল্পনায় তাদের এঁকে চলি।আমার জীবনের এমনই এক আগুন্তক তুমি।প্রথম দেখাটা আমাদের পরিকল্পনা ছিলোনা।গোলাকার পৃথিবীতে ঘুরতে ঘুরতে আমাদের হঠাৎ দেখা হয়ে গেলো।তারপর ভুলেও গেলাম।কিন্তু রাতের বেলা যখন কাঁচের ওপর বিন্দু বিন্দু পানি দেখলাম তখন হঠাৎ করেই মনে পড়ল চারমাথার মোড়ে দেখা তোমাকে।বৃষ্টির কাঁচের ন্যায় স্বচ্ছ ফোটাগুলো তোমার মুখে যত্নে ছড়িয়ে ছিলো।তখন নজরে না এলেও সেই একাকী রাতে ব্যালকোণিতে দাড়িয়ে ভেবেছিলাম আমাদের আবার দেখা হবে।
আমার নিছক ভাবনা সত্যি করে দিয়ে আমাদের আবারও দেখা হলো।ভাবতেই পারিনি এত সহজে তোমায় দেখতে পারব।এত সহজভাবে আমার সাথে সবটা সবসময় হয়না।আমার কাঙ্খিত জিনিস আমি সহজে পাই না।বিষয়টা যে কতটা কঠিন তা তখনই পরিষ্কার হলো যখন রাশেদের সঙ্গে আমার দেখা হলো।সেইদিনই বুঝেছিলাম রাশেদ তোমার বন্ধু কম ভাই বেশি।রাশেদ আমায় সবটা বলেছিলো তোমার সম্পর্কে। রাশেদ চায়না ওর বন্ধু আবারও কষ্ট পাক।কেউ তার সাথে চিটিং করুক।আমি রাশেদের কাছে ওয়াদা বদ্ধ মাহি।তাকে তাকে কথা দিয়েছিলাম আমি তোমার পাশে থাকব।রাশেদ হয়তো বুঝেছিলো আমার কথা।কিন্তু তুমি বোঝোনি।
খারাপ আর ভালো উভয়দিকের সমষ্টি আমাদের জীবন।তোমার বাবা তোমায় কতটা সাপোর্ট করে মাহি, তোমার মা,বোন তারা সবাই তোমাকে ভালোবাসে।তোমার বাবা একজন অক্ষরঙ্গানহীন মানুষ হয়েও তোমাকে আবারও অকালে ঝরে যেতে না দিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ দিয়েছে।সাথে থেকে তোমায় নিজের স্বপ্ন পুরণে সাহায্য করেছে।এগুলো অনেক সৌভাগ্যের মাহি।সবার ভাগ্য এত ভালো হয়না।এত এত ভালো কি যথেষ্ট নয় তোমার অতীতের একটা বাজে সময় ঢাকতে।একটা কালো রঙ যদি পারে চোখটাকে এত সুন্দর করতে তবে অতীতের সেই বাজে সময়টা কেনো তোমাকে সুখি করতে পারে না।সবসময় কেনো নিজেকে নেগেটিভ ভাবো।এমন মেয়েও আছে যারা হয়ত ডিভোর্সী নয়,কিন্তু বিয়ে হয়ে তারা অসুখী। তুমি একজন স্বাধীন মানুষ। একটা বাচ্চাকে সুন্দর করে সাজিয়ে কপালে বামপাশে কালো বৃত্ত এঁকে দেওয়া হয় যাতে কারো নজর না লাগে।তোমার তপ্ত অতীতটাকে তুমিও নজরটিকা বলে মেনে নাও, দেখবে নিজেকে মুক্ত লাগবে।মন খুলে হাসতে পারবে।
আমাদের জীবনে চলার পথে এমন কিছু মানুষ জোটে যারা সুনিপুণ অভিনয়ে পাশে থাকে আর সুযোগ বুঝে স্বার্থ নিয়ে কেটে পড়ে।আবির তেমনই এক মানুষ। ভালোবাসার মর্মকথা সে বোঝে বলে আমার মনে হয় না।যে মানুষটা নিজেরভালোবাসা কে যে সম্মান দিতে পারে না সে আমার কাছে মানুষ নয় মাহি।তুমি তাকে আমার চেয়ে বেশি চেনো,জানো আর হয়তো ভালোও বাসো।কারো সম্পর্কে সমালোচনা করার অধিকার আমার নেই মাহি।আমি তোমায় ভালোবাসি।আমার না হলেও চলবে।কিন্তু এমন মানুষকে নিজের জীবনে ঠাঁই দিওনা যে তোমার ভালোবাসাকে সম্মান দিতে পারবে না।
সেদিন বিকেলে আমি চেয়েছিলাম তোমাকে আমার বাড়ি নিয়ে যেতে।কিন্তু তা সম্ভব হয়নি।তুমি পিছিয়ে গিয়েছিলে।তোমার চলে যাওয়া আমি দেখেছিলাম কিন্তু আটকাতে আসিনি।আমি চাইনি তুমি জবরদস্তি আমার কাছে থাকো।ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করতে নেই।আমি তোমাকে আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে পরিচয় করাতে চেয়েছিলাম। তাদের ইতিপূর্বেই সব জানিয়েছিলাম।তারা যদি রাজি না হতো তবে আমি কখনওই তোমায় আমার নিজের মনের কথা জানাতাম না।আমি চাই না তোমায় আবারও কেউ নিজের কথা দ্বারা আঘাত করুক।কাকতালীয়ভাবে বাবার পছন্দ করা মেয়ে আর আমার পছন্দ মিলে যায়।হয়ত এটাই নিয়তির লিখন।তাই আজ আমার এই দীর্ঘ চিঠি।যদি বাবা -ছেলের পছন্দ না মিলে যেতো কিংবা তুমি আমায় পছন্দ না করতে তবে আমি কখনওই তোমায় এই চিঠিটা
লিখতাম না।
আবির যদি তোমায় না পায় তবে সে অন্য কাউকে ঠিক বেছে নেবে।এই কথাটা আমার চেয়ে তুমিই বোধহয় ভালো জানো।কিছু কিছু অপ্রাপ্তি পুরো দুনিয়া দিয়েও মেটানো যায় না।আমি তোমাকে নিজের করে চাই মাহি।আমি তোমার খারাপ ভালো সবটাকেই ভালোবাসি। আমি অপেক্ষায় রয়েছি তোমারই জন্য। আমি চাই মাহি নামের কোনো মিষ্টি এক সাতরঙা রংধনু আমায় রাঙিয়ে দিয়ে যাক।
ইতি
রিয়াদ
চোখে জমে থাকা জলবিন্দুরা গাল বেয়ে পড়তে থাকে।হাত বাড়ালেই বোধহয় ইচ্ছেরা ধরা দেবে হাতের মুঠোয়।মাহি এমন একজনকেই নিজের করে চায় যে ওকে ভালোবাসুক,বিশ্বাস করুক আর সম্মান দিক।কোনো সম্পর্কে সম্মানটা অনেক জরুরি।একসঙ্গে পথ চলার দীর্ঘ সময়ে ভালোবাসা বিশ্বাস ঠিকই অর্জন হয়ে যায়।কিন্তু সম্পর্কে ভালোবাসার আগে সম্মান দিতে শিখতে হয়।সেটা বন্ধুত্ব হোক বা ভালোবাসা।আকাশের সাদা মেঘগুলো আর নেই।সুর্য পশ্চিমদিকে হেলে পড়েছে।নাম নাজানা সেই গাছে পাখির ডাক বেড়ে গিয়েছে।বাতাসের প্রবাহ ভারী হয়ে হয়ে গিয়েছে।বেলা শেষ।আরও একটা দিনের পরিসমাপ্তি ঘটবে।কফি হাউজটা ফাঁকা হয়নি।কেউ যাচ্ছে কেউ আসছে।রবীন্দ্রনাথ বোধহয় ঠিকই বলেছিলেন যে,কাহারো অভাবে কিছুই অধিক দিন শুণ্য থাকেনা।
________
হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে নেয় আবির।ধীরকন্ঠে বলে,
“মিষ্টি আমায় ছেড়ে যেও না ”
মাহি আবিরের কথায় যতটা বেশি আশ্চর্য হয় তার থেকে বেশি আশ্চর্য হয় আবিরকে এখানে দেখে।মাহিকে চুপ থাকতে দেখে আবির আবারও বলে,
“মিষ্টি মনে করো সেই আগের দিনগুলো।যখন তুমি শুধু আমারই ছিলে।তোমার কল্পনার জগতে আমিই বিস্তার করতাম শুধু।আমি জানি তুমি ঠিক আগের মতোই আছো। আমার জন্য তোমার মনে জমিয়ে রাখা সেই সুন্দর অনুভূতিরা মরে যায় নি মিষ্টি। একবার ভাবো সেই অতীতের দিনগুলো।”
মাহি ডুব দেয় কল্পনার জগতে।যখন সে শুধু মিষ্টি ছিলো।সবাই তাকে মিষ্টি বলে ডাকত।আশেপাশের লোকদের কটুবাক্য, সংসারের দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থা, আর আবিরের চলে যাওয়া,একা একা ঘরে বসে নিরবে কান্না করা।ইশ্ কি দমবন্ধকর পরিস্থিতি। মাগরিবের আযান কানে পড়তেই ভাবনার সুতো কেটে যায় ওর।এর বেশি সে আর ভাবতে পারলো না।আবির ওর প্রথম ভালোবাসা।সেই কিশোরি বয়সের আবেগী প্রেম।আবির মোহাচ্ছন্নের মতো দাড়িয়ে থাকা মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে।চুলে হাত বুলিয়ে বলে,
“আমি তোমার সেই প্রেম মিষ্টি যার জন্য তুমি নয় বছর ধরে অপেক্ষা করেছো।আমি ক্ষমাপ্রার্থি তোমার কাছে যা যা ভুল আমি করেছি।আমায় একটা সুযোগ দাও মিষ্টি আমি তোমায় খুব ভালো রাখবো।ভালোবেসে নিজের কাছে রাখবো।তুমি শুধু আমাকে ভালোবেসে এতদিন অপেক্ষা করেছো।আমি তোমায় ভালোবাসি।তোমায় ছাড়া বাঁচতে পারবনা।”
মিষ্টি আগের ন্যায় চুপ করেই আছে।আবিরের হৃদস্পদন সে শুনতে পেলেও গভীর ভাবে অনুভব করতে পারছে না।আবির বলল সে আমায় ছাড়া বাঁচবে না।একসময় আমিও এই কথাই ভাবতাম।কিন্তু দীর্ঘ নয় বছরেরও বেশি সময় আমরা একে অপরকে ছেড়ে ভালোভাবেই বেঁচে ছিলাম।শ্বাস নিতে এতটুকু কষ্ট পর্যন্ত হয়নি।যে ভালোবাসার জন্য মাহি লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছে আজ স্বয়ং সেই মানুষটা তার কাছে আকুতি করছে।আর অন্য এক ছেলে সব জেনেও অধীরে অপেক্ষা করছে ওর জন্য।জীবনের এক পর্যায়ে এসে এমন দ্বিধাগ্রস্ত হবে মাহি তা কখনও কল্পনায়ও ভাবা হয়নি।কাকে আজ বেছে নেবে সে।এতটা একা তার কখনও মনে হয়নি।
(আপনাদের কি মনে হয়।কাকে বেছে নেওয়া মাহির জন্য ঠিক হবে।পরের পর্বে গল্পের শেষ অধ্যায়।গল্প সম্পর্কে আপনার অনুভূতি জানান)
চলবে………