অতএব_ভালোবাসি_তোমায়,পর্বঃ৭ অন্তিম
লেখিকা_আহিয়ানা_আহিরা
–আম্মু-আব্বু! এই সত্যটা না লুকালেই পারতে। আমি তোমাদের ছেড়ে চলে যাব না। আর না কায়া যাবে।
–এগুলো কি বলছো ভাইয়া? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।
–বিশ্বাস হলেও সত্য না হলেও এটাই সত্য। আমরা দুজনের একজনও আম্মু-আব্বুর সন্তান নই। আমাদের দত্তক নিয়েছেন তারা। কি ঠিক বলি নি মামিমা? (শান্ত)
মিসেস ধারা (সুহানার মা) মুখ শুকনো করে দাড়িয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়।
–এবং আম্মুর আমাদের দত্তক নেয়ার বড় কারণ ছিল সে কখনো মা হতে পারবে না। (শান্ত)
–শান্ত ভাই কি বলছো? তার মানে ওদিনের ওই রিপোর্ট টা ফুপু মায়ের ছিল?(সুহানা)
–হ্যাঁ সুহা।(শান্ত)
–ভাইয়া তাহলে তুমিও কি আমার ভাই নও?(কায়া)
–এর উত্তর তো আম্মু দেবে।(শান্ত)
–আম্মু বলো প্লিজ।(কায়া)
এবার মিসেস শিমু চোখের জল ছেড়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
–যখন শান্তর ৩বছর তখন কায়া রুমার পেটে। তোদের আসল মায়ের নাম নুরে আয়েশা। ডাক নাম ছিল রুমা। তোদের বাবার বেস্ট ফ্রেন্ড জুনায়েদ খান এর স্ত্রী ছিল রুমা। জুনায়েদ ভাইয়ের মৃত্যু হয় রুমা যখন ৭মাসের প্রেগন্যান্ট। কোন এক্সিডেন্ট না। তিনি স্ট্রোক করেছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর রুমার দেখা শোনার দায়িত্ব আমরা নিয়েছিলাম। আমরা অনেক ট্রাই করছিলাম বেবি নেওয়ার জন্য। কিছু থেকে কিছু হচ্ছিল না। তাই টেস্ট করিয়েছিলাম। ওদিন রিপোর্ট আনতে গেছিলাম। তখন রুমার ৯মাস ১২দিন। শান্তর প্রচুর জ্বর ছিলো। তাই আমি রুমা, তোর বাবা আর তুই সহ সবাই হসপিটালে যাই। আমার রিপোর্ট আসার কিছুক্ষণ পর আমরা শান্ত কে নিয়ে যাই। আমি যখন রিপোর্ট এ চোখ বুলাচ্ছিলাম তখনই রুমা চিৎকার করে উঠে। আমার আর রিপোর্ট দেখা হয়নি। সাথে সাথে রুমাকে নিয়ে দৌড়া দৌড়ি শুরু হয়। অনেক টেনশনে ছিলাম আমি। ওটির বাহিরে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম আমি আর তোর বাবা। কোলে কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে ছিল শান্ত। কিছুক্ষণ পরই খবর আসে কায়া জন্ম নিয়েছে সম্পূর্ণ সুস্থ ভাবে। কিন্তু রুমা আর নেই। শান্তি আসতে না আসতেই ভর করলো চরম বিষাদ। চোখ দিয়ে অজান্তেই পানি গড়িয়ে পরছে আমার। শেষমেষ রুমা ছেড়ে চলে গেল। রুমাকে জুনায়েদ ভাইয়ের পাশে কবর দেওয়া হয়। বাড়িতে আসার পর রিপোর্টের কথা মনে পরে আমার। রিপোর্ট দেখার পর এক এর পর এক চিৎকার করে কেঁদেছি আমি। তোর বাবাকে বলেছিলাম আরেকটা বিয়ে করতে কিন্তু কপাল করে জন্মেছিলাম। আমাকে আজও ভালোবেসে আগলে রেখেছে। ছেড়ে যায়নি আমাকে একা করে। সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোদের দত্তক নেয়ার। তোদের নিজের ছেলেমেয়ের মত আজও ভালোবেসেছি। তোরা বড় হওয়ার পর সুহাদের সাথে একসাথে বাড়ি কিনে ওঠার সিদ্ধান্ত নেই এবং তাই হয়। তারপর আমি আজ মরলেও আমার আর আফসোস নেই। (শিমু)
সবার চোখে জল। শান্ত ভাইয়া স্তব্ধ। কায়া নিশব্দে চোখের জল ফেলছে আমাকে ধরে দাড়িয়ে আছে। এবার ফুপুমা শব্দ করে কেদে উঠে বলে;
–আমাদের একা করে চলে যাস না তোরা। আজ অব্ধি কেও জানেনি তোদের মামিমা আর মামা ছাড়া।
কায়া আর শান্ত দৌড়ে জরিয়ে জরিয়ে ধরে। আর বলে;
–আমরা কখনো যাব না এবাড়ি আর তোমাদের ছেড়ে। তোমরাই সব। বলে আর কায়া কেঁদে দেয়। আর শান্ত ভাইয়ার চোখ জুড়ে জল। পলক ফেললেই গড়িয়ে পরবে। হঠাৎ ই হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে রুমে চলে যায় শান্ত ভাইয়া। এটা দেখেই বুঝে যাই আমি তার কি হয়েছে।
আমিও দৌড়ে যায় রুমে। গিয়ে দেখি রুমের দরজা লাগানো তবে লক করা নেই। আমি রুমে ঢুকেই শান্ত ভাইয়াকে খুঁজছি। বারান্দায় নেই বিছানার কাছে যেতেই দেখি বালিশে মুখ গুজে শুয়ে লুকিয়ে চোখের জল ফেলছেন তিনি। আমি কাছে গিয়ে পাশে বসে চোখের জল মুছে দিলাম। আমার অস্তিত্ব টের পেতেই আমাকে টেনে আমার কোলে মাথা দেন তিনি। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
–আমি কিন্তু কাঁদতে নিষেধ করছি।
–হুম।
–আচ্ছা আমাদের খবর বলবেন না বাড়িতে?
–হুম।
–কবে?
–বলব যখন সময় হয়।
–ভাইয়া?
–জ্বি আপু??
আপু ডাক শুনে রাগে তিরতির করে উঠে আমার গা। বলে কি আমি নাকি আপু?
–এত ভেবে লাভ নেই। যে সারাদিন ভাই ভাই করে মাথা খায় তাকে বিয়ে করার চেয়ে আমি ভাই বোনই থাকি।
এতক্ষণে বুঝলাম কি হলো।
–আচ্ছা আর ডাকবো না ভাই।
–কেন ডাকবি আমি তোর ভাই লাগিও না।
–হুম তাও।
–আচ্ছা অনেক হয়েছে রুমে যা।
–কেন?
–মাথা ব্যাথা করছে।
–আমি মাথা টিপে দেব?
–দিবি তুই?
–হুম।
–দে তাহলে।
সুহানা পরম যত্নের সাথে মাথা টিপে দেয় শান্তর। শান্ত ঘুমিয়ে যায়।
.
.
রাত ৮টাঃ
–কি হলো ভাইয়া! তুই আমাদের আবার কি বলবি?(কায়া)
–বলছি!
–হুম বল। (কায়া)
–দেখ আম্মু আব্বু, মামিমা-মামা! আমি যা বলার ক্লিয়ারলি বলছি। আমি সুহাকে আর সুহা আমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি।
–বাহ! ভালো খবর তো! বিয়ে! ওকে আমি রাজি।(ফুপুমা)
–আমিও(ফুপা)
–আমরাও(মা-বাবা)
সবার হঠাৎ একসাথে কোনো প্রশ্ন ছাড়াই রাজি হয়ে যাওয়ায় অবাক হই আমরা।
–তোমাদের কোন আপত্তি নেই?(শান্ত)
–আমরা তো সব আগে থেকেই জানি!(ফুপুমা)
–মানে? কে বলেছে?(সুহা)
–আমি বলেছি!(কায়া)
–তুই? তুই কি করে বুঝলি?(শান্ত)
–আমাদের সামনে প্রেম করবে আর আমরা বুঝবো না?(কায়া)
সবাই শব্দ করে হেসে ওঠে। লজ্জায় মরি মরি অবস্থা আমার।
.
.
সব হয়ে গেল ঝড়ের মত। বিয়ে ঠিক হয়ে গেল আমাদের। ফুপুমা এখন আগে থেকে বেশি খেয়াল রাখে আমার। আমাদের আর বিয়ের ২দিন বাকি।
হঠাৎই পেছন থেকে জরিয়ে ধরায় স্মৃতি চারণ থেকে বেড়িয়ে এলাম আমি। মনে পরে ছাদে দাড়িয়ে কয়েকমাস আগের কথাই মনে করছিলাম আমি।
–কি হয়েছে আমার বউটার?(শান্ত)
–কিছু না!(সুহা)
–কিছু তো হয়েছেই!(শান্ত)
বলে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয় আমাকে।
–বল?(শান্ত)
–আমি বিয়ে করবো না আপনাকে!(সুহা)
–মানে? কেন!(শান্ত)
–আপনি আমাকে এখনো প্রপোজ করেননি। আমি বিয়ে করবো না।(সুহা)
–ও আচ্ছা! এ ব্যাপার? এখনি সমাধান করছি!(শান্ত)
বলেই শান্ত হাটু গেরে বসে পরে সামনে। হাতে কিছু না পেয়ে নিজের ফোনটাই সামনে এগিয়ে দিয়ে বলতে লাগেন;
–আমার প্রেয়সী! তোমার ঝগড়া না শুনলে আমার কান অস্থির হয়ে যায়। তোমাকে না দেখলে চোখ অস্থির হয়ে পরে। তোমার ছোয়া গায়ে না পরলে নিজেকে অপবিত্র লাগে। তোমার রেগে নিয়ে নাক ফুলানো না দেখলে আমার মনে শান্তি আসে না। আমি কিছুই গুছিয়ে বলতে পারি না। আমি কখনো নিজের ফিলিংস স্বীকার করতে পারলেও সেটা গুছাতে পারি না আমার ফিলিংস তোমার বুঝে নিতে হবে। আমার মন পরার দায়িত্বটা নায়তো তুমিই নিও। ভালোবাসে নায়তো আগলেই নিলে। সব গুছিয়ে বলতে পারলাম না সহজেই বলবো আমি। অতএব_ভালোবাসি_তোমায়।
–খুব খুব ভালোবাসি আমিও। বলে ফোনটা হাতে নিলাম।
শান্ত আমাকে আর আমি শান্তকে শক্ত করে জরিয়ে নিলাম।
(সমাপ্ত)