তারকারাজি দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ বর্ধিতাংশ-০৫
লেখনীতে- অহনা নুযহাত চৌধুরী
তুষারধবল একখণ্ড সুবৃহৎ মেঘের কোল জুড়ে অবস্থান করেছে সূর্য। বঙ্গ দুয়ারে যে অপ্রিয়দর্শন বৈশাখীর আগমন ঘটতে চলেছে তা রোদের উত্তাপে বেশ লক্ষ্যণীয়। পিহু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে তাদের ডিপার্টমেন্টের সামনে। মাথার উপর মেলে রাখা পেঁয়াজ-রঙা গোলাপি ওড়নার মেয়েটি রাজ্যসম বিরক্তিতে নাক খাঁড়া করে আশেপাশে তাকাচ্ছে। নিশানের প্রেরিত বার্তা পেয়েই পিহু ছুটে এসেছে এ-প্রান্তে। নিভৃতে জানানো এই সাক্ষাৎকারের আহ্বান যে কোনো সাধারণ কারণে নয় তা তো মেয়েটি বুঝে ফেলেছে অনেক আগেই। কিন্তু কী কারণ? বন্ধুগুলো সব চমকে দেওয়ার ওস্তাদ বলেই জানে পিহু৷ কিন্তু হঠাৎ পিছন থেকে এসে বহুত অপ্রত্যাশিত পুরুষ কণ্ঠটি যখন বলল,
“ কী ব্যাপার, আমি আসলাম আর তুমি পিওর লাভারদের মতো তা ফিল করতে পারলে না? ঘটনা তো ভীষণ জটিল। পুলিশ কমিটিকে খবর দিয়ে তল্লাশি চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি যে, আমার বউয়ের মনটা আসলে উড়ে গেল কোথায়। ”
পিহু তখন চমকে উঠেই দু’পা পিছিয়ে দাঁড়াল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় চেহারার ওই বিস্মিত চোখ দুটো যেন স্বপ্ন দেখছে আকাশ-কুসুম। সত্যিই কি আদ্রাফ এলো? না-কি এটা ঘুম মহাশয়ের ধোঁকা? পিহু কম্পমান কণ্ঠে তীব্র আড়ষ্টতা নিয়েই বলে উঠল,
“ অ্যাই ছেলে, তুমি সত্যিই আসছো না-কি? না-কি আমিই পাগল হয়ে গেছি? আমি না জেগেছিলাম? ”
আদ্রাফ হাসলো বেশ সুন্দর করে ও অল্প নিঃস্বনে। হাতের এক পুরনো নীল ছাতাটা পিহুর মাথার উপর মেলে দিয়ে সুমিঠে কণ্ঠে বলল,
“ তুমি না বাচ্চা পোলাপানদের মতো ঘামো। এটা ধরো। রোদ লাগবে না আর। ”
এই-ই সেই নীল ছাতা; যা দেখলে মনে হয় না ঘুমের স্বপনেই শুধু ধরা দেয় তার প্রিয় পুরুষটি। প্রিয়র গৌর ত্বকে যে সুখানুভবের মধুময় প্রভা লক্ষ্য করতে পাচ্ছে পিহু, তা দেখে অন্তত সে বলবে না— এটা অবাস্তব কেবল। পিহু ছাতাটা হাতে ধরে হঠাৎই ফিক করে হেসে উঠল। চোখে কি জল এলো? না, আদ্রাফ পিহুর চমকে যাওয়া দেখতে পেলেও প্রেমিকার চোখে জল আসার দৃশ্যটি দেখতে পেল না। অবশ্য পিহু শুনেছে আদ্রাফের মুখে— তার উদয়াস্ত হেসে কুটিকুটি হওয়ার জন্যই না-কি তার প্রতি আদ্রাফের প্রণয়ানুভূতি জাগ্রত হয়েছিল। তাদের এই বহুদিন পরের সাক্ষাৎকারে যখন ভীষণ ধীরে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে চলার মুহূর্তে পিহু বলে উঠল,
“ তুমি যে আসবা এটা শুধু নিশান-ই জানতো? ”
তখন আদ্রাফ হাসল ফের। পিহুর হাত থেকে ছাতাটা কেড়ে নিয়ে প্রথমে বলল, “ দাও তো এটা। আমার মাথায় ছাতা ধরতে হলেও তোমাকে অনেক লম্বা হতে হবে। ”
তারপর আবারও বলল, “ ওরা সবাই-ই সবটা জানে। বলছিলাম শুধু নিশানকে। এই বান্দা তো রাষ্ট্র করে দিছে! বলে, ‘পিহুকে জানানোর প্রয়োজন নাই ভাই। আপনি এসে আমারে কল দিয়েন। আমরা ওরে সারপ্রাইজ দিবনি।’ মনে হচ্ছিল যেন আমার থেকে ওরাই বেশি খুশি। ”
পিহু হাসল বেশ। তখন আদ্রাফকে আবার বলতে শোনা গেল,
“ তুমি বান্দর হিসেবে বন্ধুগুলাও বান্দর-ই পাইছো। বাট ওরা কিন্তু খুব ভালো। একজন আরেকজনকে খুশি করতে কিছুই ভাবে না ওরা। শুধুমাত্র বন্ধুর হাসিটাই তাদের কাছে সব। ”
শেষের কথাগুলো ভালো লাগলেও পিহুকে তেতে উঠতে দেখা গেল আদ্রাফের প্রথম কথাতে। সে বলল,
“ অ্যাই! তোমাকে বলছি না আমাকে নিজের বোনের মতো ট্রিট করবা না? তোমার বোনের বোন হতে পারি। তাই বলে তোমারও বোন হবো? ”
“ দুনিয়ার সব মেয়েরে আমার মা-বোনের মতোই লাগে। এর জন্যই তো বলি— চলো, বিয়েটা করে নিই। কিন্তু তোমার হিটলার বাপ তো আবার সেইটা শুনবেন না। কী সুন্দর শর্ত দিয়ে দিল, ‘আমার মেয়েকে বিয়ে করতে হলে তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। পিহুর অনার্স শেষ হলেই বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে, এর আগে না।’ পাক্কা ধান্দাবাজ মানুষ! মেয়েরটা ছাড়া আর কারোরটা বোঝে না। ”
বাবাকে ব্যঙ্গ করার ভঙ্গিমা দেখে পিহু না-হেসে থাকতে পারল বলে মনে হলো না। সে হাসি মুখেই ধমকে উঠে বলল,
“ অ্যাই, তুমি আবার বাবাকে নিয়ে এগুলা বলতাছো? বয়সে বড় দেখেও তো একটু সম্মান করতে পারো? আমার বাবাকে নিয়ে এমন করলে আমি কিন্তু তোমাকে বিয়ে করব না বলে দিলাম। ”
“ উদ্ধার হবো আমি! ”
আদ্রাফের বিড়বিড়িয়ে বলা কথাটা শুনতে পেয়ে পিহু চোখ বড়-বড় করে তাকাল। তার ওই ভরাট অক্ষি দুটোর দিকে তাকিয়ে যখন আদ্রাফ হেসে ফেলল তখন পিহুও বেশ বিরক্ত হয়েই বলল,
“ তুমি কি জানো— তোমার আমার লং ডিস্টেন্স রিলেশনশিপ-ই আসলে ভালো? নয়তো আজ নির্ঘাত আমি হতাম তোমার খুনী আর তুমি হতে আমার হাতে খুন। ”
আদ্রাফ হেসেই হাওয়ায় উড়িয়ে দিল সেই কথা। পিহুর পিছে লাগতে তার বেজায় ভালো লাগে! তাই সে উত্তরটাও দিল যথোপযুক্ত। উত্তর এলো পাল্টা৷ চৈতালির গা জ্বালা করা মধ্যাহ্নের হাওয়ায় কি একটু ছড়াল ফাগুনের কিশোরী ফুলের সুবাস? হয়তো না। তবুও পিহুর নাকে আসছে হরেক রকম ফুলের সুবাস। যে সুবাসকে গায়ে মেখে নেওয়ার আনন্দ হয়তো বর্ণনাতীত।
সামনে এগিয়ে চলতেই আরাভদের আড্ডামহলটা চোখে পড়ল পিহুর। সেখানে তার বন্ধুরা নেই। এই দেখে পিহু নিজেও খুব বিব্রত বোধ করল সেদিকে যেতে। তাই দূর থেকেই আঙুলের ইশারায় আদ্রাফকে দেখিয়ে দিল তাদের। কিন্তু আদ্রাফের এই দূরবর্তী পরিচয়ে মন ভরেছে বলে মনে হলো না। পিহুর হাতে ছাতাটা ধরিয়ে দিয়ে নিজেই চলে গেল আরাভদের কাছে। পরিচিতও হলো নিজেই। আদ্রাফ যাওয়ার পর-পরই ওদের দল থেকে পিহুর ডাক পড়ল। তাকে লজ্জায় ফেলার কতোই-না আকার-ইঙ্গিত তাদের! অতঃপর মিশমি বাদে নিজের বন্ধু চারজনকে পেয়েই সেদিকে গেল মেয়েটি। তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই সকলের সাথে কথা বলার সময় হঠাৎ সানাম বলে উঠল,
“ কী ব্যাপার তনয় ভাই, আজকে মুখে সুপার-গ্লু মারছেন যে? ঘটনা কি খুব জটিল? ”
তনয় বেশ বিরক্ত হয়ে মুখ কালো করতেই শিহাব দাঁত কেলিয়ে উত্তর দিল, “ আর বলিস না রে বোন! তনয় তো প্রতিজ্ঞা করছে যে, পিহু আশেপাশে থাকলে ও নিজের মুখ খুলবে না। পিহুকে নিয়েও কিছু বলবে না এই জীবনে। ”
শিহাবের কথায় বিস্মিত হলো অপর বন্ধুদল। আদ্রাফও আশ্চর্যান্বিত চোখে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করল তার উক্তিটি। কিছু কি বুঝতে পারল? না, শিহাব নামের ছেলেটার কথার রেশ ধরতে পারল না সে। ব্যর্থ হলো সানামরা নিজেও। অতঃপর শিহাব-ই বলল,
“ বুঝলেন আদ্রাফ ভাই, আমাদের তনয় পিহুদের চার বান্ধবীদের দারুণ একটা নাম দিছে— কারেন্ট কোম্পানি। এদের কিছু করলেও ওর কারেন্ট খাওয়া লাগে আর না-করলেও কারেন্ট খাওয়া লাগে। এইযে এক মাস আগেই একটা গণ্ডগোল করে মিশমির জন্য সায়ানের হাতে মাইর খাইছে ও। তার এক মাস আগে কিছু না করেও নীলাশার জন্য আরাভের কাছে মাইর খাইছে ও। আর তারও কয়েক মাস আগে সানামের জন্য সাইফের কাছে মাইর খাইছে আমাদের এই তনয়। ও তো ধরেই নিছে যে, এর পরের বাঁশটা বোধহয় ওরে পিহুই দিবে। তাই আগের থেকেই ও সাবধানে আছে যাতে পিহুর জন্য আবার মাইর না খাওয়া লাগে ওর। ”
এই কথা শুনে পিহু যে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল তা সত্য অর্থেই ছিল চরম হাস্যকর ঘটনা। শিহাবের কথা শুনে কারো হাসি আসুক বা না-আসুক, মাঠের ভিতর পিহু থপ করে পড়ে যাওয়ার পরও হাসতে থাকাটা ছিল কৌতুকপ্রদ ব্যাপার। মেয়েটা যখন মাত্রাতিরিক্ত হাসির দাপটে পড়ে গেল তখন আদ্রাফ বলল,
“ আরেহ একটু কমায় হাসবা তো? ছোট ভাইদের সামনে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছো যে, আমার ফিউচার বউ একটা রাক্ষসী? মান-সম্মান শেষ। বাপে তো হাসতে জানে না আর মেয়ে হইছে সার্কাস একটা৷ ”
পিহু তার হাসি থামাতে পারল না কোনোমতেই। তবে সাইফ কিন্তু বেশ একটা মন্তব্য করল,
“ আমরা ভাবতাম— পিহু মানুষের সাথে দারুণ মিশে যেতে পারে। আপনি দেখি পিহুর থেকেও দারুণ মিশুক, আদ্রাফ ভাই। ”
আদ্রাফ হাসল সেই কথা শুনে। আরো অনেক কথায় তার মনে পড়ল যে, দলের আরও একজন তারকা এখনো বাকি আছে যার সাথে দেখা হয়নি তার। কোথায় সেই মিশমি? খোঁজ করতে না করতেই মিশমির দেখা মিললো। ওই দূর থেকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসা রমণীকে দেখেই রিশান বলে উঠল,
“ ছুমন্তর ছুঁ কালি কুত্তার গু। এইযে আমি জাদু করে দিলাম। এখন দেখো সবাই— মিশু ক্যামনে আছাড় খায়! ”
রিশান তার কথা শেষ করার দু’সেকেণ্ড পরই দেখতে পেল মিশমি স্বভাবসুলভ হোঁচট খেয়ে, বসে পড়ল রাস্তায়। ব্যাপারটা হয়তো এতটাও হাস্যকর হতো না যতটা হাস্যকর হলো রিশানের কথাটার জন্য। সায়ান নিজেও হাসল বেশ! মেয়েটা যে তাড়াহুড়ো একদম-ই করতে পারে না তা সে অন্তত খুব ভালো করেই জানে৷ ওদিকে পায়ের নখে অসহনীয় আঘাত পেয়ে ব্যথিত আর্তনাদ করে উঠল মিশমি। উঠে দাঁড়ানোর বেগ খুব কম— এমনটা নয়। তবুও সে উঠে দাঁড়াল না সহজে। সেখানে বসেই দেখতে পেল যে, সানাম এগিয়ে আসছে তার কাছে। তাই সে ধীরে ধীরে যখন দাঁড়ানোর জন্য উদ্যত হলো ঠিক তখনই একটি যুবক তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। যুবকটা নিঃসন্দেহে অচেনা। পরিপূর্ণভাবে অজানা এক পুরুষ। তাই সৌজন্যের খাতিরে হেসে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেই ছেলেটিকে উঠে দাঁড়াতে দেখতে পেল মিশমি। সে নিজেও উঠে দাঁড়াল। কিন্তু তারপর যা শুনতে পেল মিশমি… তা সে মোটেও আশা করেনি এই অচেনা তরুণের থেকে। তরুণটি চলতে লাগল তার ঠিক বিপরীতে। যাওয়ার সময় বেশ মিষ্টি করে বলতে লাগল,
“ সুন্দরী মেয়েদের এভাবে হুটহাট রাস্তায় পড়ে যেতে নেই, পারুলতা মিশমি। তিহামের মতো হাজারো ছেলে যে প্রেমে পড়ে যাবে! ”
মিশমির আত্মাটা কেঁপে উঠল মুহূর্তেই। আরেহ, এটা তো সেই নাম যা তিহাম দিয়েছিল তাকে। অবশ্য নামটা তিহামের মুখে স্থায়ী হয়নি। প্রথম বারের মতো এক হলুদ বিকেলে যখন তিহাম বেলিফুলের মালা নিয়ে এসেছিল তার কাছে, ঠিক তার আগের দিন শেষবারের মতো তাকে এই নামে সম্বোধন করেছিল তিহাম। পারুলতা…! তিহামের পারুল ফুল!
কয়েক মাস আগে তিহামে মুগ্ধ হওয়ার সেই মোহময় স্মৃতির ধাক্কাটা মিশমির মস্তিষ্কে এসে লাগতেই সে শুকনো ঢোক গিলে নিল। মনটা ভীষণ ছটফটিয়ে উঠল তার৷ এ কোন ভয়ঙ্কর সংকেত দিয়ে চলে গেল সেই উল্টো পথের পথিক? মিশমির হাত কাঁপলো… পা কাঁপলো। কেঁপে উঠল তার সর্বাঙ্গ। যখন সানাম খুব নিকটে এলো তখন তার মস্তিষ্ক চট করেই স্মরণ করে নিল অন্য আরেকটি কথা। ভার্সিটির বেশিরভাগ খবর-ই তো থাকে তার এই বান্ধবীর কাছে! মিশমি মুহূর্ত ব্যয়ে তার কম্পমান কণ্ঠেই প্রশ্ন করল,
“ দোস্ত, তুই ওই ছেলেটারে চিনোস? ”
মিশমিকে সাহায্যের হাত বাড়ানো ছেলেটাকে দেখেছে সানাম। তবুও নিশ্চয়তার জন্যই আরেকটু এদিক-সেদিক দেখে সে বলল,
“ আরে হ্যাঁ, ওইটা তো রুকাব ভাই। তিহাম ভাইদের ইয়ারেই… বাংলায় পড়তেছে। ম্যাগাজিনে লেখালেখি করে। কিন্তু তুই ওর কথা জেনে কী করবি? কাহিনি কী বল তো? ”
মিশমি উত্তর দিল না। আরো বার কয়েক তার ভীত চোখ দুটোর পলক ফেলে দেখতে লাগল সেই ছেলেটির চলন। পা দুটো থাকল না আর নিজের অবস্থানে। ঠিক টেনে নিয়ে চলল সে পথে, যে পথে দিনের আলোও রাত্রির অমাময় আঁধারের প্রতিবিম্ব দেখালো মিশমিকে। এই সরল মস্তিষ্ক কী নিদারুণ পরিকল্পনাটাই-না করে ফেলেছে আজ…!
কী ভীষণ অপ্রত্যাশিত তা…!
#চলবে ইন শা আল্লাহ!