প্রেম_এসেছিলো_নীরবে(৪)
সাদিয়া_জাহান_উম্মি
ড্রয়িংরুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে সবাই।হেমন্ত, হিয়া আর প্রাহি।তারা ওদের ছোটবেলার ছবি দেখবে।হিয়া এইবার ছবির এ্যালবামটা খুললো।সবার আগে আসলো অর্থ কারন সে হলো সবার বড়।ছবিটা দেখেই ওরা হেসে দিলো।অর্থ পুরো উদম হয়ে আছে আর ওর মুখে সুজি ভরা সে কান্না করছে। প্রাহি ছবিটার দিকে গভীর নয়নে তাকিয়ে রইলো।বাচ্চাটা কে সে জানে না।তবে তার খুব হাসি পেয়েছে।প্রাহি জিজ্ঞেস করলো,
-” এটা কে হিয়া আপু?”
হিয়া হাসতে হাসতেই বলে,
-” আরে এটা অর্থ ভাইয়া।তুই ভুলে গেছিস।ওহ সরি তুই তো আর অর্থ ভাইয়াকে তো তুই আর চিনিস না।”
হেমন্ত বললো,
-” এটা ভাইয়ার যখন দেড় বছর বয়স তখনকার ছবি।ভাইয়া খেতে খেতেই হিসু করে দিছিলো।আর বড়মা উনাকে ন্যাংটু করে দিয়ে আবারও খাওয়াতে চাইছিলো।কিন্তু ভাইয়া ন্যাংটু হয়ে কিছুতেই খাবে না।তাই তো সুজি দিয়ে একেবারে মুখ ভরিয়ে ফেলেছে।”
প্রাহি খিলখিল করে হেসে দিলো।হেমন্ত আর হিয়া প্রাহির হাসির দিকে তাকিয়ে রইলো।ইসস,মেয়েটা মনে হয় অনেক দিন পর এইভাবে হাসছে।প্রানটা জুড়িয়ে গেলো ওদের।প্রাহি হাসি থামিয়ে আবারও নানান ছবি দেখতে লাগলো।অর্থ’কে ও কখনোই দেখেনি।প্রাহি এইবার জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
-” অর্থ ভাইয়াকে কি আমি কখনই ছোট বেলায় দেখিনি?”
হেমন্ত আস্তে করে বলে,
-” নাহ দেখিস নি।ভাইয়ার যখন জন্ম হওয়ার এক বছর আগেই বড়মা আর বড়বাবা ভাইয়াকে তার মামা, মামির কাছে লন্ডন পাঠিয়ে দেয়।ভাইয়ার মেধা অনেক ভালো ছিলো তাই। তোর জন্মের পর একবার এসেছিলো দুমাসের ছুটিতে। তখন তোর দু’বছর বয়স ছিলো।তাই তোর কিছুই মনে নেই।”
হিয়া বলে উঠে,
-” ভাইয়া ছোট থেকেই অনেক গম্ভীর একজন মানুষ।আর যেই পরিমান রাগ ভাইয়ার। যখন রাগ উঠে বাড়ির কারো সাধ্য নেই তার রাগ কমানোর।আমরা ভয়ে কেউ যাইনা তার কাছে তখন।এখনো ঠিক সেইরকমি আছে।একটুও বদলায়নি।তবে আমাদের সবাইকে অনেক ভালোওবাসে।”
প্রাহি ছোট্ট করে ঢোক গিললো লোকটার কথা শুনেই কেন যেন ওর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে।না জানি লোকটাকে দেখে ও হার্ট এট্যাক না করে বসে।
….
গাড়িতে বসে আছে অর্থ একটু আগেই সে বাংলাদেশে ল্যান্ড করেছে।হেমন্ত আসতে চেয়েছিলো ওকে পিক-আপ করতে কিন্তু অর্থ মানা করে দেয়।শুধু বলে গাড়ি পাঠিয়ে দিতে।আজকে অর্থের কাছে কেমন যেন লাগছে।হেমন্ত’র সাথে কথা খাওয়ার পর থেকেই ওর বুকের ভীতরটা অস্থিরতা ছেয়ে আছে।কেন এমন লাগছে কিছুই বুজতে পারছে না অর্থ।গাড়ির হর্ণে ধ্যান ভাঙে।বাড়ি এসে পড়েছে।বাড়ির গেট খোলা হচ্ছে।পার্কিং লটে গাড়ি থামতেই বের হয়ে আসে অর্থ।ড্রাইভারকে লাগেজ নিয়ে আসতে বলে ও এগিয়ে যায় সদর দরজার দিকে।ঘড়ির দিকে তাকায় অর্থ রাত এগারোটা বাজে।তার বাড়ির মানুষ আবার এতো তাড়াতাড়ি ঘুমোয় না।তাদের ঘুমোতে ঘুমোতে ১২ টা বাজে।তাই নির্দিধায় কলিংবেল বাজালো।
…
-” আমি আর অর্থ ভাইয়া দু বছরের ছোট বড়। হিয়া আমার থেকে আট বছরের ছোট আর অর্থ ভাইয়া থেকে দশ বছরের।”
হেমন্তের কথায় প্রাহি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।সবাই ওর থেকে কতো বড় আর ও কি না ১৬ বছরের একটা পুচকি মেয়ে।লোকে ওকে তাহলে ঠিকই করে বাচ্চা বলে।প্রাহি বললো,
-” তোমার বয়স কতো ভাইয়া?”
হেমন্ত হালকা হাসলো বললো,
-” আমার ২৬ বছর বয়স।অর্থ ভাইয়ার ২৮ আর হিয়ার ১৮।”
প্রাহি মুখ গুমড়া করে বলে,
-” আমি তোমাদের সবার থেকে কতো ছোট।”
হিয়া খিলখিল করে হেসে বললো,
-” তাই তো তোকে পিচ্চি ডাকি।”
হঠাৎ বাড়ির কলিংবেলের আওয়াজে সবাই থেমে যায়।হেমন্ত হিয়াকে বললো গিয়ে দরজা খুলে দিতে।হিয়া উঠে গেলো দরজা খুলতে।দরজা খুলেই ‘ ভাইয়া!’ বলে অর্থকে জড়িয়ে ধরে।অর্থও গম্ভীরভাবে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।হিয়া অর্থকে ছেড়ে চিৎকার করে সবাইকে ডাকলো।এতে অর্থ ভ্রু-কুচকে রাগী কন্ঠে বললো,
-” এতো রাতে এইভাবে চিৎকার করছিস কেন? আমি কি নতুন এসেছি এই বাড়িতে।”
ভাইয়ের রাগি কন্ঠে হিয়া চুপ হয়ে গেলো।অর্থ বাড়িতে প্রবেশ করতেই রায়হানা বেগম ছুটে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো।কান্নারত গলায় বলে,
-” বাবা তুই এসেছিস।কতোদিন পর আমার ছেলেটাকে দেখলাম।আর তুই যে আসবি আমাকে বললি না কেন?”
অর্থ বিরক্তি নিয়ে বলে,
-” উফফ মা।আই ডোন্ট আন্ডার্স্ট্যান্ড হুয়াই ইউ ক্রায় সো মাচ ইন ওয়ার্ড্স। তুমি জানো না তোমার চোখে জল দেখতে ভালো লাগে না।আর রইলো আমি আসবো সেটা ইচ্ছে করেই জানাইনি।তবে হেমন্তকে বলে রেখেছিলাম।আমার মা’কে একটু সার্প্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।”
লাস্ট কথাটা বলে হালকা হেসে মাকে জড়িয়ে ধরলো।সবার সাথে কুশলাদি বিনময়ে যখন ব্যস্ত অর্থ হঠাৎ ওর নজর আটকে যায় একটা মেয়ের উপর।অর্থর ভ্রু-কুচকে দেখছে মেয়েটাকে।মেয়েটার গায়ে জড়ানো বেবি পিংক কালার স্কার্টের সাথে সাদা ফতুয়া আর বেবি পিংক কালারের স্কার্ফ গলায় পেচানো,চুলগুলো পনিটেইল করে রেখেছে।মুখশ্রীটা ভালোভাবে বুজা যাচ্ছে না মাথা নিচু করে আছে বিদায়।মেয়েটার চেহারাটা দেখার জন্যে অর্থের হৃদয়টা ছটফট শুরু করলো।তাই রায়হানা বেগমকে জিজ্ঞেস করলো,
-” মা হু ইজ সি?”
রায়হানা বেগম ছেলের প্রশ্নে একবার প্রাহির দিকে তাকালো।তারপর হালকা হেসে প্রাহির কাছে গিয়ে ওকে নিয়ে অর্থের সামনে এসে দাড়ালো।অর্থ কুচকানো ভ্রু-জোড়া আরো কুচকে এলো।রায়হানা বেগম বললেন,
-” এটা হলো প্রাহি।”
অর্থ জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে এখনো তাকিয়ে।রায়হানা বেগম আবারো বললেন,
-” ও তোমার ছোটমা’র বোনের মেয়ে প্রাহি।”
অর্থ এইবার বিষ্ময় নিয়ে তাকালো অবাক হয়ে বলে,
-” হুয়াট?ডিড ইউ জাস্ট সে দ্যাট সি ইজ প্রাহি?বাট হাউ ইজ দিছ পসিবল?”
হেমন্ত এইবার এগিয়ে এসে অর্থকে সবটা খুলে বললো।এইবার অর্থ বুজতে পারলো সবটা।হিয়া প্রাহিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-” প্রাহি মা ভাইয়াকে সালাম দেও।”
প্রাহি এইবার কাচুমাচু হয়ে আস্তে করে মুখটা উপরে তুললো।কাঁপা কন্ঠে বলে,
-” আস..আসসালামু আলাইকুম ভা..ভাইয়া।”
এদিকে অর্থ স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে।প্রাহি মুখটা তুলে ওর দিকে তাকাতেই মনে হলো অর্থের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো।এতোটা নিষ্পাপ মুখশ্রী বুজি কারো হয়?আর এতোটা মায়া জড়ানো মুখশ্রী।কাজলটানা চোখগুলোতে অর্থের মন গেঁথে গেলো,গোলাপি ঠোঁটজোড়া হালকা কাঁপছে।ফর্সা গোলগাল চেহারাটা দেখতেই অর্থের এতোক্ষন যে অস্থিরতা ছিলো তা যেন নিমিষেই বিলীন হয়ে গেলো।হিয়ার কথায় অর্থ তার সম্ভিত ফিরে পায়।হিয়া বলছে,
-” ভাইয়া প্রাহি সালাম দিয়েছিলো.! ”
-” হুম!ওহ হ্যা ওয়া আলাইকুমুস সালাম।”
প্রাহি কাঁপতে কাঁপতে আবার জিজ্ঞেস করে,
-” কেমন আ..আছেন ভা..ভাইয়া।”
-” আলহামদুলিল্লাহ! তুমি কেমন আছো।”
-” ভা..ভালো।”
রায়হানা বেগম এইবার অর্থকে বললো গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসতে।তিনি অর্থের খাবার তার রুমে পাঠিয়ে দিবেন।অর্থ একপলক আবার তাকালো প্রাহির দিকে।তারপর গটগট পা ফেলে চলে গেলো নিজের রুমে।আস্তে আস্তে বাকিরাও চলে গেলো ঘুমোতে কারন রাত হয়েছে।হেমন্ত প্রাহিকে নিয়ে প্রাহির ঘরে গিয়ে প্রাহিকে মেডিসিন খাইয়ে দিয়ে ও চলে গেলো নিজের রুমে।
প্রাহি সুয়ে সুয়ে বার বার এপাশ ওপাশ করছে।কিছুতেই ওর ঘুম আসছে না।আকস্মিক সুখের দেখা পেয়ে প্রাহি অনেকটা ভীতু হয়ে আছে।কারন ওর জীবনে সুখ বেশিদিন টিকে না।সেই ভয়ে ও চেয়েও মন থেকে হাসিখুশিভাবে থাকতে পারছে না।হারানোর ভয় ওকে সর্বদা আকড়ে ধরে রাখে।প্রাহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানা থেকে নেমে ব্যালকনিতে গিয়ে দাড়ালো।নীকষ আঁধার কালো আকাশে এক থালা চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারা মেলা খুব অল্প।তবে জ্যোৎস্নার আলোতে চারপাশ মুখরিত হয়ে আছে।প্রাহির চোখের কোনে জল ভরে উঠলো।প্রতিটা রাত মা,বাবা না থাকার কষ্টটা যেন ওর হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে দেয়।বোজার বয়স হতে কখনো সে একবেলা ঠিকঠাকভাবে খেতে পারেনি।সবসময় মামা,মামি আর মামাতো বোনের অত্যাচারে জীবনটা বিষিয়ে উঠেছিলো ওর।বারবার মরে যেতে ইচ্ছে করতো ওর।কিন্তু চেয়েও পারতো না।কারন আত্মহত্যা মহাপাপ। ওর শরীরে যে কতোশতো আঘাতের চিহ্ন তা একজন সুস্থ্য স্বাভাবিক মানুষ দেখলেও ভয় পাবে।আর পারলো না প্রাহি বুকে জমে থাকা কষ্টগুলো জল আকারে গড়িয়ে পড়লো ওর মৃসন কোমল গাল বেয়ে।প্রাহি সাথে সাথে চোখের জলটুকু মুছে নিজের ঘরে চলে গেলো।এতোক্ষন সবটাই নিজের ব্যালকনি থেকে দেখছিলো অর্থ।গোসল সেরে সে ব্লাক কফি খাচ্ছিলো ব্যালকনিতে বসে।হঠাৎ প্রাহিকে পাশের ব্যালকনিতে দেখে ভ্রু-কুচকে তাকিয়ে ছিলো।মেয়েটার ফর্সা কোমল চেহারাটা দেখলেই অর্থের কেমন যেন একটা অনুভূতি হয়।শুধু সেই চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে।প্রাহিকে যখন দেখছিলো অর্থ তখন হঠাৎ প্রাহির চোখে জল দেখে কেন যেন ওর বুকের ভীতরটাও মোচড় দিয়ে উঠেছিলো।কিন্তু কেন এমনটা হচ্ছে?এই মেয়েটাকে এই নিয়ে শুধু দুবার ভালোভাবে দেখলো।একবার যখন প্রাহি খুব ছোট ছিলো আর এখব আবার দেখলো।তাহলে এই মেয়ের জন্যে ওর হৃদয়ে এতো অস্থিরতা কিসের। অর্থ বিরক্ত হয়ে কফি মগটা ব্যালকনি থেকে নিচে সজোড়ে আছাড় মারলো।তারপর হনহন করে চলে গেলো নিজের ঘরে।এখন ঘুমই পারবে তাকে এই অস্থিরতা থেকে মুক্তি দিতে।
#চলবে,,,