প্রেম_এসেছিলো_নীরবে(৭)
সাদিয়া_জাহান_উম্মি
নিস্তব্ধ পরিবেশ।সবার মুখ থমথমে হয়ে আছে।প্রাহির কাপুনি দিয়ে জ্বর এসেছে।হেমন্ত গিয়েছে ডক্টরকে আনতে।এতো ঝড়বৃষ্টি দিয়ে ডক্টর আসবে কিভাবে?তাই হেমন্ত নিজেই বললো আমি গিয়ে নিয়ে আসছি।প্রাহির সারা মুখশ্রী ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।ঠান্ডায় ঠোটগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে।অর্থকে বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছে।সে অস্থির হয়ে অনবরত প্রাহিকে ডেকেই চলেছে,
-” এই মেয়ে?এই,চোখ খুলো। লুক এট মি?হেই।”
হিয়া গিয়ে পানি আর জলপট্টি নিয়ে আসলো।তারপর প্রাহির অন্যপাশে বসে তাকে জলপট্টি দিতে লাগলো। কিছুক্ষনের মাজেই ডক্টর চলে আসলো।অর্থ উঠে দাড়ালো।ডক্টর প্রাহিকে চেক-আপ করে কিছু মেডিসিন দিয়ে চলে গেলো।আকস্মিক বৃষ্টিতে ভিজায় জরটা এসেছে।প্রাহি থরথর করে কাঁপছে তাই ওকে দু’টো লেপ দিয়ে ভারিভাবে পেচিয়ে রাখা হয়েছে।
আজ সারাদিনই সবাই প্রাহির সেবা করলো। মেয়েটাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে।প্রাহির এই অঁঅসুস্থতার সাথে সবাই আরো অবাক হলো আরো একটা বিষয়ে।অর্থকে প্রাহির জন্যে এতোটা অস্থির হতে।এরকম অস্থিরতা দেখেছিলো অর্থ’র দাদির জন্যে।অর্থ আগে এতোটাও চুপচাপ ছিলো না।হ্যা সে রাগি, আর গম্ভীর ছিলো।বাট আনন্দ আড্ডার সময় যথেষ্ট ভালো মুডে থাকতো ও।চার বছর আগে ওর দাদি মারা যাওয়ার পর থেকে মনে হয় একেবারে রোবট হয়ে গিয়েছে ছেলেটা।কারো সাথেই ভালোভাবে দুদন্ড কথা বলতো না।দাদিকে যে প্রচন্ড ভালোবাসতো সে।কারো কথা না শুনলেও দাদির কথা শুনতো সব।এইতো দাদি মারা যাবার সময় তার কাছে আবদার করেছিলো যে অর্থ যেন আর কোনদিন বিদেশ না যায়।আর নিজের জীবনের প্রতি যেন কোনরূপ হোয়ালি না করে।সেই হতে অর্থ আর বিদেশে যায়নি।না কোন মেয়ের সাথে রিলেশন করেছে।অবশ্য মেয়েরা নিজেরাই আসতো ওর কাছে।যারা স্বইচ্ছায় রিলেশন করতে চাইতো অর্থ তাদের সাথেই রিলেশনে যেতো।কিন্তু অর্থ যেই রাগি আর গম্ভীর ছিলো মেয়েরা উর্ধ্বে দশদিনের বেশি তার সাথে থাকতে পারতো না।অর্থ প্রচন্ড হাসতো মনে মনে।সে ভাবতো এই পৃথিবীতে তাকে সামলানোর মতো কোন মেয়েই জন্ম হয়নি। কিন্তু কে জানতো এই রাগি অর্থ একটা ছোট্ট পিচ্চির প্রেমে পড়েছে। জীবনে কেউ কখনো দুধে ধোওয়া তুলসীপাতা হয়না।সবার জীবনেও কিছু না কিছু তিক্ত স্মৃতি থাকে।অর্থের জীবনেও ছিলো।কিন্তু দাদি মারা যাওয়ার পর ছেলেটা একেবারে চুপচাপ হয়ে গিয়েছে।আজ সারাদিন অর্থ কোথাও গেলো না।
হিয়ান্ত আর হিয়াজ সিকদার চলে গেলেন তাদের কাজে।তারা আর থেকে কি করবে?প্রায় বিকেলের দিকে জ্ঞান ফিরে আসে প্রাহির।চোখ খুলেই নিজের পাশে অর্থকে আর রায়হানা বেগমকে বসে থাকতে দেখে আস্তে করে উঠার চেষ্টা করলো।কিন্তু পারলো দূর্বলতার কারনে। অর্থ প্রাহিকে ধরে উঠে বসালো।প্রাহি অর্থের ছোঁয়ায় কেঁপে উঠে অর্থের হাত খামছে ধরলো। অর্থ ওর মাকে বললো,
-” মা যাও তো একটু স্যুপ নিয়ে আসো ওর জন্যে।”
রায়হানা বেগম এখনো অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।ছেলেকে এই রূপে দেখে তিনি বিষ্মিত সাথে আবার খুশিও হচ্ছেন।যদি তার ছেলেটা একটু হাসিখুশি হয়ে যায় তাহলে আর কিছুই চাননা তিনি।তিনি নিচে কোচিং এ চলে গেলেন।বাড়িতে নুরুল আমিন, হেনা আর রায়হানা বেগম আর সেলীমা আছেন।নুরুল আমিন অসুস্থ্ তাই সুয়ে আছেন।হিয়া গিয়েছে কোচিং এ।হেনা আর রায়হানা বেগম এখন কিচেনে।অর্থ এইবার প্রাহিকে বললো,
-” এখন কেমন ফিল করছো?”
প্রাহি আস্তে করে বলে,
-” ভা..ভালো।”
অর্থ হালকা রাগি স্বরে বলে,
-” বৃষ্টিতে ভিজেছিলে কোন খুশিতে?মানে নিজের শরীরের প্রতি কোন খেয়াল নেই।ডাফার একটা।”
অর্থের এমন রাগি কথায় কাঁদো কাঁদো হয়ে তাকায় প্রাহি অর্থের দিকে তাকায়।এতে অর্থ এইবার ভ্রু-কুচকে বলে,
-” হুয়াই আর ইউ মেকিং ইউর ফেস লাইক দ্যাট?”
প্রাহি মন খারাপ করে বলে,
-” আ..আপনি আ..আমার সাথে শুধু ধ..ধমকা ধ..ধমকি কেন করেন?”
অর্থ দাতেদাত চিপে বলে,
-” তুমি যে বড্ড ভালো কাজ করো তাই।”
প্রাহি ঠোঁট উলটে মুখ ফুলিয়ে ফেললো।অর্থ এইবার হালকা হাসলো।যা প্রাহির নজরে এলো না।অর্থ নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে প্রাহিকে দেখছে।এই এটুন একটা পিচ্চি একটা মেয়ের মাজে কি আছে?আছেটা কি?যা অর্থকে এমনভাবে পাগল করে দিলো।অর্থ তার গভীর দৃষ্টিতে প্রাহিকে দেখছে।ঘুম থেকে উঠায় মেয়েটার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।ঠান্ডার কারন কান,গাল নাক, ঠোঁট সবকিছু লাল হয়ে আছে।মেয়েটা ঠোঁট উল্টে মুখ ফুলিয়ে থাকায় অর্থের প্রাহিকে একদম একটা কিউট পুতুল মনে হচ্ছে।অর্থের মনে নিষিদ্ধ অনুভূতিরা ডানা ঝাপ্টিয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে।অর্থ চোখ বুজে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করলো।তারপর বাকা হেসে প্রাহির কানে কানে ফিসফিস করে বলে,
-” ইফ ইউ মেক আ কিউট ফেস লাইক দিছ।দেন আই উইল বাইট এভ্রি ইঞ্চ ওফ ইউর ফেস এন্ড মেক ইট রেড। সো স্টোপ ওল দিছ।”
প্রাহি এইবার বিষ্ময়ে হা করে তাকালো অর্থের দিকে।অর্থ এটা কি বললো এইমাত্র?ওকে কামড় দিবে?অর্থের চোখে চোখ পরতেই চোখ নামিয়ে নিলো প্রাহি।ইসস, লোকটার চাহনী যেমন মারাত্মক তেমন কথাবার্তাও মারাত্মক। এইযে প্রাহির ছোট্ট হৃদপিন্ডটা জোড়েজোড়ে লাফাচ্ছে মনে হচ্ছে এই বুজি ব্লাস্ট হয়ে যাবে।লজ্জায় গালদুটো লাল হয়ে উঠলো।অর্থ সাথেসাথে চেচিয়ে উঠে,
-” ডোন্ট ব্লাস, আদাওয়াইছ আই কান্ট হ্যান্ডেল মাইসেল্ফ এনিমোর।নাউ লেট্স গো।”
কথাগুলো বলতে দেরি অর্থ সাথে সাথে প্রাহিকে কোলে তুলে নিলো।প্রাহি ভয় পেয়ে সাথে সাথে অর্থের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
-” কি..কি কর..করছেন?না..নামান আমাকে প্লিজ।”
অর্থ বাকা হেসে বললো,
-” উহুম! বৃষ্টিতে ভিজার শাস্তি আজ তোমাকে এই ব্যালকনি থেকে ফেলে দিবো।”
প্রাহি ভয় পেয়ে সাথে সাথে অর্থের গলা জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুজে দিয়ে বলে,
-” প্লিজ এমনটা করবেন না।আমি আর কখনো বৃষ্টিতে ভিজবো না।তাও আমাকে ফেলে দিয়েন না,প্লিজ।”
অর্থ তো স্থির হয়ে আছে।প্রাহি ওর বুকে মাথা রাখায় মনে হচ্ছে ওর পুরো শরীর জুড়ে আলাদা শীহরন বয়ে যাচ্ছে।হৃদয়টা শীতল হয়ে এসেছে।অর্থ ঘোর লাগা কন্ঠেই বললো,
-” প্রাহি,হোয়াট হেভ ইউ ডান টু মি।”
তারপর প্রাহির অজান্তেই প্রাহির চুলে ঠোঁট ছোয়ায়।প্রাহিকে নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে গিয়ে নামিয়ে দিয়ে বলে ওকে ফ্রেস হয়ে আসতে।প্রাহি মনে মনে খুশি হলো যাক বাবা বজ্জাতটা ওকে ব্যালকনি থেকে ফেলে দেয়নি।প্রাহি খুশি মনে ফ্রেস হয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতেই অর্থ আবারও ওকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলো।প্রাহি ওয়াশরুমে থাকাকালীন সেলিমা স্যুপ দিয়ে গিয়েছে।অর্থ এইবার প্রাহিকে সুন্দরভাবে তা খাইয়ে দিলো তারপর মেডিসিনগুলোও খাইয়ে দিলো।এরই মাজে ফোন বেজে উঠলো অর্থ’র।
অর্থ দেখে আরাফ ফোন করেছে।ফোন রিসিভ করতেই আরাফ বললো,
-” কিরে কি অবস্থা?”
অর্থ প্রাহির দিকে তাকিয়েই বললো,
-” বেশি ভালো না।”
আরাফ শব্দ করে হেসে দিলো।অর্থ শক্ত কন্ঠে বলে,
-” ডোন্ট লাফ ইয়ার।সি ইজ ইল।আ’ম ফিলিং সো হেল্পলেস।”
আরাফ বলে উঠে,
-” হুম! শুনলাম আমি মাত্র হিয়া থেকে।”
অর্থ ভ্রু-কুচকে বলে,
-” হিয়া তোর সাথে?”
-” হ্যা! কোন প্রোবলেম দোস্ত?”
-“নাহ! বাট বাহিরে এখন হালকা হালকা বৃষ্টি পরছে।খেয়াল রাখিস ওর।”
আরাফ হালকা হাসলো।বললো,
-” ওর খেয়াল রাখবো না তো কি করবো?ওর কিছু হলে তো আমিই মরে যাবো।”
-“আচ্ছা সাবধানে থাকিস।”
অর্থ ফোন কেটে দিতেই।আরাফ হাসতে শুরু করলো।হিয়া অবাক হয়ে বলে,
-” হাসছেন কেন?”
আরাফ বাকা হেসে বলে,
-” তোমার ভাই প্রেমে পড়েছে।ঠিক আমার মতো।যেমনটা আমি প্রেমে পড়েছি তোমার।”
হিয়া যেন ধপাস করে কোন পাহার থেকে পরে গেলো।কি বলছে এসব আরাফ।তার ভাই প্রেমে পরেছে।হিয়া কৌতুহল ধমিয়ে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
-” কার প্রেমে পরেছে ভাইয়া।আর আপনি এসব কি বলছেন?ভাইয়া আর এসব?মানে কিভাবে কি?”
আরাফ প্রিয়তমার এতোটা অস্থিরতা দেখে তাকে জড়িয়ে ধরলো।হিয়াও চুপটি করে আরাফের বুকে মাথা রাখলো।আরাফ আস্তে আস্তে সবটা বলতে লাগলো হিয়াকে।ঠিক যেভাবে যেভাবে অর্থ ওকে বলেছে।সব শুনে হিয়া চোখ কপালে তুলে বলে,
-” কিইইই?প্রাহিকে?মানে কিভাবে কি?মানে মা ভাইয়াকে বিয়ে করানোর জন্যে কতোশতো মেয়ে দেখালো।অথচ শেষমেষ প্রাহির মতো একটা পিচ্চি মেয়েকে ভাইয়া ভালোবাসলো?”
আরাফ ভ্রু-কুচকে বলে,
-” এতে সমস্যা কি?আমিও তো তোমার কতো বড়?”
-” নয় বছর কোন ব্যাপার না।আর ভাইয়া প্রাহির থেকে বারো বছরের ছোট।আবার ভাইয়া যদি প্রাহিকে বিয়ে করে তাহলে তাকে আরো দু বছর অপেক্ষা করতে হবে।আর যেটা মোস্ট ইম্পোর্টেন্ট কথা প্রাহিই কি বা ভাইয়ার অনুভূতিগুলো বুজতে পারবে?”
আরাফ হিয়াকে নিজের সাথে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে চুমু খেলো বললো,
-” সেটা সময় আসলেই দেখা যাবে।অর্থ’কেই সামলাতে হবে সবটা।আর আমি জানি ও সব ঠিক মতোই পারবে।এখন এসব বাদ দেও তো।তোমার বরটার দিকেও একটু নজর দেও।আই মিস ইউ সো মাচ।”
হিয়া মুচকি হেসে বলে,
-“আই মিস ইউ টু।!”
#চলবে____