প্রেম_এসেছিলো_নীরবে(১১)

0
2120

প্রেম_এসেছিলো_নীরবে(১১)
সাদিয়া_জাহান_উম্মি

সময় নদীর স্রোতের মতো প্রবাহমান।দেখতে দেখতে কেটে গেছে একটা মাস।এই একটা মাসে বদলেছে অনেক কিছু।প্রাহি পুরো চুপচাপ হয়ে গিয়েছে।আগের মতো আর হাসি খুশি থাকে না।শুধু আনমনা হয়ে থাকে।কি নিয়ে এতো ভাবে যে পিচ্চিটা কেউ তা আন্দাজ করতে পারে না।স্কুলে যায় আবার ফিরে এসে রুমে ডুকলে সহজে বের হয় না রুম থেকে।রুম অন্ধকার করে রাখে সবসময়।বাড়ির প্রতিটি লোকও সেদিনের পর থেকে অনেক চিন্তিত হয়ে থাকে।প্রাহিকে নিয়ে অনেক ভয় হয় তাদের।ছোট্ট মেয়েটা মনে ভীষন আঘাত পেয়েছে। তাই তো কিছুতেই নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছে না।হেনা দীর্ঘশ্বাস ফেললো কবে যে সব ঠিক হবে জানা নেই তার।শুধু সৃষ্টিকর্তার কাছে সবকিছু ঠিক হওয়ার আশায় আছেন তিনি।হেনা রান্না ঘরে চলে গেলেন।গিয়ে দেখে রায়হানা বেগম আনমনা হয়ে রান্না করছেন।তিনি গিয়ে রায়হানা বেগমের কাধে হাত রাখেন।কারো হাতের ছোঁয়া পেতেই রায়হানা বেগম তাকান।হেনা দেখে মলিন হাসে।তা দেখে হেনা বলে,

-” কেন নিজেকে আর অর্থকে কষ্ট দিচ্ছো?ছেলেটা তো কষ্ট করলো এই একটা মাস যাবত।এইবার ক্ষমা করে দেও ভাবি।”

রায়হানা বেগম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না।আচঁলে মুখ চেপে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো।কান্না করতে করতে বলে,

-” আমারও তো কষ্ট হও তাই না?আমার ছেলেটাকে আমি একটা মাস যাবত চোখের দেখা দেখতে পারিনা।ছেলেটাও অভিমান করে আমার কাছে একটা ফোনও করে না।আমি ফোন করলে বলে,তোমাদের কথা মতো তো সবটাই হচ্ছে তাহলে বার বার ফোন দিয়ে জ্বালাচ্ছো কেন? আমার ছেলে বলে আমি না-কি ওকে জ্বালাই।বল তো ছোট আমি কিভাবে ওকে জ্বালাই একটু ওর খোঁজ খবর নিতে চাই।আমি তো মা একটামাস যাবত নিজের সন্তানকে দেখি না।আমার কলিজাটা যে পুরে ছাড়খার হয়ে যায় ও কি সেটা বুজেন না।”

হেনারও চোখ ছলছল করছে।তিনি বলেন,

-” ভাইজান যে কেন শুধু এরকম করলো?অর্থকে একটু ভালোভাবে বুজালেই হতো।ওতো আর ছোট না বুজতো।”

রায়হানা বেগম চোখ মুছলেন।তারপর হঠাৎ শক্ত কন্ঠে বলে,

-” নাহ! এতোটুকু শাস্তি ওর প্রাপ্য ছিলো।ধমকা ধমকি বকা ঝকা মেনে নেওয়া যায়।কিন্তু গায়ে হাত তোলা এটা অন্যায়।আর আমি অন্যায়কে প্রসয় দেই না।হিয়াজ যা করেছে আমি ওর সাথে একমত।”

-” কিন্তু ভাবি এইবার থামো।বাড়িটা একেবারে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে।হিয়া আর হেমন্তও রাগ করে অর্থের কাছে চলে গেছে।তাদের একটাই কথা তার ভাই যেখানে থাকবে না তারাও সেখানে থাকবে না।”

রায়হানা বেগম মাথা ঝাকালেন।অনেক হয়েছে শাস্তি।আর না। হিয়াজ সিকদারকে তিনি এইবার বলবেন অর্থকে বাড়িতে ফিরে আসতে।

একটা মাস আগে হিয়াজ সিকদার সেদিন অর্থকে জানায় তাকে এক মাস প্রাহি থেকে দূরে থাকতে হবে।এবং রাগ নিয়ন্ত্রন করার জন্যে হালকা পাতলা কিছু ট্রিটমেন্ট নিতে হবে।এক মাস পর অর্থ এই বাড়িতে ফিরতে পারবে তার আগে না।সন শুনে অর্থ রেগে গিয়ে ভাংচুর করে সবকিছু।প্রাহি সেদিন হুশে ছিলো না।সেদিন মেয়েটার ভীষন জ্বর এসেছিলো তাই ঘুমের ঔষুধ দেওয়া হয়েছিলো ওকে।তাই ও এসবের কিছুই টের পাইনি।অর্থ চিৎকার চেঁচামেচি, ভাংচুর করেও কাউকে মানাতে পারেনি।শুধু হিয়াজ সিকদারের একটা কথা অর্থকে থামিয়ে দেয়।অর্থ যদি এখন তার কথা না শুনে তাহলে তার একটা বন্ধুর ছেলে আছে তার সাথে প্রাহির এংগেজমেন্ট করিয়ে দিবে।আর প্রাহির বড় হলে বিয়েটাও দিয়ে দিবেন।অর্থ ভয় পায় ভীষন ভাবে।প্রাহিকে হারাবার ভয় ওর মনে ঝেকে বসে।অবশেষে অর্থ সেদিন সব ব্যাগপত্র গুছিয়ে গুলশানে তাদের যেই ফ্লাট আছে সেখানে চলে যায়।হিয়াজ সিকদার জানতেন তার ছেলেকে এই একটা কথা দ্বারাই রাজি করানো যাবে।অবশ্য তিনি এমন কিছুই করতেন না শুধু অর্থকে ভয় দেখানোর জন্যে এমনটা বলেন।সেদিন রায়হানা বেগমও বুকে পাথর চেপে স্বামি যা বলেন তা মেনে নিয়েছিলেন।হেমন্ত হিয়াও রাগ করে অর্থ’র সাথে চলে যায়।তাদের একটাই কথা তার ভাই যেখানে থাকতে পারবে না তারাও সেখানে থাকবে না।
——
বর্তমান,,,,
রাত দশটা বড়রা যখন সোফায় বসে সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলো অর্থকে এখন এসে পরতে বলবেন এই বাড়িতে তার জন্যে হিয়াজ সিকদারকে বুজাচ্ছিলেন।ঠিক তখনি সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে অর্থ।আর পিছু পিছু হেমন্ত আর হিয়া।অর্থকে দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়।রায়হানা বেগম কান্না করে দিয়ে ছুটে চলে যায় ছেলের কাছে।অর্থকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকে।তবে আজ আর অর্থ তার মাকে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দিচ্ছে না।অভীমান জমেছে যে অনেক অভিমান। নিজের বাবা মার প্রতি। এই একটা মাস সে সে তার জীবনের সবচেয়ে কঠোর দিনগুলো পালন করেছিলো।দিনরাত ছটফট করেছিলো একপলক প্রাহিকে দেখার জন্যে প্রাহির আওয়াজ শুনার জন্যে।কিন্তু কেউ সেই সুযোগ দেই নি।ফোন দিয়ে প্রাহির সাথে কথা বলতে চাইলেও কেউ দিতো না।
অর্থ রায়হানা বেগমের বাহু ধরে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিলো।তারপর শক্ত কন্ঠে বলে,

-” তোমার স্বামিকে জিজ্ঞেস কর এক মাস পূরন হয়েছে।আরও কোন কিছু করার বাকি আছে?নাকি তিনি চান আমি একেবারে মরে যাই।”

হিয়াজ সিকদার শুকনো মুখে ছেলের কথা শুনলেন।রায়হানা বেগম বললেন,

-” এসব কেন বলছিস বাবা?আমরা কেউ তোর খারাপ চাই না।”

অর্থ রাগি গলায় বললো,

-” সেটা আমার থেকে অন্তত কেউ ভালো জানে না।তোমরা কি চাও।”

বলেই হনহন করে উপরে নিজের রুমে চলে গেলেন রায়হানা বেগম শতোবার ডাকলেও একটাবার তার দিকে ফিরেও তাকালো না অর্থ।হেমন্ত আর হিয়া সবার দিকে তাকালো।হেমন্ত রাগে গজগজ করতে করতে বলে,

-” এই একমাস এই শাস্তি না দিয়ে একেবারে ভাউকে মেরে ফেলতে তাই ভালো ছিলো।”

হেমন্তও চলে গেলো।হিয়া ছলছল চোখে তার মা বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” এই একটা মাস ভাইকে তিলে তিলে কষ্ট পেতে দেখেছি।মরন যন্ত্রনার মতো কাতরেছে সে।তাও তোমাদের মন গললো না বাবা, মা।যা করেছো ভালো করেছো খুব ভালো।ভাইয়ের রাগ তো কমানো গেলেও না।উলটো আমার মনে হয় তার রাগের মাত্রা তোমরা আরো বাড়িয়ে দিলে।”

হিয়াও চলে গেলো।এদিকে বাকিরা ভাবছেন ছেলেকে এতোদূরে রেখে ঠিক করেননি বোধ হয়।অর্থ যে রাগ। না জানি রাগের মাথায় ছেলেটা কি করে বসে।

——-
ব্যালকনির ফ্লোরে আনমনা হয়ে বসে আছে প্রাহি।এই একটা মাস এই ব্যালকনিটাই তার সাথি হয়ে গিয়েছে।সে পারেনা ভালো মতন একটা ঘুম দিতে।চোখ বন্ধ করলেই অর্থ’র মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠে।অবশ্য জেগে থাকলেও অর্থ’র কথা ওর মাথাতে ঘুরতেই থাকে।মামনি থেকে শুনেছে অর্থকে নাকি এই বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে থাকতে দেওয়া হয়েছে।তাই জন্যে হেমন্ত আর হিয়াও চলে গেছে তার সাথে।প্রাহির এখন নিজেকে ছোট লাগছে নিজের কাছে।তার কারনেই অর্থ কি অর্থ চলে গিয়েছে।আসলেই ও অলক্ষি না।তার কারনে সবাই কষ্ট পায়। প্রাহির নিজেকে নিজের পাগল পাগল লাগে।এই একটা মাস শুধু অর্থকে একপলক দেখার জন্যে ওর পরান পাখিটা ছটফট করেছে।কেন করেছে?অর্থ’র কথা চিন্তা করলেও এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে বুকটা ভরে যায়।আবার অর্থকে একপলক দেখতে না পাওয়ার কষ্টতে কাঁদতে কাঁদতে দিনদুনিয়া ভুলে যায়। অদ্ভুত অনুভুতিতে আজ প্রাহি তিক্ত।কিসের জন্যে সে অর্থকে এতোটা মিস করে।কেন অর্থ’র আশায় দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে।এ কেমন অনুভূতি ওকে ঝেকে ধরেছে।অর্থ’র অনুপুস্থিতি ওকে দিনরাত কুরে কুরে খাচ্ছে।কেন এমন লাগে?ও নিজেই তো চেয়েছিলো অর্থ যেন ওর কাছ থেকে দূরে থাকে।তাহলে আজ ও নিজেই কেন ভালো নেই।কেন নেই? প্রাহি দু হাতে নিজের মাথা চেপে ধরলো।ভালো লাগছে না কিছুই কিছুই ভালো লাগছে না।অর্থকে এখন দেখতে পাওয়ার জন্যে ওপর ভীতরটা পুরে যাচ্ছে।
প্রাহি যখন এসব ভাবতে ব্যস্ত। হঠাৎ নিস্তব্ধ পরিবেশে কারো শান্ত কিন্তু ভয়ানক কন্ঠস্বরে কেঁপে উঠে প্রাহি।কেউ বলেছে,

-” মিস মি প্রাহি?ডিড ইউ মিস মি?”

#চলবে______

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here