প্রেম_এসেছিলো_নীরবে(২২)
সাদিয়া_জাহান_উম্মি
সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। কক্সবাজার জেলা শহর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে সাগর বক্ষের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ সেন্টমার্টিন। এ দ্বীপ ৭.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং আয়তন প্রায় ৮ বর্গ কিলোমিটার। এ দ্বীপকে ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ও বলা হয়। মূল দ্বীপ ছাড়াও আরও একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ রয়েছে যা ‘ছেড়াদ্বীপ’ নামে পরিচিত। যেদিকে চোখ যায় শুধু নীল আর নীল। আকাশ আর সমুদ্রের নীল সেখানে মিলেমিশে একাকার। এখানে অগভীর দীর্ঘ সমুদ্রতট, সামুদ্রিক প্রবাল, সাগরের ঢেউয়ের ছন্দ সবাইকে মুগ্ধ করে। নান্দনিক নারিকেল গাছের সারি যেন চিরল পাতায় দোলা দিয়ে যায়। সাগরতীরে বাঁধা মাছ ধরার নৌকা-ট্রলার, সৈকতজুড়ে কাঁকড়া, ঝিনুক, গাঙচিল- এসবই সেন্টমার্টিন দ্বীপের বৈশিষ্ট্য। যা ছোট্ট এ দ্বীপকে করেছে অনিন্দ্যসুন্দর। স্বচ্ছ পানিতে জেলি ফিশ, হরেক রকমের সামুদ্রিক মাছ, কচ্ছপ এবং প্রবাল এ দ্বীপের অন্যতম আকর্ষণ।
সবাই সাড়িবদ্ধভাবে হাটছে।কারন সেন্ট-মার্টিন ফেরিঘাট হতে একটু দূরেই ব্লু মেরিন রিসোর্ট আছে।হিয়ার বিয়ের জন্যে সেটাই বুকিং করা হয়েছে।হিয়া, প্রাহি আর ইশি একসাথে হাটছে।আর নিজ নিজ প্রেয়সীদের চোখে চোখে রাখছে আরাফ,অর্থ আর হেমন্ত।
প্রাহি তো হা করে চারদিক দেখছে।চোখের সামনে প্রকৃতির এমন সুন্দর জ্বলসানো রূপ দেখে ও বিমোহিত।মানে ওর চোখের কোণে অস্রু কনা এসেও ধরা দিয়েছে।কিন্তু হঠাৎ হাটার পাশে পিছন হতে ধাক্কা অনুভুত হওয়ায় হুরমুড়িয়ে সামনে উপুর হয়ে পরে প্রাহি।ওর সামনেই একটা ছোট্ট পাথর ছিলো সেখানেই কপালটা লেগে অনেকখানি কেটে গেলো।ফলে গলগল রক্ত ঝরে পুরো অবস্থা খারাপ।এদিকে আকস্মিক কি হলো কেউ বুজতে পারলো না।প্রাহির শরীরে একবিন্দু শক্তি নেই যে ও উঠে দাড়াবে।মাথায় ভীষন আঘাত পেয়েছে।অর্থ দৌড়ে গেলো প্রাহির কাছে।বাকিরাও প্রাহির দিকে এগিয়ে আসলো।অর্থ গিয়েই প্রাহির মাথাটা উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো।অস্থির কন্ঠে বলে,
—-” প্রাহি, হেই প্রাহি।এই মেয়ে তাকাও আমার দিকে।চোখ খুলে রাখো।আমি এখনি তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।ডোন্ট ক্লোজ ইউর আইছ ওকে।”
অর্থ জলদি প্রাহিকে কোলে তুলে নিলো।এরমাজে হিয়া প্রাহির কপাল একটা রুমাল দিয়ে বেধে দিয়েছে।প্রাহির চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে।এ স্পষ্ট বুজেছে কে ওকে ধাক্কা মেরেছে।কিন্তু আপাততো সেটা বলার মতো ও কোন শব্দ পাচ্ছে না।ওর শরীর আর ওকে চোখ খুলে রাখার সায় দিচ্ছে না।আস্তে আস্তে প্রাহি চোখ বুজে নিলো।এতে যেন অর্থ’র ভয়টা আরো বেড়ে গেলো।অর্থ চিৎকার করে প্রাহির নাম ডাকতো লাগলো।
এদিকে হেমন্ত সবাইকে রিসোর্টে যেতে বলে প্রাহিকে নিয়ে অর্থ আর হেমন্ত আবারও টেকনাফ রওনা হলো।কারন সেন্ট মার্টিন দ্বীপে কোন চিকিৎসা ব্যাবস্থা নেই।একটা হস্পিটাল আছে কিন্তু সেখানে কখনো ডাক্তার থাকে না।
—–
—-“কাজটা কি ঠিক করলে?যদি মেয়েটা তোমার নাম বলে দেয়?”
ইলফার মা’র কথায় ইলফার মধ্যে কোন ভাবান্তর হলো না।মুখে শয়তানি হাসি ঝুলিয়ে বলে,
—-“তুমি চিন্তা করোনা।ওই মেয়ে কাউকেই কিছু বলবে না।শুধু মনে রেখো অর্থকে আমার চাই।যেকোন মূল্যে চাই।ওই মেয়েটাকে তো আমি এখানেই মেরে সমাধি দিয়ে দিবো।”
ইলফা মা এসে মেয়ের কাধে হাত রাখলেন।চিন্তিত স্বরে বলে,
-” আরাফ জানতে পারলে কিন্তু আমাদের বাড়ি থেকে বাহির করে দিবে।আর অর্থ যে কি করবে সেটা কল্পনার বাহিরে।”
ইলফা রিরক্ত হয়ে বললো,
-” উফফ! মা এতো ভাবাভাবি করলে কি কোন কাজ করা যাবে?সাহস নিয়ে একটা কাজ করতে হয় যাতে কাজটা অনায়াসে আমরা কমপ্লিট করতে পারি।”
ইলফা ভয়ানকভাবে হেসে কাউকে ফোন দিলো।
—-” যেই কাজ দিয়েছিলাম।সেটা করলে আমি আরো ফিফটি কে বারিয়ে দিবো।বাট কাজটা হওয়া চাই।এখানে কখন আসবে? গুড,জলদি আসো আমার কাজটা হওয়া চাই মানে চাই।”
ইলফা হা হা করে হাসতে লাগলো।আর ওর মার মুখে চিন্তার আভাস।
——-
প্রায় চারঘন্টা কেটে গেছে।রিসোর্টের বিশাল বড় একটা টেবিলে সবাই একসাথে লাঞ্চ করতে বসেছে।কিন্তু কারও মুখে কোন কথা নেই।সবাই চিন্তিত।রায়হানা বললেন,
—-” মেয়েটার উপর দিয়েই যতো ঝড়ঝাপ্টা আসে।কেন যে আল্লাহ্ ওকে এতো কষ্ট দেয়।”
হেনা চোখ মুছে বলেন,
—-” আমার মেয়েটা কারো সাথে কোনদিন খারাপ কিছু করেনি।আল্লাহ্ কেন যে ওকে বার বার আঘাতের সম্মুখীন করেন।”
হিয়াজ সবাইকে শান্ত হতে বলেন,
—-” চিন্তা করো না সব ঠিক হয়ে যাবে।অর্থ আর হেমন্ত গিয়েছে তো।”
ইশি খাবার খেতে খেতে ওর সামনে বসা ইলফার দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।এখন অর্থ আসলেই ওকে যা করার যা করার করতে হবে।এই ডায়নীটাকে ওর একটুও দেখতে ইচ্ছে করে না।প্রাহিকে যে ইলফা ধাক্কা দিয়েছে সেটা ইশি নিজেও দেখেছে।এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।
খাওয়া দাওয়া প্রায় হয়ে গিয়েছে।এর মধ্যেই রিসোর্টে প্রবেশ করলো অর্থ,হেমন্ত,আর প্রাহি।প্রাহিকে কোলে নিয়ে আসছে অর্থ।প্রাহি নিষ্প্রান হয়ে অর্থ’র বুকের সাথে ল্যাপ্টে আছে।ওরফ কপালে আর আর ডানহাতে ব্যান্ডেজ করা।সবাই টুকিটাকি জিজ্ঞেস করছিলো।কিন্তু অর্থ একটা কথায় জবাব দেয়নি।হেমন্ত সবাইকে টুকটাক বুজিয়ে শুনিয়ে দিয়েছে।অর্থ গম্ভীর কন্ঠে হিয়াকে উদ্দেশ্যে করে বলে,
-” হিয়া তোদের রুমটা কোথায়?”
হিয়া যেতে যেতে বলে,
-” আসো ভাইয়া দেখিয়ে দেই।”
হিয়া পিছু পিছু অর্থ প্রাহিকে নিয়ে চললো।যাওয়ার আগে রায়হানাকে স্যুপ নিয়ে আসতে বলেছেন।আর আপাততো প্রাহির কাছে ভীর করতে মানা করেছেন।যার যার রুমে তারা তারা যেন বিশ্রাম নেয়। অর্থ রুমে প্রবেশ করে প্রাহিকে বিছানায় সুয়িয়ে দিলে ওর ডানহাতের কনুইতে হালকা ব্যাথা পেয়ে ‘ আহহহ’ করে উঠে।অর্থ তড়িঘড়ি করে বলে,
—-” সরি! সরি! আমি দেখিনি।দারাও হাতের নিচে একটা পিলো দিয়ে দেই।”
অর্থ সাবধানে প্রাহির হাতের নিচে বালিশ দিয়ে তার ওপর প্রাহির হাতটা রাখলো।এর মাজে রায়হানা এসে স্যুপ দিয়ে গেলেন।এর বাকি সবাইকে একটু সময়ের জন্যে রুম ত্যাগ করতে বললেন।সবাই যেতেই অর্থ প্রাহির দিকে ঝুকে ওর বুকে মাথা রাখলো।প্রাহি ওর বাম হাতটা অর্থ’র মাথায় রাখলো।অর্থ ধরা গলায় বলে,
—-” কেন এমন করো?কেন নিজের খেয়াল রাখো না?আমাকে কষ্ট দিতে কি তোমার ভালো লাগে?”
প্রাহি মৃদ্যু হেসে বলে,
—-” আমি ঠিক আছি। চিন্তা করবেন না।”
অর্থ প্রাহির বুক হতে মাথা উঠিয়ে বললো,
—-” হ্যা তা তো দেখছি।ঠিকভাবে কথাও বলতে পারছো না।এখন চুপচাপ এই স্যুপ টুকু খাবে।”
অর্থ উঠে প্রাহিকে স্যুপ খাওয়াচ্ছে, প্রাহিও খেয়ে নিলো।তারপর মেডিসিন খাইয়ে দিলো।তাপর প্রাহিকে বুকে জড়িয়ে নিলো।প্রাহি হালকা আওয়াজে বলে,
-” এই সামান্য আঘাত কিছু না।আপনি শুধু শুধু অস্থির হচ্ছেন।এর থেকেও কতো বেশি আঘাত পেয়েছি।মামা মামি কতো জঘন্যভাবে অত্যাচার করেছে।এইগুলা কিছু না।শুধু শুধু চিন্তা করবেন না।”
অর্থ প্রাহির কপালে চুমু খেয়ে বলে,
—-” আমার সামনে আর কোনদিন যেন এইসব কথা আর বলতে না শুনি।আর আমার কাছে আসলে এইসব কঠিন কথা বলবে না। সবার সামনে আমি তোমাকে কঠিন প্রাহি হিসেবে দেখতে চাই।আর আমার সামনে তুমি হবে আহ্লাদি আহি। তোমার সব আহ্লাদ আমি পূরন করবো।তুমি আমার সামনে যতোটা নরম হয়ে থাকবে,বাচ্চামো করবে এক একটা জিনিস আবদার করবে।কিন্তু বাকি সবার কাছে তুমি কঠিন মনের অধিকারি হবে প্রাহি।তোমাকে শক্ত মনের হতে হবে।পরিস্থিতি সামলে উঠার ক্ষমতা রাখতে হবে।”
প্রাহি ছলছল চোখের অর্থ’র দিকে তাকালো। বললো,
-” আমাকে একটু সময় দিন।আমি ইনশাআল্লাহ আপনার মনের মতো প্রাহি হয়ে দেখাবো।আমাকে আরেকটু সময় দিন।আমি পড়ালেখা করে নিজের পায়ে দাড়াবো।আমার আব্বু আম্মুর মনের ইচ্ছা পূরন করবো। শুধু একটু অপেক্ষা আর আপনি সাথে থাকলেই হবে।কি থাকবেন তো আমার সাথে?”
প্রাহি ওর হাতটা বাড়িয়ে দিলো অর্থ’র দিকে।অর্থ প্রাহির হাতটা নিজের হাতের মুঠোও নিয়ে চুমু খেলো।প্রাহি হালকা কেঁপে উঠে।চোখ বন্ধ করে নিয়ে আবার খুলে তাকালো।অর্থ প্রাহির হাতটা ওর বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
—-” তুমি তো আমার অস্থিত্বে মিশে আছো।নিজের অস্থিত্ব ছাড়া কি কেউ কোনদিন ভালো থাকে।এই আমি অর্থ তোমার সাথে থাকবো সারাজীবন। শেষ নিশ্বাস অব্দি।আমার বেচে থাকার কারন তুমি।তোমার কিছু হলে আমি থাকবো কিভাবে?তুমি আমার।শুধু এবং শুধু আমার।”
#চলবে________