বর্ষা দুপুর ( পর্ব-৪)

0
1040

বর্ষা দুপুর ( পর্ব-৪)
হালিমা রহমান

নীরা আঠারো নম্বর চিঠিটা পেল আজ সকালে।সেই আগের মতোই, একটা সুন্দর সাদা কাগজে কয়েকটা লাইন। লেখাগুলো এতো জঘন্য! নীরা ভেবেই পায় না, এই সুন্দর কাগজটা নষ্ট করার মানেটা কি?যে ওকে এই চিঠিগুলো পাঠায়, সে নিশ্চয়ই বয়সে ছোট নয়।এতো বড় একটা মানুষের লেখা এরকম কীভাবে হয়! নীরা চিঠি নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়।যার ইচ্ছে হচ্ছে দেক।কিন্তু, খচখচানি বলতেও একটা শব্দ আছে পৃথিবীতে। না চাইতেও মাথায় চলেই আসে, কে দেয় এসব চিঠি?কে এতো পর্যবেক্ষণ করে নীরাকে?

কোথা থেকে রুমের ভিতর উড়ে এলো কুসুম।ছিনিয়ে নিলো নীরার হাত থেকে চিঠিটা।এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললো দুটো লাইন।

নীরা
তুমি ভয়াবহ বিধ্বংসী। তোমার অনুরোধ তোমার মতোই ভয়াবহ,কিছুতেই ফেলে দেয়া যায় না।

ইতি
তোমার নাম পুরুষ।

—“বাহ! লাইনগুলো তো বেশ।কিন্তু, লেখাগুলো এরকম কেন, নীরাপু?”
—” আমি কী করে জানব?”
—” সেটাও একটা কথা।”
কিছুক্ষণ চুপ করে দু- জনেই চিঠির দিকে চেয়ে রইলো। কয়েক সেকেন্ড পর কুসুম নিজেই মুখ খুললো।
—” আচ্ছা নীরাপু,আগের চিঠিটা পাওয়ার পর তুমি কার কাছে অনুরোধ করেছিলে? ”
—“মানে?”
—” মানে বলছি যে, এখানে তো অনুরোধ করার কথা বলা আছে।এই চিঠির আগের চিঠিটা পেয়েছিলে কালকে।তার মানে তুমি নিশ্চয়ই কালকে কারো কাছে অনুরোধ করেছ।কার কাছে করেছিলে,তা যানতে পারলেই তো কেল্লা ফতে।আমরা দুজন যেয়ে ওই নাম পুরুষের গলা টিপে ধরব।ভালো না বুদ্ধিটা?”
কুসুম চওড়া হাসলেও, নীরার মুখে আষাঢ়ের মেঘ ছেয়ে গেল মূহুর্তে। এই কথাটা যে তার মাথায় আসেনি ব্যাপারটা তেমন নয়।নীরার স্পষ্ট মনে আছে সে সারাদিনে শুধুমাত্র ইশরাকের কাছে অনুরোধ করেছিল। নীরার মনে হলো কুসুমের সাথে এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা উচিৎ। মেয়েটা ছোট হলেও অবুঝ নয়।
—” কুসুম তোকে কিছু কথা বলি? কিছু কিন্তু মনে করতে পারবি না।”
—“কী বলবা নীরাপু? তোমারে এমন লাগতেসে কেন?”
—” আমার না কেন যেন মনে হয় চিঠিগুলো ইশরাক ভাই পাঠায়।”

অবাকের পরের শব্দটা বোধহয় মহাঅবাক।কুসুম ঠিক মহা অবাক হয়ছে।মুখটা হা হয়ে গেছে তার।ইশরাক!!! কিন্তু, তা কীভাবে সম্ভব?
কুসুম অবাক কন্ঠে বললঃ ” তুমি কী নিশ্চিত? ভাইয়ার এমন কোনো আচরণ চোখে লেগেছে তোমার?”
নীরা গতকাল সকালের পুকুর পাড়ের কথা ও বিকালের শার্ট ধোয়ার অনুরোধের কথা সব খুলে বলল।সবকিছু শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো কুসুম। নীরার মনে হচ্ছে, ও কথা সাজিয়ে নিচ্ছে।
বেশ অনেক সময় পার হওয়ার পর কুসুম মুখ খুললো।
—” নীরাপু,তুমি যা বললে তার দুটো মানে হয়।তোমার কথা শুনলে মনে হয় ইশরাক ভাই করছে এগুলো। কিন্তু, ভালোভাবে ভেবে দেখলে বুঝা যায় ব্যাপারটা কাকতালীয় হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।”
নীরা কিছুই বলল না কেবল শান্ত চোখে চেয়ে রইলো।
—” ইশরাক ভাইয়ার লেখা আমরা চিনি।এতো জঘন্য কখনোই নয় তার লেখা।দ্বিতীয়ত,চিঠিতে তোমাকে কেউ একজন পুকুর পাড়ে যেতে নিষেধ করেছে জোকের জন্য।তেমনি সকালবেলা,ইশরাক ভাইয়াও তোমাকে নিষেধ করেছে। কিন্তু তুমি চিন্তা করো, তোমার যায়গায় আমি থাকলেও ইশরাক ভাই একই কাজ করতো।শুধু আমি কেন বাড়ির যে কেউ যেতে চাইলেই ইশরাক ভাই নিষেধ করতো।এ থেকে বুঝাই যায় ইশরাক ভাই কখনোই নাম পুরুষ হতে পারে না।আচ্ছা, তুমিই বলো ভাইয়া কি কখনো আমাদের চার বোনকে আলাদা করে দেখেছে?”
নীরা মাথা নাড়লো। অসহায় কন্ঠে বলল,
—” কিন্তু, তুই ভেবে দেখ কুসুম জানালার কথা, খাটের কথা, অনুরোধের কথা সব কেন শুধু ইশরাক ভাইয়ার দিকেই ইঙ্গিত করে?চিঠিগুলো যেই দেক সে নিশ্চয়ই বাড়ির ভিতরের কেউ।আর কাল বিকেলে সেখানে ছেলেদের মধ্যে শুধু ইশরাক ভাই ও রেদু ভাইয়াই ছিল।রেদু ভাইয়া নিশ্চয়ই এগুলো করবে না।তার লেখাও আমরা জানি।তাহলে?”
—” তুমি শুধু শুধু এতো চিন্তা করছো, নীরাপু।ইশরাক ভাই এই বাড়িতেই থাকে।আমার সাথে বহুবার কথা বলার জন্য ভাইয়া এঘরে এসেছে।তাই খাট – জানালার কথা জানা এমন কঠিন কিছু নয়।আচ্ছা, সব বাদ দেও শুধু এতুটুকু চিন্তা কর ভাইয়া যদি তোমাকে অন্য চোখে দেখেই থাকে তবে তা মুখে বলবে।আমার ভাইকে তো আমি চিনি।তোমার মাথায় গিঁট লাগানোর মতো এতো বুদ্ধি তার নেই।যে ছেলে এখনো রাস্তা- ঘাটে আছাড় খেয়ে পরে, সে নাকি আবার পাঠাবে চিঠি।হাহ! পাগল আরকি।এমন তো হতেই পারে চিঠিগুলো বাইরে থেকে আসে।”

কুসুমের কথায় আশ্বস্ত হলো।ওর কথাগুলো ফেলে দেওয়ার মতো না।নীরার মন থেকে মনে হয় একটা পাথর সরে গেল।সকাল থেকেই মনে হচ্ছিলো ইশরাক বদলে গেছে।আগের মতো নেই।এবাড়িতে ইশরাকের একচেটিয়া জনপ্রিয়তা। তওসিফ বখে গেছে বলেই হয়তো সব আদর – আবদারের ভাগ ইশরাকের ঝুলিতে জমা হয়েছে।ইশরাক মানেই বোনদের আবদারের স্থান,বড়দের ভরসা।সেই ইশরাকই যদি বদলে যেত তবে সবচেয়ে দুঃখ নীরার হতো।নীরার আপন বড় ভাই নেই।ছোট থেকেই ইশরাক ও তওসিফকে নিজের ভাই হিসেবে জেনেছে।বাড়ির বড় মেয়ে হিসেবে নীরা ছোট বেলা থেকেই প্রচুর আদুরে।ছোটবেলা থেকে ইশরাক কত কত আদর করেছে ওকে।সব স্মৃতিগুলো যেন চোখের উপর দিয়ে দৌড়ে চলে গেল।চওড়া হাসি হাসলো নীরা। নাহ,ইশরাকের কথায় আচরনে যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা হলো স্নেহ, অপত্য স্নেহ।এগুলো কিছুতেই কামনা হতে পারে না।
কুসুমের কথায় ঘোর কাটলো নীরার।
—” কালকে আমি যখন বিকালে কবরস্থানে ছিলাম,তখন চেয়ারম্যান কাকার ছেলেরে দেখসি আমাদের বাড়ির দিকে উঁকি দিতে। আমার চোখে চোখ পরতেই চলে গেছে সেখান থেকে।”
—” উনি না ঢাকায় থাকে?”
—” থাকতো। কবেই তো গ্রামে আসছে।”

***
রেদোয়ানের শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে।মাথাটার ওজন মনে হচ্ছে চল্লিশ কেজি।কাথা গায়ে দিয়ে শুয়ে আছে খাটে।রেদোয়ানের শরীরের চাইতে মনটা বেশি খারাপ।চাকরি কী হবে না? কতদিন আরেকজনের বাড়িতে পরগাছার মতো থাকতে হবে? রেদোয়ানের যে এখনো অনেক স্বপ্ন ছোঁয়া বাকি।সেগুলো কী আদোও পূরণ হবে নাকি স্বপ্নই থেকে যাবে? জানে না রেদোয়ান। ভাবতেও পারে না।মাথাটা চক্কর দিচ্ছে খুব।মনে হয় এখনি খুলে পরে যাবে।

***

কুসুমের বাবা আজ বাড়ি ফিরেছে সন্ধ্যার দিকেই।শরীরটা ভালো যাচ্ছে না ইদানিং। ঘরে ঢুকেই বাতি জ্বালিয়ে বসলেন তিনি।রুমটা ঠিক আগের মতোই আছে।মমতা ঠিক যেরকম সাজিয়ে রেখেছিল সেভাবেই আছে।পার্থক্য শুধু আগে এই ঘরটাকে সাজিয়ে রাখত মমতা, এখন রাখে কুসুম।কুসুমের মা মমতা বেগম মারা গেছেন আজ থেকে দু- বছর আগে।এরকমই বর্ষা ছিল তখন।এক বর্ষার দুপুরে প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়েছিল।বাতাসের ঝাপটায় উঠোনের সুপারি গাছগুলো মনে হচ্ছিলো মাটিটাকে ছুঁয়ে দেবে।কী বজ্রপাতটাই না হয়েছিল সেদিন! মনে হচ্ছিল আকাশ বুঝি দু- ভাগ হয়ে যাবে।এমন ভয়ংকর দুপুরে মমতা বেগম বেড়িয়েছিলেন মুরগি খুজঁতে।হতভাগা মুরগি ঝড়ের আভাস পেয়ে কোথায় লুকিয়েছিল কে যানে! সাধের মুরগি খুঁজতে সেই যে মমতা বেগম বেড়িয়েছিলেন আর ফিরেননি ঘরে।বজ্রপাতে মারা গিয়েছিলেন তিনি।কুসুম তখন ক্লাস এইটে পড়ে কেবল।মায়ের মৃত্যু যেন এক লহমায় মেয়েটাকে বড় করে ফেললো। কান্নাকাটি বাদ দিয়ে ভেঙে পরা বাবা ও ভাইকে সামলে নিলো।আজকাল মমতার কথা খুব মনে পড়ে কুসুমের বাবা,জনাব ইদ্রিসের।ছোট- খাটো মেয়েটা এ সংসারে এসেই যেন বড় হয়ে গেল।কুসুম একদম মায়ের চেহারা পেয়েছে।যখনই মমতার কথা খুব মনে পরে, তখন ইদ্রিস আলী মেয়েকে দু- চোখ ভরে দেখে।মেয়ের হাসি দেখলেই মনে হয় এইতো মমতাই হাসছে।

বাবার খাবার হাতে ঘরে ঢুকলো কুসুম।ইদ্রিস আলী তখন পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসেছিলেন। কুসুম ঘরে ঢুকে কিছু বলল না।খাবারের প্লেট টেবিলের উপর রেখে বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। এওটা তার নিত্যদিনের অভ্যাস।ইদ্রিস আলী মৃদু হেসে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
—” আম্মাজানের কী খবর?”
—” ভালো।”
—” সন্ধ্যায় কিসু খাইসেন?”
—” না,তোমার সাথে খাব।”
—” আমি এখন কিছু খামু না আম্মাজান।ভালো লাগতাসে না।আপনে খায়া নেন।ঠিকাসে?”
—” আচ্ছা।তোমার আজকে মায়ের কথা খুব মনে পরছে, তাই না বাবা?”
চুপ করে রইলেন ইদ্রিস আলী। মেয়েটা কী করে বুঝে যায়! তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে বললেনঃ” তুমি নাকি এই বিষ্টি – বাদলার দিনেও কবরস্থানে যাও? কথাডা কী সত্য?”
কুসুম হাসলো।নিশ্চয়ই নীরা নালিশ করেছে।
—” আম্মাকে আমার খুব মনে পরে, বাবা।বিকাল হলেই মনে হয় যেন কবরটা আমায় ডাকছে।জানো, মায়ের কবরের উপর একটা শিমুল তুলার গাছ হয়েছে।কী সুন্দর টকটকে লাল রঙের ফুল ফুটে সেখানে!”
—” আর যায়ো না আম্মা।বিষাক্ত পোকামাকড়ও থাকতে পারে।”
—” চেষ্টা করব।আচ্ছা, বাবা তোমার কখনো আমার জন্য নতুন মা আনতে ইচ্ছে হয়নি?”
হাসলেন ইদ্রিস আলী। মেয়ে এই প্রশ্ন প্রায়ই করে।
—” না, আম্মা।আমার ভয় হয় যদি আপনার নতুন মা আমার আম্মারে কষ্ট দেয়, তহন কী করুম আমি?”
কুসুম জানে এটা কেবল তাকে ভুলানোর জন্যই বলেছে বাবা।সত্যিটা হলো, বাবা এখনো মাকে ভুলতেই পারে নি।কুসুমের কাছে মনে হয় এই পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী অনুভূতির নাম মায়া।এই মায়াই তার বাবাকে এখনো দু- বছর পিছনেই ফেলে রেখেছে।কুসুম বুঝতে পারে, বাবার এখন একটা সঙ্গী প্রয়োজন। বৃদ্ধ বয়সে এই প্রয়োজন আরো প্রকট হবে। তখন কী করবে বাবা?হঠাৎ করেই কুসুমের রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর একটা বিখ্যাত কবিতার কথা মনে পরলো।সে ভরাট গলায় আবৃত্তি করলো রুদ্রবাবুর সেই কবিতার দুটো লাইন–

” চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন করা- আদ্র রজনী”….

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here