বর্ষা দুপুর(পর্ব-৫)

0
1024

বর্ষা দুপুর(পর্ব-৫)
হালিমা রহমান

সকাল সকাল খুব রেগে গেলেন জয়নব বেগম।রাগে তার ভারী শরীরটা কেঁপে উঠলো বার- দুয়েক।জয়নব বেগব রেগে গেলে, তার শরীর কাঁপে।
সকালের খাবার খেয়ে মাত্র বসেছিলেন জয়নব বেগম।সকাল থেকেই শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল তার।ভেবেছিলেন, দুপুরে আর রান্নাঘরের দিকে যাবেন না।সাহানা ও রুমাকে বলবেন রান্নাটা সামলে নিতে।কিন্তু,বিধি বাম! ঘর থেকে বের হয়ে দেখেন, তাদের ছুটা কাজের ছেলেটা মাথায় মাঝারি আকারের একটা ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তাকে দেখে বিগলিত হেসে ঝুড়ি নামায়।ঝুড়ি ভর্তি ছোট- বড় মাছ।কয় কেজি পাঠিয়েছে কে যানে!পুঁটি থেকে শুরু করে মলা,ঢেলা, নারকেলি,কৈ,টাকি — কী নেই সেখানে।জয়নব বেগম হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলেন।এই মাছ কাটঁতে কয় বেলা পার হয় আল্লাহ মালুম।তার বিস্ময় বিরক্তিতে পরিনত হলো সাহানার কান্ড দেখে।এতো মাছ দেখে সাহানা বেগম মুহূর্তেই অসুস্থ হয়ে গেলেন।হুরহুর করে বেড়ে গেল তার বাতের ব্যাথা।তিনি এখন কিছুতেই বিছানা থেকে উঠতে পারবেন না।টুনিকে নিয়ে রুমাও পড়েছে বিপদে।মেয়েকে কোল থেকে নামাতেই পারছে না,মাছ কাটঁবে কী করে?জয়নব বেগম অসহায় চোখে তাকালেন ছোট দুই জা’ য়ের দিকে।যৌথ পরিবারের এই এক জ্বালা।সবাই গা বাঁচিয়ে চলবে। এখানে যেন প্রতিযোগিতা চলে,কে কত কম কাজ করবে।

জয়নব বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বটি নিয়ে বসলেন।উঠোনের মাঝে পিড়ি পেতে অভ্যস্ত হাতে কেঁটে চললেন একের পর এক নিষ্প্রাণ মাছ।তার জীবনটাই শেষ হয়ে গেল এই ভালোবাসাহীন দুধভাতের সংসারে।কিছুক্ষণ পর, রুমাও এলো বটি নিয়ে।মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসেছে।
নীরা মাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলো।

নীরাদের মাছের ব্যবসা।চার ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে প্রায় চল্লিশজন জেলে মাছ ধরে।কমদামে মাছ কিনে বেশি দামে বেচা, এই হলো তাদের ব্যবসা।তাই, নীরাদের বাসায় মাছ আসার কোনো ঠিকঠাক সময় নেই।মাছ বিক্রি না হলেই ঝুড়ি ভরে বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।
কিছুক্ষণ পর কুসুমও এলো।মাছ কাঁটতে বসার আগে নীরার ওড়না ঠিক করে দেয়ার অজুহাতে,নীরার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বললঃ” সেজ কাকি কই?”
–” শুয়ে আছে।তার নাকি বাতের ব্যাথা, পা ফেলতে পারছে না মাটিতে।”
—” হুহ, বাতের ব্যাথা।আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তো দেখছি, বাড়িতে মাছের ঝুড়ি আসলেই তার বাতের ব্যাথা শুরু হয়।কই যখন চিবিয়ে চিবিয়ে মাছের মাথা খায় তখন তো দাঁতে ব্যাথা হয় না?”
—” আস্তে কথা বল, আম্মা শুনলে বেয়াদবির অপরাধে দাঁত ভেঙে দেবে।”
—” মেজমা এতো আহ্লাদ করে কেন? আমি তার যায়গায় থাকলে জীবনেও সেজ কাকির সাথে কথা বলতাম না, একসাথে থাকা তো দূরের কথা।”
— “এই জন্যই তুই আম্মার জায়গায় নেই, আর আমরা এখনো একসাথে থাকি।যৌথ থাকতে হলে এরকম মেনে নেয়া লাগেই।”
জয়নব বেগম রামধমক দিলেন দু-টোকে।
—” কাজ করতে হইলে কর নইলে ঘরে যা।চোখের সামনে এতো গুজুরগুজুর কীসের?নাটক যতসব।বাড়িটা ভইরা গেল নাটকে।”
কুসুম নাক মুখ কুঁচকে কাজে হাত দিলো। হাহ! তার মেজমা শুধু তাদের সাথেই পারে।

***

রেদোয়ানের জ্বর নেই এখন।দুটো দিন খুব ভুগিয়েছে জ্বর।শরীর অনেক দুর্বল হয়ে গেছে।খেতেও ইচ্ছে করে না,শুয়ে থাকতেও ভালো লাগে না আবার বেশিক্ষণ বসে থাকলেও মাথা ঘুরায়।এ এক অসহ্যকর যন্ত্রণা। রেদোয়ানের অবস্থা দেখে জয়নব বেগম নীরা – কুসুমকে পড়তে আসতে দেননি।আজ একটু ভালো লাগছে রেদোয়ানের। তাই কুসুমকে ডেকে পাঠিয়েছে।পড়াগুলো দিয়ে দেবে।কিছু ই- মেইল জমে আছে।চেক করা হয় না তিনদিন যাবৎ।অবশ্য রেদোয়ান ইচ্ছে করেই করে না।প্রত্যেকবার অনেক আশা নিয়ে ই- মেইল দেখতে বসে।যদি কোনো চাকরির ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক আসে।কিন্তু,প্রতিবারই হতাশ হয় রেদোয়ান। তার প্রত্যাশিত ই- মেইল আসেনি এখন পর্যন্ত। আচ্ছা,লকডাউন তো শিথিল হয়েছে অনেক।তবে রেদোয়ানের চাকরিটা কেন হচ্ছে না?
কুসুম দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিলো।অনুমতি চাইল ভিতরে আসার।
—” ভেতরে এসো কুসুম।”
কুসুমের এক হাতে বই অন্য হাতে কাঁচা আম ভর্তার বাটি।বইগুলো টেবিলে রেখে বাটি এগিয়ে দিলো রেদোয়ানের দিকে।
—” ভাইয়া,মেজমা পাঠিয়েছে আপনার জন্য।বলসে জ্বরের মুখে ভালো লাগবে।”
— ” আচ্ছা, রাখো ওখানে।”
রেদোয়ান বইগুলো থেকে পড়া দিচ্ছে কুসুমকে।কিছু কিছু জায়গা বুঝিয়েও দিচ্ছে।কিন্তু যাকে বুঝানো হচ্ছে সে কী আদোও মনোযোগ দিচ্ছে? ভাবনার বিষয়।
ইদানিং, রেদোয়ানকে খুব ভালো লাগে কুসুমের।আগে যে খারাপ লাগতো ব্যাপারটা তা নয়।শিক্ষক হিসেবে রেদোয়ান খুব ভালো।তাই তাকে ভালো লাগা খুব স্বাভাবিক বিষয়।কিন্তু কুসুমের চোখে কেবল শিক্ষক হিসেবে নয়, একজন বলিষ্ঠ পুরুষ হিসেবেও ভালো লাগে।কোথায় যেন পড়েছিল কুসুম,বাঙালি মেয়েদের অনুভূতির হাতে- খড়ি হয় গৃহ- শিক্ষককে ঘিরে।তার সাথেও কী এরকম কিছু হচ্ছে? জানে না কুসুম।শুধু জানে,রেদোয়ানকে তার ভালো লাগে।তার কিশোরী মনে অন্যরকম আনন্দ হয় রেদোয়ানকে দেখলে।রেদোয়ানের সবকিছু কুসুমের ভালো লাগে।যখন পড়া বুঝায়,মুখরা সেজ কাকির কথার জবাব দেয়,মেজমার স্নেহের বিপরীতে মুচকি হাসে,তর্জনী আঙুল দিয়ে নেমে আসা মোটা ফ্রেমের চশমাকে নাকের উপরে ঠেলে দেয়— তখন খুব ভালো লাগে কুসুমের।এমনকি কুসুম ও নীরা যখন পড়া পারে না তখন রেদোয়ান তাদেরকে শাস্তি হিসেবে কান ধরে উঠ-বস করায়।কখনো পঞ্চাশ বার আবার কখনো একশ বার।এটাও খুব ভালো লাগে কুসুমের।কান ধরে উঠ-বস করতে করতে রেদোয়ানকে ফিসফিসিয়ে বলতে ইচ্ছে করেঃ” আরে রেদু ভাই,আপনার সবকিছু আমার এতো ভালো লাগে কেন? আপনার শাস্তিটাও কী সুন্দর! এতো সুন্দর শাস্তি দিতে আমি কাউকে দেখিনি।”

—” কুসুম তুমি কী শুনছো”?কুসুম,কুসুম?”
রেদোয়ানের কথায় ঘোর ভাঙলো কুসুমের।ভাবনার দেয়ালগুলো হঠাৎ করে ভেঙে যাওয়ায় খানিকটা অপ্রস্তুত হলো সে।তবে কুসুমের সামলে নেয়ার ক্ষমতা প্রবল।সে মাথা নেড়ে বললঃ” শুনছি তো রেদু ভাই।”
বিশ্বাস হলো না রেদোয়ানের।ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলোঃ” তুমি সত্যি শুনছো তো?”
—” হ্যাঁ, এইযে আপনি মূলধন ব্যয় বুঝাচ্ছিলেন।আমাকে জিজ্ঞেস করুন, আমি পারব।”
— ” আচ্ছা, ঠিকাছে।আজকের জন্য শুধু পড়া দিয়ে দিচ্ছি।কালকে থেকে পুরোপুরি পড়ানো শুরু করব।ঠিক আছে?”
—” জ্বি, আচ্ছা।”
—” ওহ, আরেকটা কথা।যাওয়ার সময় টেবিলের উপর থেকে অনিরুদ্ধ কাহালীর বাংলা ২য় পত্র বইটা নিয়ে যেয়ো নীরার জন্য।”
—” কিন্তু নীরা আপুর তো বই আছে।”
—” থাকুক। বই পড়লে কারো জ্ঞান কমে না।আর তাছাড়া নীরা বাংলা ২য় পত্রে অনেক কাচা।নিয়ে যেয়ো।”
—” ঠিকাছে ভাইয়া।”
বাইরে বেড়িয়ে বড় একটা দম নিলো। ভাগ্য ভালো তখন পড়া ধরেনি। ধরলে আজ খবর ছিল কুসুমের।

***

এই নিয়ে তিনবার গোসল করেছে নীরা।হাত দুটো ধুয়েছে বোধহয় পঞ্চাশ বারের বেশি।তবু মাছের আশঁটে গন্ধ যাচ্ছে না হাত থেকে।লেগেই আছে।আজকে নিশ্চিত নীরা ভাত খেতে পারবে না।আশঁটে গন্ধ একদম সহ্য হয় না নীরার।এই গন্ধ নাকে আসলেই মনে হয় যেন আশেপাশে অশরীরী মাছখেকো পেত্নীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে।মাছের গন্ধের লোভে নীরাকে লাল লাল জ্বিভ দিয়ে চেটে দেবে তারা।শিউরে উঠে নীরা।নীরা খুব ভীতু মেয়ে।ভূত- পেত্নিতে তার ভীষণ ভয়,অগাধ বিশ্বাস।
আরো একবার গামছা কাঁধে গোসলঘরের দিকে এগোয় নীরা।আরেকবার গোসল করেই দেখা যাক গন্ধ যায় নাকি।
তবে যাওয়া হয় না তার।উঠোনের মাঝে আসতেই দেখা যায় নীরাদের সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকছে রিমা।বোরকায় মোড়ানো রিমাকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে যায় নীরা।প্রাণপ্রিয় বান্ধবীকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।রিমাও জড়িয়ে ধরে নীরাকে।
রিমা ও নীরা দুই বান্ধবী।ছোট বেলার বান্ধবী যাকে বলে আরকি।দুই জনের মাঝে তুমুল ভাব।তবে, লকডাউনে কলেজ বন্ধ হওয়ার পর একটু ভাটা পড়েছিল বন্ধুত্বে।আসা- যাওয়া,প্রত্যেকদিন কথা বলা কমে এসেছিল অনেকটাই।আজ অনেকদিন পর দেখা হওয়াতে মনে হয় যেন বন্ধুত্বের নদীতে জোয়ার এসেছে।কথা যেন ফুরাচ্ছেই না।
বিকেলের অর্ধেকটা প্রায় শেষ তবে কথা এখনো শেষ হয়নি।আড্ডার একপর্যায়ে রিমা জিজ্ঞাসা করলোঃ ” নীরা,বাজারে যাবি? ইশরাক ভাইয়ের দোকানে?”
—” কেন? সেখানে কী?”
—” আরে,আমার কিছু জিনিস কিনার দরকার ছিল। চল না আমার সাথে।”
নীরা নাইনুকুর করলো কিছুক্ষণ। কারণ, তার আম্মা কিছুতেই এখন যেতে দেবে না।তবে রিমাও দমবার পাত্র নয়।সে নীরাকে অভয় দিয়ে বললঃ” আমি আন্টিকে রাজি করালে তুই যাবি তো? আমি এখনি যেয়ে রাজি করাচ্ছি।তুই রেডি হ।”
কথা রাখতে পারলো রিমা।বহু তেল মেখে,অনুরোধ করে জয়নব বেগমকে রাজি করালো।তবে শর্ত হলো,কুসুমকে নিয়ে যেতে হবে।সন্ধ্যার আগে আগে বাড়ি ফিরতে হবে।
মেনে নিলো রিমা।কুসুমকে নিতে কোনো সমস্যা নেই কুসুমের সাথে তার খুব ভাব।আর রইলো সন্ধ্যার আগে ফিরার কথা।তা তো পারবেই।কয়টা আর জিনিস কিনবে,কতক্ষণই বা সময় লাগবে।

রাস্তায় বেড়িয়ে ভীষণ ভালো লাগলো নীরার।কতোদিন পর বের হলো। রিমাকে জড়িয়ে ধরে দুটো চুমু দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।এমনিতে মা তো ওকে একা বের হতেই দেয় না।
বড় বাজারে ইশরাকের দোকান।বাজারে সবচেয়ে বড় দোকানটা ইশরাকের।সব পাওয়া যায় এখানে।
দোকানে যাওয়ার কিছুটা রাস্তা তখনো বাকি।এমন সময়,কুসুমের চোখে পড়লো মেহরাবকে।মেহরাব,এ গ্রামের চেয়ারম্যানের ছেলে।ঢাকায় থাকে।লকডাউনের জন্য গ্রামে এসেছে।কুসুম সেদিন মেহরাবকেই দেখেছিল, কবরস্থানে দাঁড়িয়ে। আজকেও কেমন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে।বড্ড অদ্ভুত লাগলো কুসুমের।মেহরাবের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ওদেরকে থামিয়ে দিলো মেহরাব। কুসুমকে বিগলিত হেসে জিজ্ঞাসা করলোঃ” ভালো আছো কুসুম?”
একটু অপ্রস্তুত হলো কুসুম।মেহরাব অনেক পরিচিত না আবার একদম অপরিচিত না।তাই হালকা হেসে বললোঃ” জ্বি, ভালো আছি।আপনি ভালো আছেন?”
—” হুম।ওরা কারা? ”
— ” আমার বড় আপু হয়।নীরাপু এইটা মামা হয়।ওইযে আমার বান্ধবী নূরজাহান আছে না,ওর মামা। ”
নীরা সালাম দিলো মেহরাবকে।মেহরাবও ভোতা মুখে সালামের উত্তর নিলো।শেষ পর্যন্ত মামা!
কুসুম হালকা গলায় জিজ্ঞেস করলোঃ” মামা,নূর ভালো আছে?”
—” হ্যাঁ, ভালো আছে।আচ্ছা পরে কথা বলব। যাও তোমরা যেখানে যাচ্ছিলে।”
বিরসমুখে অন্যদিকে চলে গেল মেহরাব।কুসুমের সামনে থাকলে নিশ্চিত যেকোনো সময় ঠাটিয়ে দুটো চর মারতো।যাদের বাড়িতে উঁকি দেয়া মেহরাবের অভ্যাস হয়ে গেছে,সেই বাড়ির মেয়ে নাকের ডগা দিয়ে মামা ডেকে গেল।ছিঃ! কী গা ঘিনঘিনে ব্যাপার।
ইশরাকের দোকানে ঢুকে তিনজন আলাদা হয়ে গেল।নীরা – কুসুম চলে গেল আইসক্রিমের দিকে।একটা আইসক্রিম খেলে মন্দ হয় না।রিমা একা একা প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো দেখতে লাগলো।রিমাকে একা পেয়ে এগিয়ে এলো ইশরাক।সবার অগোচরে রিমার বাম হাত চেপে ফিসফিস করে বললঃ” আমার ফোন ধরো নাই কেন, ফাজিল মহিলা? আমাকে টেনশন দিতে খুব ভালো লাগে?আরেকদিন এরকম করলে মেরে ফ্রিজে ভরে রেখে দেব,বেয়াদব।”

( চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here