বর্ষা দুপুর (পর্ব-৭)

0
1005

বর্ষা দুপুর (পর্ব-৭)
হালিমা রহমান

প্রিয় নীরা,

আমার দেখা সবচেয়ে বোকা মেয়ে তুমি।শুধু বোকা নও, ভয়াবহ বোকা।এই চিঠি পাওয়ার আগ পর্যন্ত তুমি বুঝতে পারোনি নাম পুরুষ আমিই ছিলাম।অথচ, আমি ভেবেছিলাম তুমি দু- তিনটে চিঠি পাওয়ার পরেই বুঝে ফেলবে।তুমি যে বাংলা দ্বিতীয় পত্রে এতোটা কাঁচা, তা কিন্তু আমি জানতাম না।
তুমি কী পুরুষ পড়নি?পড়লে তো জানার কথা আমি,আমরা আমাদের,তুমি,তোমরা, তোমাদের ; এইগুলো ছাড়া বাকি সব নাম পুরুষ। মানে হচ্ছে সব জায়গায় তৃতীয় ব্যাক্তিটাই নাম পুরুষ হয়।আমি তো তোমাদের পরিবারে তৃতীয় ব্যাক্তিই ছিলাম।তাই নামের পরিবর্তে এই সম্বোধন ব্যবহার করতাম।তোমার ঘরের জানালা দিয়ে প্রতি রাতে আমিই চিঠিগুলো ছুঁড়ে মারতাম।যদিও কাজটা ঠিক ছিল না।কিন্তু অন্যভাবে দিলে তুমি বুঝে যেতে। তাই সাহস হয়নি।
এবার আসি হাতের লেখার কথায়।আমি বা হাতি হলেও, আমার ডানহাত অকেজো নয়।ঐ হাত দিয়েও আমি লিখতে জানি।তবে জঘন্য হয় সে লেখা।তাছাড়া অনেক বেশি লিখতেও পারি না।তোমাকে চিঠিগুলো লিখতাম আমি ডানহাত দিয়ে।তাই লেখার অবস্থা এতো বাজে হতো।চিঠিগুলোও ছোট হতো।এইবার মাথার জট খুলেছে?
পড়ানো শুরু করার পর থেকেই তোমাকে খুব ভালো লাগতো। তবে সেটা ছিল কেবল ভালোলাগা।অন্যরকম অনুভূতি শুরু হয় গত দু- মাস থেকে।আমি হুটহাট তোমার প্রেমে পড়িনি।তোমাকে ঘিরে অনুভূতিরা দেয়াল তুলেছে ধীরে ধীরে। মনে আছে, গ্রীষ্মের শেষ সপ্তাহের কথা?কোনো এক দুপুরে পড়তে এসেছিলে তুমি।হঠাৎ করেই শুরু হলো কালবৈশাখীর তান্ডব।মনে হচ্ছিলো, দমকা বাতাসে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে।ঘরের জানালা খোলা থাকার কারণে তীব্র বাতাস তোমার বইয়ের পাতা এলোমেলো করে দিলো,মাথায় দেয়া ঘোমটা ফেলে দিল,তোমার এলোমেলো চুলগুলো আমার সামনে নিয়ে এলো।সেই মুহুর্তে হতচ্ছাড়া বাতাস শুধু তোমাকেই এলোমেলো করে দেয়নি,আমার দুর্বল মনটাকে আরো দুর্বল করে ফেললো।না চাইতেও সারাটা সময় একনাগাড়ে পর্যবেক্ষণ করেছি তোমায়।সর্বনাশের শুরু সেখানেই।হাঁটু ভেঙে,পা পিছলে সেই যে পড়েছি ;এখনো সেখান থেকে এখনো উঠতে পারিনি।
আমি চলে যাচ্ছি নীরা।ইচ্ছে করে নয়,বাধ্য হয়ে।আমার পায়ের তলার মাটিটা যদি একটু স্থায়ী হতো,তবে আমি কখনো তোমাকে ফেলে যেতাম না।
বেকার ছেলেদের প্রেমে পড়া পাপ।কারণ তাদের ক্ষেত্রে ভালোবাসার চাইতে অক্ষমতার পাল্লা ভারী থাকে।সেই পাপটাই আমি করেছি।এখন পুড়ছিও আমি।তুমি কী আমার জন্য অপেক্ষা করবে,নীরা? আমি ফিরে আসব।প্রতিজ্ঞা করছি,কোনো একদিন আমি ফিরে আসব।আজ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে রাতের আধারে পা বাড়াচ্ছি,কোনো একদিন সম্রাটের মতো আসব।তুমি কী ততোদিন আমাকে মনে রাখবে নীরা?
আমার বইগুলো সব তোমায় দিয়ে দিলাম।যত্ন করে রেখো।নিজের যত্ন নিয়ো,ভালো থেকো।আশা করছি খুব শীঘ্রই দেখা হবে।
প্রিয় নীরা,ভালোবাসি।

ইতি
রেদোয়ান।

চিঠিটা পড়ে হাহাকার করে উঠলো কুসুম।কত ভালোবাসে লোকটা! নীরাপু কত ভাগ্যবতী!কুসুমের একটু একটু খারাপ যে লাগছে না, তা নয়।শত হলেও তার প্রথম অনুভূতি।নীরা উদাসীন চোখে জানালা দিয়ে চেয়ে রইলো।এই জানালা দিয়েই চিঠি ফেলতো রেদোয়ান।
—” নীরাপু,তোমার কেমন লাগতেসে?”
অমনোযোগী চোখে তাকালো নীরা।
—” কেমন লাগবে?”
—” না মানে,এখন তো জানলাই তোমারে কে চিঠিগুলো দিত।তোমারও কী এখন রেদোয়ান ভাইরে ভালো লাগে? ”
—” রেদোয়ান ভাইয়াকে আমার সবসময়ই ভালো লাগতো।চমৎকার একটা মানুষ তিনি।”
—” মানে,আমি এইরকম ভালো লাগার কথা বলছি না,আমি…
কুসুমকে থামিয়ে দিলো নীরা।
—” তুই একটা গাধা কুসুম।আমাকে কেউ এসে ভালোবাসি বলবে আর আমিও লাফাতে লাফাতে বলব ভালোবাসি! এটা কী সম্ভব! তিনি চাকরির জন্য ঢাকায় গেছেন।মেধাবী মানুষ। হয়তো চাকরি পেয়েও যাবেন।তোর কী মনে হয়,তখন আমার মতো একটা গ্রামের মেয়েকে তার মনে থাকবে? কখনোই না।জীবন তো আর নাটক- সিনেমা না।”
—” আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি না, নীরাপু। ”
কুসুমের মাথায় আলতো টোকা দিলো নীরা।
—” মানে আমি বুঝাতে চাচ্ছি,ঢাকায় যাওয়ার পর রেদোয়ান ভাইয়া পুরোদমে বদলে যাবে। আশেপাশের সুন্দর,শিক্ষিত, আধুনিক মেয়েদের ভীড়ে তোর নীরাপুর কথা তার মনেও থাকবে না।দেখে নিস।”
বিশ্বাস করলো না কুসুম। অবিশ্বাসের সুরে বললঃ” এহ,বলসে তোমারে।উনি মোটেও ওরকম না।”
—” মিলিয়ে নিস আমার কথা।”
—” যদি তোমার কথা না ফলে? যদি রেদোয়ান ভাইয়া আবার আসে?”
—” আমার মনে হচ্ছে আসবে না।”
—” ধরো যদি আসে?তখন?”
—“সেটা তখন দেখা যাবে।যা এখন এখান থেকে।সকাল সকাল তোর সাথে আলাপ করে আমার মাথা ধরে গেছে।দূর হ এখন।”

***

নীরাদের গ্রামের চেয়ারম্যানের নাম কাশেম খান।তিনি টানা দুইবার চেয়ারম্যান হয়েছেন।গ্রামজুরে তার একচেটিয়া জনপ্রিয়তা। তাই চেয়ারম্যান গিন্নি কমলা বানুর অহংকারের শেষ নেই।তার স্বামী লাখে একটা।তার ছেলে মেহরাব কোটিতে একটা।এরকম ভাগ্যবতী মহিলা হতে গেলে সারাজীবন পূণ্য করতে হবে।এই তার ধারণা।
সকাল সকাল কমলা বানু রান্নাঘরের বারান্দায় বসে আছেন।মুখে পান চিবোচ্ছেন,হাতে বানাচ্ছেন নারকেলের নাড়ু।ছেলেটা খুব পছন্দ করে যে! কমলা বানু তার ছেলে মেহরাবের প্রতি বড্ড দূর্বল। এতোটা দূর্বলতা মেয়ের প্রতি নেই।কমলা বানুর কাজের মাঝেই কাশেম সাহেব এলেন রান্নাঘরে।
—” কমলা নাস্তা দেও বসার ঘরে।”
কমলা বানু একবার পানের পিক ফেললেন বাইরে।
—” কেউ কী আইছে?”
—” হুম।ঐ যে পাশের গ্রামে মোখলেস ঘটক আছে না,সে আসছে।”
ঘটকের নাম শুনে কপাল কুঁচকে ফেললেন কমলা বানু।
—” সকাল সকাল ঘটকের কী কাম?”
—” মেহরাবের জন্য একটা পাত্রীর খবর নিয়া আসছে।”
—” আমি হেরে কইছিনি এহন পোলা বিয়া দিমু?”
—” আহা,রাগ করছো কেন? ছেলে- মেয়ে বড় হলে এরা আসেই।”
ফুঁসে উঠলেন কমলা বানু।
—” আপনের আহ্লাদ আপনের কাসেই রাখেন।আমার পোলার বিয়ার বয়স হয় নাই।পোলার বিয়ার বয়স হইলে আমি নিজেই পাত্রী খুঁজুম।কোনো ঘটকের দরকার নাই।আর শুনেন,আপনেও কিন্তু কাউরে কোনো কথা- টথা দিবেন না।পোলারে কষ্ট কইরা বড় করছি।আগে পোলার কামাই খামু তারপর বিয়ার কথা ভাবুম।বউ আইলে কী আর তহন পোলায় বাপ- মায়ের কথা চিন্তা করব?”
কাশেম সাহেব তিক্ত মেজাজে আবারো বসার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।সারা গ্রামে তিনি ডাকসাইটে চেয়ারম্যান। অথচ, নিজের বউয়ের কাছে বিড়াল।দু-টাকার দামও দেয় না কমলা তাকে।কাশেম সাহেব মনে করেন, জীবনের সবচেয়ে অলুক্ষণে সময়ে কমলার সাথে তার বিয়ে হয়েছে।অসহ্য, জাহেল একটা মহিলা।মাথামোটা মহিলা মনে করে পৃথিবীতে সে একাই ঠিক,বাকি সবাই ভুল।

কমলা বানু নাড়ুর থালা হাতে নিয়ে মেহরাবের ঘরে ঢুকলেন।বিছানার উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে ছেলেটা।কমলা বানু পাশে বসে হাত বুলিয়ে দিলেন ছেলের গায়ে।সোনার টুকরা ছেলেটা গ্রামে আসলেই শুকিয়ে যায়।ছেলের মুখের দিকে তাকালে স্বর্গীয় আনন্দ খুঁজে পান কমলা বানু।
অবশ্য মেহরাব গর্ব করার মতোই একটা ছেলে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছে এবার। রেজাল্ট এখনো বেরোয় নি।করোনা আসার আগে যখন প্রাইমারি স্কুলে সরকারি শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছিল,তখন শখের বশেই বন্ধুদের সাথে অনলাইনে আবেদন করে মেহরাব।ভাগ্য ভালো থাকায় মেধাবী মেহরাব চাকরিটা পেয়েও গেছে।কিন্তু শিক্ষকতা করা আর হয়নি, করোনার জন্য।স্কুল – কলেজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চলে এসেছে গ্রামে।কাজ-কর্ম, পড়ালেখা কিছু নেই।সারাদিন কেবল গ্রামে ঘুরে বেড়ায়।মেহরাব দেখতে খুব সুন্দর।যতটা সুন্দর হলে সচরাচর মানুষের চোখে পরে, ততোটাই সুন্দর।চেহারার মতো আচরণও খুব সুন্দর। কোনো অহংকার নেই ভিতরে।মেহরাবের আরেকটা পরিচয় অবশ্য আছে।সে একজন কার্টন ব্লগার।তার কার্টুনগুলো নেট দুনিয়ায় বেশ জনপ্রিয়।

কমলা বানু ছেলের মাথায় বার কয়েক হাত বুলিয়ে দিলেন।মৃদু স্বরে বললেনঃ” আব্বা,উঠো।তোমার লেগা নাড়ু বানাইছি।খাইবা না?”
মায়ের আদরমাখা ডাকেও উঠলো না মেহরাব।বরং দু- একবার কপাল কুঁচকে আবারো ঘুমিয়ে পড়লো।
আর বিরক্ত করলেন না কমলা বানু।থাক ঘুমাক,ছেলেটা।তার একটামাত্র ছেলে।এতো সকালে ঘুম থেকে উঠে করবেটা কী?

***

বিকেলে ইশরাক দোকানে বসে অকারণেই খুব রেগে গেল।অবশ্য অকারণে নয়।তার দোকানের সামনে দিয়ে রিমার বাবার ঠিক করা প্রবাসী, তার পরিবার নিয়ে রিমাকে দেখতে গেছে কিছুক্ষণ আগে।রিমার কথা শুনে ইশরাক কালকেই এর খোঁজ নিয়েছিল।তাই মূহুর্তেই চিনে ফেলেছে।ঘটনা এখানেই শেষ নয়।মেয়ে দেখার জন্য মিষ্টি, কেক সব ইশরাকের দোকান থেকেই কিনেছে।ইশরাক না পেরেছে কিছু বলতে,না পেরেছে সইতে।জমিয়ে রাখা রাগটুকু দোকানের কর্মচারীর উপরই দেখালো।অসহ্য লাগছে সব। গ্রামে বিয়ে করার জন্য কি আর মেয়ে ছিল না? রিমাকেই কেন পছন্দ করতে হবে?

বিকালে কুসুম – নীরা একসাথে পুকুর পাড়ে হাঁটছে।রেদোয়ান নেই, তাই তাদের পড়াও নেই।একটামাত্র মানষ নেই বাড়িতে।অথচ, পুরো বাড়িটা কেমন খালি খালি লাগছে।হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের সিঁড়ির দিকে চলে গেল দুজনে।ওরা দুজন একসাথে থাকলে অনেক কথা বলে।কুসুম কথা বলতে বলতে এদিক – ওদিক চোখ ঘুরালো। তখনি চোখে পড়লো বড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মেহরাবকে।কুসুমের চোখে চোখ পড়তেই মেহরাব উল্টো দিকে হাঁটা দিলো।কপাল কুঁচকে গেল কুসুমের।কুসুম তাদের বাড়ির আশেপাশে প্রায়ই দেখে মেহরাবকে।কী এতো দেখতে আসে মেহরাব? এদিকে দেখার মতো কী আছে?

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here