কুহুকথা,পর্বঃ৮
নুশরাত_জেরিন
–এই কুহু,এই?
কুহু বাড়ি ফিরে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছিলো।রায়হান নামক লোকটার সাথে দেখা করতে যাওয়াটা তার বিরাট বোকামী হয়েছে।চাকরীর লোভে যাওয়াটা তার একদম উচিৎ হয়নি।সে ভেবেছিলো লোকটা চাকরী ব্যতিত বাইরের কোন কথা বলবেনা।বড়লোক মানুষ,হয়তো মানবতার খাতিরে অথবা দয়া দেখাতে চাকরী দিতে চেয়েছে।সে নিশ্চয়ই নিজের মৃত বাবার অবৈধ কন্যাকে নিজের বোন বলে পরিচয় দেবেনা।কিন্তু হলো তার উল্টো।
সে তো কুহুকে বোন বলে ডাকাও শুরু করে দিয়েছে।এমনতর ব্যবহার করলে কিকরে সেখানে চাকরী করবে কুহু?তার কষ্ট হবেনা?ক্ষনে ক্ষনে কান্না পাবেনা?
সে ডাক শুনে থমকে দাড়ালো।
কন্ঠটা সে চেনে।খুব ভালোকরে চেনে।
সেই ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে।
রোবটের মতো পেছন ঘুরে পিহুর মুখোমুখি দাড়ায়।
পিহুর মুখটা হাসিহাসি।যেনো আজ তার পরিক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে এবং সে খুব ভালো রেজাল্ট করেছে।নয়তো বিশ্ব জয় করেছে।
তাকে দেখে বোঝাই যাচ্ছেনা সে এই কিছুদিন আগে নিজের বাবা মার মুখের ওপর চুনকালি লাগিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো।তার তো থাকা উচিৎ মুখ গোমড়া করে,চোখ মুখ ফুলিয়ে।
অথচ সে দিব্যি হেসে খেলে বেড়াচ্ছে?
কুহু শুকনো গলায় বলে,
—কিছু বলবি আপা?কখন এলি?
পিহু জোরেসোরে মাথা নারে।
—কিছুক্ষণ আগে।
সে হাসি হাসি মুখে আরও বিস্তর হাসি যোগ করে।বলে,
—তোর বরটা দেখতে কেমন রে?শুনলাম খুব সুন্দর নাকি?রাজপুত্রের মতো দেখতে!সত্যি?
তো এমন বর ফেলে চলে এলি কেনো?
পছন্দ হয়নি?
কুহু চোখ তীক্ষ্ণ করে।পিহুর এই স্বভাবটা তার অসহ্য লাগে।সারাক্ষণ ছেলেদের গল্প মুখেমুখে। কেনো ছেলে বিনা আর কোন বিষয় নেই পৃথিবীতে?
–পছন্দ হবেনা কেনো আপা,অবশ্যই পছন্দ হয়েছে।নয়তো তাকে বিয়ে করতাম নাকি?এতো সুন্দর ছেলে পৃথিবীতে খুব কম দেখা যায় বুঝলি?
তুই শুনলাম বিয়ে করেছিস?ওই পাড়ার রাশেদ না কি নাম যেনো তার?
পিহু মুখ গোমড়া করে।যেনো খুব অপছন্দের কথা বলে ফেলেছে কুহু।মুখ চোখ বাঁকিয়ে বলে,
–হু,রাশেদ।
—সে কি আবিরের চেয়েও বেশি সুন্দর আপা?
—ঘোড়ার ডিমের সুন্দর। না আছে রুপ আর না গুন।গুন্ডা বদমাশ একটা।
আমাকে বলে কিনা তুমি চলে যাও,আমি তোমার সাথে সংসার করবোনা।তুমি লোভি!কতোবড় সাহস ওর!
কুহু মুচকি হাসে।সে জানতো পিহু রাশেদের সাথে থাকতে পারবেনা।কখনোই না।
ছেলেটা ভালো না, চরিত্রে দোষ আছে।মেয়ে দেখলেই ছুঁকছুঁক করে।যদিও পিহুও সাধু না।যেমন রাশেদ ঠিক তেমনটাই পিহু।একেবারে পার্ফেক্ট ম্যাচ যেনো।
তারপরও কুহুর শান্তি লাগে।
পিহুর জন্য ভালো লাগে।অবশেষে সে রাশেদকে চিনতে পেরেছে, ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এসেছে এই ঢেড়।
সে ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পিহু আবার বলে,
—আফসোস হয় বুঝলি,মনে হয় ঠকে গেছি খুব।ইশ আগে যে কেনো আবিরকে দেখলামনা?
কুহুর বুক জ্বলে ওঠে।আবিরকে সে স্বামী বলে মানে।বিয়েতো জিবনে একবারই হয়।এখন নাহয় সে সংসার করছেনা,কিন্তু ভবিষ্যতে? যখন বাবা মার একটা ভালো কোন ব্যবস্থা করতে পারবে তখন?সেকি সংসার করার কথা ভাববে না?তাছাড়া আজ যখন আবির উদ্ভান্ত চেহারা নিয়ে সামনে এসে দাড়িয়েছিলো,নিজের অনুভূতিগুলো অকপটে স্বীকার করেছিলো তখন কি কুহুর ভালো লাগেনি?খুশিতে পাগল পাগল মনে হয়নি?নিজের অনুভুতি প্রকাশ করার ভয়েই তো সে পালিয়েছিলো।রাগ দেখিয়ে চলে এসেছিলো।
,
,
সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয় কুহুর।মোবাইলে সময় দেখতেই তার চক্ষু কপালে ওঠে।কতো বেলা হয়ে গেছে।
আজ নতুন টিউশনিতে যাওয়ার কথা ছিলো।প্রথম দিনেই লেট করলে কেমন হবে?টিউশনিটা কি অদৌও টিকবে?
তাছাড়া কাল রায়হানের সাথে দেখা করার পর থেকে কুহুর মনটাও ভালো নেই।ক্ষনে ক্ষনে বুকে ব্যাথা করছে।অস্থির লাগছে।
কুহু অবাক হয় খুব!অচেনা অজানা একজন ছেলের জন্য তার এমন অদ্ভুত লাগার কারন কি?রক্তের সম্পর্ক আছে সেইজন্য? রক্তের সম্পর্কের কি এতোই জোর?
ভাবনা চিন্তা ফেলে সে উঠে দাড়ায়।
কাজা নামাজ আদায় করে।
জামা কাপড় পাল্টে তাড়াতাড়ি বের হয়।
খাওয়ার রুমে পিহু বসে আছে।
তার মুখচোখ কুঁচকানো।
সে ভাতের প্লেট সামনে নিয়ে চিল্লায়।
বলে,
—এসব খাবার মানুষ খায় নাকি মা?কি সব ছাইপাঁশ রাধো বলোতো,একটু ভালো কিছু রান্না করতে পারোনা?
আসমা বেগম পিহুর থেকেও বেশি মুখ কুঁচকান। বলেন,
—ঘরে এসব ছাইপাঁশ ছাড়া আর কিছু নেই।ইচ্ছে হলে খা নইলে না খেয়ে থাক।
ভালমন্দ খেতে হলে যা না নিজের স্বামীর কাছে যা।
পিহু মুখ কাঁদো কাঁদো বানায়।ন্যাকা কান্নার সুর তোলে,
—তুমি এভাবে আমায় বলতে পারলে মা,এভাবে বললে?কুহুও তো বিয়ের পর বাবার বাড়িতে আছে, কই তাকে তো কিছু বলোনা?
—কুহু কামাই করছে,আমাদের খাওয়াচ্ছে, সংসার টানছে।আর তুই কি করছিস?
পিহু কান্নার সুর জোরে করে,
–তুমি এভাবে আমায় খাবার খোঁটা দিচ্ছো?আমি না তোমার আপন মেয়ে?
আসমা বেগম চোখ তীক্ষ্ণ করেন।
—কুহু কি আমার পর মেয়ে?
পিহু উত্তর দেয়না।মনে মনে বিরবির করে,
—পরই তো।
কুহুকে যেতে দেখে আসমা বেগম দৌড়ে আসেন।
বলেন,
—এতো সকাল কোথায় যাস কুহু,তোর টিউশনি আটটা থেকে না?
—না মা,নতুন টিউশনি পেয়েছি।সেটা শুরু হবে সাতটা থেকে।
—খালি মুখে যাবি নাকি?আয় খেতে আয়।
কুহু তাড়াহুড়ো করে।
—সময় নেই মা,এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।
রাস্তায় কিছু খেয়ে নেবো।
আসি।
আসমা বেগম অপলক কুহুর পথের পানে চেয়ে থাকেন।তিনি জানেন কুহু রাস্তায় ও কিছু খাবেনা।নিজের জন্য এক পয়সাও খরচ করে না সে।
আসমা বেগমের আফসোস হয়,কেনো তার গর্ভে এমন রত্ন ধারন করতে পারলেন না?
আঁড়চোখে পিহুর দিকে তাকান।সে আরামছে খেতে ব্যাস্ত।
একটু আগের কান্নার কোন ছাপই তার মুখে নেই।
আসমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন,
তার মেয়েটাই এমন স্বার্থপর কেনো হলো?
চলবে…..