কুহুকথা,পর্বঃ৯
নুশরাত_জেরিন
—কুহু,
কুহু থমকে দাড়ালো।আবিরের কন্ঠটা সে এক ঝটকায় চিনতে পেরেছে। তবে লোকটা এতো সকালে এই এলাকায় কি করে?পরমুহূর্তেই মনে পরলো এটা আবিরের বাড়ির সামনের রাস্তা। কুহুর বিরক্ত লাগলো খুব।
রিমার টিউশনিটা বাদ দেবার পর কুহু হন্যে হয়ে টিউশনি খুজে ছিলো। নয়তো সংসার চালানো তার জন্য মুশকিল হয়ে যেতো।নতগন টিউশনি জোগার করে দিয়েছে তার এক বান্ধবী। নতুন টিউশনি পাবার খুশিতে আশেপাশের কোন কিছু তার মাথায়ই ছিলোনা।
শেষে কিনা তাকে প্রতিদিন আবিরের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া আসা করতে হবে?
হঠাৎ কুহুর টনক নড়লো।আবির তার নাম ধরে ডেকেছে? কিভাবে?সে কি সত্যিটা জেনে গেছে?এখন কি করবে কুহু?সে চোখ পিটপিট করে পেছন ঘুরলো।
আবিরের মুখটা হাসিহাসি। পরনে তার জগিং স্যুট।নিশ্চয়ই বেটা জগিং করছিলো।
কুহু বড় করে নিশ্বাস ফেললো।
—কি চাই?
আবির আরো দুকদম এগিয়ে এলো।সকাল সকাল সে কুহুকে দেখতে পাবে ভাবতেও পারেনি।ভেবেছিলো অফিস যাবার পথে কুহুর বাড়ির সামনে দাড়াবে।একনজর তাকে দেখে দিন শুরু করবে।
কিন্তু সৃষ্টিকর্তার হয়তো অন্য ইচ্ছে ছিলো।
এটাকে কি মিরাকেল বলা যায়?নাকি মনের টান?
কুহুর ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আবির মুচকি হাসলো।যতোই কুহু চেষ্টা করুক নিজের ভয়টাকে ভেতরে দমিয়ে রাখবার,তবুও সে ব্যার্থ।তার চোখমুখেই ভয়ের ছাপ ফুটে উঠেছে। নিশ্চয়ই সে ভাবছে আবির তাকে এখনই টেনেটুনে বাড়ি নিয়ে গিয়ে তুলবে।
অথচ আবির সেরকম কিছুই করবেনা।
সে তো ভালবাসতে চায় মেয়েটাকে।তাকে সেচ্ছায় ঘরে তুলতে চায়!কেনো বুঝছেনা মেয়েটা এই সামান্য কথা?
সে কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
—তুমি জানোনা আমি কি চাই?
—আশ্চর্য!আমি কিভাবে জানবো?আমি কি মন পরতে পারি নাকি?
আবির ব্যাকুল হয়ে বললো,
—কেনো পারোনা কুহু?কেনো মন পরতে পারোনা?
কুহুর বুকটা ধক করে উঠলো।এতো আকুলতা মিশিয়ে কেনো কথা বলছে লোকটা?সে কি জানেনা,এভাবে কথা বলতে নেই?বুকে লাগে যে খুব!
—কিসব আবোলতাবোল কথা বলছেন?কেনো বলছেন?আমাকে যেতে দিন।
–ধরে তো রাখিনি।সে অধিকার কি আমার আছে?
কিছুক্ষণ থেকে আবার বললো,
—সে অধিকার দেবে কুহু?
কুহু চোখ বুজে দম দিলো।এতো এলোমেলো কেনো লাগছে তার?এতোটা অসহায়?কেনো লাগছে?
সে কেনো পারছেনা মুখের ওপর দুটো কড়া কথা শুনিয়ে দিতে?কেনো এতো অস্থির লাগছে?
বেশকিছু সময় ধরে নিজেকে সামলালো সে।
তাকে ছাড়া বাবা মার কি হবে?কে দেখবে?একটা ব্যবস্থা তো অন্তত করতে হবে।
অথচ সামনে দাড়ানো লোকটাকেও ফিরিয়ে দিতে মন টানছেনা।
কি অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পরেছে সে।
কাঠকাঠ গলায় বললো,
—সম্ভব না।
–কেনো?
—জানিনা,আমি কিচ্ছু জানিনা।
তাছাড়া তখন কোথায় ছিলো আপনার এই অনুভূতি যখন আমি সারাটাক্ষন করিডোরে দাড়িয়ে ছিলাম।কোথায় ছিলো আপনার ভালবাসা,যখন আমায় ঘরে ঠাই দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন?
আমি বাড়ি ছেড়ে চলে আসার সময়ও তো আটকাননি আমায়?
—ভুল হয়ে গেছে কুহু,বড্ড ভুল হয়ে গেছে।কি করবো বলো,তখন যে মাথা কাজ করছিলোনা।
জিবনের সব আকস্মিক ঘটনা একবারে সামনে এসে দাড়িয়েছিলো। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম আমি।
তবে ভুল বুঝতে পেরে শোধরাতে তো ইচ্ছুক বলো।
সামান্য ভুলের জন্য এতো বড় শাস্তির কি আমি প্রাপ্য?
—পথ ছাড়ুন।
–যদি না ছাড়ি?
—চিৎকার করবো,লোক জরো করবো।
—তবু উত্তর দেবেনা?
কুহু চোখ নামালো।সে এই মুহুর্তে এখান থেকে পালাতে যায়।পরিস্থিতি মোকাবেলা করার শক্তি তার নেই।
একেবারেই নেই।
—কুহু?এখানে কি করছো?
হঠাৎ তৃতীয় ব্যক্তির কথায় আবির কুহু দুজনেই চমকে তাকায়।
রায়হান বসে আছে গাড়িতে।
কাচ নামানো গাড়ির।
সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে কুহুর দিকে।
কুহু এগিয়ে দাড়ায়।বলে,
—টিউশনিতে যাচ্ছি।
রায়হান তীক্ষ্ণ চোখে আবিরের দিকে তাকায়।মনে হয় তার বোনের পেছনে ছেলেটা লেগেছে।অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছে সে।তাছাড়া কুহুর মুখটাও শুকনো।রায়হান দাঁতে দাঁত চেপে ধরে।তার ইচ্ছে করছে সামনে দাড়ানো ছেলেটাকে পিটিয়ে সোজা করতে।
তবু পরিস্থিতি ঠিক রাখতে সে নিজেকে সামলায়।বলে,
—তো,এখানে কি?গাড়িতে উঠে আসো।আমি পৌছে দিচ্ছি।
কুহু থমকে দাড়ায়।কথাটার ভেতর কি জোর ছিলো!কেমন অধিকারবোধ ছিলো।ভাইয়েরা কি বোনদের উপর এভাবেই অধিকার ফলায়?কি জানি?
কুহু আর দেরি করেনা।ফটাফট গাড়িতে উঠে বসে।অন্যসময় হলে সে কক্ষনো উঠতো না,কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন।
আবিরের সামনে থেকে সে সড়তে চায়।
নয়তো আবিরের এমন আকুল কথায় গলে যাবে যে!
গাড়ি চলে যেতেই আবিরের চোয়াল শক্ত হয়।কুহুকে অন্য ছেলের সাথে দেখে তার চোখ লাল বর্ন ধারন করে।
গটগট পায়ে বাড়ির পথে হাটে সে।
রুমে ঢুকে ইচ্ছে মতো ভাঙচুর করে।
নিজের মনকে শান্ত করে ধপ করে বিছানায় বসে।
বিরবির করে বলে,
—ভালবাসায় এতো কষ্ট কেনো?
চলবে…..