কুহুকথা,পর্বঃ১২
নুশরাত_জেরিন
সকাল সকাল কুহুর মেজাজ গরম হয়ে আছে।যেনতেন গরম না পুরো ফুটন্ত টগবগে গরম।পাশের বাসার আন্টি ভোর হতে না হতে এ বাড়ি এসে হাজির।তার কথার মুল হলো সে পরশু আবিরকে দেখেছে।শপিংমলের সামনে একটা মেয়ের সাথে ডলাডলি করছিলো।গাল ভরা হাসিও ছিলো তার।
মাঝে মাঝে নাকি মেয়েটার গায়েও হাত দিচ্ছিলো।
কুহু মোটেও বিশ্বাস করেনি এসব।
কেনো বিশ্বাস করবে?সে কি আবিরকে চেনে না?যদিও আবির সম্মন্ধে খুব কম ধারনা আছে কুহুর।তারপরও যতটুকু চিনেছে ততটুকুতেই জানে,আবির মোটেও ওরকম ছেলে না।সে ভালো,খুবই ভালো।
তাছাড়া আন্টির যে বাড়িয়ে কথা বলার অভ্যাস আছে সেটা কুহু ভালোভাবেই জানে।
তারপরও তার রাগ হচ্ছে। মনে হচ্ছে আন্টি টার সামনে গিয়ে তার চুলের গাছি ধরে ইচ্ছে মতো টানতে।গাল টেনে ইয়া বড় করে দিতে।
এমন ভয়ংকর ভাবনা ভাবতেই কুহু চমকে উঠলো।সে এমন ভাবনাও ভাবতে পারে?কেনো আন্টির ওপর এতো রাগলো সে?আবিরকে বাজে বলেছে তাই?কিন্তু এতে কুহুর কি যায় আসে?আবির কি তার কিছু হয়?সে তো এই মাস দুয়েক কোন খোঁজই নেয়নি কুহুর।সেদিন ওভাবে বলার পর আবির কি রেগে গেছে তার ওপর?কিন্তু কুহু কি ই বা খারাপ কিছু বলেছিলো?সত্যিই তো,ভালবাসা কি জোর করে হয়?
আবির কি তবে সময় দিচ্ছে? কুহুর মনে তার জন্য ভালবাসার চারা গজানোর সময়?
কুহু আবারও চমকালো।চারা কি সত্যিই গজায়নি?এই যে আবিরের মুখ ফিরিয়ে রাখা,তাকে আর না দেখতে পাওয়া।এতে কি কুহুর খারাপ লাগছে না?সে তো প্রতিনিয়ত জ্বলছে।
আবিরকে একনজর দেখার জন্য চোখ আকুল হয়ে থাকে।হৃদয় বারবার সুর তোলে, মনে হয় একঝলক যদি তাকে দেখতে পেতাম।
তবে কি একেই ভালবাসা বলে?কুহু জানেনা।সে কখনোই ভালবাসার সংজ্ঞা বুঝতে পারেনা।
কিন্তু এই অনুভূতি? এটাই কি ভালবাসা?
সে ভাবনা চিন্তা ফেলে ঝটপট তৈরী হতে লাগলো।আজ টিউশনি আছে।সামনের মাস থেকে ছাত্রীর পরিক্ষা।
হঠাৎ বিছানায় চোখ পরতেই কুহুর কপাল কুঁচকে এলো।
ডায়েরী?পিহুর ডায়েরী!
নিশ্চয় আজ সে কিছু চাইবে।বিরক্তি মুখে ডায়েরী হাতে তুলে নিলো সে।কাগজের পাতা উল্টাতে ইচ্ছে করছে না।দামী কোন জিনিসের কথা লিখেছে বোধহয়।
কুহুর হাতে এখন কোন টাকা নেই।পিহু চাইলেও সে কিছুই দিতে পারবেনা।
টাকা না থাকলে কি করে দেবে? সে তোআর চুরি ডাকাতি করতে পারেনা!
ডায়েরীর পাতা উল্টাতেই কুহু স্তব্ধ হয়ে বসে পরলো।
ডায়েরির মাঝে কানের দুল রাখা।কি সুন্দর দেখতে!
ছোট্ট সর্নের ফুল বসানো।
তবে সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে এটা কুহু দেখেছিলো।কিছুদিন আগেই পিহুর সাথে বাজার করতে গিয়ে দোকানে দেখেছিলো।কুহু কখনোই এতো মনোযোগ দিয়ে কোন জিনিস দেখেনা।
তবে কেন যেনো দুলটা খুব পছন্দ হয়েছিলো তার।তবে পরক্ষনেই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো।সংসারের প্রয়োজন মেটাতে গেলে নিজের শখ জলান্ঞ্জলী দিতেই হয়।
কিন্তু এই দুল এখানে কেনো?
কুহু চোখ বড় করে ডায়েরিতে নজর বুলালো।
একটা চিঠি আছে লেখা।
দেখলেই বোঝা যায় পিহুর হাতের লেখা।
কুহু পড়তে শুরু করলো,
কুহু,
তোকে প্রিয় বলে সম্মোধন করলাম না।কেননা কোনকালেই তুই আমার প্রিয় ছিলি না।
তোকে বাবা মা বরাবরই আমার চেয়ে বেশি ভালবাসতো।আমার হিংসে হতো খুব।পরের মেয়েকে নিয়ে এতো আদিক্ষেতা কেনো?আমি তো তাদের নিজের মেয়ে বল?তবুও তোকে কেনো বেশি ভালবাসবে?বেশি ভালবাসা প্রাপ্য তো আমার।
তবে আজ বুঝতে পারছি,সত্যিই আমি না,তুই বেশি ভালবাসা পাবার যোগ্য।
আচ্ছা, তুই এতো ভালো কেনো বলতে পারিস?যে তোর খারাপ চায় তুই তার ও কেনো ভালো করতে চাস?আমার ইদানীং তোকে আবারও হিংসে করতে ইচ্ছে হয়।
আমি কেনো তোর মতো ভালো হতে পারলাম না?কেনো তোকে নিজের বোনের মতো ভালবাসলাম না?ভেতরে ভেতরে কি যে আত্মগ্লানিতে ভুগছি!
যেই আমি সারাজীবন তোর খারাপ চেয়েছি সেই তুই কিনা আমার সংসার গুছিয়ে দিচ্ছিস?
রায়হান সাহেবকে বলে তুই রাশেদকে চাকরী পাইয়ে দিয়েছিস?ওকে সঠিক পথে এনেছিস?
জানিস ও একটা বাড়ি কিনেছে।আমার পছন্দসই আসবাব কিনেছে।আমাকে বলেছে,তাড়াতাড়ি ওর বাসায় চলে যেতে, নিজের সংসার নিজের হাতে তুলে নিতে।
আমার কি যে আনন্দ হচ্ছে!
তুই এতো কেনো করলি আমার জন্য?এতো ঋন আমি কিভাবে শোধ দেবো?
কোনদিন তোর কোন ইচ্ছে অনিচ্ছা জানতে চাইনি,ভেবেছি তোর হয়তো এসব নেই ই।
আজ খুব ইচ্ছে করছে তোকে কিছু দিতে।কিন্তু আমার সামর্থই বা কতটুকু?তবুও চেষ্টা করলাম।
দুলটা পছন্দ হয়েছে তো?ভাব না এটা তোর বোনের দেওয়া প্রথম উপহার!
ইতি,
তোর বাজে বোন।
কুহু কেঁদে উঠলো।তার কান্না পাচ্ছে খুব।
এতো কান্না পাচ্ছে কেনো কে জানে?
পিহু তাকে বোন বলেছে সেইজন্যে?নাকি অন্যকোন কারনে?
,
—তোমার ইদানীং কি হয়েছে বলোতো?
আবির এইমাত্র অফিস সেড়ে বাড়ি ফিরেছে। ড্রয়িং রুমে সোফায় গা এলিয়ে দিতেই দাদুর প্রশ্নে সোজা হয়ে বসলো।আজিজ হোসেন ততক্ষণে পাশে এসে বসেছেন।আবিরের উত্তর না পেয়ে আবার বললেন,
—কোন সমস্যা হয়েছে?
—না তো!
—তবে শরীরের এই অবস্থা কেনো?চোখের নিচে কালির ছাপ?
আবির আমতাআমতা করলো।সে কিকরে বলবে কুহুকে না দেখতে পেয়ে তার এই হাল।মেয়েটা নিজের মুখে ভালবাসার কথা বলবে বলেই তো এতো কষ্ট সহ্য করছে আবির।কিন্তু কবে হবে সেই অপেক্ষার অবসান?অদৌও হবে কি?কুহু আসবে তো?
আজিজ হোসেন বলে ওঠেন,
—উত্তর দিলেনা?
আবির হকচকিয়ে উঠলো,
—না মানে,অফিসে কাজের চাপ খুব।
—তাহলে কাজ কমাও একটু।নিজেদেরই তো কোম্পানি। শরীরের দিকেও নজর দাও।এতো পরিশ্রম করলে হয় নাকি?
আবির মাথা নিচু করলো।সে কাজের মাধ্যমে নিজেকে ব্যাস্ত রাখে।নয়তো বেহায়া মন কুহুকে দেখার জন্য উতলা হয়ে পরে যে।
হঠাৎ পাশে এসে দাড়ালো রুনা বেগম।তার হাতে কফির মগ।
একটা মগ আজিজ হোসেনের দিকে এগিয়ে দিয়ে আরেকটা আবিরের হাতে তুলে দিলো।
একটু সময় নিয়ে বলে উঠলো,
—আব্বা?
আজিজ হোসেন বিরক্ত হলেন।চোখমুখ কুঁচকে বললেন,
—যা বলার বলে ফেলো।
—কুহুর বিষয়ে কথা বলবো।
—কেনো?তার বিষয়ে কেনো?সেকি তোমায় জালাচ্ছে?চলে গেছে তো,তবুও তার পিছু লেগেছো কেনো বউমা?
রুনা বেগম মুখ ফুলালেন।খুব করে চেষ্টা করলেন চোখে পানি আনার।কিন্তু শয়তান পানির দেখাও মিললো না।
তিনি হতাশ হলেন খুব।
তবুও মুখটা কাঁদো কাঁদো করে বললেন,
—আপনি আমায় এতোটা বাজে ভাবেন আব্বা? আমি কুহুর পিছে লাগবো কোন দুঃখে?সে কি আমার শত্রু?আমার ছেলের বউ সে!
আজিজ হোসেন চোখ বড় করে তাকালেন।আবিরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—তোমার মায়ের আজ হয়েছে টা কি আবির?কুহুকে ছেলের বউ বলছে যে?
আবির হাসলো।
—মা কুহুকে আরও অনেকদিন আগে থেকেই মেনে নিয়েছে দাদু।
—তাই নাকি?
আবির আবার হাসলো।দুষ্টুমী মাখা কন্ঠে বললো,
—আমার মা কিন্তু ওতোটাও খারাপ নয় দাদু,তুমি শুধুশুধুই তার সাথে ঝগড়া করো।
রুনা বেগম খুশিতে বাক-বাকুম হয়ে আবিরের গাল টেনে দিলেন।আজ জিবনের প্রথম তার ছেলে দাদুর কাছে তার হয়ে কথা বলেছে।
আজিজ হোসেন হেসে উঠলেন।উচ্চ স্বরের হাসি।
তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।
চলবে…..