স্বয়ম্বরা (৩য় পর্ব)

0
796

স্বয়ম্বরা (৩য় পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি


ইশতিয়াক চৌধুরী? নামটা শোনা শোনা লাগছে। কিন্তু কোথায় শুনেছি? মনে করতে পারছি না। ছেলেটা এখন কিচেনে। কফিমগগুলো সিঙ্কে রেখে আসতে বেশি সময় লাগার কথা না। কাজ শেষে বেরিয়ে আসবার জন্য অপেক্ষা করব? অবশ্য এখান থেকে একটু গলা উঁচু করে জিজ্ঞেস করা যায়। করব? না ওখানে গিয়ে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেব?
যেমন প্রফেশনালিজম দেখাচ্ছে, আর কোন ক্লু দেবে বলে তো মনে হচ্ছে না। স্টিল, জিজ্ঞেস করতে সমস্যা কি? কি হবে, বড়জোর সেই কিলিং স্মাইল দেবে। নট অ্যা ব্যাড ডিল।
কিচেন থেকে এখনও বেরোয়নি। দুটো মগ রাখতে এতোক্ষণ লাগে? কিছুটা পানির আওয়াজ পাচ্ছি মনে হল। ব্যাটা কি মগগুলো ধুচ্ছে নাকি? আরে তাই তো, এই বাড়ীর সব কাজ করে কে? বুয়া টুয়া টাইপ কাউকে এখনও দেখিনি। হয়তো ছুটা বুয়া, সকাল সকাল আসে। ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে। নিজস্ব লোক না হলে, ওর মাধ্যমে পালানোর একটা ট্রাই নেয়া যাবে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, ওখানে গিয়েই কথাটা বলব। কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজার কাছে পৌঁছে যা দেখলাম, তার জন্য সত্যিই তৈরি ছিলাম না। রীতিমত অ্যাপ্রন আর মাথায় ক্যাপ পড়ে আলুর ছিলকা ছিলছে। যদিও বলেছিল, চিকেন, আলু ভর্তা আর কি যেন আছে রাতের খাবারে, বাট এভাবে, একেবারে রাঁধুনী স্টাইলে কাজটা নিজেই করবে, এক্সপেক্ট করিনি। বেশ পেশাদার কিডন্যাপার মনে হচ্ছে। কিডন্যাপ করার পরে, কিডন্যাপড পারসনের জন্য বাকী যা যা করণীয়, সব কিছু কি তাহলে নিজেই করে? সেফটি? বেশ মজার তো? তার মানে বেশ ভালোরকম ট্রেনিং নিয়েই এই প্রফেশানে এসেছে। কিডন্যাপিংকে বেশ এক্সাইটিং প্রফেশান মনে হচ্ছে। কেমন রোমাঞ্চ ফিল করলাম। এগিয়ে গিয়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ালাম। ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি নিয়ে জানতে চাইলাম
— রান্নাও পারেন?
— জ্বী।
এবার পুরো রান্নাঘরটা দেখলাম। ভেতরটা বেশ সুন্দর ক্যাবিনেট করা। এক পাশে সিঙ্ক। সেটার ওপর একটু আগে খাওয়া কফির মগ দুটো উল্টো করে রাখা। তারমানে ধোয়াধুয়ির কাজ উনি নিজেই করছেন। একপাশে ডাবল বার্নারের একটা চুলা। সেটার ওপর দুটো প্যান রাখা। একপাশে রাইস কুকার। কিচেনের কোথাও একফোঁটা ময়লা নেই। বেশ পছন্দ হল রান্নাঘরটা। এই ব্যাটার নিজ হাতে সাজানো? ভ্রু কুচকে গেল।

বার্নার দুটোই বন্ধ। রান্না সম্ভবতঃ সব হয়ে গেছে। এখন আলুভর্তা করছে। ভর্তার চেহারাটা দেখে লোভই হচ্ছিল। আইটেমগুলো সবই আমার ফেভারেট। ‘প্ল্যানড’? চিন্তাটা একবার মাথায় এসেই মিলিয়ে গেল। সম্ভাবনা কম। কোইনসিডেন্সই হবে। আমার উঁকিঝুকি দেয়াটা বোধহয় লক্ষ্য করেছিল। ওর দিকে চোখ তুলে তাকাতেই দেখলাম আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই স্পেশাল স্মাইলটা দিল। কেন যেন বলে ফেললাম
— বেশ সুন্দর।
— আর মিনিট দুয়েক।
— হেল্প লাগবে?
আলুভর্তায় ফিনিশিং টাচ দিচ্ছিল। সেটা করতে করতে ঘাড় কাত করে আমার দিকে তাকাল। উত্তরে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছুই বলল না। আমার কথা শুনতেই পায়নি এমন ভাব করে কেবল বলল
— আপনি টেবিলে গিয়ে বসুন। আমি এক্ষুণি নিয়ে আসছি।
ছুতমার্গ আছে নাকি? রান্নাঘরে ঢুকতে দেবে না? জানা খুব জরুরী না। শ্রাগ করে ডাইনিং টেবিলে ফিরে গেলাম। রান্নার ঘ্রাণটা এখনও নাকে লেগে আছে। বেশ ক্ষিধেও পেয়েছে।
দুহাতে দুটো ডিশ নিয়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে ছেলেটা। এগিয়ে এসে টেবিলের ওপর রাখল। আমি এদিক ওদিক তাকালাম। ছেলেটা বোধহয় বুঝল আমি কি খুঁজছি। আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল থালাগুলো কোথায় আছে। দুটো থালা নিলাম। থালাগুলো যথাস্থানে রাখতে রাখতে জানতে চাইলাম
— আপনিও খাবেন তো?
আমার গলার আওয়াজে কিংবা ব্যাবহার কিছু একটা বোধহয় ছিল, ছেলেটা দেখলাম ভ্রু কুচকে ফেলল। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে জানতে চাইলাম
— এনিথিং রং?
আবার সেই স্মাইল। তবে মাথা দুদিকে নেড়ে না সুচক ইঙ্গিতটা করল। এরমানে নাথিং রং হলেও আসলে বলতে চাইছে, ‘রংটা বলব না। এনিওয়ে, ডিশ দুটো রেখে বাকী ডিশ আনতে গেল। সময় লাগল না। কিছুক্ষণ পরেই ফিরে এল। টেবিলে সব সাজিয়ে নিজে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। আমি এখনও কিছু নিচ্ছি না দেখেই হয়তো ফর্মালি অফারটা করল
— শুরু করুন।
মেনে নিলাম। শুধু রিকোয়েস্টটা না, উনার আতিথেয়তাও। নিজের পাতে ভাত তুলতে তুলতে নিজেই তাই ব্যাখ্যা দিলাম
— ভেবে দেখলাম, আপনি এখনও পর্যন্ত যেহেতু কোন মিসবিহেভ করেননি, আমি যতটা সম্ভব আপনার সাথে কোঅপারেট করব।
ছেলেটা আমার দিকে এক নজর তাকাল। কিছু বলল না। খাবার সময় কথা বলে না? আমিও আর কিছু বললাম না। ভাতটা বেশ ঝরঝরে হয়েছে। চিকেনটাও দেখতে টেস্টি মনে হচ্ছে। উনার অফারের জন্য এবার আর অপেক্ষা করলাম না। নিজেই বেড়ে নিলাম। মুখেও দিলাম। ওয়াও। ডেলিশাশ। ব্যাটা তো দারুণ রাঁধে।
অবশ্য ব্যাটার রান্না এই মুহুর্তে আমার কনসার্ন না। আপাততঃ জানা দরকার, হু ইজ মিস্টার ইশতিয়াক। আর সম্ভব হলে সেই ব্যাটার প্ল্যানটা কি? র‍্যানসম? না অন্য কিছু।
ছেলেটার দিকে আবার তাকালাম। একমনে খেয়ে যাচ্ছে। কথাটা কি এখনই জানতে চাইব? অস্থির লাগছে। বলেই ফেললাম
— আপনার এথিকসে আর কি কি আছে?
ছেলেটা এবার অবাক চোখে আমার দিকে তাকাল। বোঝার চেষ্টা করল, কি বলতে চাইছি। ওর প্রশ্ন ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে এবার খুলে বললাম
— এই মিস্টার ইশতিয়াক চৌধুরীকে আমি চিনতে পারছি না। একটু ডিটেলস দেয়া যাবে? আই মিন আপনার প্রফেশনাল এথিকসে এই তথ্যটা দেয়া কি বারণ?
ছেলেটা মুখের খাওয়াটা শেষ করল। এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
— না। বারণ না। দেয়া যাবে।
ছেলেটা আবার খাওয়ায় মনযোগ দিল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। ভেবেছিলাম বাকী উত্তরটা দেবে। দিল না। রেগে উঠতে যাচ্ছিলাম, নিজেকে সংযত করলাম। স্বর যথাসম্ভব মোলায়েম করে জিজ্ঞেস করলাম
— তা কখন দেয়া যাবে?
ছেলেটা এবার আর চোখ তুলে তাকাল না। খেতে খেতেই উত্তর দিল
— খাওয়াটা শেষ করুন।
এরপরে চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বাকী কথাটা শেষ করল
— তারপরে ডিটেইলসে বলি?
ছেলেটার দিকে তাকালাম। কিছুটা রাগ হচ্ছিল, তবে এটাও মনে হল, হি মিনস ইট। ও বলবে। তাই আর তর্ক করলাম না। মনে আরেকটা ব্যাপার তখন অস্বস্তি তৈরি করছিল। এবার সেই কথাটা বললাম
— একজন মেয়ে হিসেবে আমি কি আপনার কাছে কিছু ডিসেন্সি এক্সপেক্ট করতে পারি?
— কোন ইনডিসেন্সি কি করেছি?
— সেটাই জানতে চাইছি।
— একটু ক্লিয়ার করবেন?
— আমাকে অজ্ঞান করার সময় কি আমার গায়ে হাত দিয়েছিলেন?
ছেলেটা এবার আমার দিকে তাকাল। কিছুটা অপরাধবোধ আর কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে উত্তর দিল
— উপায় ছিল না। সরি ফর দ্যাট।
এরপরে আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে বাকী কথাটা বলল
— তবে গায়ে হাত দেয়া বলতে আপনি যা মিন করছেন, নাথিং লাইক দ্যাট। আর আপনি যদি কো অপারেট করেন, ইট ওন্ট হ্যাপেন এগেইন।
স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। এরপরে বললাম
— আর মানে? আবারও অজ্ঞান করবেন নাকি?
— আশা করছি লাগবে না।
কথাটায় কিছু একটা ইঙ্গিত আছে, তবে এই মুহুর্তে বিস্তারিত জানতে মন চাইছে না। বরং জরুরী আরেকটা ব্যাপারে ফয়সালা করা দরকার। বললাম
— আমার বাবা হার্টের পেশেন্ট। আমি বাড়ি ফিরছি না দেখে, হি মে রিয়াক্ট। উনাকে একটা ফোন করতে পারি? কল ট্রেস করা এড়াতে আপনি চাইলে যে কোন প্রিকশান নিতে পারেন। ভিওআইপি কিংবা অন্য কিছু ইউজ করতে পারেন।
ছেলেটা স্মিত হাসল। এরপরে বলল
— ডোন্ট ওরি। আই হ্যাভ অলরেডি ডান দ্যাট।
খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। হতবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেছি। ‘অলরেডি ডান দ্যাট’ মানে কি? রাগের চোটে মুখে কথা আসছে না। কেবল ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। ছেলেটা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। এরপরে বলল
— ভয়েস সিন্থেসাইজারের নাম শুনেছেন?
অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলাম ছেলেটার দিকে। এবার ছেলেটা ব্যাখ্যা দিল
— এটা একটা ডিভাইস। এটাতে যা বলা হয়, তা অন্য কারো ভয়েসে কনভার্ট করে দেয়। মানে যদি যার ভয়েসে কনভার্ট করতে চান, তার স্যাম্পল ভয়েস থাকে।
ব্যাপারটা বোধহয় এবার বুঝতে পারছি। বাট আমার ভয়েসের স্যাম্পল পেল কোথায়? আমার চেহারায় বোধহয় প্রশ্নটা লেখা ছিল। ছেলেটা এবার উত্তরটা দিল। চোখের দৃষ্টিতে সাপের চাহনি
— হঠাৎ করে আপনাকে কিডন্যাপ করা হয়নি। মাস খানেক আপনাকে ফলো করা হয়েছে, আপনার ডিটেলস কালেক্ট করা হয়েছে, ভয়েস স্যাম্পলও নেয়া হয়েছে।
আমি তখনও অবাক হয়ে তাকিয়েছিলাম ছেলেটার দিকে। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে ছেলেটা ইশারায় আমাকে বসতে বলল। এরপরে বলল
— আর কোন প্রশ্ন?
ধীর ধীরে চেয়ারে বসলাম। বুঝতে পারলাম, বেশ প্রফেশনাল আর রুথলেস একটা গ্রুপ। হোমওয়ার্ক করেই কাজে নেমেছে। রুমের পোষাক থেকে সব কিছু কেন এমন হাই কোয়ালিটির, ব্যাপারটা এবার স্পস্ট হল। হতবাক অবস্থাটা নিজের অজান্তেই অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসল। স্বাভাবিকভাবে খেতে খেতেই এবার জানতে চাইলাম
— ইশতিয়াক চৌধুরীটা কে?
আমার দিকে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ছেলেটা এবার উত্তর দিল
— ভদ্রলোক আপনার পাণিপ্রার্থী। হি ওয়ান্টস টু ম্যারি ইউ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here