স্বয়ম্বরা (১১তম পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি
১১
এরপরে, আমার কিডন্যাপ সাগাতে, বেশ নাটকীয় একটা মোড় এল। হ্যান্ডসাম বাবাজী জানাল, সে আমাকে মুক্তি দিচ্ছে। আমি সবকিছু বুঝে যাওয়ার পরে, আই মিন, আসিফ যে ভাড়াটে কিডন্যাপার না, সে ই যে ইশতিয়াক, এটা জেনে যাওয়ার পরে, এছাড়া তার হাতে আর কোন অপশানও ছিল না। গর্দান যাওয়ার যেসব ফাঁকা বুলি দিচ্ছিল, সেসব যে ও কার্যকরী করতে পারবে না, সেটা আমি বুঝে গেছি। আর তাই, এখান থেকে কাজী অফিস, সেখানে বিয়ে সেরে কমিউনিটি সেন্টার, এসব নাটকীয় প্ল্যান সে চাইলেও একজিকিউট করতে পারছে না। তাই, আমার ‘হোয়াট’স নেক্সট’ এর উত্তরে পরাজিত সৈনিকের মত উত্তর দিল
–আগামীকাল, আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি।
ঠোঁটের কোণে বিজয়ীর একটা হাসি নিজের অজান্তেই চলে আসল। অবশ্য আরও একটা ব্যাপার ঘটল। এই ব্যাটাকে ভয়ংকর কোন শাস্তি দেয়ার যে প্ল্যান কষছিলাম, সেটায় উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম। আমাকে কিডন্যাপ করে কাজটা খারাপ করেছে, নো ডাউট, তারপরও, কেন যেন মনের ভেতর প্রতিহিংসার ফিলিংটা আর টের পাচ্ছি না। বরং ছেলেটার সঙ্গ খানিকটা এঞ্জয় করতে শুরু করেছি। ঠিক করলাম, আজকের দিনটা ওর সাথে গল্প করে কাটাব।
বিকেলে লিভিং রুমে বসে একটা গল্পের বইয়ে চোখ বুলাচ্ছি, এমন সময় আসিফ অর ইশতিয়াক, যে নামেই ডাকি, লিভিং রুমে আসল। সঙ্গে ওর ল্যাপটপ। আমার সামনের একটা সোফায় বসল। প্রথমে ভেবেছিলাম, আমার সাথে গল্প করতে এসেছে, কিন্তু কিছুক্ষণের ভেতরেই বুঝলাম, ব্যাপারটা তা না। বসেই যথারীতি ল্যাপটপে মনোযোগ দিল। কিছুটা আত্মসম্মানে লাগল। সামনে আমার মত একজন সুন্দরী বসে আছে অথচ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। হাও ডেয়ার হি!
কিছু বললাম না। ভেবেছিলাম কিছুক্ষণ পরে একবার তাকাবে। ‘হাই’ না বলুক অ্যাটলিস্ট সোশ্যাল টাইপ একটা স্মাইল দেবে। কিছুই করল না। রাজ্যের মনোযোগ দিয়ে ল্যাপটপে কাজ করে যাচ্ছে।
মিনিট পনের কাটল। আমার নজর বইয়ের দিকে থাকলেও বই পড়ছি না। অপেক্ষা করছি কখন কথা বলে। মাঝে মাঝেই ওর দিকে তাকাচ্ছি। নাহ। বেশ অনেকটা সময়ই অপেক্ষা করা হয়েছে। এতো অবজ্ঞা সহ্য করা যায় না। যখন দেখলাম হাফ অ্যান আওয়ার পরেও আমার দিকে ফিরে তাকাল না, তখন মেজাজ গরম হতে শুরু করল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, রাগ দেখানোর মানেই হচ্ছে, বুঝিয়ে দেয়া যে আমি ইনসাল্টেড ফিল করছি। সেটা করা যাবে না। যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত করে তাই স্বাভাবিক আলাপ শুরুর চেষ্টা করলাম।
— আচ্ছা, আপনারা ছেলেরা এতো গাধা কেন?
এল প্যাটার্নে সাজানো সোফায় বসে আছে। সো ঘাড়টা একটু বাম দিকে ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। এরপরে সেই কিলার স্মাইল সহযোগে জানতে চাইল
— কি গাধামি করল ছেলেরা?
কথাটা বলে আবার ল্যাপটপের দিকে নজর ফেরাল। মেজাজ খারাপ হলেও সামলে নিলাম। শান্তভাবেই বললাম
–এই যেমন আপনি। ভেবেছিলেন আমাকে কিডন্যাপ করার পরেও আমার মনে আপনার জন্য প্রেম জাগবে। এটা গাধামি না?
প্রশ্নের উত্তর দিতেই হোক আর রিফ্লেক্স বশেই হোক এবার আমার দিকে তাকাল। দৃষ্টিটা দেখে মনে হচ্ছে দূরে কোথাও দেখছে। আমার দিকে তাকিয়ে আছে বটে কিন্তু মনে হচ্ছে না আমাকে দেখছে। ও আসলে অন্য কিছু ভাবছে। সম্ভবতঃ নিজের কাজ নিয়ে। তবে উত্তর দিল। কেমন যন্ত্রচালিতের মত বলল
— পৃথিবীতে মন বলে কি কিছু আছে?
বেশ অবাক হলাম। ব্যাটা বলে কি? দার্শনিক ফার্সনিক নাকি? নাহ, তা কি করে হয়? এই ব্যাটার তো একটা গার্ল ফ্রেন্ডও ছিল। মেয়েটা মরার পরে এই অবস্থা? না যন্ত্র নিয়ে কাজ করতে করতে মানুষকেও যন্ত্র ভাবতে শুরু করেছে? ওর প্রশ্নটা ক্লিয়ার হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম
— মানে?
ওএবার ভালোভাবে চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। এরপরে ছাত্র পড়ানোর ভঙ্গিতে বোঝাতে শুরু করল
— মানে হচ্ছে, মন বলতে আমরা যা বুঝি, তা তো আসলে ব্রেন। আমাদের চিন্তা, ভাবনা, ডিসিশান, ইভেন প্রেম ভালোবাসা, সব ডাটার অরিজিন তো আসলে ব্রেন।
হারামজাদা ইচ্ছে করেই আমাকে রাগাচ্ছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করলাম। আমি মরছি আমার যন্ত্রণায় আর এই ব্যাটা আছে মন আর ব্রেনের পার্থক্য নিয়ে। অন্য সময় হলে কি করতাম জানি না, তবে এই মুহূর্তে এমন উদ্ভট আলোচনায় যাওয়ার মুড ছিল না। যে ম্যাসেজটা ওকে দেয়ার ইচ্ছে ছিল, সেটা সরাসরিই জানালাম। বললাম
–ব্রেন, হার্ট, মন, হোটেভার, সেটা তো এভাবে, আই মিন একটা মেয়েকে কিডন্যাপ করে…
কথাটা আমাকে শেষ করতে দিল না। আমার কথার মাঝেই বলতে শুরু করল
— এভাবে কোন মেয়ের মন পাওয়া যায় না, এই তো?
বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। ব্যাটা তো সবই বোঝে। তারপরও কেন এমন গাধামি করছে? এনিওয়ে, আসল উত্তর পাব বলে মনে হচ্ছে না। তারপরও কথা চালিয়ে গেলাম। ওর কথার উত্তরে কেবল ছোট্ট করে বললাম
— হ্যাঁ।
আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মাইক্রোচিপের কারণে আমার চিন্তা তো বুঝতেই পেরে গেছে। ‘জোর করে যদি আমাকে বিয়ে করে, সুযোগ পেলেই এই ব্যাটাকে আমি খুন করব’। হয়তো সেজন্যই আমাকে এই বন্দী দশা থেকে ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু এমন কম্পিউটার জিনিয়াস, এতোটা গাধা হবে, মানতে পারছি না। জোর করে একটা মেয়েকে পাওয়ার চেষ্টা যে গ্রেট গাধামি, এ ব্যাপারটা না বোঝার মত ইডিয়ট এই ব্যাটাকে আমার মনে হয়নি। কেন যেন মনে হচ্ছে, ঘটনা অন্য কিছু। ধরতে পারছি না।
ইশতিয়াকের দিকে তাকালাম। ও আবার ল্যাপটপে ব্যস্ত। আমারও আর কথা বলার মুড ছিল না। উঠতে যাব এমন সময় ও আবার শুরু করল
— দেখুন, ব্রেন ব্যাপারটা আসলে কি? কিছু সিগন্যাল, কিছু ডাটা ট্রান্সমিশান, কিছু স্টোরেজ। আর একটা সিস্টেম সেটা অপারেট করছে…
অন্য কোন পরিস্থিতি হলে হয়তো এসব আলাপ মনোযোগ দিয়ে শুনতাম, কিন্তু এখন কথাগুলো শোনার মত অবস্থা নেই। ওর কথার শুরুতে একটা সোশ্যাল স্মাইল ঠোঁটে ঝুলিয়ে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বাট যখন দেখলাম ও পুরো টিচিং মোডে, তখন আর পারলাম না। ওকে থামিয়ে বলেছিলাম
–খুব সাইন্স ফিকশান মুভি দেখেন, না?
থট রিড তো করতেই পারছে। আর না পারলেও আমার কথা শুনে যে কেউ বুঝবে, এসব শোনার ইচ্ছে আমার নাই। তারপরও আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। এরপরে হেসে উত্তর দিল
— আর আপনার খুব অপছন্দ, না?
আমিও হেসে ফেললাম। অনেস্ট স্মাইল। তারপরে আর কথাবার্তা হল না। বইটা হাতে নিয়ে আমার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজায় পৌঁছে একবার পেছন ফিরে তাকালাম। ইশতিয়াক ব্যস্ত নিজের ল্যাপটপে। একটু অবাক লাগছিল। কি এমন কাজ যে আমার দিকে এক নজর তাকাবার সময়ও পাচ্ছে না। কথাটা নিয়ে ভাবতে না চাইলেও, মনের কোণে থেকে গেল। রাতে খাবার টেবিলে তাই জিজ্ঞেস করে ফেললাম
–ল্যাপটপে কি করছেন সারাক্ষণ?
খুব ছোট্ট করে উত্তরটা দিল
— একটা লকারের সিকিউরিটি ভাঙ্গার চেষ্টা করছি
ও, এই ব্যাপার। মিথ্যে বলব না, ওর এসব হ্যাকিং ফ্যাকিং এর গল্প শুনতে একটু এক্সাইটিং তো লাগছিলই। সেই ছোট বয়সে পড়া থ্রিলার স্টোরির পার্ট মনে হচ্ছিল নিজেকে। অনলাইন রবারি? লকারের কোড ভাঙবার চেষ্টা লাইভ দেখতে পাচ্ছি শুনে কেমন রোমাঞ্চ ফিল করলাম। বেশ উৎসাহ নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম
— পারলেন?
চিন্তিত মুখে আমার দিকে তাকাল। মুখে খাবার। আমিও উৎসাহী চোখে তাকিয়ে আছি আসিফের দিকে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে খাবারটা পেটে চালান করল। এরপরে উত্তরটা দিল
–নাহ। যা ভেবেছিলাম তার চেয়েও বেশি সিকিওরড।
–কি আছে লকারে?
–বিশ্বের সবচেয়ে দামী সম্পদ
–কি সেটা?
আবার সেই কিলার স্মাইল দিল। অর্থাৎ উত্তর দেবে না।
তারপরও চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। বললাম
— কে বানিয়েছে সিস্টেমটা?
কোন উত্তর না দিয়ে একবার শুধু হাসি হাসি মুখে তাকাল। আবার ল্যাপটপে চোখ। আবার চেষ্টা করলাম
— চেনেন উনাকে?
এবার উত্তর আসল
— দেখিনি কখনও। তবে শুনেছি ওয়ার্ল্ডের বেস্ট সিকিউরিটি সিস্টেম ডিজাইনার
–ওয়াও। আপনার চেয়েও জিনিয়াস? কি নাম ভদ্রলোকের?
উত্তরে ইশতিয়াক আর কিছু বলল না। ভ্রু কুঁচকে শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে থাকল। বেশ রাগ হলেও আর কথা বাড়ালাম না। আসলে বাড়াবার সুযোগ পাইনি। একটা ফোন আসে। জানি না সত্যি ফোন না নিজের থট অ্যাক্টিভেটেড ফোন ইউজ করে নিজেই নিজেকে করেছে। তবে কথা আমার সামনেই বলল
–জ্বি…। না, সব আগের প্ল্যানেই হচ্ছে।
কথাটা শুনে রীতিমত চমকে গেলাম। ভেবেছিলাম, দ্যা গেম ইজ ওভার। ধরা পড়ার কারণে ইশতিয়াক ওর প্ল্যান বাতিল করেছে। যেহেতু ওপাশের কথা শুনতে পাচ্ছি না, তাই বুঝতে পারছি না ওর প্রফেশনাল লাইফের কোন প্ল্যান কি না, আমাকে নিয়ে করা ওর প্ল্যানের কথা বলছে। কেন যেন মনে হল আমার ব্যাপারেই কথা হচ্ছে। কি যে হল, চিৎকার করে জানান দিলাম
— নেভার। কক্ষনো না।
আসিফও হাত দিয়ে মাইক্রোফোন ঢাকে। এরপরে আমাকে উদ্দেশ্য শুধু বলল
— প্লিজ।
এরপরে ফোনে অপর পক্ষের কথা শুনল। তারপরে উত্তর দিল
— আমি জানি হাতে সময় নেই। আই অ্যাম ট্রাইয়িং মাই বেস্ট টু মেক ইট ফাস্ট। আপনার তরফ থেকে একটু চেষ্টা করুন।… ইয়েস। আই গেস তিন তারিখে, দুপুর বারোটার ভেতরেই।… ইয়েস। ঠিক সময়ে আমরা আপনার ওখানে পৌঁছে যাব।
এবার আমি সিওর, কথা আমাকে নিয়েই হচ্ছে। ইশতিয়াক লাইন ডিস্কানেক্ট করে আমার দিকে তাকাল। আমিও তখন জানতে চাই
–আমরা মানে? আর তিন তারিখ দুপুর বারোটা মানে কি?
উত্তরে কিছু বলল না। শুধু একটা স্মাইল দিল। যে সফটনেস ওর জন্য তৈরি হয়েছিল এক লহমায় সেটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। যত বড় জিনিয়াসই হোক, এই হারামজাদাকে আমি ছাড়ব না। দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিস করে শুধু বললাম
— মানে আপনার প্ল্যান থেকে আপনি সরে আসেননি?
— নো। আমাদের বিয়ে হচ্ছে। আর তিন তারিখেই হচ্ছে।
নিজের মুখ দেখতে পাচ্ছি না, তবে আমার ধারণা, রাগে তখন আমার চোখ দিয়ে আগুন বেরোচ্ছিল। কোন রকমে শুধু বললাম
— নো। এবিয়ে হবে না।
খুব শান্ত চেহারা নিয়ে আমার চোখে চোখ রেখে ইমতিয়াজ শুধু বলল
–হবে।
–জোর করবেন?
মাথা দুদিকে নেড়ে বোঝাল ‘না’। এরপরে বেশ শান্তস্বরেই উত্তরটা দিল। চোখে কোন অনুশোচনা নেই, কোন অপরাধবোধ নেই। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর ভয়ংকরতম জীব। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে তখন নেমে যাচ্ছে ঠাণ্ডা এক স্রোত। কানে তখন বাজছে ওর উত্তরটা
— বিয়ে আপনার কনসেন্টেই হবে। আপনি হাসিমুখেই বিয়ের পিঁড়িতে বসবেন।
চলবে