প্রবঞ্চনা,পর্ব_১
লেখা- জান্নাতুল নাঈমা
৬ মাসের উঁচু পেট নিয়ে বদ্ধ ঘরের বাইরে বসে আছে শিরিন৷ বদ্ধ দরজায় মাথা ঠেকিয়ে দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে হাতের পিঠে কামড়াচ্ছে সে। এতোটাই তীব্র কামড় যে চামড়া খসে রক্তপাতও হচ্ছে। কিন্তু এ রক্তপাত তার বক্ষস্থলের রক্তপাতের চেয়ে কম বৈকি বেশি হতে পারেনি। দু’চোখের ভারী বর্ষণও তার বক্ষের ক্ষত কতোখানি নিশ্চিত করতে পারবে না। এ পৃথিবী এবং এ পৃথিবীর মানুষ গুলো সম্পর্কে শিরিনের ধারণা খুবই স্বল্প। এই স্বল্প ধারণা তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াবে কখনো ভাবতেও পারেনি। বদ্ধ ঘরের ভিতর থেকে দু’জন নরনারীর উন্মাদীয় কন্ঠস্বর ভেসে আসছে। একজোড়া মানব-মানবীর উত্তপ্ত নিঃশ্বাসের বিস্ফোরিত শব্দগুলো শোনা যাচ্ছে তীব্রভাবে। পুরুষ লোকটি শিরিনের স্বামী দুর্জয়, আর নারী লোকটি দুর্জয়ের শয্যাসঙ্গিনী।
_______________
৬ মাসের অন্তঃসত্ত্বা শিরিনের বয়স মাত্র ষোল বছর। দুর্জয়ের সঙ্গে তার বৈবাহিক সম্পর্কের সূচনা ঘটে ৯ বছর বয়সে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবার পাঁচ কন্যার সর্বকনিষ্ঠ কন্যা শিরিন। শিরিনের বাবা সংসার কিভাবে পরিচালনা করবে, বড়োজনদের বিবাহ কিভাবে দেবে,তিনবেলা এতোগুলো পেটে ভাত জোগানোতেই তার সমস্ত চিন্তা, সমস্ত সময় ব্যয় হয়ে যেতো৷ ছোট কন্যাটির ওপর বাবা,মায়ের নজর একবারে ছিলো না বললেই চলে। সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় ছুটোছুটি করে বেড়াতো মেয়েটি। ভাগ্যক্রমে উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে দুর্জয়ের চোখে পড়ে যায় সে৷ ভালোবাসা নাকি অন্য কিছু ছিলো দুর্জয়ের চোখে তা কেবল রহস্যই বটে। ১৯ বছর বয়সী ছেলেটি বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায় ৯ বছরের শিরিনকে বিয়ে করার জন্য। ঊনবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে দুর্জয়ের এমন প্রস্তাব আহামরি সমস্যার সৃষ্টি করেনি। তবে প্রশ্ন ছিলো এটুকুন মেয়ে’কে বিয়ে করে কোন কার্যটি সিদ্ধি হবে তার? এমন ধারার প্রশ্নে দুর্জয় কেবল একটিই উত্তর দিয়েছিলো – “ভালোবাসাবাসিতে কার্য কেবল একটাই পাশের মানুষটিকে ভালো রাখা। ”
সত্যি বলতে শিরিনের প্রতি দুর্জয়ের অনুভূতি ভালোবাসা বিহীন অন্য কিছু হতে পারে তা ভাবতেও দুঃস্বপ্নের মতো লাগতো সবার। পরিবারের অজস্র অবহেলা যে মেয়েটির সর্বাঙ্গে লেপ্টে থাকতো সে মেয়েটিকে বিয়ে করে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ করে রেখেছিলো দুর্জয়। হাফপ্যান্ট পড়ুয়া নয় বছরের মেয়েটিকে যখন বক্ষে চেপে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকতো দুর্জয়। ঘুমের ঘোরে বিছানা ভিজিয়ে দিতো শিরিন। মাঝরাতে দুর্জয় যখন টের পেতো তার বউ তার গা এবং বিছানা ভিজিয়ে প্রস্রাব করেছে অট্রস্বরে হাসতে থাকতো সে। শিরিন তখন অত্যন্ত লজ্জিত ভঙ্গিতে কেঁদে ফেলতো। ধীরে ধীরে বিছানা ভিজানোর অভ্যাস দূর করলো দুর্জয়। রোজ সকালে বিছানার চাদর পরিষ্কার করা,তোষক শোকানো নিয়ে
আগের মতোন ভাবিরাও আর তাদের দেখে ঠোঁট টিপে হাসতো না। প্রতিবেশীরাও টিটকারিজনিত কথাবার্তা বলতো না৷
আই.এ পাশ করার পর আর পড়াশোনা করেনি দুর্জয়। বাবা ভাইয়ের সঙ্গে পারিবারিক ব্যবসায় যোগদান করে। শিরিনকে ভর্তি করিয়ে দেয় স্কুলে। হাফপ্যান্ট পড়ুয়া শিরিন সেলোয়ার-কামিজ পড়ে স্কুলে যেতে শুরু করে। রোজ বিকালে পাড়ার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলতে যাওয়াও ধীরে ধীরে কমিয়ে দেয়। বুঝতে শেখে সে এখন কারো ঘরের বউ। যে সে আচরণ এখন তাকে মানায় না। সময় বহমান, বহমান মানুষের জীবনের গতিও। এই নীতির বিরুদ্ধে দুর্জয় বা শিরিন কারো জীবনই যেতে পারেনি। নয় পেরিয়ে তেরোতে পদার্পণ করে শিরিন। ঊনিশ পেরিয়ে তেইশে পদার্পণ করে দুর্জয়। আদর, স্নেহে মাখামাখি অবস্থা জীবনে আকস্মিকভাবেই প্রেমের আবির্ভাব ঘটে। নিত্য নতুন অনুভূতিতে মাতাল হয়ে যায় দুর্জয়। চোখের সামনেই সতেজ কলিটি যেনো ধীরে ধীরে ফুটতে থাকে। একই ঘর একই মানুষ একই বুকে লেপ্টে থাকে কিন্তু অনুভূতি গুলো হয়ে যায় বড্ড অচেনা। হবে নাই বা কেন? দেহ,মন যেখানে একে অপরের পরিপূরক সেখানে তাদের শারিরীক পরিবর্তনই কি তাদের মনের পরিবর্তন ঘটানোর একমাত্র কারণ নয়? জীবনের একটি মুখ্য বিষয় হচ্ছে পরিবর্তন। দুর্জয় শিরিনের জীবনে সবচেয়ে বড়ো পরিবর্তন ঘটেছিলো সেদিন যেদিন মাঝরাতে বন্ধু মহল থেকে মদ্যপান করে ঘরে ফিরেছিলো দুর্জয়। নেশার ঘোরে পরম সোহাগে স্বামীর অধিকার আদায় করেছিলো শিরিনের থেকে। সে প্রথম মাতোয়ারা প্রণয়ে আবদ্ধ হয় তারা৷ সেদিনের পর থেকে প্রতিটা রাত ছিলো অন্যরকম এক মাদকতায় ঘেরা। মাস খানেক পর যখন অপ্রত্যাশিত ভাবে গর্ভবতী হয় শিরিন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায় দুর্জয়। সব ঠিকি থাকে শুধু বাবা হওয়ার প্রতি কোন আগ্রহ থাকে না তার। তাই জোর পূর্বক মেডিসিন খাওয়িয়ে বাচ্চা নষ্ট করে দেয়। প্রথম প্রথম স্বামীর ভালোবাসায় বিভোর থেকে সবটা মেনে নেয় শিরিন। চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে দুর্জয়কে। কিন্তু একটা সময় এসে তার নিজেরও বাচ্চার প্রতি লোভ আসে। মন প্রাণে চায় তার গর্ভের সন্তান এ পৃথিবীতে আসুক। দুর্জয়কে তার মনের কথা জানালে সে তাকে নানারকম ভাবে বোঝায়। বয়স,পড়াশোনা ইত্যাদি নানা বাহানায় বাচ্চা নেওয়া থেকে বিরত রাখে৷ কিন্তু ছোট্ট, নিষ্পাপ মা মন’কে অতো সহজে ভোলানো সম্ভব হয়নি। সব বাঁধা পেরিয়ে আবারো গর্ভবতী হয় সে। দুর্জয়’কে এ খবর জানানোর ঠিক তিনদিনের মাথায় বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। পরপর সাতটা বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পর হুঁশ ফেরে শিরিনের। বাপের বাড়ি গিয়ে মা বোনের সহায়তায় জানতে পারে দুর্জয় তাকে ভিটামিনের ওষুধ বলে বাচ্চা নষ্ট হওয়ার ওষুধ খাওয়িয়েছে। যার ফলে পরপর এভাবে তার বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অবুঝ মন তবুও বুঝতে পারেনি সামনে তার জন্য ঠিক কি অপেক্ষা করছে। বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি আসার তিনমাসের মাথায় আবারো গর্ভে অষ্টম সন্তান ধারণ করে শিরিন৷ এবারে আর বোকমি করে না। যেদিন জানতে পারে মহান আল্লাহর কৃপায় আবারো তার গর্ভে একটি ছোট্ট প্রাণ এসেছে সেদিনই বাপের বাড়ি চলে যায় । দুদিন যেতে না যেতেই দুর্জয় তাকে নিতে যায় সে আসতে না চাইলেও জোর পূর্বক নিয়ে আসা হয় তাকে। তখনো দুর্জয় জানেনা শিরিন সন্তান সম্ভবা। গভীর রাতে দুর্জয় যখন শিরিনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হওয়ার চেষ্টা করে ছলে বলে কৌশলে নিজেকে রক্ষা করে শিরিন। পরপর দুদিন এভাবে যাওয়ার পর ব্যবসার কাজে শহরে যেতে হয় দুর্জয়কে। দু’মাস পর শহর থেকে ফেরার পর সে জানতে পারে শিরিন চারমাসের অন্তঃসত্তা। দু বাড়ির সকলেই এ খবরে ভীষণ খুশি। দুর্জয় ইচ্ছে সত্ত্বেও এবারে বাচ্চাটিকে আর ত্যাগ করতে পারেনি। কিন্তু গভীর রাতে নিজ চাহিদা না মিটিয়েও থাকতে পারেনি। শিরিনকে দিয়ে যখন তার শারীরিক চাহিদা মিটতো না তখন সে বদ্ধ উন্মাদ হয়ে বাইরে ছুটে যেতো। এসব বিষয়ে একেবারেই অবগত ছিলো না শিরিন। সেদিন পাঁচ মাসের পেট নিয়ে সংসারের কাজ সামলে ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দেওয়া মাত্রই হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে দুর্জয়। আচমকাই শিরিনের দু’পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে। ভয়ে জর্জরিত শিরিন শোয়া থেকে বসে দুর্জয়কে প্রশ্ন করে,
– কি হয়েছে তোমার কাঁদছো কেন?
দু’হাত জোর করে দুর্জয় বলে,
– আমি আর থাকতে পারছিনা শিরিন তুমি আমাকে বাঁচাও।
হতভম্ব শিরিন দুর্জয়ের কপোলদ্বয় হস্তদ্বয় দ্বারা আবদ্ধ করে নেয়। বলে,
– কি হয়েছে তোমার এমন করছো কেন?
অস্থিরচিত্তে দুর্জয় তার কামনা বাসনার কথা ব্যক্ত করে। ঘৃণায় জর্জরিত হয়ে ছিটকে সরে যায় শিরিন। কম্পিত কন্ঠে বলে,
– এসব তুমি কি বলছো পাগল হয়ে গেছো?
শিরিনের দু’পা আঁকড়ে ধরে মিনতির সুরে দুর্জয় বললো,
– আমাদের সন্তানের দোহাই শিরিন তুমি রাজি হও৷
স্তব্ধ হয়ে স্বামীর মুখপানে তাকিয়ে রয় শিরিন। এ পৃথিবীতে কি সেই প্রথম নারী? যার স্বামী পরনারী’র শরীর দ্বারা নিজের শরীরের খায়েশ মেটানোর জন্য তার কাছে আকুতি মিনতি করছে? এ পৃথিবীতে কি তার স্বামীই প্রথম পুরুষ? যে কিনা নিজের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী’র কাছে অনুমতি চাইছে পরনারী’কে নিজের শয্যাসঙ্গিনী করার জন্য। এ পৃথিবীতে তার সন্তানই কি প্রথম সন্তান যার বাবা তার মা’কে সন্তানের দোহাই দিচ্ছে পরনারীর সঙ্গে রাত্রি যাপনে অনুমতি দেওয়ার জন্য!
চলবে…