আবার_দেখা_হবে,পর্বঃ২

0
1969

আবার_দেখা_হবে,পর্বঃ২
জাহান আরা

বলেই মেয়েটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো,আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না,জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলাম।

জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমি ফ্লোরে শুয়ে আছি, রাফিদ বিছানায়,এখন রাত কয়টা?
আমি বিছানায় এলাম কিভাবে?
আর ওই মেয়েটা?
কি যেনো নাম,লীলাবতী,ও কোথায়?

হঠাৎ করেই আমার বুকের ভিতর অজানা ভয়ে কেঁপে উঠলো,ছাদে দেখা ওই মেয়ে স্বাভাবিক কোনো মেয়ে ছিলো না,তারমানে আমি যাকে দেখেছি সে অশরীরী কেউ,হঠাৎ করে তীব্র ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে,আমি চিৎকার করে উঠি।

আমার চিৎকারে রাফিদ ঘুম থেকে উঠে যায়,লাইট অন করে আমার কাছে আসে,আমাকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে।

আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে,দাঁতে দাঁত আটকে গেছে,কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে,গোঙাচ্ছি শুধু।

রাফিদ কি করবে বুঝতে পারছে না,আয়াতুল কুরসি পড়ে আমাকে ফুঁ দিচ্ছিলো,ছুটে গিয়ে রান্নাঘর থেকে সরিষার তেল এনে হাতে পায়ে মালিশ করতেছিলো।

এক সময় রাফিদের গায়ে আমি ঢলে পড়লাম।
আমার চোখে মুখে পানির ছিটা দিলো,আবার চোখ খুলে তাকালাম আমি।

রাফিদঃ কি হয়েছে তোমার?

আমিঃ আমি ছাদে কাউকে দেখেছিলাম,মেয়েটা বাতাসে মিলিয়ে গেছে,আমাকে পদ্মা কে দেখিয়েছে,পদ্মা ওর ক্লাসের অনিকের সাথে পালিয়ে গেছে।

রাফিদঃ কি যা তা বলছো,তুমি কিভাবে পদ্মা কে দেখবা,আর ছাদে তো কেউ ছিলো না আমি যখন তোমাকে আনতে গিয়েছিলাম আমি গিয়ে তো দেখি তুমি সেন্সলেস হয়ে আছো।

আমিঃ বিশ্বাস করেন আপনি,আমি মিথ্যা বলছি না।সত্যি একজন ছিলো,আপনার বিশ্বাস না হলে আপনি অনিক ভাইয়াদের বড়িতে খবর নিয়ে দেখেন,জানতে পারবেন,পদ্মার বিয়ের শাড়ি কি রঙের আমি তাও দেখেছি,ওই মেয়েটা আমাকে দেখিয়েছে, পদ্মার পরনে নীল শাড়ি ছিলো,অনিক ভাইয়া পরেছিলো স্যুট,আমি সত্যি বলছি বিশ্বাস করেন।

রাফিদঃ আমি দেখছি বিষয় টা,আর হ্যাঁ তুমি,কিভাবে রাজী হলে বিয়ে করতে,i think you know that how much i dislike you.আমি পদ্মাকে ভালোবাসি তোমাকে না পরী,কেনো আমার জীবন এভাবে নষ্ট করে দিলে তুমি?

আমিঃ আমি রাজী হই নি,কিন্তু আপনার বাবা আর আমার বাবা আমাকে অনুরোধ করাতে আমি পারি নি তাদের ফিরিয়ে দিতে,আপনি আমাকে পছন্দ করেন না সেটা আমি খুব ভালো করে জানি।

রাফিদঃ তোমাকে আমি জীবনেও মেনে নিবো না পরী,তোমাকে আমি সারাজীবন ঘৃণা করবো।

আমিঃ আমার কি দোষ ছিলো,পদ্মা আপনাকে ভালোবাসে না,তাতে আমার কি অপরাধ?

রাফিদ আচমকা আমার গালে কষে এক চড় বসালো,আমি বিমূঢ় হয়ে রইলাম তার দিকে তাকিয়ে

রাফিদঃ পদ্মা আমাকে ভালোবাসে,সেটা আমি জানি,আর আমার কাছে প্রমাণ ও আছে,দাঁড়াও দেখাচ্ছি

রাফিদ ফোন বের করে পদ্মার সাথে মেসেঞ্জারে চ্যাটিং দেখাতে লাগলো আমাকে।

আসলেই তো পদ্মা ওনাকে ভালোবাসে তাহলে অনিকের সাথে পালিয়ে যাওয়া,মিলাতে পারছি না আমি কিছুতে।।

আমিঃ বিশ্বাস করেন পদ্মা অনিক ভাইয়ার সাথে পালিয়ে গেছে,আপনি চাইলে আসতে পারেন আমার সাথে অনিক ভাইয়ার বাড়িতে,তাহলেই বুঝবেন।

রাফিদঃ ঠিক আছে দিনে দেখা যাবে,এখন ঘুমাও,ভোর হতে চলেছে।

আমিঃ আমার খুব ভয় লাগছে,প্লিজ আপনি রুমে থাকেন।

রাফিদঃ গো টু হেল

বলেই রুম থেকে চলে গেলো।
আমি একা বসে রইলাম,কিছুক্ষণ পরেই আজান দিলো,নামাজ পড়ে বের হলাম রুম থেকে,টানা বারান্দায় দাড়াতেই দেখি রাফিদ আসছে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে,আমার মনটা ভালো হয়ে গেলো এটা দেখে,আমি একজন নামাজি মানুষ চেয়েছি সব সময়।

রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিলাম।

নিচে নামতেই দেখি রান্নাঘরে ব্যস্ততা বাড়ছে,আমার শাশুড়ী মা আমাকে দেখেই বুকে টেনে নিলো।

মাঃ জানিস পরী,বাড়ি এসে যখন শুনেছি পদ্মা না আমার ছেলের বৌ তুই কি যে খুশি হয়েছি আমি।তুই হয়তো জানতি না তোকে আমি কতোটা পছন্দ করতাম আল্লাহ আমার ইচ্ছে পূর্ণ করেছে মা।আজ আমার সব ইচ্ছে পূর্ণ। আয় আমি তোকে নিজে খাইয়ে দিচ্ছি।আর শুন আমার মেয়ে নেই তুই আমাকে কিন্তু মা বলে ডাকবি,আম্মা বল্লে আমি রাগ করবো।

মা আমাকে টেনে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন।

কাকে যেনো নাশতা আনতে বলে নিজে আলমারি খুললেন,এক জোড়া বালা এনে আমাকে পড়িয়ে দিলেন।
আরেকটি বক্স থেকে একটা হার বের করে আমার গলায় পড়িয়ে দিয়ে বল্লেন,এই হার সব সময় বাড়ির বড় বৌয়ের অধিকার। আমি ছিলাম বড় বৌ সেই সূত্রে আমি পেয়েছি,তুই আমার বড় ছেলের বৌ তাই তুই এটার অধিকারী। এটা শুধু হার না,এটা চন্দ্রহার।এর অনেক গুণ।এই হার কখনো হারাবি না মা,এতে তোর অমঙ্গল হবে,কখনো,কোনো অবস্থায় এটা গলা থেকে খুলবি না।

একটু পরে একজন নাশতা নিয়ে রুমে এলো

মা আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিতে লাগলেন।

রাফিদ মা কে ডাকতে ডাকতে রুমে এলো,এসেই দেখে মা আমাকে খাইয়ে দিচ্ছে,মুখ কালো করে বের হয়ে গেলো ও।

আমিঃ মা আমি আর খাবো না,উনি হয়তো কি বলতে এসেছে,আমি যাই,ওনাকে ডাকুন আপনি।

মাঃ চুপ করে বসে থাক,নিজেই আসবে আবার দরকার হলে,তুই কেনো যাবি না খেয়ে।

খাওয়া দাওয়া করে আমি পুরো বাড়ি দেখতে বের হলাম,এতো বড় বাড়ি,সেই পুরোনো আমলের স্ট্রাকচার,ডিজাইন,কি সুন্দর।
রাজবাড়ী পুরো। কতো ঘর,কতো অলিগলি।
অনেকগুলো ঘর তালা দেওয়া।
জমিদারদের আমলে হয়তো এসব খুলতে হতো।
দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম।
অনেক ঘরের জানালা ভাঙা, ভিতর দেখা যায়।

দেখতে দেখতে একটা জানালার সামনে এসে দাড়ালাম,ভিতরে তাকাতেই আমার বুকের ভিতর কেঁপে উঠলো।
দেয়ালে একটা মেয়ের ছবি, যেই মেয়েকে আমি কাল রাতে ছাদে দেখেছিলাম।
কি আজব,এই মেয়ের ছবি এখানে কেনো।
দরজায় তালা লাগানো, কিন্তু আমি হাত দিতেই দরজা খুলে গেলো।
কিন্তু কেনো জানি আমি মোটেও ভয় পাচ্ছিলাম না এতে।
ভিতরে ঢুকলাম।
একটা বিশাল রুম,দেয়াল জুড়ে অনেক ছবি,তারমাঝে সেই মেয়ের ছবি,নিচে লিখা,”লীলাবতী “।
পুরো রুমে অনেক জিনিস রয়েছে।তবলা,তানপুরা,হারমোনিয়াম,অনেকগুলো ঘুঙুর।
পাশের আলমারির দরজা টান দিতেই দেখি খুলে গেলো দরজা, ভিতরে অনেকগুলো কাপড়। কি আজব,মনে হচ্ছে যেনো এই মাত্র কেউ ধুয়ে শুকিয়ে ভাঁজ করে রেখে গেছে।
কিন্ত কিভাবে সম্ভব।

বাহিরে অনেক মানুষের কথা শুনা যাচ্ছে,নিশ্চয় আমাদের বাড়ি থেকে মেহমান এসেছে, তাড়াতাড়ি ওই ঘর থেকে বের হয়ে আসতে নিলাম।
দরজা টান দিতেই আমি অবাক,দরজা কিছুতেই খুলছে না,অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করে পারছি না খুলতে,তাড়াতাড়ি আমার ফোন বের করলাম,রাফিদ কে কল দিতে যাবো কিন্তু একি,ফোনে কোনো নেটওয়ার্ক নাই।
এটা কিভাবে সম্ভব, কিছুই বুঝতেছি না।
পুরো ঘরে চোখ বুলালাম।
হটাৎ করেই কেনো যেনো লীলাবতীর ছবিটি আমার কাছে জীবন্ত মনে হতে লাগলো, আমার মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করলো।
পুরো ঘর যেনো ঘুরছে,আমি দেখতে লাগলাম আমি নৃত্য করছি,পায়ে ঘুঙুর পরে,আলতা পায়ে।আমি হয়ে গেছি লীলাবতী।
কি যেনো ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম আমি,আমি বুঝতেছি আমার ডান হাত কেউ ধারালো ছুরি বা ব্লেড দিয়ে কাটতেছে,তবু আমি নৃত্য করে যাচ্ছি।

তারপর আর কিছু মনে নেই।

চোখ খুলতেই দেখি আমি বেডরুমে। রাফিদ আর বাবা সোফায় বসে আছে, মা খাটের উপর,আমার ডান হাত ব্যথা করতেছে,তাকাতেই দেখি অসংখ্য কাটার দাগ পুরো হাতে।

মা আমাকে চোখ মেলতে দেখেই জড়িয়ে ধরলেন। বার বার বলতে লাগলেন কেনো তুই এভাবে হাত কাটলি,এতো রক্ত ঝরালি কেনো মা,তোর কিছু হয়ে গেলে আমাদের কি হতো, তোর বাবা মাকে কি জবাব দিতাম??
তোর এই অবস্থা দেখে তোকে আজকে তোদের বাড়িতে ও যেতে দিতে পারি নি,তোর মা কে বলেছি তোকে আরো কয়েকদিন পরে দিবো,তোকে আমার যেতে দিতে ইচ্ছে করে না।
আজ যদি তোর মা এসব দেখতো আমাকে কি ভাবতো??
উনি ভাবতো আমি ওনার মেয়ের খেয়াল রাখতে পারি নি,মা রে যা হবার তা হয়ে গেছে,আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে,তোর ভাগ্য ছিলো আমার ছেলের বৌ হবি,এখন ওসব না ভেবে সব মানিয়ে নে,আমার ছেলেকে আমি বুঝিয়েছি মা,তুই পাগলামি করিস না,আর রাফিদ যদি কোনো খারাপ ব্যবহার করে তুই আমাকে বলবি ওকে আমি শাসন করবো,তবু তুই নিজের ক্ষতি করিস না।

আমি বুঝতে পারলাম ওনারা ভেবেছে আমি নিজেই নিজের হাত কেটেছি।

বাবাঃ ওদের জন্য খাবার পাঠিয়ে দাও,রেস্ট নিক এখন ও,খেয়ে নিবে পরে।

মা বাবা রুম থেকে বের হয়ে গেলেন,কিছুক্ষণ পরেই একজন খাবার রেখে গেলো।

রাফিদ কিছু না বলে সোফায় শুয়ে রইলো,আমার ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে,সকালে নাশতা করেছি,আর কিছুই খাই নি,তার উপর সারাদিন মনে হচ্ছিলো যেনো আমি নৃত্য করে গেছি,হাত থেকে অনেক রক্ত ও গেছে,খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছিলো নিজেকে।

বিছানায় উঠে বসলাম,ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি রাত সাড়ে নয়টা,তারমানে সেই সকালের পর থেকে আমি সেন্সলেস,বাম হাতে প্লেট নিয়ে ডান হাতে খেতে যাবো কিন্তু হাতের ব্যথায় পারছি না,চোখ দিয়ে পানি পড়ছে অনবরত।

রাফিদ আমার দিকে তাকিয়ে আছে,কিছু বলছে না।

না পেরে আমি প্লেট রেখে দিলাম।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রাফিদ উঠে এলো,প্লেট হাতে নিয়ে আমার পাশে বসে খাওয়া শুরু করলো।
ওকে খেতে দেখে আমার ক্ষিধে আরো বেড়ে গেছে।

আজ যদি আমার জায়গায় পদ্মা হতো রাফিদ কি এরকম করতো?
মানুষ এতো নিষ্ঠুর ও হয়?

নিশ্চয় সে তখন পদ্মা কে খাইয়ে দিতো,আমার পোড়াকপালে সেই সুখ বিধাতা লিখে নাই,কোনোমতে এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে গেলাম।

রাফিদ নিজের খাওয়া শেষ করে আমাকে বললো,উঠো এখান থেকে।

আমিঃ কেনো?
আমাকে কি আজও ছাদে রেখে আসবেন?

রাফিদঃ উঠতে বলছি উঠো।

আমি উঠে দাড়ালাম বিছানা থেকে।
রাফিদ একটা বালিশ আর চাদর আমাকে দিয়ে বললো,ফ্লোরে শুয়ে পড়ো,ভেবো না মা বলেছে বলেই আমি তোমাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবো,i always hate you.

আমি কিছু বল্লাম না,২ চোখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো।
ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম।
আমার ঠান্ডা সহ্য হয় না কখনো,রাতে গলা ব্যথা শুরু হয়ে যায়,কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পারি আমার জ্বর আসছে।
ঠান্ডায়,তার উপর হাতের ব্যথায় জ্বর এসে গেছে আমার।

কাউকে কিছু বলতে পারলাম না।
রাতে প্রলাপ বকতে লাগলাম।
আমি বার বার দেখতেছি,কোথাও আমি নৃত্য করে যাচ্ছি অনবরত। নাচের তালে তালে কি কি যেনো বলে যাচ্ছি জানি না।আমি যেনো আমি না,আমি লীলাবতী হয়ে গেছি।
উন্মাদিনীর মতো প্রলয় নৃত্য করে যাচ্ছি।এই প্রলয়ের যেনো শেষ নেই

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here