হিমির_বিয়ে(৪র্থ পর্ব)

0
1229

হিমির_বিয়ে(৪র্থ পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda

বাবার পছন্দের ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করাতে মায়ের অমত কেন আমি ঠিক বুঝলাম না। যখনই সব কিছু ছেড়ে দিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালাম তখনই মা বিরোধিতা শুরু করলো। এখন আমি কই যাবো। সব কিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ করেই বাবা চলে আসলেন। এসে বললেন…

– বাবা রায়ান, একটা ভুল তো করে ফেলছি।

– কি ভুল বাবা?

– তোর মামা বাড়ির তো কাউকে জানালাম না তোর ব্যাপারে।

– মামা বাড়ি দিয়ে কি হবে? মা অমত আমি না পারছি মায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করতে, না পারছি আপনার বিরুদ্ধে কিছু করতে।

– তোর মায়ের মত লাগবে না। তুই তো আমার ছেলে। বাড়ির হর্তাকর্তা পুরুষেরাই। সো আমি যেটা বলবো সেটাই হবে। বুঝিস না তোর মা কথাশুনার ভয়ে নারাজ।

– মায়ের এই অমতে আমি কি করতে পারি। তারচেয়ে বরং একটা কিছু খেয়ে আমিই মরে যাই।

– থাপ্পড় চিনিস বেয়াদব?

– এটাই তো পারবেন শুধু বকা দিতে, রাগ দেখাতে। কারো কিছু হলে তো আপনার কিছু না।

– কাল অনেক কাজ পড়ে আছে। এখন বেশি কথা বলিস না। আমাকে একটু রেস্ট নিতে দে। আর হ্যা চিন্তা করিস না তোর মা রাজি হয়ে যাবে।

– উহু আমার কোনো চিন্তা নাই। আপনি জন্ম দিয়েছেন তাই আপনার উপরেই সব। কারো কথা আপনার চিন্তা করতে হবে না। আপনি আপনারটা নিয়েই থাকেন। আমাদের কোনো কিছুর উপরে রাইট নাই।

বাবা আমার সামনে থেকে চলে গেলেন বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছি আমি। কোন দিকে যাব বুঝতে পারছিনা। প্রথমত মা এই বিয়েতে অমত তাই কথা বলতে পারছিনা।

আমি সবকিছু ভেবে দুই বছরের ভালোবাসাকে ভুলে যেতে চলছি মায়ের সম্মানের কারণেই। কারণ এতদিন আমি ডিভোর্সিদের ঘৃণা করে এসেছি এবং বিভিন্ন ধরনের কথা শুনিয়ে এসেছি। যেটা শুনেয়েছি আমার মায়ের সামনেই। জানতাম না আমার মাও ছিলেন একজন ডিভোর্সি। আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে ডিভোর্সিরাও মানুষ। তাদেরও আলাদা একটা জীবন আছে। আমি সবসময় আমার নিজের স্বার্থই দেখেছি। তানহাকে পাওয়ার জন্য কত রকমের কথা বলে এসেছি। সেই তানহাকেই আমার ভুলে যেতে হচ্ছে। ভুলে যেতে হচ্ছে বললে ভুল হবে, আমি তানহাকে কখনো ভুলে যেতে পারব না। ভালোবাসাকে চাইলেই কখনো ভুলে যাওয়া যায়না। আমাকে বাধ্য করেছে ভুলে যাওয়ার জন্য। ভুলে যাওয়ার অভিনয় করা যায় কিন্তু ভুলে যাওয়া অতটা সহজ নয়। সম্পর্কের সেই শুরু থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভালোবাসার মানুষটি তার হৃদয়ে গেঁথে থাকে। চাইলেই মুছে ফেলা যায় না। কিন্তু আমি কিভাবে তানহাকে আমার জীবন থেকে মুছে ফেলি? আমার ভালোবাসাকে অসম্মান করে বাবার কথায় মত দিয়ে অন্য আরেকটি মেয়েকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। কারণ এছাড়া যে আমার আর কোনো উপায় নেই। আমি যে বাবার সন্তান আমি কিভাবে বাবা-মায়ের কথা ফেলবো? যতই চেষ্টা করি না কেন আমার ভালোবাসার মানুষটিকে কাছে পেতে ততোই ব্যর্থ হই। কোনভাবেই মানিয়ে উঠতে পারছি না। এটা আমার ব্যর্থতা। ভালোবাসায় হয়তো আমি কমতি রেখেছি যে কারণেই তানহাকে হারাতে হচ্ছে।

সকালবেলা মেয়ে দেখতে যাবো। আগামীকালকেই বিয়ে। আমি বাবাকে বলেছি আর দেরি না করতে। কিন্তু আমার জীবন তো ধ্বংসের পথে। আমি কিভাবে অন্য আরেকটি মেয়েকে কষ্ট দিয়ে নতুন করে সংসার সাজাবো? রাতের পর রাত দিনের পর দিন কষ্টের বোঝা বইয়ে যেতে হবে ।

তানহাকে যদি একটা বার আমার কাছে পাই তখন আমি তানহাকে কষে একটা থাপ্পর দিব। হঠাৎ করে কেন আমার জীবন থেকে সরে গেল? তানহা কোথায় আছে কি করছে কিছুই জানি না। কেন আমাকে জানাচ্ছে না? তাহাকে ভুলে যেতে হবে মানে কোনদিন আমার করে নিতে পারবো না।

গতকাল রাগ করে আমার মোবাইল ফোনটা পানিতে ফেলে দিয়েছি। নাম্বার তো আমার হৃদয়ে গেঁথে রয়েছে। পারবোনা হয়ত তানহাকে ভুলে যেতে। আমাকে ফোন দিয়ে পাবে না আমার আর কোন নাম্বার নেই,আমার পরিবারের কারো নাম্বারও জানা নেই।

কথার ফোনটা হাতে নিয়ে আমি তানহার নাম্বারে ফোন দিলাম। কিন্তু ফলাফল শূন্য। তানহার ফোনটা যে বন্ধ ওকে যে কোনভাবেই পাচ্ছিনা।

ভাবতে ভাবতে রাতটা যে কখন পার হয়ে গেল আমি বুঝতেই পারলাম না। একটা সেকেন্ডের জন্য আমি ঘুমাতে পারিনি। আমার চোখে একটুও ঘুম ছিলনা। বাসার মধ্যে আর বাসার বাইরে হাটতে হাটতে সময় পার হয়ে গেছে। সিগারেট ফুকতে ফুকতে এখন আর সিগারেট টানতে পারছি না। গলায় কাশি বেধে গেছে।

আচ্ছা আমার মরণ হয় না কেন? পৃথিবীতে তো অনেকে কোন না কোনভাবে মরে যায়। বিধাতা কি আমাকে চোখে দেখেনা? আমাকে কি নিয়ে যেতে পারে না? আমি এই কষ্ট চেপে নিয়ে কিভাবে থাকবো? আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার ভিতরটা পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।

ভেবেছিলাম তানহা আমার লাইফ পার্টনার হবে। আমরা বিয়ে করবো সংসার করবো কত কিছুই না ভেবে রেখেছিলাম। আমাদের সংসারে সন্তান আসবে। কিন্তু সবকিছু ধুলোর সাথে মিশে যাচ্ছে। এটাই কি নিয়তির খেলা? জন্মের সময় কি আমি এটাই চেয়েছিলাম বিধাতার কাছে।

ঘড়ির কাঁটা দ্রুত গতিতে চলছে। খুব দ্রুত সময় পাড় হচ্ছে। সকাল হয়ে দশটা বেজে গেল বুঝতেই পারলাম না। খাবার খাওয়ার পরে বাবা আমাকে রেডি হতে বললেন। তানহাকে কল দিয়ে আর অপেক্ষা করতে করতে আমি আর রেডি হলাম না। পরবর্তীতে বাবার ধমকের পরে রেডি হয়েছি। যখন আমি আর বাবা সেই মেয়ের বাসার উদ্দেশ্যে বের হবো তখন আমার মা আবারো তার কাছে ডাকলেন। আমি মায়ের দিকে হেঁটে গেলাম….

– রায়হান তোর বাবার কথা মত তুইও তো দেখছি বিয়ে করতে চলে যাচ্ছিস। একটা বারও কি তুই আমার কথা ভাবলিনা? তোকে আমি কি বলেছিলাম? তোর কাছে কি তোর মায়ের কোন মূল্য নাই?

– মা তোমার ধারনা ভুল।ওই মেয়েকে বিয়ে করলে আমি ভালো থাকব। আর ভাবছো সেই মেয়ে অনেক কথা শুনবে, কিন্তু আমি এমনভাবে রাখবো যে ওই মেয়েটি কথা শোনার কোন সময় পাবে না। ওকে বিয়ে করে বাবার মত অনেক দূরে চলে যাবো। লোক চক্ষুর আড়ালে চলে যাব।

– ঠিক আছে যা ভালো বুঝো সেটাই কর। আমার এখন ভাবতেই অবাক লাগছে। আমি আমার পেটের দশ মাস দশ দিন গর্ভে রেখেছিলাম এই ছেলেকে? রাখতে পারলি না আমার কথা। তোর বাবার কথা অনুযায়ী তুই বিয়ে করতে চলে যাচ্ছিস।

– হ্যাঁ আমি বিয়ে করতে চলে যাচ্ছি। এতদিন ডিভোর্সি মেয়েদের নিয়ে অনেক কথা বলেছি অনেক অপমান করেছি। আমার চোখে যেন ডিভোর্সি মেয়েরা কেন জানো শত্রু ছিলো। ওদের আমি ঘৃণার চোখে দেখতাম। কিন্তু আমি যে জানতাম না আমি এতদিন যাদের ঘৃণার চোখে দেখে এসেছি তাদের দলে যে আমার মাও ছিলেন একজন। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বাবার পছন্দের ওই মেয়েকেই বিয়ে করবো। আমি পিছনের সব কিছু ভুলে গেছি। আমার জীবনে যে তানহা নামের একটি মেয়ে ছিল তাকে ভুলে গেছি। আমার সব কিছু ভুলে গিয়ে সাম্নের দিকে যেতে হবে। ভুলে গিয়ে ফোন করে সংসার সাজাতে হবে।

– আচ্ছা ঠিক আছে তুই তো দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছিস। তুই কি আমার বুকে একটু আসবি?

আমি আমার মাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম তার আড়ালে চোখের জল টুকু মুছে ফেললাম। কপালটা ছুঁয়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু এঁকে দিলেন। আমি আমার মায়ের পা দুটি ধরে সালাম করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম।

মেয়ে পক্ষের বাসায় বসে আছি। এই বাসায় অনেক মেহমান। বাবা সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন। অনেক খাবার দাবারের ব্যাবস্থা করেছেন। আমার দেখে প্রচুর হাসি পাচ্ছে। এত কিছুর দরকার ছিলো না। তাদের মেয়ে বিয়ে পড়িয়ে দিয়ে আমার সাথে পাঠিয়ে দিলেই তো হতো। বাবা ও খুশি হতেন।

মেয়েটি আমাদের সামনে এসে বাবার পা ধরে সালাম করলেন। মেয়ের বাবা আর আমার বাবা আলাদা ভাবে কথা বলার জন্য ছাদে পাঠিয়ে দিলেন। আমি আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে তার পিছন পিছন ছাদের উপরে উঠছি।

তার সাথে কিভাবে কথা শুরু করবো ভেবে পাচ্ছি না। ভাবতে ভাবতেই মেয়েটি বলে উঠলো…

– এই বিয়েতে আপনার মত আছে তো? আমি ডিভোর্সি মেয়ে। আমি বুঝতে পারছি না একটা ডিভোর্সি মেয়েকে আপনার মত গ্রাজুয়েট ছেলে আমাকে বিয়ে করতে এসেছে কেনো?

– বাবা-মায়ের অমতের বাহিরে আমি যেতে পারব না।এখানে আমার অমতের কিছুই নাই। আচ্ছা আপনার নামটা যেন কি?

– হিমি! জানেন আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে?

– কেনো?

– কারন আমার মত মেয়েকে বিয়ে করতে আপনি আসবেন কেনো? আপনাকে তো বাধ্য করা হয়েছে আমাকে বিয়ে করতে। আপনার বাবা বাধ্য করেছে আপনাকে। আমাকেও বাধ্য করেছে আমার বাবা। আমার ইচ্ছা ছিলো অনেক দূরে গিয়ে একা কাটিয়ে দিবো। কিন্তু বাবার জন্য পারলাম না।

– আপনার আর কিছু বলার আছে?

– নাহ কেনো?

– তাহলে নিচে চলুন।

– সিগারেট খান?

– হ্যাঁ। কেনো?

– চাইলে এখানে জ্বালাতে পারেন। আপনাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে।

– থ্যাংকস। সুযোগ দেওয়ার জন্য।

পকেট থেকে সিগারেট বের করে মেয়েটির সামনেই জ্বালিয়ে দিলাম।খুব আরাম করে টানছি। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম আমি তো তার সামনেই সিগারেট টানছি। সম্পুর্ন ধোঁয়া তার মুখে যাচ্ছে। আস্তে করে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে পায়ের তলায় পিষিয়ে নিলাম।

বাবার চিৎকারে ছাদ থেকে দৌড়ে নামলাম। বাবার সামনে যাওয়ার পরে বাবা আর কথা বলতে পারছে না। ফোনটা হাতে।

কানের কাছে ফোন নিয়ে চিৎকার শুনতে পাই।

কথা চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলতেছে,,

“মা মরে যাচ্ছে, মা মরে যাচ্ছে। আমার মা পয়জন খেয়ে ফেলেছে। কেউ মাকে বাঁচাও।”……….

(চলবে…….)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here